
ইথার রৌদ্র জগন্নাথ
১.
জীবনের অর্থ এবং মর্ম কী ও কেমন হওয়া শোভনীয় তার উপর বিস্তর গবেষণা করে ডিনার টেবিলে আসলাম। সবার আগে চোখ পড়লো কুচি করে কাটা ঢেড়স ভাজির উপর; সাদা ধবধবে কাচের বাটিতে সবুজ তেলতেলা ঢেড়স ভাজি তখন চকচক করছে। ভাত নেওয়ার আগে প্লেটে ওটা কিছুটা নিয়ে খাওয়া আরম্ভ করলাম। আমার মা আমার সামনে বসা। বেশ কিছুদিন যাবত তার মন খারাপ – আমি কারণটা জানি। খাবারে আরেকটু মনোযোগী হতে যাবো তখন মা বললেন “আমি কী পেলাম এই সংসারে এসে! “ আমি মৃদু হাসলাম, হাসির ব্যাপার না তবুও। আমাদের পরিবার কোনো dysfunctional পরিবার না, আমরা বেশ ভালো আছি কিন্তু সবার মনে কিছু না কিছু একটা চাপা কথা আছে, চাপা কষ্ট আছে। আজ আমার মা তার কথা প্রকাশ করছেন, একদিন বাকিরা সবাই করবো, ক্রমান্বয়ে।
২.
সাদাফ আমাকে অনেক ভালোবাসে। আমাকে জানিয়ে ভালোবাসে ৪ বছর এবং আমাকে না জানিয়ে ভালোবেসেছে আরো ২ বছর। সে প্রথম ছেলে না যে আমাকে ভালোবেসেছে বা বাসতে চেয়েছে। সবাইকে সময়মতো বিদায় করে দিতে পারলেও এই ব্যক্তিকে কোনোভাবেই বুঝানো যায়না আমাকে ভালোবাসা টা তার জন্য ফলপ্রসূ হবেনা। এতে আমিও কিছুটা দোষী। কিভাবে দোষী সেটা বলি – সাদাফ বা অন্য কোনো ছেলের প্রতি আমি কখনো রোম্যান্টিক্যালি, মেন্টালি বা ফিজিক্যালি কোনো কিছুই অনুভব করিনি। এদিকে সাদাফ গতানুগতিক ছেলেদের মতো না। ওর মধ্যে আমার ভালোলাগার বেশ কিছুদিক আছে তাই ওর প্রেম নিবেদনটাও আমার মনে ধরেছিলো। তখনও আমি সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন এক্সপ্লোর করিনি তাছাড়া এসব ব্যাপারে জানতাম ও না। বিশ্বাস করতাম “I haven’t found the right person yet”. ও আমার বন্ধু থেকে বেশি কিন্তু ভালোবাসার মানুষ থেকে কম – এটা এখন বুঝলেও ওই সময়টাতে তার প্রতি আমার “Platonic Attraction/Love” কেই ওর প্রতি ভালোবাসা বলে মেনে নিয়েছিলাম। মেনে নিয়েছিলাম ঠিকই, তবে ওই সময়ে আমি সম্পর্ক চাইনি তাই কোনো সম্পর্কও হয়নি আমাদের মধ্যে। একসময় অনেক ঝামেলা পার করেছি আমরা। কতক ঘটনার সূত্র ধরে একে অপরের সাথে যোগাযোগ বন্ধ ছিলো বহুদিন। আবার যখন সব ঠিক হয় ততোদিনে আমি আমার আইডেন্টিটির ব্যাপারে জেনে গিয়েছি। তাই সম্পর্ক হওয়ার কোনো প্রশ্নই আসেনি। কিন্তু, আবার দুজনের যোগাযোগ শুরু হলে বুঝতে পারি আমার প্রতি ওর অনুভূতির কোনো পরিবর্তন হয়নি বরং ও আগের থেকেও বেশি সিরিয়াস। সাদাফকে দেখে অনেক মায়া লাগে আমার, ওকে দেখলে বারবার আমার নিজের কথা মনে পড়ে। সাদাফ আর আমার একটা জায়গায় ভীষণ মিল। সাদাফ আমাকে যেমন ভালোবাসে আর আমি আমি রুবিয়া কে যেভাবে ভালোবাসি – এ যেন একই অনুভূতি!
৩.
বাস্তবে রুবিয়াকে দেখিনা ২ বছর। রুবিয়া হয় সত্যিকারে অসম্ভব সুন্দরী নাহয় আমি তাকে অসম্ভব ভালোবাসি বলে এরকম লাগে। ২ বছর তাকে দেখিনা তবুও অন্য কাউকে আমার ভালো লাগেনা। কারো মধ্যে ভালোবাসা খুঁজতেও ইচ্ছা করেনা। রুবিয়ার প্রতি এই আনুগত্য বোধহয় নিজের সাথে অনেকটা বে-আইনী। রুবিয়াকে ফাল্গুনের রাণী মনে হয় আমার কাছে। একটা সময় ছিলো বৈকি যখন প্রতি সন্ধ্যায় তাকে খোলা চিঠি লিখতাম। লেখা শেষে আকাশের দিকে তাকিয়ে চিঠি ভাজ করতে করতে ভাবতাম এই শহরে আমার মতোই একাধিক মানুষ আছে যারা রুবিয়াকে অনেক ভালোবাসে। ওকে ভালোবাসা দেওয়ার জন্য আমরা সবাই বসে আছি, সবকিছু সাজিয়ে, সবকিছু থামিয়ে। এতে কি রুবিয়ার কখনো কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিলো বা হবে?
একবার কল্পনা করেছিলাম, আমি বসে আছি রুবিয়া আর ওর বড় বোনের সাথে। ভীষণ গভীর আলোচনা আমাদের মধ্যে হচ্ছে। আলোচনার বিষয় – কেন রুবিয়ার বিয়ে আমার সাথে দেওয়া উচিত এবং সে সুখী হবে নাকি। রুবিয়া খুব টেনসড, ও আমার সাথে থাকতে চায় তবে বোনের বিরুদ্ধে যেতে চায়না। রুবিয়ার বোন, শার্লিন আপু, ইউনিভার্সিটি লেকচারার – হ্যাপিলি ম্যারিড এন্ড মাদার অফ টু। সে আমার পক্ষে-বিপক্ষে কোথাও না। অপরদিকে আমি বেশ আরামে বসে মনে মনে চিন্তা করছি রাজি না হলে বন্দুক ঠেকানো উচিত হবে নাকি না? আমার মতো almost well-mannered, successful business entrepreneur and potential first bengali multi-billionaire woman – কে এরকম আচরণ শোভা দেয় কিনা। আমার কল্পনা এর বেশি আর আগায় না, এখন পর্যন্ত আগাতে পারিনি
৪.
সমাজ সমকামী বিয়ে মেনে নেয় না। ৩৭৭ ধারা না থাকলেও এই সমাজে এটা প্রচলিত হবে কিনা আমার সন্দেহ আছে। নারীর ক্ষমতায়ন যে সমাজ এতদিনেও মেনে নিতে পারছেনা সে সমাজ সমকামীতা কিভাবে মেনে নিবে? এতটা সহজ মানুষের মনোভাব বদলানো? আমি স্ট্রেইট হলে কি আমি পারতাম! রুবিয়াকে নিজের কাছে রেখে সর্ব সুখ ওর জন্য লুটাতে ইচ্ছে করে, পরক্ষণেই মনে হয় সেটা কি আদৌ সম্ভব? অনেক বছর পর রুবিয়া একদিন ডাইনিং-এ বসে এভাবে বলবে না তো “কী পেলাম আমি এই সংসারে এসে?”! আমাদের একসাথে থাকাটা ওর জন্য মংগলময় না হলে? রুবিয়ার জীবনে আমি আসলে সাদাফ। সেই সাদাফ যে অনেক ভালোবাসে এবং রুবিয়া একদিন আমার এই অনুভূতি বুঝলেও তার কাছে কিছু করার থাকবেনা। শার্লিন আপু একটা সময় আমাকে ‘না’ করে দিবেন। স্বামী-সংসার নিয়ে সুখে থাকবে রুবিয়া এটাই উনি চাইবেন। জেনে শুনে একটা মেয়ের সাথে এরকম সম্পর্কে দিয়ে নিজের বোনের জীবন নষ্ট করবেন কেন? শার্লিন আপুর জায়গায় আমি থাকলে আমার সিদ্ধান্ত কি খুব ভিন্ন হতো! একইরকম ভাবতাম না কি? আমি বন্দুক ঠেকাতে পারবোনা কখনোই। রুবিয়ার একদিন আমার জন্য মায়া হবে, সে প্রথমে পরোক্ষ ও পরে প্রত্যক্ষভাবে বলে দিবে সম্ভব না । ধরি, এমন না হতো, তাহলে?
আমি কিছু বছর পরে মা,রুবিয়া,শার্লিন আপু আর সবাইকে নিয়ে একসাথে সুখে থাকার স্বর্গীয় আশা রাখতে পারতাম।বহু বছর পর আজকে ২০২১ এর এই সমকামী বিদ্বেষমূলক চিত্র বদলাবে সেটা সুখকর এবং অপরিহার্য। শুধু এই বহু বছরের স্রোতে হারাতে থাকবে আসমারা, রুবিয়া, সাদাফ – রা। সাদাফ কখনো জানবেনা কেন আসমারা ওকে ভালোবাসেনি, আসমারা কখনো জানবেনা শার্লিন আপু যদি পারতেন এই বিয়েতে কখনো না করতেন না, রুবিয়া কখনো জানবেনা আসমারা ওকে সুখে রাখতে কী কী ভেবেছিলো। এই সমাজ কখনো জানবেনা আসমারা-রুবিয়া একসাথে কতটা সুখে থাকতে এবং তাদের আশেপাশের মানুষদের কতোটা সুখে রাখতে পারতো।
প্রথম প্রকাশিত
আসর
বাংলাদেশের প্রথম ও ভিন্ন ঘরানার বহুমাত্রিক ক্যুইয়ার নারী সংকলন

Leave a comment