“প্রথম প্রভাত” এর চিঠি…

অন্য ভুবন

প্রিয় অর্ন’দা ,

ওহ! সরি, দেখেছো কত ভুলো মন আমার! আমি ভুলেই গিয়েছিলাম তোমাকে এই নামে ডাকার অধিকার আমি চার বছর আগেই হারিয়ে ফেলেছি, এখন আর আমার সে অধিকার নেই। কেমন আছো তুমি? নিশ্চয়ই ভাল আছো, খারাপ থাকতে যাবে কেনো? জানো, আমিও না খুব ভাল আছি! এক ঝটকায় আমি আনেক বড় হয়ে গেছি, এখন আর আগের মতো দুষ্টুমি করি না আমি। তোমার মনে আছে, যেদিন তুমি প্রথম বার আমাদের বাসায় এসেছিলে সেদিন আমি কি করেছিলাম?? সেই দিনটার কথা মৃত্যুর আগ অব্দি আমার মনে থাকবে, দিনটা ছিল ০৭ জানুআরি ২০০৫। আমাকে আগেই বলা হয়েছিল আমার দেখাশুনো করার জন্য গ্রাম থেকে মাসিমণি তাদের এক দুরসম্পর্কের বোনের ছেলেকে পাঠাচ্ছে, এটা শুনেই আমার মেজাজ সপ্তমে উঠে গিয়েছিল। তাইতো তোমাকে স্বাগত জানানোর সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। যখন তুমি আমাদের বাসায় আসলে তখন আমি বারান্দায় বসা ছিলাম, তুমি এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলে -এটা কি জয় সাহেবের বাসা? আমি পেয়ারা চাবাতে চাবাতে বললাম, না ভাইয়া এখানে জয় বা মনি নামে কেউ থাকেনা, এটা বলেই জিভ কাটলাম। (মনেমনে বল্লাম ইস! ধরা পরে গেলাম! তুমি তো আমাকে শুধু আব্বুর কথা জিজ্ঞেস করেছিলে আম্মুর কথা তো জিজ্ঞেস করনি!) এর মধ্যে মা ভিতর থেকে বলে উঠল -বাপ্পি কে এসেছে রে… আমি কিছু বলার আগেই তুমি বললে -মাসিমা আমি অর্নব গোপালগঞ্জ থেকে এসেছি। গীতা রায়ের ছেলে, সবিতা মাসি আমাকে পাঠিয়েছেন। মা ভিতর থেকে এসে বলল -তুই এসে পরেছিস, আয় বাবা ভিতরে আয়। তা বাড়ি চিনতে কোনো সমস্যা হয়নি তো? অমনি আমার মুখ শুকিয়ে গেল, আর তুমি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললে -না না কোনো সমস্যা হয় নি।
কি যে অপরূপ ছিল সে হাসি! আমিও তোমাদের পিছু-পিছু মাথা নিচু করে ঘরে ঢুকে পরলাম। সে কথা মনে পরলে আজও খুব হাসি পায়। তারপর সারা বিকেল একবারো তোমার সামনে যাই নি আমি, আমরা তখন দুটো রুম আর একটা বারান্দা ওয়ালা একটা বাড়িতে ভাড়া থাকতাম। এক রুমে থাকত মা বাবা ও ছুটকি আর আরেকটাতে আমি আর মাসিমনি। মাসিমনি একটা স্কুলে চাকরি করতে গ্রামে গিয়েছে দুমাস হলো, তাইতো তোমার আগমন। আমি খুব ভালই বুঝতে পেরেছিলাম যে আমার বেডরুমে তুমি ভাগ বসাবে তাই রাতে তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে আমি আগেভাগে রুমে গিয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিলাম, তার মিনিট পনেরো পরেই তুমি এলে। আমি নিজমনে পড়ছি হঠাৎ তুমি হাত বাড়িয়ে বললে -হাই আমার নাম অর্নব, তোমার নাম বাপ্পি তাই না? অমনি আমি উঠে বললাম, -জি না আমি সুমন, শুধু মা আমাকে ওই নামে ডাকে!
তুমি – আমি তোমাকে কি বলে ডাকব? মন বলে ডাকি??
আমি -কেনো! আপনি খামাখা আমাকে মন বলে ডাকতে যাবেন কেনো?
তুমি – না মানে তোমাকে তো সবাই আলাদা আলাদা নামেই ডাকে দেখছি, যেমন মাসিমা ‘বাপ্পি,’ বাড়িতে বোসে শুনেছি মাসিমনি তোমাকে ‘চান্দু’ বলে ডাকে, তাই ভাবলাম আমিও তোমাকে একটা নাম দেই। একথা বলেই তুমি একটা মুচকি হাসি দিলে। তখন রাগে আমার গা জ্বলে যাচ্ছিল। মনে মনে বলছিলাম (মাসিমনি আমাকে চান্দু বলে ডাকে সেটা এই লোকটাকে বলার কি দরকার ছিল!)
তো আমি তোমাকে বললাম – দেখুন আমাকে যারা বিভিন্ন নামে ডাকে, তারা আমার কাছের মানুষ, আপনাকে তো আমি চিনিই না এর আগে কোনদিন দেখিও নাই, আপনি কেনো আমাকে নাম দেবেন! সবাই আমাকে যে নামে ডাকে আপনিও আমাকে সেই নামে ডাকবেন।
তুমি বললে -আচ্ছা বাবা ঠিক আছে যেদিন তোমার কাছের মানুষ হতে পারব সেদিন না হয় তোমাকে ‘মন’ বলে ডাকব, সেই দিনের আগ অব্দি না হয় সুমন বলেই ডাকবো। (আমি তো বিশাল বড় একটা টাস্কি খাইলাম, ভাবতে লাগলাম এই পোলায় কয় কি! কাছের মানুষ হইবো এই কথার মানে কি!)
এরই মধ্যে তুমি আবার বলে উঠলে -ভয় পেলে নাকি? আরে ভয় পাওয়ার কিছু নাই, কাছের মানুষ বলতে আমি বোঝাতে চেয়েছি আমি যেদিন তোমার বন্ধু হতে পারবো সেদিন না হয় তোমাকে মন বলে ডাকব। এটা বলে তুমি হা……হা… করে হেসে উঠলে। আমি শুধু মনেমনে বললাম, কি আজিব মানুষ রে বাবা! এই বলে আমি আবার লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পরলাম, তার একটু পরে টের পেলাম তুমিও শুয়ে পরেছো।

আচ্ছা অর্ন’দা এসব তোমার এখনো মনে আছে?? আমি কিন্তু আজও কিছুই ভুলিনি! ১০ বছর পরও সবকিছুই আমার মনে আছে, মৃত্যুর আগ অব্দি সব মনে থাকবে। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি তুমি হা করে ঘুমিয়ে আছো, আগের দিন অনেক টা পথ জার্নি করেছিলে তো তাই বোধহয় একটু গভীর ঘুমে ছিলে, নিস্পাপ ছোট্ট শিশুর মত দেখতে লাগছিল তোমাকে …

হটাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ৮টা বেজে গেছে, তাই আমি ‘অর্নব ভাইয়া এখন উঠুন অনেক বেলা হয়েছে’ বোলে তোমাকে ডাকতে লাগলাম। দু-তিনটে ডাক দিতেই তুমি ঝকমকিয়ে উঠে বললে -ইস! অনেক দেরি গেছে তাই না? স্যরি আমি – না না It’s ওকে। কাল তো আপনি অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছেন তাই এমনটা হয়েছে, তাছাড়া আমি খুব ভাল করেই জানি গ্রামের মানুষ অনেক ভোরে ঘুম থেকে ওঠে, বরং আমরা শহুরে ফার্মের মুরগিরাই বেলা করে ঘুম থেকে উঠি। আমার কথা শেষ হতে না হতেই তুমি হো হো করে হেসে উঠলে, আমি শুধু ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ছিলাম,
এর মধ্যে তুমি বললে -এইযে সুমন বাবু আমি কি বুড়ো নাকি যে আমাকে আপনি করে বলছো? আমাকে তুমি করে বলবে, আর ‘অর্নব ভাইয়া’! এত বড় ডাক আমার হজম হবে না, তুমি চাইলে আমাকে অর্ন’দা বলে ডাকতে পারো।
আমি বললাম -আমি অচেনা মানুষকে তুমি করে বলি না বুঝেছেন, আর আপাতত ‘অর্নব ভাইয়া’ ই ঠিক আছে কখনো যদি সময় আসে সেদিন না হয় অর্ন’দা বলে ডাকবো।

এসব কি তোমার আজও মনে আছে? নাকি ভুলে গেছো সব?? তারপর দিনগুলো বেশ ভালই কাটছিল। আমরা তখন যে বাড়িতে ভাড়া থাকতাম সেখানে সাপ্লাই পানি ছিল না তাই ছেলেরা সবাই কলতলাতেই গোসল করত, তোমাকে যখন খালিগায়ে গোসল করতে, তখন লুকিয়ে লুকিয়ে তোমাকে দেখতাম। হয়তো তুমি বুঝতে কিন্তু কোনো দিন কিছু বলতে না। কি সুখের ছিল সেই দিনগুলো! ধীরে ধীরে আমরা খুব ভাল রূপান্তরিত হলাম, তুমি ‘তুমি’ ছেড়ে তুই তে নেমে এলে আর আমি ‘আপনি’ ছেড়ে তুমি তে। সব কাজ আমাদের একসাথে করা চাই। একসঙ্গে খাওয়া, কলতলায় একসাথে গোসল করতে গিয়ে মগ,বালতি,সাবান এসব নিয়ে ঝগড়া করা, রাতে দুজনে একসাথে পাল্লা দিয়ে বই পড়া। তোমার মনে আছে সেই প্রতিযোগিতার পুরস্কার আর শাস্তি কি ছিল? কথা ছিল যেদিন যে তার পড়া আগে শেষ করতে পারবে না সেদিন বিছানা করা আর সকালে ওঠানোর কাজ টা তাকে একাই করতে হবে। আমি কিন্তু মাঝেমাঝে চিটিং করতাম। এভাবে ৭টা মাস কেটে গেল তারপর এলো আমার জীবনের সবচেয়ে সুখময় দিনটা, সেদিন ছিল আমার জন্মদিন, এতদিনে আমরা প্রাণের বন্ধু হলেও পূর্বের কথামতো তুমি কিন্তু আমাকে ‘মন’ বলে ডাকা শুরু করো নি। বিষয়টা আমার খারাপ লাগলেও আমি কখনো তোমাকে বলিনি পাছে তুমি কিছু মনে করো? আমি কি জানতাম তোমার মনে কি ছিল! আমি সেদিন সজাগই ছিলাম মিডট্রাম পরীক্ষা চলছিল আমার তাই পড়ছিলাম। রাত ঠিক ১২:০১ মিনিটে বিছানা থেকে উঠে দুহাত দিয়ে আমার মাথাটা চেপে ধরে আমার কপালে তোমার ঠোঁটের ছোঁয়া দিয়ে বললে -Happy Birth Day আমার মন! আমি একটু অবাক হয়ে বললাম -তুমি কিভাবে জানলে আজ আমার জন্মদিন! আর তোমার মন! এই কথাটার মানেই বা কি?? তুমি বললে -ইচ্ছে থাকলেই জানা যায়, আর ‘আমার মন’ বলতে আমি কি বোঝাতে চেয়েছি সেটা না বোঝার মতো বোকা তো তুই নোস, দ্যাখ মন আমরা কেউ কাউকে না বললেও দুজনেই খুব ভাল করে জানি যে আমরা দুজনেই একই পথের পথিক আর আমি এও জানি তুই অন্য কাউকে ভালবাসিস না। কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি তোকে আমার প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসি রে…. ভালবাসবি আমাকে?? আমার চোখ দিয়ে শুধু এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পরছিল, সেটা দেখে তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলে -আমি আমার উত্তর পেয়ে গেছি মন বাবু।

তারপর তোমার ভালবাসায় আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেলে। এর পরের সাড়ে চার বছর কিভাবে কেটে গেছে টেরই পাই নি, মনে পরে? একবার বাসার সবাই পনেরো দিনের জন্য দেশের বাড়ি গিয়েছিল, বাসায় শুধু তুমি আর আমি, তুমি বলেছিলে ‘এই পনেরো দিন হবে আমাদের হানিমুনের’ লজ্জায় আমার মুখটা একেবারে লাল হয়ে গিয়েছিল, তাই দেখে তুমি বললে ‘হয়েছে আর লজ্জা পেতে হবে না।

এসব কিছুই তোমার মনে নেই তাই না অর্ন’দা?? কিন্তু আমি সেই দিনগুলো কখনোই ভুলতে পারবো না। ২০১০ সালে তুমি আমাদের বাসা থেকে চাকরির উদ্দেশ্য বিদায় নিলে, সেদিন আমি কি কান্নাটাই না কেঁদেছিলাম, আমার সেই কান্না দেখে তুমি বলেছিলে -ধুর বোকা ছেলে আমি কি একেবারে চলে যাচ্ছি নাকি আবার আসব তো!

কই আর তো ফিরে এলে না! এর পরের ছ-সাত মাস ফোনে যোগাযোগ রেখেছিলে কিন্তু একসময় সেটাও বন্ধ করে দিলে, হয়েতো তুমি নতুন কাউকে খুঁজে নিয়েছো, কিন্তু আমি যে শত চেষ্টা করেও কিছুই ভুলতে পারছি না! কিভাবে পারলে সবকিছু ভুলে যেতে…. কিভাবে??…………..

আর কিছু লিখে তোমার মূল্যবান সময় নস্ট করবো না। ভাল থেকো অর্ন’দা, অনেক অনেক ভাল থেকো।।

ইতি

আজো তোমার অপেক্ষায় ভাঙ্গা মন

উৎস: অন্যভুবন

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.