
কাশফুল
শাহবাগ মোড়ে সব রকম ফুল পাওয়া যায়। ফুলের দোকানগুলো দেখতে অনেক সুন্দর দেখায়। যতবার এই ফুলের দোকান গুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে যেতাম, ততবারই আবিরের কথা মনে পরতো।
চঞ্চলতা আবিরের একটি বিশেষ গুণ। একই এলাকায় বেড়ে ওঠা আমাদের। বেশ ভাব ছিলো আমাদের মধ্যে বরাবরই। বন্ধু বান্ধবি- যাই বলিনা কেন সবই ছিলো ও। দুজনার বাবা একই প্রাইভেট ইন্জিনিয়ারিং সেক্টরে কাজ করার দরুন আমাদের দুই পরিবারে মধ্যে খুবই ভালো সম্পর্ক ছিলো। সেই সুত্রে আমরা একে অপরের বাড়িতে প্রায়ই যাওয়া আসা করতাম। বেশ ভালো বন্ধু ছিলাম আমরা। জীবনে বেশিরভাগ সময়টাই আমি ওর সাথে পার করেছি।
মনে পরে ওদের ছাদে আমরা এই সমসময়টাতেই কতো ঘুড়ি উড়িয়েছি! মনে পরে সেদিনের ওর আল্লাদের ঘুড়িটা কেটে যাওয়ার জন্য কতই না কেঁদেছিল ও। ওর কান্না থামানোর জন্য বাবার মানিব্যাগ থেকে টাকা চুরি করে ওকে নতুন ঘুড়ি কিনে দিয়েছিলাম। টের পেয়ে বাবা আমাকে কতোনা বেদম প্রহর দিয়েছিল সেদিন।
পড়াশোনাতে বরাবরই ভালো ছিলোনা আবির। ওর বাবার হাতে কতো মার খেয়েছে ও। মাঝে মাঝে আমি ওর পিঠের ছালা হয়েছি। ওর মন খারাপ হলে আমরা ধানমন্ডি লেকে গিয়ে বসতাম। বাদামের খোসাগুলো সব আমাকেই ছাড়িয়ে দিতে হতো। ওর আলসেমি এখনও আমাকে ভাবায়।
এভাবেই বেড়ে উঠতে লাগলাম দুজনে। কলেজ পার করে ভার্সিটি। সমান তালে দুজনে বেড়ে উঠলেও দুজনের বেড়ে ওঠা স্বাভাবিক হলোনা। ও পেলো একটা স্বাভাবিক সত্ত্বা। আর আমি অর্জন করলাম সেই সমপ্রেম নামক এক অভিশপ্ত সত্ত্বা।যে সত্বা সবসময় নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করে।যে সত্বা বোবা।যে সত্বার নিজের ভাব প্রকাশ করার কোন অধিকার নেই এই সমাজে।যেই সত্বার দরুন আমি অনেক আগেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম আবিরকে………………..
আবিরের কথা সবসময়ই মনে পড়ে।মস্তিষ্কের একটি কোণা দখল করে আছে সে।যে অংশটি সবসময় আবিরকে নিয়েই ভাবতে থাকে।সম্ভবত আমার ছোট মস্তিষ্কের লিম্বিক সিস্টেম পুরোটাই তারই দখলে।
প্রবাসে আসার ঠিক দুদিন আগে কথা….
রাতের খাবার শেষ করে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছি।কাল আবিরের সাথে শেষ দেখা হবে ধানমন্ডি লেকের পাড়ে।মনকে সেদিন খুব কষ্টে রাজি করেছিলাম।
কাল আমার সত্বাকে আবিরের কাছে জানান দিবো।হয়তো আর সময় পাবোনা।বোবা এই প্রেমের কথা সাহস হবেনা মুখে বলতে।তাই অবলম্বন হিসেবে বেছে নিলাম চিঠি নামক সেই সহজ পদ্ধতিকে।সেই রাতেই ডায়রির প্রায় সব পাতাকে নষ্ট করে শেষ পাতায় লিখে ফেললাম কিছু অন্যায় আবদার।আর সেটাকে একটি রঙিন খামে পুরে দিয়ে খামটির মুখখানা ভাতের আঠা দিয়ে জুড়ে দিলাম।
পরদিন বিকেলে।ইচ্ছে করছিলো শাহাবাগের সবগুলো ফুল ওর জন্য নিয়ে যাই করি।ইচ্ছে করলেই সব কিছু করা যায় না।আর এত টাকা আমার কাছে নেই।সব গুলো দোকান খুঁজে সবচেয়ে সুন্দর গোলাপটি খুঁজে বের করেছি আবিরের জন্য।আগের রাতে ওর জন্য লেখা একটা চিরকুট(চিঠি) আর গোলাপটা নিয়ে ধানমন্ডির দিকে রওনা হলাম।
ধানমন্ডি যাওয়ার মত ভাড়া নেই পকেটে।বেকার ছেলেদের হাতে প্রচুর সময়।পায়ে অনেক শক্তি।তাই পায়ে হেঁটেই চলতে লাগলাম।
আবির যথাসময়ে পৌচেছে।গিয়ে দেখলাম লেকের পারে বসে আছে একলা।গিয়ে বসলাম।
আবিরের সাথে দেখা হওয়ার পর নিজেকে সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছিল।
জিঙ্গাসা করলামঃ কেমন আছ?
ও বললঃ ভাল আছি।
আমি কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। কিছুই মনেও পড়ছিল না।
মুহুর্তেই পরিবেশটা আমার বিপক্ষে চলে গেল।সবকিছু মাটি হলো।বাসা থেকে ফোন আসায় তারাহুরা করে চলে গেলো ও।আজ আর বাদাম খেলোনা।চিঠিটা দেওয়া হলোনা।
বুকের ভিতর যেন কেমন কেমন করছিল।বেশ কিছুক্ষন বসে রইলাম লেকের ধারে।শত সহস্র ফুলের মাঝখানের থেকে বেছে আনা গোলাপ আর রাতজেগে লেখা কলমের সেই ঘাম ঝড়ানো কষ্টের ফসল,মনের মাঝের লুকানো সত্বার সেই জাগ্রত উন্মুক্ত চিঠিটা পকেটের ভাজেই চাপা পরে রইল।
সন্ধ্যা নেমেছে।বাড়ির দিকে রওনা হলাম।কাল ফ্লাইট।
হাটতেছি…………….
আকাশের দিকে তাকাতেই দেখলাম পূর্ন গ্রহনে সেজেছে চাঁদটি।বুঝলাম আমাকেই অনুসরন করছে সে ।পিছু ধরেছে আমার।হয়তো আমার একাকিত্বের সঙ্গী হতে চেয়েছিলো।তাই আমি যেদিকে যাচ্ছি,চাঁদও সেদিকেই যাচ্ছিল।কিন্তু আজ ওর সঙ্গ আমার কাম্য ছিলোনা।
কিছুটা বিব্রত বোধ করে।মুখটাকে আমাবস্যার আধার বানিয়ে চাদের পুর্নিমাকে কলঙ্কিত করে ওর থেকে চোখটা সরিয়ে,মাটির দিকে তাকিয়ে আবার হাটা শুরু করলাম।
প্রায় পৌছে গেছি।বড়রাস্তার মোড়টা ঘুরতেই ওদের বাড়ি।তার ঠিক তিনবাড়ি পরের বাড়িটা আমাদের।ওর বাড়ি পার করেই আমাদের বাড়ি যেতে হয়।
আবিরের বাড়ির সামনে দিয়ে আসতেই হঠাৎ চোখদুটো আটকে গেল আবিরের বাড়ির পশ্চিম পাশের রাস্তার ধারের বারান্দার সহিত ঝোলানো পুরাতন সেই পরিত্যাক্ত বিলবক্সটির উপর।বেশ কয়েক বছর ধরেই ওটা ব্যাবহার হয়নি।মনখানিক ওজনের সুবিশাল তালা ঝোলানো সেটায়।হয়তো চাবিটাও আর নেই।কোনদিন খোলা হবেকিনা তাও জানিনা।কোনদিন চিঠিটা আবিদের হাতত পর্যন্ত পৌছবে কিনা তাও জানিনা।তবুও শেষ ভরসাটা ওর কাছেই রাখলাম।
মুহুর্তেই ভেবে নিয়েছি সবকিছু।শত ফুলের রানী,পকেটের ভাজে চাপা পরা গোলাপটিকে শুকোতে দেইনি। আমার অন্যায় আবদার আর অন্যায় আবেগ আর অমূল্য সস্তা কলমের কালিতে লেখা ওই চিঠিটির মধ্যে গোলাপটি ভরে তার উপর কিছু সস্তা চুম্বন একে চিঠিটি সেই পরিত্যাক্ত বিলবক্সের গর্ভে দিয়ে দিলাম।আর চিঠিটির স্ট্যাম্প হিসেবে রেখেছিলাম একটি প্রত্যাশা।
“হয়তো কোনদিন বিলবক্সটি খোলা হবে।”
উৎস: অন্যভুবন