
মেঘ রাজ সাইমুন
পলাশ রাঙা ফাগুনের পড়ন্ত বিকেলের সূর্যটা লাল হতে শুরু করেছে,যার আভা ছড়িয়ে পড়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি লালমাই পাহাড়ে|
কুমিল্লা সদর,সদর দক্ষিণ ও বগুড়া উপজেলার বুক জুড়ে প্রত্যেকটা পাঁজরের বাঁধনে যার অবস্থান;সেই লালমাই পাহাড়| যেন মেঘ রাজকুমারের স্বপ্নের রাজ্য| এমন ভুবন ভুলানো প্রাকৃতিক কারুকার্য পৃথিবীর অন্য কোথাও বিরল| আভিজাত্যের উষ্ণ ছোঁয়ায় ভরিয়ে দেয় মানবকুলের প্রতিটি সন্তানকে|
বসন্তের হালকা শীতল হাওয়া ছুঁয়ে গেল লালমাই পাহাড়ে দাড়িয়ে থাকা একটি ছেলেকে| ছেলেটির হাতে একটা গিটার| পাহাড়ের এই মনোরম পরিবেশে যার বেড়ে ওঠা| দুরন্ত শৈশব-কৈশোরের স্বপ্ন তুলি যার এই পাহাড়| অনুভূতির প্রতিটি শিহরণে কেঁপে যাওয়া বিকাল|
লালমাই পাহাড়ের বিকালটা জমে ওঠে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চমনির গানে,গল্পে আর আড্ডায়| সেই কখন থেকে সাইমুন দাঁড়িয়ে আছে,এখনো নিরা,অন্তু,রাই আর পরশের দেখা নেই| কি যে করে সব ফাজিলগুলা! পৃথিবীর অসহ্য কাজগুলার মধ্য একটি হচ্ছে অপেক্ষা করা| অপেক্ষার প্রহর খুব দীর্ঘ হয়|
অবশেষে দেখা মিললো গাধাগুলার| এমন ভাব যেন কিছুই করেনি!
~সরি দোস্ত|একটু দেরি হয়ে গেলো|
~তুই ছাড়তো আমাকে|
~প্লিজ,মাফ করে দে| এই কান ধরছি| এই অন্তুর জন্যই তো দেরি হলো|
~দেখ পরশ, মিথ্যা কথা বলবি না,তুই ই তো সাথীর জন্য….
~চুপ কর তুই| মার খাবি|
~ও মার খাবে কেন?তুই বল তুই সা…
~ভালো হচ্ছে না কিন্তু রাই|
~তোরা থামবি এবার| এই নিরা বলতো কি হয়েছে?
~আমি কিছু জানি না|
~প্লিজ দোস্ত| বললাম তো সরি|
পরশ আবার সাইমুনকে জড়িয়ে ধরলো| সাইমুনের সব রাগ পানি হয়ে গেলো| এই একটা মানুষকে সাইমুন কখনো এড়িয়ে চলতে পারে না|
~ওকে,তোরা সবাই বস্ তো এখন| আমি দাঁড়িয়ে এতক্ষনে বোরড হয়ে গেলাম|
এই হলো পঞ্চমনি| কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ২য় বর্ষের অর্থনীতির পাঁচ বন্ধু| সকলের মধ্যে পরশ অত্যন্ত বেখেয়ালি এবং মিশুক| সারা ভার্সিটি ওর জন্য মেঘলা দুপুরের ক্লান্ত পথিকের মত হয়ে পরে| ভার্সিটির প্রত্যেকটা মেয়ের সাথে ওর ফ্লার্ট করা চাই| এইতো বিকালের আড্ডায় আসার মাঝপথে সাথীকে দেখে ফ্লার্ট করতে পিছু নিল| অযথা নিরা,অন্তু এবং রাইয়ের ও আসতে দেরি হয়ে গেলো| সেই কথাই ওরা সাইমুনকে বলতে যাচ্ছিলো| কিন্তু বলার সুযোগ পেলে তো! ভার্সিটির সব থেকে দুরন্ত ছেলেটা পরশ আর সব থেকে শান্ত,মনোযোগী ছেলেটা সাইমুন| কিন্তু এই শান্ত আর দুরন্ত একত্রে অনন্ত|
ভার্সিটির প্রথম দিনেই এই অসম্ভব দুষ্টু ছেলেটি মন কেড়েছিলো সাইমুনের|
নিরা এদের মধ্যে সব থেকে স্বল্পভাষী এবং অহংকারী একটি মেয়ে| তারপর কিভাবে যেন ওর বন্ধু্ত্ব হলো এদের সাথে| অন্তু ছেলেটা কবি টাইপের, তার কবিতার জন্য ক্লাসের সবাই অতিষ্ট| আর রাই পৃথিবীর সব থেকে সহজ-সরল একটা মেয়ে,কারোর সাতেপাঁচে ও নেই| কিন্তু কথা বলে খুব বেশি|
সবাই শেষ বিকেলের লাল মাটিতে বসে পরলো| অন্তু বলে উঠলো,
~এই তোরা একটা কবিতা শুনবি,গত রাতে লিখেছি প্রীতিলতাকে নিয়ে|
সবাই হো হো করে হেসে উঠলো| পরশ বলল,
~তাহলে হয়েছে| তুই কি এবার জীবনানন্দ দাসের প্রীতিলতার ধারাবাহিক লিখবি নাকি?
~এই সাইমুন,গিটারটা হাতে নিয়ে একটা গান ধর না?
~এ বাবা যা! আমাদের নিরা গান শুনবে,এতো কল্পনা করা যায় না|
~পরশ তুই কিন্তু সব সময় ফাজলামো করিস!
~ওকে| তোরা ঝগড়া থামা| আমি গাইছি|
সাইমুন গিটার হাতে গাইতে শুরু করলো বেলাল খানেরঃ
“তোমার কি একটা বিকেল হবে,আমায় একটা বিকেল দেবে|
নিতে চাই যদিও ধার,চাইলে ফেরত নিও আবার|
শুধুই তো একটা বিকেল,চাইলে ফেরত নিও আবার| ঐ
বলতে চাই সে কথা যে কথা হয়নি বলা,
চলতে চাই সে পথে যে পথে হয়নি চলা| ঐ
ও বন্ধু তুমি শুনছো কি?
নতুন ভোর নতুন আলো পাবো নতুন দিন
রেখে দেবো হৃদয় ঘরে ভালোবাসা অন্তহীন|
দেখে যাবো সে আকাশ যা আজও হয়নি দেখা,
লিখে যাবো সে কথা যা আজও হয়নি লেখা|
ও বন্ধু তুমি শুনছো কি?
সময় যায় পাখির মতো আসে দারুন সাজ,
তুমি দিও রাতের ঘুমে স্বপ্ন ছোঁয়া কারু কাজ||”
সবাই মুগ্ধ হয়ে সাইমুনের গান শুনছিলো| এভাবে প্রতিটি বিকেল কেটে যায় গানে,গল্পে আর আড্ডায় ,লালমাই এর অনীল সৌন্দর্য্যে পঞ্চমনি জীবনগুলো। আমাদের গল্প সাইমুন আর পরশকে নিয়ে|
১|
সালমানপুর|
কুমিল্লার লালমাই পাহাড় সংলগ্ন প্রত্যন্ত একটা অঞ্চল|
দোতলা বাড়ি থেকে টুংটাং গিটারের শব্দে আজকের ভোরটা স্নিগ্ধময় লাগছে|এই বাড়ির মালকিন শাহানা বেগম| কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপিকা| স্বামীর মুত্যৃর পর একমাত্র ছেলে সাইমুনকে নিয়ে তার সংসার| সাইমুন ঐ বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র| দেখতে অসম্ভব রকমের সুন্দর| ফর্সা চেহারায় তিলকের খুদ পর্যন্ত নেই| অত্যন্ত শান্ত প্রাকৃতিক একটা ছেলে| পাহাড়ী দুরন্ত কিশোরের মত তার জীবন কেটেছে মায়ের আদরে| মায়ের ভালোবাসা তার একমাত্র বিশ্বাস,ভরসা সব| সাইমুনের অসম্ভব সুন্দর গানের কণ্ঠ| সে গাইলে পাহাড়ের মনোরম পরিবেশ আরো নীলিমায় গুটিয়ে যায়| সাইমুনের প্রিয় গায়ক বেলাল খান| মা,গান আর গিটার তিনই তার জীবনপ্রদ্বীপ|
আরেকটা প্রিয় মানুষ আছে অবশ্য তার জীবনে| সবার অজান্তে মনের ঘরে তার বসবাস|
নিচ থেকে মায়ের ডাকে গিটারের সুরে ছেদ পড়লো|
~কিরে মুন|সেই কখন থেকে ডাকছি!নাস্তা করে যা!
~আসছি মা|এক মিনিট|
~এক মিনিট এক মিনিট করে দশ মিনিট পার করলি| আয় তো বাবা আমি ভার্সিটিতে যাবো| তোরও তো ক্লাস আছে| আয় না!
নিচে নেমে সাইমুন মাকে জড়িয়ে ধরলো| পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর দৃশ্য হলো মা সন্তানের এই শুভক্ষণ|
~মা তুমি এতো তাড়াহুড়া করো কেন?একটু দেরিতে গেলে কি হয়?
~ছাড় তো মুন| আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে|
হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠলো|
~দেখতো কে এলো বাবা!
~কে আবার? তোমার গুনধর পুত্র এসেছে|
~পরশ!যা তো তুই দরজা খুলে দে|
দরজা খোলার জন্য সাইমুন এগিয়ে গেলো|
~এই এতো সকালে এখানে কি?হোস্টেলে খাবার জুটেনি বুঝি?
~তুই সরতো মুন! আমি মায়ের কাছে এসেছি|
~এই তোকে কতদিন না বলেছি আমাকে মুন বলে ডাকবি না! আমার মা শুধু ওই নামে ডাকবে|
~ঐ তোরা দুটোতে দরজায় দাঁড়িয়ে ঝগড়া না করে নাস্তার টেবিল বস্| পরশ তুই এদিকে আয় তো বাবা|
~দেখছো মা| মুন কি করে সারাক্ষণ আমার পিছে লাগে|
~ঐ আমার মাকে তুই মা বলবি না| মা শুধু আমার|
~বলবো বলবো| এই দেখ জড়িয়েও ধরলাম|
~মুন থাম তো| এই দিকে এসে বস্| পরশ তুই ওর সাথে কথা বলিস না তো|
~মা এই এক বছরের বেশি হলো কুবিতে পড়ছি| তোমার ছেলে কিন্তু এখনো আমাকে পুরো কুমিল্লা টা ঘুরে দেখালো না| মুন কি স্বার্থপর, দেখছো মা?
~ঐ বিলাই| তুই তো এখানের সব চিনিস,একা একা ঘুরতে পারিস না! নিরাকে বললেই তো পারিস| এতো আহ্লাদি ভাব তো দেখাস ওর সাথে|
~দোস্ত,|তুই না থাকলে হয় বল! তুই তো আমার সব|
~ঢং দেখাস না| গিলতে এসেছিস,গেল|
~তোরা ঝগড়া কর| আমি গেলাম| মুন সখীকে বলে যাস দরজা লাগাতে|
পরশ আর সাইমুন একে অন্যকে না দেখে এক মিনিটও থাকতে পারে না| সারাদিন একসাথে থাকবে আর ঝগড়া করবে| মাঝরাতে দেখা যাবে হোস্টেলে পরশের ঘুম না এলে সাইমুনের বেড রুমে হানা দিয়েছে| ঢাকার ছেলে হিসেবে পরশ একটু অশান্ত| তবুও শান্ত সাইমুনের হৃদয়ের একটা টুকরো পরশ|
ভার্সিটিতে এসে ওরা দেখল অন্তু,রাই আর নিরা চাতকপাখির মত দাঁড়িয়ে আছে| রাই বললো,
~আর বলিস না|মুনের জন্য দেরি হলো| ওর নাকি পেটে ব্যথা করছিলো|
~তুই এতো মিথ্যা কথা বলতে পারিস! বলিস কি করে রে? আমি কখন বললাম আমার পেটে ব্যথা করছে!
~পরশকে আমরা চিনি| এবার চলতো ক্লাসে যাই।
~চল|
সবাই একসাথে ক্লাসে গেল| ঢুকতেই রেজা এসে পরশকে বলল,
~দোস্ত অনেক দিন পর সাথী এসছে ক্লাসে|
পরশ সাইমুনের দিকে আড়চোখে তাকালো| সাইমুন কিছু না বলে সিটে গিয়ে বসলো|
ভার্সিটি ছুটির পর সাইমুন গেটে এসে দাড়িয়েছে। |দুর থেকে পরশকে দৌড়ে আসতে দেখা গেল| হাপাতে হাপাতে বলল,
~রাগ করেছিস মুন? সরি| আসলে রেজা বললো বলেই তো!
~আমি রাগ করবো কেন?তোর যা ইচ্ছা তাই কর| আমি বলার কে?
~প্লিজ মুন! বললাম তো সরি| ওকে বাবা! চল বাসায় যাবো| মা ফিরেছে তো?
~তোর যেতে হবে না| আমি একলা যেতে পারি|
~আমি যাবো| তুই পারলে ঠেকা তো দেখি|
বলেই একটা রিকশা ডেকে তাতে উঠে বসলো| বাধ্য হয়ে সাইমুন পাশে উঠে বসলো|
পরশের এধরনের ছেলেমানুষি সাইমুনকে খুব টানে| ওর দীঘল নাসিকা,তীক্ষ্ম চোখ জোড়া আর বাঁকা ঠোঁট এর হাসিতে সাইমুন মুগ্ধ হয়| জীবনের পরম পাওয়ার ভিতর একটা হলো বন্ধুত্ব| সেটা সাইমুন পেয়েছে পরশের কাছ থেকে| কিন্তু পরশের মেয়েপাগলামি দেখলে কেন জানি সাইমুনের বুকের ভিতর কাঁপুন ধরে| ওর উপর অত্যন্ত অভিমান হয়| কি দরকার মেয়েদের পিছনে দৌড়ানোর!| সাইমুন কোন মেয়েকে ফ্লার্ট পর্যন্ত ও করেনি| কেন জানি ওর অনুভূতিগুলো ভিন্ন| মা,গান আর গিটারের ছন্দে ওর জীবন পরিপূর্ণ| পরশের সাথে বন্ধুত্বের পর তার একটা অংশ হয়েছে পরশও|
বাড়িতে ঢুকেই সাইমুন শাওয়ার নিতে বাথরুমে চলে গেলো| পরশ কম্পিউটারে গেম খেলতে লাগলো| এই বাসায় এলে ওর এটা একটা বড় কাজ হয়ে দাঁড়ায়| যেন অফিশিয়াল কর্মে ব্যস্ত বড়বাবু|
শাওয়ার নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো সাইমুন| ওর চুল থেকে এখনো পানি ঝরছে টপটপ করে| উষ্ণ ঠোঁটের কোণায় এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো গাল বেয়ে| পরনে একটা সবুজ তোয়ালে ওর| দেখতে দারুন সুন্দর লাগছে ওকে| পরশ কম্পিউটার থেকে মুখ তুলে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
~কিরে মুন, তোকে তো আজ পূর্ণিমার মুনের মতো লাগছে! মেয়েরা এই অবস্থায় তোকে দেখলে তো পাগল হয়ে যাবে|
~ফাজলামি রাখতো| আমার কম্পিউটার থেকে উঠতো এবার|
~সত্যি মুন তোকে দারুন লাগছে| তুই মেয়ে হলে আমি তোকে এখনি কিস করতাম|
~এই ফাজিল! দেবো একটা|
সাইমুন তো তেমনই চায়| কিন্তু পরশ তো ওকে বন্ধুর মতোই ভালোবাসে| নিজের ভালোবাসার কথা জানাতে গিয়ে যদি বন্ধুত্বটাই নষ্ট হয়ে যায়! ওর মাকে পরশ মা বলে ডাকে| শাহানাও ওকে নিজের সন্তানের মতো জানে| জীবনে অনেক কিছু পাওয়ার ইচ্ছা থাকে,কিন্তু ভালোবাসা হারানোর ভয় থাকলে সেটা তুচ্ছ মনে হয়| সাইমুনের জীবনের একটা বড় সত্য হলো ও পরশকে ভালোবাসে| ও জানে এটা সমাজ,ধর্ম সব নিয়মের বাইরে| তবুও ভালোবাসা তো নিয়ম বোঝে না,মনের শাসন মানে না| প্রেম থাকে মনের ফুলে,হৃদয়ের ভরাল নদীর দুটো কুলে| যে প্রেম নীল আসমানের শুভ্র মেঘ বেয়ে স্বপ্ন শিশিরের মতো মাটির পৃথিবীতে নামে|আজ লুকানো প্রেম কিছুটা হলেও পরশের ছোঁয়া পেতে চাইছে|
২|
আজ সাইমুন আর পরশ লালমাই পাহাড়ে ওদের আড্ডার জায়গায় এসেছে| ভার্সিটি ছুটির কারনে রাই আর অন্তু দেশের বাড়ি চলে গেছে| আর নিরা মামা বাড়ি বেড়াতে গেলো| তাই ওরা দুজনই এলো| আজ সারা কুমিল্লা সাইমুন পরশকে ঘুরিয়ে দেখাবে| এই লালমাই পাহাড় উত্তর-দক্ষিণে ১১ মাইল লম্বা এবং পূর্ব-পশ্চিমে ২ মাইল চওড়া| পরশ পুরো লালমাই পাহাড় আজও দেখেনি| সাইমুন পাহাড়ে আগে আগে উঠছিলো, পরশ তাকে ডাক দিলো|
~মুন,একটু হাতটা ধর না দোস্ত|
~এতো বড় খোকা তার আবার হাত ধরো| দে হাতটা বাড়িয়ে|
সাইমুন পরশের হাত ধরলো| ওর শরীর শিউরে উঠলো,এর আগেও ও পরশের হাত ধরেছে কিন্তু আজ কেন এমন হলো বুঝতে পারছে না|
~আচ্ছা মুন|এই পাহাড়ের নাম লালমাই পাহাড় হলো কেন?
~কথিত আছে রাম রাবনের যুদ্ধে রামের ছোট ভাই লক্ষণ গুরুতর আহত হয়| বৈদ্যের চিকিৎসা মতে বৈশুলার পাতার রস সংগ্রহের জন্য হনুমান পাহাড়ের অরণ্যে সেটি খুঁজতে যায়| কিন্তু চিনতে না পেরে পুরো অরন্য পাহাড়টা হাতে করে নিয়ে আসে,চিকিৎসা শেষে যথা স্থানে রেখে আসতে গিয়ে হনুমানের হাত থেকে কিছু অংশ লমলমে পতিত হয়,মনে করা হয় সে অংশের পাহাড় এটি| তাই লমলম থেকে একে লালমাই পাহাড় বলা হয়| অন্য একটা স্থানে উল্লেখ আছে এখানে এক প্রভাবশালী ব্যক্তির দুই কন্যা ছিল। একজনের নাম লালমতি আরেকজনের নাম ময়নামতি;সেই নামানুসারে এই পাহাড়কে লালমাই এবং ঐ পাহাড়কে ময়নামতি নামে ডাকা হয়| আরেক জায়গায় উল্লেখ আছে অসুরকুলের নাশের জন্য এই পাহাড়ে মা দূর্গা আবির্ভূত হয়| দূর্গার পায়ের আঘাতে মাটি পুড়ে লাল হয়ে যায়,তাই একে লালমাই পাহাড় বলা হয়| এক কথায় এই পাহাড়ের মাটি লাল তাই একে লালমাই পাহাড় বলা হয়| বুঝলি?
~এবার একটু দম ছাড় মুন| একনাগাড়ে যেভাবে বললি, না বুঝে উপায় আছে!
~চল,চন্ডীমন্দিরে এসে গেছি| জানিস এখানে মনে মনে যে যা চায় তার মনোস কামণা সেভাবে পূর্ণ হয়| চন্ডীমন্দির কুমিল্লার প্রাকৃতিক নিদর্শনের একটি|
~আচ্ছা দাঁড়া দোস্ত, আমি কিছু চাই|
তারপর সাইমুন আর পরশ কিছুক্ষণ করজোর করে দাড়িয়ে থাকলো|
~কি চাইলি পরশ?
~বললে তো মনোস কামণা
পূর্ণ হয়,তাই না?
~তুই কি চাইলি?
~তোকে বলব কেন?
পাহাড়ের চূড়ায় শ্রমিকদের জন্য একটা টি স্টল আছে| ওখানে ওরা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চা পান করলো| জায়গা নিরাপদ না হওয়ায় সাইমুন আর দাঁড়াতে চাইছিলো না|
ওখান থেকে ওরা গেলো কুমিল্লার সিসিএন পলিটেকনিক ইনিস্টিটিউটে| শালবন বিহার কুমিল্লার প্রাণ| এখানে সুন্দরবনের মত গেওয়া,গরান,বাইন গাছ থাকলেও শাল গাছের আধিক্যের জন্য একে শালবন বিহার বলে| এখানে প্রাচীন নিদর্শন হিসাবে আছে বৌদ্ধবিহার| লালমাই পাহাড়ের উত্তর-পশ্চিমে কুমিল্লা সেনানিবাস| এখানে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়| পাহাড়ের গায়ে এখনো গুলির চিহ্ণ পাওয়া যায়| কুটিলামুড়া,রুপবানমুড়া ও চারপত্রমুড়া কুমিল্লার আভিজাত্য| চারপত্রমুড়ায় বাংলাদেশের বৃহৎ সংস্থা BARD অবস্থিত| কুমিল্লায় আরো আছে নূরজাহান ইর্কো পার্ক,রাজেশ ফরেস্ট,শাহ সুজা বাদশাহ মসজিদ,রাজা ধর্মমানিক্যের খননকৃত ২৩.১৮ একরের ধর্মসাগর,গোমতী নদী,কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজ|
সব স্থান ঘুরে সাইমুন পরশকে নিয়ে এলো নীলাচল পাহাড়ে| নীলাচল পাহাড় কুমিল্লার রমণীয় রুপ| দুই পাহাড়ের মাঝে সৌন্দর্য্যের আধার যেন ঠুকরে পরছে।
পরশ আর সাইমুন এখন দাঁড়িয়ে আছে নীলাচলে| পরশ একটু এগিয়ে গিয়ে সাইমুনকে জড়িয়ে ধরলো|
~দোস্ত| সো সো থ্যাংকস| তোদের এখানে যে এতো সুন্দর কিছু আছে তা জানতাম কিন্তু দেখতে যে এতো সুন্দর,তা না দেখলে আজ উপলব্ধি করতে পারতাম না|
~এই গাধা থ্যাংস দেওয়ার কি আছে!
~নিরা,অন্তু আর রাই আসলে অনেক মজা হতো,তাই না মুন?
~কেন আমার সাথে একা ঘুরতে তোর খারাপ লাগছে?
~আমি কি তাই বললাম বিলাই?
~জানিস!এই নীলাচলে মানুষ তার প্রিয়জনকে নিয়ে আসে| অনেক প্রেমিক যুগলের স্মৃতি চিহ্ণ এখানে আছে|
~তো তুই কি কাউকে নিয়ে এসেছিস? ডাল মে কুচ কালাহে!
~আমিও তো প্রিয়জনকে নিয়ে এসেছি|
~মানে?
~কেন তুই আমার প্রিয় বন্ধু না? প্রিয় বন্ধু তো প্রিয়জনই হয়|
~ওহ! তাই বল?আচ্ছা মুন তুই কি কাউকে ভালোবাসিস?
~হুম বাসি। ভালোবাসি তো| সে সারাক্ষণ আমার অস্তিত্ব জুড়ে থাকে| তাকে
ভালোবেসে আমি নিজে কেমন আছি,সেটা ভুলে গেছি| নিজের স্বপ্নগুলো আজ আমি তার মাঝে খুঁজে ফিরি| ভালোবাসলে মানুষ এমনই হয়| হৃদয়ের গহীনে ভালোবাসার মানুষটিকে একলা বন্ধ করে রাখতে মন চাই| শরীরের সবটুকু আদর তাকে ছুঁয়ে যায়| নীলাকাশের নীলপাখির মত বিকেলের রোদের ঝিলিক খেলা করে মুক্ত ডানায়| পৃথিবীর সব কিছু স্বপ্নময় লাগে| কিন্তু কষ্ট লাগে যখন ভালোবাসার মানুষটিকে বলতে পারি না আমি তোমাকে ভালোবাসি| যেদিন আমি আমার ভালোবাসার স্বীকৃতি পাবো,সেদিন এই নীলাচলকে সাক্ষ্য রেখে প্রথম চুম্বন আঁকবো তার ফর্সা কপালে|
~কি ব্যাপার মুন? আজকাল অন্তুর মতো কবি কবি ভাব তোর? তো কে সে রমণী?
~ছাড় তো! তোর কথা বল!
~আমার আবার কি কথা? আমি কাউকে সিরিয়াসলি নেই না| তবে আজকাল একজনকে খুব ভালো লাগতে শুরু করেছে| দেখলে কেমন জানি বুকের ভিতর চিনচিন করে|
~কে সে?
~সময় আসুক বলবো|
~হুম| চল সন্ধ্যা হতে চললো| মা টেনশন করবে|
~ক্ষুধাও লাগছে|
দুজনেই চলতে শুরু করলো| পিছনে রইলো স্মৃতিময় একটা দিন|
৩|
এসো হে বৈশাখ এসো এসো…..
কবি কাজী নজরুল ইসলামের বৈশাখ বরণ গানে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় জমে উঠেছে| আজ পহেলা বৈশাখ| বাঙালিদের বাংলা শুভ নববর্ষ| সারা ভার্সিটি জুড়ে তরুণ-তরুণীরা পহেলা বৈশাখের পোষাকে মুড়ে এসেছে| সাইমুন আর পরশ পরেছে কলার এবং হাতের প্রান্তে লাল কারুকার্যের সাদা পাঞ্জাবী| দুটোকে আজ দারুন লাগছে| সকালে সাইমুনের মায়ের হাতের পান্তা ভাত আর ইলিশ মাছ ভাজি খেয়ে,মায়ের দেওয়া পাঞ্জাবীতেই দুটোতে সেজে এসেছে| পরশ প্রতিটি উৎসবেই সাইমুনের মায়ের কাছ থেকে এমন উপহার পায়| এতে সাইমুনেরও খুব ভালো লাগে| মনের মানুষকে খুশি দেখতে কে না চায়|
ওরা ভার্সিটি গেটে ঢুকতে অন্তু আর রাই এর সাথে দেখা| রাই বললো,
~কিরে আসতে এতো দেরি করলি কেন তোরা? আর সাইমুন তোর গিটার কই?
~মানে কি? গিটার লাগবে কেন? হোয়াই!
~শফিক স্যার কনসার্টে গান গাওয়ার জন্য তোর নাম দিয়েছে|
~হোয়াট?না না আমি পারবো না গাইতে টাইতে!
~ভণিতা করিস নাতো| স্যার অনেক ডিসপ্লিসড হবে সাইমুন|
~হোক| তাতে কি, আমি পারবো না|
~পরশ দোস্ত, তুই বোঝা না একটু ওকে প্লিজ!
~হুম| পাগলামি করিস না মুন| স্যার যখন নিজে থেকে বলছে,গা না!আমি বলছি তো|
~গাইবো? ওকে| তুই যখন বলছিস, কিন্তু আমার গিটার….
অন্তু বললো,
~আমি আনার ব্যবস্থা করছি তোর গিটার|
~সো থ্যাংক ইউ দোস্ত| তুই যা, আমরা ওদিকটাই গিয়ে বসি|
সাইমুন,পরশ আর রাই এসে কনসার্ট স্টেজের ডানে নিরার কাছে গিয়ে বসলো|স্টেজে ভার্সিটির বিভিন্ন ছাত্রছাত্রীদের কালারফুল প্রোগ্রাম চলছে| এরইমধ্যে অন্তু সাইমুনের গিটার নিয়ে এসেছে| স্টেজ হতে সাইমুনের নাম ঘোষণা হলো| সে গিটার নিয়ে স্টেজে উঠলো| সবাই একসাথে চিৎকার করে উঠলো| সাইমুন গাইতে শুরু করলঃ
“মেঘলা দুপুরে কার নুপুরে মন খুঁজে যায় সুর,
কার অনুভবে খুব নিরবে মন নেশায় হয় চুর|
জানি না সে কেন এমন মরীচিকা ছায়া যেমন,
কেন আসে না সে আমার আঙিনায়;
একলা একলা দিন যায়,আজও একলা একলা দিন যায়|
আনমনা মনে ঝড়ো শিহরণে তুলে সে বারে বারে,
কখনো এসে স্বপ্নে দুয়ারে গোপনে কড়া নাড়ে|
জানি না সে কেন এমন মরীচিকা ছায়া যেমন,
কেন আসে না সে আমার আঙিনায়;
একলা একলা দিন যায়,আজও একলা একলা দিন যায়|
ভাবনা জুড়ে মুখখানি তার সোনা রোদ হয়ে হাসে,
একটু ছুঁয়ে দিতে তবু থাকে না সে পাশে|
জানি না সে কেন এমন মরীচিকা ছায়া যেমন,
কেন আসে না সে আমার আঙিনায়;
একলা একলা দিন যায়,আজও একলা একলা দিন যায়|
মেঘলা দুপুরে কার নুপুরে মন খুঁজে যায় সুর,
কার অনুভবে খুব নিরবে মন নেশায় হয় চুর|
জানি না সে কেন এমন
মরীচিকা ছায়া যেমন,
কেন আসে না সে আমার আঙিনায়;
একলা একলা দিন যায়,আজও একলা একলা দিন যায়|”
সাইমুনের চোখ থেকে পানি পড়ছে| সারা অডিয়েন্স নীরব| হঠাৎ করধ্বনিতে মুখোরিত হলো চারদিক| ছেলেটা সত্যি অসাধারণ গায়| হৃদয়ের সবটুকু সুর ঢেলে দেয় গানে|
স্টেজ থেকে নামার পথে অন্তু,রাই,নিরা এবং পরশ দাঁড়িয়ে আছে| পরশ সাইমুনকে আনমনে জড়িয়ে ধরলো| ওর চোখ থেকেও পানি পরছে| অন্তু,রাই,নিরাও কাঁদছে| একটা আনন্দ অশ্রুর ঝিলিক সবার চোখে| জড়িয়ে ধরে রেখেই পরশ বললো,
~সত্যি দোস্ত|তোর কন্ঠে জাদু আছে|কি সাংঘাতিক সুর!
~ছাড়তো পাম দিস না| আমার ক্ষুধা লাগছে কিছু খাওয়া|
~জ্বে হুকুম জাহাপনা!এই তোরাও আয়|
ওরা সবাই খেতে বসলো ভার্সিটির ক্যাফেতে| এই পঞ্চমনির বন্ধুত্ব দেখলে ভারতবর্ষের মহান শিল্পী মান্না দে’র কফি হাউসের গানটা মনে পরে যায়|
~এই মা আজ দুপুরে তোদের সবাইকে খেতে ডেকেছে|তোরা আসচ্ছিস তো?
~অবশ্যই!মা ডেকেছে আর আমরা আসবো না,তা কি করে হয়!
~ঐ পেটুক তুই চুপ কর| অন্তু,নিরা,রাই তোরা বল?
~হুম|ম্যাডাম খেতে ডেকেছে অবশ্যই যাবো|
~হুম|তাহলে এখন উঠিরে| মাকে দুপুরের জন্য একটু হেল্প করতে হবে| পরশ তুই ওদের নিয়ে আয়|
~নো ওয়ে| আমি তোর সাথে যাচ্ছি মার কাছে| অন্তু তুই রাই আর নিরাকে নিয়ে আয়| চল মুন|
সকাল থেকে শাহানা বেগমের অনেক তাড়া ছিলো|ছেলের বন্ধুদের দুপুরের খাবার কথা বলেছে| রান্নাবান্না প্রায় শেষপ্রান্তে| এখন সাইমুন এসে দেখলে খুব খুশি হবে| ছেলের একটু খুশির জন্য এই রমণী পারে না এমন কোন কাজ পৃথিবীতে নেই! মায়েরা বোধহয় এমনই হয়|
ভার্সিটি থেকে সাইমুন আর পরশ ফিরে এসেছে| এসেই পরশ দৌড়ে কিচেনে গেল,
~মা মা!দাও তো তোমাকে একটু হেল্প করি|
~তুই সর তো! আমার সব কমপ্লিট হয়েছে গেছে| যা তুই মুনকে নিয়ে উপরে যা|
সাইমুন কিচেনের দরজায় দাঁড়িয়ে পরশের পাগলামি দেখছিলো| এই ছেলেটা পারেও বটে| বললো,
~দাও তো মা| ওকে একটু কালি মাখিয়ে,সেটাই ওকে ওয়াশরুমে নিতে হেল্প করবে|
~এই তোরা দুটোই যা তো এখান থেকে|
~ওকে, ডিয়ার মাম্মি|
~পরশ ছাড়তো| ভাগ এখান থেকে| না হলে মার খাবি| মুন বাঁদরটাকে কান ধরে নিয়ে যা তো|
~ধরবো কান?মায়ের আদেশ বলে কথা!
~মুন তুইও এতো ফাজিল হয়ছিস|
সাইমুন পরশকে নিয়ে তার রুমে চলে গেল| এদের এমন বাঁধন দেখলে যে কেউ ঈর্ষায়িত না হয়ে পারবে না!
দুপুরে অন্তু,রাই,নিরা এসে খেয়ে চলে গেলেও পরশ ঠিকই সাইমুনকে জ্বালিয়ে ভাজা ভাজা করতে রয়ে গেছে| তখন থেকে বসে বসে সাইমুনের ল্যাপটপের বারোটা বাজিয়ে চলছে| সাইমুন বাঁকা বাঁকা চোখে তা দেখে চলেছে|
~পরশ এবার থাম তো|
~কেন ডার্লিং? আপনার সমস্যাটা কোথায়?
~যা তো সন্ধ্যা হয়ে আসছে| হোস্টেল যা|
~নো ওয়ে মিঃ মুন| আমি আজ রাতে এই বিছানায়ই থাকবো|
~ফাজলামি করিস না| যা ভাগ|
~ফাজলামির কি হলো? বললাম তো আজ রাত এখানে থাকবো|
~ওকে| ফাইন| তুই থাক আমি গেস্টরুমে গেলাম|
~এই যা বাবা| আমি তো একলা থাকবো না| তোর সাথেই ঘুমাবো|
~পারবো না| তাহলে তুই গেস্টরুমে যা|
এর মাঝে শাহানা বেগম দুগ্লাস দুধ হাতে রুমে ঢুকলো|
~কিরে তোরা আবার কি নিয়ে বালিশ চালাচালি করছিস? তোদের নিয়ে আর পারি না| কি হলো?
~দেখতো মা!আমি আজ রাতে মুনের কাছে একটু ঘুমাতে চাচ্ছি| ও প্রতিবারের মতো আমাকে গেস্টরুমে পাঠিয়ে দিচ্ছে|
~মুন| থাক না পরশ! একরাত ই তো|
~উফঃ মা| তুমিও না| যা তা| ও আমাকে সারারাত ঘুমাতেও দেবে না|
~এই কান ধরে প্রমিজ করছি| তুই সারারাত কুম্ভকর্ণের মত ঘুমাস| আই ওন্ট ডিসটার্ব ইউ|
~দেখছো মা! কান ধরে কেউ প্রমিজ করে| ওর সবতেই মিথ্যা লুকিয়ে থাকে|
~দুটো তে সব সময় ফাইট করিস| থাক তোরা আমি গেলাম| পরশ দুধটুকু খেয়ে নিস বাবা|
~এই এই দাঁড়াও| চলো আমি তোমাকে ঘুমি পাড়িয়ে রেখে আসি| আর তুই একটু দাঁড়া, আমি ফিরে মজা দেখাচ্ছি|
~দেখ পরশ| ভালো হচ্ছে না কিন্তু|
পরশ শাহানাকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে
গেলো| সাইমুন গজগজ করতে করতে ওয়াশরুমে ঢুকলো|
মিনিট দশেক পরে পরশ ফিরে এসে দরজার ছিটকিনি আটকে দিলো| তারপর সাইমুনকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় ফেলে বুকের উপর উঠে বসলো|
~কি বললি মাকে| আমি তোমাকে সারারাত ঘুমাতে দিবো না| দেখ তাহলে এবার|
~পরশ ভালো হচ্ছে না কিন্তু| আমি কিন্তু মাকে ডাক দিবো|
~কি?তাহলে ঠোটে কিস দিয়ে ঠোট সেলাই দিবো|
~মা ও মা……..
হঠাৎ পরশ সাইমুনের লাল ঠোটে কিস করে কামড়ে ধরে বসলো| সাইমুনের সারা শরীর অজানা শিহরণে সমুদ্রের ঢেউ খেলে গেলো| অপলক দৃষ্টিতে পরশের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো|
~কি ডাকবি না মাকে| ডাক! ডাকনা! দেখি কেমন পারিস|
বলেই পরশ থমকে গেলো|তারও নিঃশ্বাস হ্রস দীর্ঘ হতে শুরু করেছে| ধীরে ধীরে দুটি মানব নিজেদের অনাবৃত হতে দেখলো| একে অপরের ইঞ্চি ইঞ্চি জায়গা চিনে নিতে লাগলো| জিহ্বার তুলিতে সারা দেহে আদর চিত্র আঁকতে লাগলো| কখনো আর্তনাদ,কখনো সামান্য চিৎকার,কখনো বা অনাবিল সুখে ভরে গেলো সারা ঘর| একে অপরকে সুখের জোয়ারে ভাসিয়ে দিয়ে নিথর দুটি দেহ পড়ে রইলো গোলাপফুল অঙ্কিত বিছানায়| বৈশাখের প্রথম নিশিতে রচিত হলো ভালোবাসার ছোঁয়া| যদিও কখনো ভালোবাসা কথাটি কেউ কাউকে বলেনি| তবুও কি ভালোবাসার বাঁধনে বাঁধা পড়লো দুটি মন? এ রাতে দুজন হলো দুজনার! হোক না সেটা প্রথম মিলনে|
সকালে পরশকে কোথাও খুঁজে পেলো না সাইমুন|
৪|
সেই রাতের পর থেকে আজ দশদিন হলো পরশ সাইমুনের সাথে কথা বলে না| সাইমুন কিছু বললে দায় সারা উত্তর দিয়ে পাশ কেটে চলে যায়| এমনকি ওদের বাসাতে পর্যন্ত মায়ের কাছে যায় না পরশ| ভার্সিটিতে মায়ের সাথে দেখা হলে সামান্য একটু কথা বলে চলে যায়| সেই পাগলামি,দুষ্টুমি আর বাচালতা তার মাঝে নেই| সাইমুনের আজকাল খুব কষ্ট হয় নিজেকে গুছিয়ে নিতে| ভাবছে সেই রাতের ব্যাপারে হয়তো পরশ খুব অনুতাপে ভুগছে| কিন্তু ওতো ভুগছে না! কারন ও পরশকে ভালোবাসে! আর ভালোবাসা দোষের নয়!
ভার্সিটিতে আসতেই সাইমুনের সাথে রাই,অন্তুর দেখা হয়ে গেলো| অন্তু বললো,
~কিরে সাইমুন|পরশ আর তোর মাঝে কি এমন হলো?
~তোর সাথে ও তেমন কথা বলছে না| আমাদের কেও এড়িয়ে চলছে| শুধু নিরার সাথে দেখছি হেসে হেসে কথা বলছে| ও দেখ দুজন কেমন পাশাপাশি বসে আছে|
~অন্তু,সাইমুন তোরা জানিস না!পরশ নিরাকে ভালোবাসে| সেদিন নিরাই তো আমাকে বললো|
~কি বলিস রাই এসব|আমরা একটু জানলাম না| সাইমুন তুই জানিস?
রাই এর কথাটা শুনেই সাইমুনের সারা পৃথিবীকে শূণ্য মনে হলো| পায়ের নিচের মাটি আগলা হতে লাগলো| একি বলে রাই! পরশ নিরাকে ভালোবাসে? তাহলে আমার সাথে সেই রাতে যা হলো! তা কি সব ভুল ছিলো? দুজনের এতো কাছে আসা সব মিথ্যা!
সাইমুনকে আজকাল সব যেন কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে| যাকে ভালোবাসে সে কেমন করলো| পৃথিবীতে সব কষ্ট সহ্য করা যায়, কিন্তু আপনজন কষ্ট দিলে সে কষ্ট হৃদয়ে রাখার জায়গা থাকে না| পরশ আর নিরাকে আজকাল সব সময় কাছাকাছি দেখা যায়| ভার্সিটির প্রতিটি কোণায় ওদের অবতরণ| এসব দেখে সাইমুনের বুক ফেটে যায়| হৃদয়ের গহীনে কেমন রক্তক্ষরণ হয়| পরশ ইদানিং সাইমুনের সাথে কথা বলা একেবারেই ছেড়ে দিয়েছে| সাইমুন বলতে গেলে নিরাশ হয়ে ফিরে আসে| ক্লাসেও তেমন দেখা যায় না ওকে| পরশের স্পেশাল সিটের দিকে সাইমুন মাঝে মাঝে শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে|
সকাল থেকে সাইমুন গিটার হাতে টুংটাং করে চলেছে| মা অনেকবার খেতে ডেকেছে| কিন্তু ওর কোন সাড়া শব্দ নেই| শাহানা বেগমও ছেলের উদাসীনতা লক্ষ্য করেছে| আজকাল ছেলেটা কেমন যেন হয়ে গেছে| মায়ের সাথে তেমন একটা কথাও বলে না|বপরশটাও তেমন এমুখো হয় না| কি হলো যে এদের? সাইমুনের সাড়া না পেয়ে শাহানা নিজেই ছেলে রুমে গেলো| গিয়ে দেখে মুন একনাগাড়ে গিটার বাজিয়ে চলেছে|হাত থেকে রক্ত পড়ছে|
~কিরে মুন এসব কি হচ্ছে?পাগলামি করছিস কেন বাবা?
সাইমুন কাঁন্নায় মায়ের বুকে ভেঙ্গে পরলো|
~মা আমি আর পারছিনা!
~কি হয়েছে বাবা?আমাকে সব খুলে বল| পরশটাও আজকাল কেমন জানি করে| কি হলো তোদের?
~মা আজ একমাস হলো পরশ আমার সাথে কথা বলে না| চোখের দিকে তাকায় না পর্যন্ত| আমি ওকে ছাড়া কেমন করে থাকবো| বলো তুমি?
~কেন?
~জানি না!
~তুই কি পরশকে ভালোবাসিস?
~হ্যা মা|
~দেখ মুন| প্রথমবার যখন তুই শুভ্রকে ভালোবেসেছিলি তখন আমি আপত্তি করেছিলাম| কারন সব মা ই চায় তার সন্তান সুস্থ স্বাভাবিক হোক| আমি চেয়েছিলাম আমার ছেলের টুকটুকে একটা বউ হবে, সুন্দর নাতি নাতনিদের হাত ধরে বৃদ্ধ বয়সে খেলা করে সময়টা কাটিয়ে দিবো| কিন্তু তোর বাবা আমাকে বুঝিয়ে যে সমকামী/সমপ্রেমী একটা সুস্থ স্বাভাবিক ব্যাপার| কারন তিনি আধুনিক একজন পরম পুরুষ ছিলো| তার মুত্যৃর পর আমিই তোকে আগলে রেখেছি| তোদের সম্পর্ক মেনেও নিয়েছিলাম| কিন্তু শুভ্র কি করলো,আমার এই ইন্টারপড়ুয়া ছেলেটাকে এক বুক জ্বালা দিয়ে চলে গেলো| তারপর তোকে স্বাভাবিক করতে আমার ছয়মাস কেটে গেলো|
~আমি সব জানি মা|আমি এখন শুভ্রকে ভুলে গেছি|
~কিন্তু পরশ কি তোকে ভালোবাসে?
~না মা|ও নিরাকে ভালোবাসে!
~দেখ|বভালোবাসা জিনিসটা মন থেকে আসতে হয়| সবারই অধিকার আছে নিজের মতো করে কাউকে ভালোবাসার। পরশ তোকে ভালোবাসে না,সে স্বাভাবিক একটা ছেলে| তোর কোন অধিকার নেই তাকে পথচ্যুত করা|
~মা| আমি তা করতেও চাই না| আমি চাই, ও নিরাকে নিয়ে সুখে থাকুক|
~এই তো আমার ছেলের মতো কথা|
~কিন্তু আমি চাই ও যেন আমাকে ভুল না বোঝে| আমাদের বন্ধুত্বটা স্বাভাবিক হোক| আমি ওকে দুর থেকে আজীবন ভালোবেসে যাবো| মা প্লিজ তুমি পরশকে একটু বোঝাও|
~হুম| ঠিক আছে বাবা| তুই পরশকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিস| এবার একটু হাস তো| আর চল হাতে ব্যান্ডেজ করে দি, না হলে সেফটিক হবে|
~আমার লক্ষী মা|
~এবার ছাড়| হয়ছে| তুই আমাকে কথা দে আর কখনো কাঁদবি না| এই হাসিটা আমি তোর মুখে সারাজীবন দেখতে চাই| বিকজ এই হাসিটা আমার মুনের মুখ বেশ শুট করে| তুই মুন,চাঁদ! তোর কাজ পৃথিবীকে আলোকিত করা| যদিও অমাবস্যা ক্ষণিকের অন্ধকারে তোকে গ্রাস করে, তবুও তিথিলগ্ন পেরিয়ে তুই আবার হাসবি| সবার হৃদয়কে আলোকিত করবি|
মায়ের কথা শুনে সাইমুনের চোখে পানি চলে এলো, যেটা আনন্দ অশ্রু, সন্তানকে দেওয়া এক মায়ের ভরসা অশ্রু| সাইমুন শাহানাকে আবার জড়িয়ে ধরলো|
~ইউ আর মাই গ্রেট মম|
ছেলের হাসি,আনন্দে, কাঁন্নায় সব মা কি এমন হয়? ছেলের সমকামী সত্ত্বাকে ক’জন মা মেনে নিতে পারে? ক’জন মা পারে ছেলের নিষিদ্ধ ভালোবাসার গল্প শুনে চোখে পানি আনতে?
সমপ্রেমিতা মেনে কোন মা পারে সন্তানের কষ্ট মুক্তির জন্য আজীবন নীলাকাশে মুক্তপাখির দিকে চেয়ে থাকে?
সাইমুন তার মাকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে নাস্তা করতে গেল|
আজ ছুটির দিন| সকাল থেকে শাহানা বাড়িতেই আছে| সাইমুন তার নিজের রুমে বসে গিটার বাজাচ্ছে|
কলিংবেলের শব্দ হলো| শাহানা উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলো|
~কেমন আছো মা?
~এতোদিন পর মায়ের কথা মনে পড়লো! আয় ভিতরে এসে বস্|
~সরি মা| বলো কি জন্য ডেকেছো?
~পরশ! মুন আর তোর মাঝে কি হয়েছে রে?
~কই কিছু না তো মা! মুন তোমাকে কিছু বলেছে?
~নাহ্| তোদের দুটো কেই আজকাল কেমন যেন দেখছি| তুই ও এমুখো হোস না| তাই বললাম|
~আসলে মা ২য় ইয়ারে উঠছি,পড়ার চাপ একটু বেশি| তাছাড়া তোমার সাথে, মুনের সাথে তো ভার্সিটিতে দেখাই হয়| তাই আর….
~দেখ পরশ! কথা লুকাস না| মুন যেমন আমার সন্তান তুইও আমার তেমন আরেক সন্তান| বুকে হাত রেখে বলতে পারবি এই মা কখনো তোদের দুজনকে আলাদা করে দেখেছে? তোদের মাঝে যদিও মান অভিমান কিছু হয়ে থাকে, সেটা দেখিয়ে এই বয়সে আমাকে কষ্ট দেওয়ার কোন মানে হয় বাবা|
~সরি মা|
বললেই পরশ শাহানাকে জড়িয়ে ধরে|
~সত্যি মা |বড় ভুল হয়ে গেছে| আমাকে তুমি মাফ করে দাও|
~পাগল ছেলে| যা উপরে যা| দেখ মুন উপরে আছে|ভআমি চাই তোদের বন্ধুত্ব আজীবন এমন থাকুক| আর হ্যা!নিরা কেমন আছে রে?
~ভালো আছে!
বলেই পরশ উপরে ছুটে গেলো| যেখানে অধীর আগ্রহে বসে আছে সাইমুন| ভালোবাসাকে নয়, বরং ভালোবন্ধুকে কাছে পাবে সেই প্রত্যাশায় দুটো অভিমানী চোখে নিয়ে|
৫|
আজ অনেকদিন পর সাইমুন আর পরশ একসাথে ভার্সিটিতে এলো|
সাইমুন এই ভেবে খুশি যে,তার ভালোবাসা স্বার্থক না হোক,তার ভালোবাসার মানুষের হাসিখুশি মুখ তো সে সবসময় দেখতে পাবে| যদিও পরশকে নিরার সাথে দেখলে বুকের ভিতর ব্যথা করে উঠবে, অবাধ্য চোখ দুটো অশ্রু ঝরাতে চাইবে| তবুও পৃথিবীতে ক’জন পারে ভালোবাসার মানুষের এতো কাছে থাকতে?
ক্লাসে পারমিতা ম্যাম প্রবেশ করলো|
~কি ব্যাপার?পরশ সাইমুন যে?আজকাল যে তোমাদের দেখা মিলা ভার!
~সরি ম্যাম!একটু ঝামেলায় ছিলাম|
~এখন ঠিক আছো দুটোতে|
~হ্যা ম্যাম|
~ওকে| ক্লাসে মন দাও এবার| স্টুডেন্ট কাল আমরা…….
ভার্সিটির ক্লাস শেষ হয়ে গেছে সেই কখন! এখনো পরশের দেখা নেই| সাইমুন গেটে দাঁড়িয়ে বোরড হচ্ছে|
~কিরে সাইমুন, বাসায় যাবি না?
~ওহ রাই! হ্যা যাবো তো| দেখ না পরশটার জন্য দাঁড়িয়ে আছি,ওর দেখা নেই| ফাজিলটাকে একটু দেখা না গেলে বাসায় গিয়ে থাকতে পারবো না| দু পিরিয়ড করে কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেলো| ও জানে যে আমি দাঁড়িয়ে থাকবো,তবুও….
~ওমা! ওকে তো নিরার সাথে ক্যাফেতে দেখে এলাম|
~ওহ্| আচ্ছা চল্ তাহলে বাসায় যাই|
~হুম চল| এই অন্তু যাবি| এবার গল্প ছাড় তো|
~রাই, সাইমুন| দাঁড়া,এক মিনিট দোস্ত|
~আচ্ছা রাই,পরশ কি সত্যি নিরাকে ভালোবাসে?
~তুই কি যে বলিস সাইমুন?একসাথে ডেটিং এ যায়,আড্ডা মারে আমাদের রেখে!
~ওহ| এই আমি গেলাম| তুই অন্তুকে নিয়ে আয়|
~এই কি হলো রে তোর? আচ্ছা যা|
~বাই|
সাইমুন ধীর পায়ে বাড়ি চলতে লাগলো|
পৃথিবীতে সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার হলো ভালোবাসার মানুষকে অন্যের সাথে দেখা| জীবনের সমস্ত সুখ সেখানেই বিলীন হয়ে যায়|
লালমাই পাহাড়ে সাইমুন একলা দাঁড়িয়ে আছে| বর্ষার হালকা হাওয়া ওর চুলকে ভিজিয়ে দিচ্ছে| আকাশে বর্ষার মেঘ জমেছে| তা সাইমুনের হৃদয় আকাশের থেকে বেশি না| নীলাকাশ কাঁদলে বৃষ্টি ঝরে| মানুষের মনের আকাশ কাঁদলে কষ্টের রক্ত ঝরে| যা অনেক দিন ধরে সাইমুনের মনের আকাশ থেকে ঝরছে| সে আকাশ আজ শূণ্য প্রায়| ভালোবাসা ধীরে ধীরে অভিমানে রুপ নিচ্ছে সাইমুনের বুকের ভিতর| অভিমান হয়তো রুপ নিবে রাগে,তারপর রাগ থেকে হৃদয় হবে পাথর| না পাওয়া ভালোবাসা কি সত্যি মানুষকে নীরব করে দেয়?
হঠাৎ সাইমুন কাঁধে কারোর শীতল স্পর্শ পেলো| ফিরে দেখলো পরশ পিছে দাঁড়িয়ে আছে|
~কিরে এই বৃষ্টিতে ভিজছিস কেন মুন?
~এমনি রে|
~এটা আমার প্রশ্নের উত্তর হলো?বাসায় গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,মা বললো জানে না তুই কোথায়!তাই খুঁজতে খুঁজতে এই পঞ্চমনির আড্ডায় এলাম| কি হয়েরে তোর দোস্ত?
~কিছু হয়নি তো| বল খুঁজছিস কেন?
~কিছু হয়নি তা কাঁদছিস কেন?
~দুর!কি যে বলিস! কই কাঁদছি? ঝিরঝির বৃষ্টির পানি চোখের কোণে জমেছে!
~তাই না!
~আচ্ছা পরশ তুই কি নিরাকে সত্যি ভালোবাসিস?
~কেন তোর কি মনে হয়? মিথ্যা মিথ্যা ভালোবাসি!
~ধ্যাত| বাদ দে তো |তুই সুখে থাকলেই হলো| চল অনেকক্ষণ ভিজছি ঠান্ডা লাগলে মা বকবে|
~মুন তোকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি,তুই কি আমার কোন ব্যবহারে কষ্ট পাচ্ছিস? এই যে আমি নিরাকে ভালোবা…..
~কি যে বলিস না| পাগল হলি নাকি?
~সত্যি বল না প্লিজ|
~আরে না| আচ্ছা তোকে একটা রিকুয়েস্ট করবো! রাখবি?
~হুম বল|
~তুই আর আমাকে মুন বলে ডাকিস না প্লিজ| আমার কেমন কেমন জানি লাগে| প্লিজ|
~হুম| চল! মা চিন্তা করবে|
সেদিন পরশের চোখ থেকেও দু’ফোঁটা অশ্রু ঝরে পরেছিলো| যা বর্ষার পানিতে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলো| হয়তো সাইমুনের প্রতিও পরশের ভালোবাসা ছিলো| কিন্তু কি ছিলো তার চোখের পানিতে?
আজ পহেলা ফাল্গুন| পলাশ ফুলে সেজেছে সারা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়| ফাল্গুনী উৎসবে মেতেছে তরুণ-তরুণীরা। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চমনিরা ৩য় বর্ষে পড়ছে| যদিও এক মনি এখন আর নেই| সাইমুন আর পরশ আজ হুমায়ূন আহমেদের হিমুর হলুদ পাঞ্জাবী যেন চুরি করে পরে এসেছে| অসম্ভব সুন্দর লাগছে দুই
বন্ধুকে| এদের বন্ধুত্ব আজও তেমন আছে| অচেনা কেউ একজন পরশকে ডাক দিলো|
~সাইমুন,আমি একটু আসছি| তুই দাঁড়া তো|
প্রায় একবছর হলো পরশ সাইমুনকে মুন বলে ডাকে না|
~হুম যা|
পরশ চলে গেলে সাইমুন কনসার্ট মঞ্চের দিকে গেলো|
হঠাৎ নিরার সাথে দেখা সাইমুনের|
~কিরে নিরা| কেমন আছিস? এতোদিন পর দেখা!কোথায় ছিলিরে?
~এই সাইমুন| দোস্ত কেমন আছিসরে? আমি ভালো আছি| তোদের কি খবর?
~আর খবর! আছি মোটামুটি| তোর খবর বল| এতোদিন কোথায় ছিলি?
~হ্যাজবেন্ডের সাথে সেই সুদূর আমেরিকায়। বুঝলি বুদ্ধু|
~আমেরিকা?বকি বলিস এসব? কবে বিয়ে করলি? পড়ালেখা ছেড়ে দিলি?
~ছাড়বো কেন?ওখানেই পড়ছি| এবার বল পরশ কেমন আছে?
~যেমন রেখেছিস তেমন আছে!
~মানে? আমি আবার কি করলাম?
~তুই ওকে ভালোবেসে ধোকা দিছিস| এখন ড্রামা করছিস?
~কি বলিস সাইমুন? আমি ওকে ভালোবাসতে যাবো কেন? ওতো তোকে ভালোবাসে! জাস্ট আমাকে একটু অ্যাক্টিং করতে বলেছিলো, তাই করেছিলাম|
~কি? আমাকে ভালোবাসে! মজা নিচ্ছিস?
~সত্যি ও তোকে ভালোবাসে| শুধু বন্ধুত্ব নষ্ট হওয়ার ভয়ে তোকে বুঝতে দেয়নি| তোর মাকে মা ডাকে সেই মর্যাদা রাখতে ও তোকে ভালোবাসার কথাটা পর্যন্ত বলেনি| পরশ খুব ভালোরে সাইমুন| আচ্ছা দাঁড়া…সুমন সুমন| সাইমুন এই আমার হাজবেন্ড! আর সুমন,এই আমার বন্ধু সাইমুন|
~হ্যালো|
~হ্যালো|
এরই মাঝে স্টেজে সাইমুনের নাম ঘোষণা হলো|
~নিরা আসছি|
~হুম,বেস্ট অফ লাক|
সাইমুন স্টেজে উঠে গিটার বাজিয়ে গাইতে শুরু করলোঃ
“এখনো আছে তোকে নিয়ে বেঁচে থাকার স্বাদ,
এখনো সেই ভালোবাসা রয়েছে নিখাদ|
এখনো সেই চায়ের কাপে পুড়ে যাওয়া চাঁদ,
এখনো তুই ছাড়া যেন শেষ হয় না রাত|
না পারি নারে আর খুলে রাখি দুয়ার,
আয় ফিরে তুই আয় না আবার,
আর একটি বার,তুই হবি কি আমার?
আর একটি বার,তুই হবি কি আমার?
খুঁজে ফিরি বারে বারে,
দেখা যদি হয় আবার,
আবেগী সে মন,
আছে কি তেমন?
ও খুঁজে ফিরি বারে বারে,
দেখা যদি হয় আবার,
আবেগী সে মন,
আছে কি তেমন|
না পারি নারে আর খুলে রাখি দুয়ার,
আয় ফিরে তুই আয় না আবার,
আর একটি বার,তুই হবি কি আমার?
আর একটি বার,তুই হবি কি আমার?
দুরে বসে অজানায় মনে পড়ে কি আমায়?
কিভাবে আছি,কি করে বাঁচি|
ও দুরে বসে অজানায় মনে পড়ে কি আমায়?
কিভাবে আছি,কি করে বাঁচি|
না পারি নারে আর খুলে রাখি দুয়ার|
আয় ফিরে তুই আয় না আবার|
আর একটি বার,তুই হবি কি আমার?
আর একটি বার,তুই হবি কি আমার?
এখনো আছে তোকে………………………”
সবাই মুগ্ধ যেন সাইমুনের গানে| নিস্তব্ধ নীবর পুরো মঞ্চ|
সাইমুন দেখলো দুরে নিরার সাথে কথা বলছে পরশ|
একটা ছেলে এসে সাইমুনের হাতে এক টুকরো কাগজ গুজে দিয়ে গেলো| সাইমুন কাগজের ভাঁজটি খুলে দেখলো একটা লাইনে লেখাঃ
“আর একটি বার, তুই হবি কি আমার?”
দুরে দাড়িয়ে পরশ আনমনে তাকিয়ে আছে গিটারধারী সাইমুনের দিকে| সাইমুন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এক টুকরো কাগজের দিকে| যাতে টপটপ করে অশ্রু পরছে|
বাসায় ঢুকে সাইমুন উপরে চলে গেলো| সারা রাস্তা একটা কথা পর্যন্ত বলেনি|
~কিরে পরশ?ওটার আবার কি হলো?
~কি জানি মা| তোমারই তো ছেলে|
~মার খাবি কিন্তু| তুই কার ছেলে শুনি? যা গিয়ে দেখ|
~জো হুকুম| রাণীমা|
~আবারো দুষ্টুমি!
পরশ সাইমুনের রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো| সাইমুন দৌড়ে এসে পরশকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো|
~কিরে হাবা| কি হলো?
~তুই আমাকে এতো ভালোবাসিস বলিস নি কেন?
~বলতে হবে কেন? তুই বুঝিস না বিলাই! তুইও তো আমাকে এতো ভালোবাসিস, বলিস নি কেন?
~বুদ্ধু কোথাকার| তুই বুঝিস না!
~আমি তোর মুখ থেকে শুনতে চেয়েছিলাম বিলাই| তাছাড়া মা কে হারানোর ভয়ে বলি নি|
~ঐ হারামি| মা জানে যে আমি তোকে ভালোবাসি| বুঝলি?
~রেলি? আমার শ্বাশুড়ি জানে?
~মার খাবি কিন্তু!কে তোর শ্বাশুড়ি?
~কেন মা!
~দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা!
বলেই সাইমুন পরশকে বিছানায় ফেলে দিলো| সেই একি গোলাপ অঙ্গিত বিছানা,একি বালিশ কাঁথা| আর দুজনের মনে সেই পহেলা বৈশাখের মধুময় রাতের স্মৃতি| পরশ আদরে আদরে ভরে দিচ্ছে সাইমুনের শরীরকে| সাইমুনের কানের কাছে মুখ এনে পরশ ফিসফিস করে বলল,’আর একটি বার,তুই হবি কি আমার?’ সেই রাতের মতন করে| সাইমুন শিহরিত হয়ে বলল, শুধু একটি বার নয়,আমি হাজার বার তোর হতে রাজি। বুদ্ধু কোথাকার! অনাবিল সুখে হারিয়ে গেল দুটি দেহ|
সাইমুন আর পরশ এখন নীলাচল পাহাড়ে| পরশ সাইমুনকে পিছ থেকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে| এই সেই নীলাচল,সেখানে সাইমুন ভালোবাসার মানুষকে কিস করতে চেয়েছিলো| পরশ সাইমুনের কানের লতিতে কামড়ে ধরে বললো,
~এবার কি মুন বলে ডাকতে পারি জনাব?
~জে স্যার পারেন|
পরশ সাইমুনের মুখ ফিরিয়ে তার লাল ঠোটে কিস দিতে শুরু করলো|
পলাশ রাঙা সূর্যের বিকেলের রোদের ঘ্রাণ বসন্তের হাওয়াতে মিশে ওদের ছুঁয়ে গেলো|
“আহা আজি এ বসন্তে,কত ফুল ফোটে,কত পাখি গায় গান…..
সুখে আছো যারা,সুখে থেকো তারা”
(বিঃদ্রঃ গল্পটিতে সাইমুন চরিত্রে আমি নিজেকে খোঁজার চেষ্টা করেছি,চেয়েছি এমন মা,এমন একজন পরশকে আর এমন বন্ধু পঞ্চমনিকে|যদিও তা পাবো না জানি!)
~সমাপ্ত~
উৎস: অন্যভুবন