
সাকির মাটি
হালকা নীল রঙের আলোতে জলের ফোঁটাটা নীল মুক্তার মতো মনে হয় ।
হয়তো সেই মুক্তার সৌন্দর্যে তিন বা চার সেকেন্ড হারানো যায়, তার বেশি নয় ।
তারপর আবার এক ফোঁটা জল এসে সেই সুন্দরকে ভাসিয়ে নেয় ।
অর্পন হাতের সৌন্দর্যে মনোযোগ দেয় । যেটা হাত থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে পরে সাদা পৃষ্ঠায় ।
জীবনের প্রথম পূর্ণতার অর্জনে পৃষ্ঠাটা ভিজে যায়, সিক্ত হয় ।
ভাগ্যবান রবীন্দ্রনাথকে দূরে সরিয়ে রাখতে রাখতে অর্পনের মনে পরে, কোন এক রাত্রিতে রবীন্দ্রনাথকেই বুকের নিচে থেকে ঘুম পাড়াতে হত।
প্রকৃতির পরিমার্জিত ধারাবাহিকতায় আজ তার বুকের নিচে ঘুমের নির্ভরতায় থাকে নীল রঙের স্বপ্ন।
উপুড় হয়ে শোয়া অর্পনের হাত মুক্তাহীন, সরু একটা জলের ধারা গড়িয়ে পরছে চোখ থেকে হাতের ওপর দিয়ে বিছানায় ।
বাম হাতের মুঠোফোনে ২৯৮ বার ডায়াল করা নম্বরে আরও একবার ডায়াল করে অর্পন ।
যদিও ফোন খোলার সঙ্গে সঙ্গে পাঠানো এসএমএসের ডেলিভারি রিপোর্ট আসবে । তার পরও অর্পন ডায়াল করে ।
আবার ডায়াল করে । এত গভীর রাতে নীল নিশ্চয়ই ফোন ধরবে না । ঘুম ভেঙ্গে হয়ত একবারও মনে পরবে না অর্পনের কথা ।
হয়ত গতকালের রাগটুকুও আর নেই নীলের মাঝে । অর্পন জানে, বোঝে । তবুও মন মানে না ।
কোন একটা কাঙ্ক্ষিত সচেতনতা, কাঙ্ক্ষিত পরশ বারবার পেতে ইচ্ছে করে । সেকন্ডগুলো বারবার বলে যায়, তুমি পাবে না ।
তুমি পাবে না । তারপরও খুব পেতে ইচ্ছে করে । অর্পন একটা ছোরা নিয়ে বসে বারবার চামড়ায় স্পর্শ করে ।
ইচ্ছে করে চামড়া কুটি কুটি করে এই কষ্টকে আড়াল করতে কিন্তু একটি বাক্য তাকে চেপে ধরে বলতে থাকে, ‘আমার দেহটাকে তুমি কোনদিন কষ্ট দেবে না ।’
অর্পনের হাত আর সামনে এগোতে দেয় না নীলের একটা কথা । অর্পন কারও সম্পদে আঘাত করতে চায় না । কাউকে কষ্টও দিতে চায় না ।
সে ঘুমাতে চায় কিন্তু ঘুমাতে পারে না । বৃষ্টির শব্দ তাকে ঘুমাতে দেয় না, মেঘের গর্জন তাকে ঘুমাতে দেয় না । অর্পন ঘুমাতে চায়, গভীর ঘুমে অচেতন হতে চায় ।
বৃষ্টি কমে আসে, মেঘের গর্জন থেমে আসে, রাতের আঁধার চিরে আলোর ছটা বেরিয়ে আসে, অর্পনের চোখও ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসে ।
গতকাল রাতের ছবি হুবহু অর্পনের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ।
নীলের ভাসা ভাসা নরম কিন্তু প্রবল বাক্যগুলো হালকা বাতাস কিন্তু প্রকট তীক্ষ্ণতায় বাসির সুর থেকে বেরোনো শূন্য শব্দের মতো মনে হয় ।
এক মুহূর্তের জন্য বুকের ভেতরটা পুরোপুরি শূন্য হয়ে যায় । জীবনকে অনিশ্চিত মনে হয় । মনে হয় জীবনই বুঝি জীবনেরই শত্রু, রাতই বুঝি রাতের কান্না ।
নীলই বুঝি নীলের কষ্ট ।
“ভালো থেকো । সুখে থেকো ।” নামক দুটো বাক্যের পরে সবকিছু নিথর হয়ে যায় । হৃদপিণ্ডের স্পন্দন বাদে সবকিছু নিস্তব্ধ হয়ে যায় ।
সমস্ত রাগ হৃৎপিণ্ডের কাছে গিয়ে থেমে যায় ।
অর্পন চেষ্টা করে আর বারবার একজন মানুষ তার সবচে পছন্দের বাক্য আউরে যায় ।
অর্পণ ধীরে ধীরে জানালার কাছে যায়, যেখান থেকে নিচে তাকালে আঁধার ছাড়া কিছু দেখা যায় না ।
অর্পণ পেছন ঘুরে আস্তে করে শরীরটা জানালা দিয়ে নিচে ছড়িয়ে দেয় । সব কষ্ট শূন্যে ভেসে থাকে, অর্পণ শূন্য দেহের সঙ্গে নীল থেকে কালোতে হারিয়ে যায় ।
জানালায় একটা নীল মুখ অর্পণের চোখ ছুঁয়ে যায় ।
শঙ্কিত চিন্তিত মুখখানি ধীরে ধীরে বেপরোয়া হয় । অর্পণ ভয় পায়, নীল মুখটা জানালা দিয়ে ছিটকে বেরোতে চায় ।
অর্পণ চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘তুমি এসো না, তুমি এসো না ।’ হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া মুখের আশঙ্কায় আঁধারে হারাতে হারাতেও তার বুকের ভেতরটা কামড়ে ওঠে, সমস্ত শরীর নড়ে ওঠে, হৃৎপিণ্ডটা রক্তজোড় চোখ হয়ে জানালায় ছুটে যায় ।
অর্পণের চোখ খুলে যায় । খুব ভয় করে, দুশ্চিন্তা হয়, ভীষণ ভয়ে তার ঘর্মাক্ত শরীর সংকুচিত হয় । ভয়ে ভয়ে মুঠোফোনের সবুজ বাটনটাতে ক্লিক করে ।
ওই মহিলা আবারও উতলানো ভাতে নাড়া দিয়ে যায় ।
সঙ্গে সঙ্গেই মুঠোফোনের স্ক্রিনে একটা পরিচিত নম্বর ভেসে ওঠে, মুঠোফোনে ভাইব্রেশন হয় ।
এক ঝটকায় উঠে অর্পণ সবুজ বাটনে ক্লিক করে স্পিকার কানে ধরে ।
ওপাশ থেকে ঝরঝরে একটা নীল কণ্ঠ, নিস্তব্ধ রাত্রিকে কোন কষ্ট না দিয়ে একটু আড়ালে এসে নীরব হাসিতে বলে ওঠে, ‘কেমন আছ অপু ?’ অর্পণ কোন কথা বলে না ।
এই কণ্ঠস্বরে ভর করে একটা উষ্ণ শিহরন ছুটে চলে শরীরের বিশেষ অঙ্গগুলোতে ।
অর্পণ অনুভব করে, মুহূর্তগুলোকে গায়ে মাখে । কথার পিঠে কথা বলে এই সুন্দরকে আড়াল করতে মন চায় না ।
নিজেকে মিশিয়ে ফেলতে চায় এই সুন্দরের মাঝে।
আবারও রাতের নিস্তব্ধতার চেয়ে অনের বেশি নিরবে, অনেক বেশি শান্ত কণ্ঠে নীল ছোট্ট করে বলে, ‘ভালোবাসি অপু ।’
অর্পণের চোখে হাসি ফোটে, গাল গড়িয়ে জল পড়ে, বাঁ হাতটা আপনা থেকেই বুকের কাছে চলে যায় ।
নীল কিছুই দেখতে পায় না । বুঝতেও পারে না ।
খুব ইচ্ছে করে অর্পনের গত রাতের কষ্টগুলো খুলে খুলে দেখাতে, প্রতিটি সেকেন্ডের বিবরণ দিতে, প্রতিটি মুক্তার জীবনী আওরাতে, বীভৎস স্বপ্নটার কথা বলতে ।
তারপর খুব করে বকতে, নষ্ট নষ্ট গালি দিতে ।
অর্পণ কিছু করে না ।
এই নীরব হাসির সামনে অর্পণ কিছু বলতে পারে না ।
এই হাসিকে এতটুকু মলিন করার ক্ষমতা সে খুঁজে পায় না । কেন পায় না জানে না ।
অর্পণ কিছুই জানে না । জানতে চায়ও না ।
শুধুমাত্র বীভৎস একটা রাত্রিকে আবারও আড়াল করে ।
আড়াল করে বলে যায়, ‘ভালবাসি শুধুমাত্র ভালবাসি ।’
উৎস: অন্যভুবন