হ য ব র ল : বাংলাদেশি মিডিয়ায় কুইয়্যার কমিউনিটির বেহাল দশা

নরএপিনেফ্রিন

পশ্চিমা মিডিয়ায় অনেক আগে থেকেই কুইয়্যার জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কন্টেন্ট তৈরি হচ্ছে। তাদের কাজের ক্ষেত্র বড় এবং রক্ষণশীল নয়। তারা কানে কানে ফিসফিস করে কুইয়্যার কমিউনিটির গল্প বলেনা। তবে উপমহাদেশের মিডিয়ার চিত্র ভিন্ন। পাকিস্তানের জনপ্রিয় ‘HUM TV’ তাদের এক সাপ্তাহিক নাটকের একটি পর্বে এরকম সমকামী নারীর গল্প তুলে ধরেছিল। ফলাফল স্বরূপ, সেই চ্যানেলের প্রচার ৬ মাসের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জরিমানা করা হয়। এছাড়াও হুমকি-ধামকি তো ছিলই। নেট ঘেটে যতটুকু জানা যায়, গল্প ছিল এরূপ যে, বিবাহিত নারী তার স্বামীকে ছেড়ে অন্য নারীর সাথে পালিয়ে গিয়েছিল। এমনিতেই দেশটা পাকিস্তান, তার উপর সমকামী চরিত্র নিয়ে নির্মিত এবং একবার ভেবে দেখেন তাদের কন্সেপ্টটা কী নির্বাচন করা হয়েছিল! হায় বিধাতা! কেন নির্মাতাদের মনে হল এরকম একটা গল্প এবং দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমেই কুইয়্যার কমিউনিটিকে প্রমোট করা সঠিক হবে? পাকিস্তানের কথা বাদই দিলাম। কোলকাতা ছাড়া সম্পূর্ণ ভারতও বাদ। আমরা আজকে শুধু বাঙালি (বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ) মিডিয়া জগতে কুইয়্যার জনগোষ্ঠীর ভুল, অপব্যাখ্যা, ও বিভ্রান্তিকর কিছু প্রদর্শনীর উদাহরণ দেখব এবং সামগ্রিকভাবে বিশ্লেষণ করব। 

পশ্চিমবঙ্গ মিডিয়া এবং কুইয়্যার কমিউনিটি;

৬ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সালে ভারত তাদের সংবিধানের ৩৭৭ ধারা বাতিল করে। এরপর থেকে সারা ভারত জুড়ে, বিশেষ করে বলিউডে কুইয়্যার কমিউনিটি নিয়ে ব্যাপক কন্টেন্ট হয়েছে এবং হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ মিডিয়া এই দৌড়ে পিছিয়ে থাকলেও যা করছে তা নিতান্তই অল্প নয় কিন্তু যেভাবে করছে তা নিয়ে অবশ্যই অসংখ্য প্রশ্নের জায়গা সৃষ্টি হয়। একটা করে ‘দশক’ পার হলেও কুইয়্যার কমিউনিটিকে নিয়ে গল্প বলার ‘দশা’ পাল্টায়নি!

উদাহরণস্বরূপ, অগ্নিদেব চ্যাটার্জি পরিচালিত ‘তিন কন্যা’ মুভিটি ২০১২ সালে রিলিজ হয়। অপর্না (ঋতুপর্না সেনগুপ্ত), দামিনী (উন্নতি দাভারা), ন্যান্সি (অনন্যা চ্যাটার্জী) নামক তিন জন নারী ঘটনাসূত্রে একে অপরের সাথে পরিচয় হয়। গল্পটা প্রচার করা হয় এভাবে যে, দামিনীর সাথে অপর্নার স্বামী সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন যা অপর্না জানতে পারলে দামিনীকে ঘৃণা করতে শুরু করেন। কিন্তু একদিন অপর্নার স্বামী হঠাৎ কিডন্যাপড্ হয়ে গেলে দামিনী আর অপর্না একে অপরের সাথে পরিচিত হন ও অপর্না দামিনীর প্রতি আকৃষ্ট হতে শুরু করেন। প্লট ইন্টারেস্টিং লাগতে পারে তবে সত্যিটা শুনুন – পুরোটা মুভি জুড়ে দেখানো হয় অপর্না একটু পাগলাটে স্বভাবের এবং সে তার স্বামীকে অনেক ভালোবাসে। বহুবার প্যাচানোর পর মুভির শেষে আমরা জানতে পারি অপর্নার স্প্লিট পার্সোনালাটি ডিজঅর্ডার রয়েছে এবং এজন্যই সে দামিনীর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল! এছাড়া দামিনীর সাথে অপর্নার স্বামীর কখনো কোনো সম্পর্ক ছিল না, সেটাও কল্পনা মাত্র। অপর্না যে দামিনীর প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে এই বিষয়টা মুভির শেষ পর্যন্ত স্পষ্ট করে বলা হয়নি। ইনিয়ে বিনিয়ে যতটুকু না বললেই না ততটুকু এর চেয়েও কম বলে পরিচালক বুঝাতে চেয়েছেন। মুভির ক্লাইমেক্সে দেখানো হয় অপর্না মানসিক হাসপাতালে ভর্তি। সুতরাং পরিচালক অগ্নিদেব বলতে চাচ্ছেন, একজন সুস্থ মস্তিষ্কের নারী কখনোই অন্য নারীর প্রতি আকৃষ্ট হতে পারেন না। তাকে হয় স্প্লিট পার্সোনালিটির অধিকারী হতে হবে অথবা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। আশ্চর্যের বিষয়, এই মুভিটা কীভাবে কুইয়্যার কমিউনিটিকে রিপ্রেজেন্ট করে সেই প্রশ্ন কেউই করেননি। বড় বড় কাস্টিং করে আপনার লাভ কী যদি সম্পূর্ণ মুভিতে আপনি একটা বার স্বীকারই করতে না পারেন এক নারী চরিত্র অন্য নারী চরিত্রের প্রতি আকৃষ্ট অনুভব করে ও সেই অনুভূতি কোনো মানসিক অসুস্থতা থেকে জন্ম নেয়নি? এই মুভি কোনো আঙ্গিকেই কুইয়্যার কমিউনিটিকে প্রতিনিধিত্ব করেনা। উল্টো দর্শকের কাছে বিভ্রান্তিমূলক বার্তা পৌঁছে দেয়। 

‘তিন কন্যা’ সিনেমাটি হতে ২০০৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘নীল নির্জনে’ সিনেমাটি যথেষ্ট প্রগ্রেসিভ ছিল বলে আমি মনে করি। এই ছবিতে রাইমা সেন ও তার মা মুনমুন সেন প্রথমবারের মতো রিল জগতে মা-মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করেন। তবে এটা এখানে মূখ্য নয়। সিনেমাটিতে দেখানো হয় সদ্য কৈশোর পার করা রাইমা সেন তার মায়ের সাথে ছুটি কাটাতে একটি রিসোর্টে যান। একই রিসোর্টে মৌ নামে আরেকটি মেয়ের সাথে তার পরিচয় এবং সেই পরিচয় বন্ধুত্বে, বন্ধুত্ব প্রণয়ে রূপ নেয়। এই মুভিতেই টালিউড ইন্ডাস্ট্রির প্রথম দুইটা লেসবিয়ান চুম্বনের দৃশ্য ধারণ করা হয়। 

ঋতুপর্ণ ঘোষের বদৌলতে কোলকাতার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বেশ কিছু পুরুষ সমকামী গল্পের অসাধারণ মুভি পেয়েছে তবে এটা আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা কি না জানিনা, আমি পুরুষ সমকামী চরিত্রদের নিয়ে হাল আমলে ওইরকম মুভি বা ওয়েব সিরিজ কম পেয়েছি। কোলকাতার চলচিত্র জগৎ যেন পুরুষ ও ট্রান্সজেন্ডার চরিত্রের প্রণয়ের দিকে খানিকটা বেশি দুর্বল। তাই ‘নগরকীর্তন’, ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’, ‘চিত্রাংগদা’ ইত্যাদির মতো সিনেমা পেলেও দুজন সিস-ম্যান এর রিলেশনশিপ নিয়ে উল্লেখ করার মতো বাঙালি মুভি পাইনি। তবে পরিবর্তন হয়তো আসছে। “Klikk” নামক একটা OTT প্লাটফর্ম “Amra2gayther” নামে ওয়েব সিরিজ এনেছে। সাধারণত এই ওটিটি প্লাটফর্ম গুলো থেকে এখন যে কুইয়্যার কমিউনিটি রিলেটেড কন্টেন্ট আসছে তার উদ্দেশ্য যে একমাত্র ব্যবসায়িক স্বার্থ, তা বুঝতে আপনাকে আইবিএ তে চান্স পেতে হবেনা। অনেক বেশি মশলা মাখানো, ওভারলি ড্রামাটিক, ক্লিশেইড স্টোরিজ ও স্টেরিওটাইপসে ভরপুর এসকল সিরিজ কীভাবে কুইয়্যার কমিউনিটিকে রিপ্রেজেন্ট করে জানি না। শতকরা ৯৫ ভাগ পরিচালক জানেনইনা রিপ্রেজেন্টেশন আসলে কী, কেন করতে হবে, কীভাবে করতে হবে! 

বিশেষ করে একটা কুইয়্যার ক্যারেক্টার এবং ক্যারেকটারের পার্সোনালিটি ডেভেলপমেন্টের সময় পরিচালক বা স্ক্রিপ্ট রাইটাররা কোনো রিসার্চ করেননা। যেমন আপনি অধিকাংশ সময় লেসবিয়ান/বাইসেক্সুয়াল নারীর চরিত্রে দেখবেন উদাসীন, নেশাগ্রস্ত, হতাশায় নিমজ্জিত, জীবনে কোনো লক্ষ্য নেই, আশেপাশের দুনিয়ার কোনো খবর নেই এরকম একটা মানুষকে। তারপর বাইসেক্সুয়াল ফিমেল ক্যারেক্টার ছাড়া ৯৮ শতাংশ পরিচালক ভাবতেই পারেননা। আপনি খুব কমই দুইজন লেসবিয়ান কে ঘিরে গল্প আগাচ্ছে এইধরণের কন্টেন্ট দেখতে পাবেন। একজন নারীর জীবন শুধু আরেকজন নারীকে ঘিরেই থাকবে এরূপ মারাত্মক স্বপ্ন হয়তো ডাইরেক্টররা ঘুমের মধ্যেও দেখতে চান না। আবার পর্দায় উপস্থাপন করবেন? বেশি আশা করে ফেললাম বোধহয়! 

একটা কাপলকে ডেভেলপ করার সময় (সেটা গে কাপল হোক অথবা লেসবিয়ান অথবা বাইসেক্সুয়াল) সাধারণত একজন গতানুগতিক পুরুষের ভূমিকা এবং আরেকজন গতানুগতিক নারীর ভূমিকা পালন করবে এই সিকুয়েন্স মেইনটেইন করা হয়। কিন্তু আমরা জানি এই ধরণের কোনো সিকুয়েন্স মেইনটেইনের কোনো প্রয়োজন নেই। গে কাপলে দেখা যায় একজন চরিত্রে নারীর বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে এবং লেসবিয়ান কাপলের একজন চরিত্রে পুরুষালি বৈশিষ্ট্য দেওয়া হচ্ছে। আমরা কেন বুঝিনা আমাদের আসলে bride-groom এর প্রয়োজন নেই, bride-bride and groom-groom is perfectly alright।

পর্দায় একজন পুরুষকে গে হিসেবে উপস্থাপন করার সবচেয়ে প্রচলিত পন্থা হলো তাকে নারীর মতো করে তুলে ধরে। প্রথমত এটা একটা বিশাল স্টেরিওটাইপ আবার নারীর মতো করে তুলে ধরতে গিয়ে যেভাবে ফেমিনিন বৈশিষ্ট্য দেখানো হয় ওটা সেক্সিস্ট এবং স্টেরিওটাইপ উভয়ই। আমরা যদি কন্টেন্টগুলোতে গে/লেসবিয়ান কাপলদের পরিণতির কথা বিশ্লেষণ করি সেখানেও সেক্সিস্ট ও স্টেরিওটাইপিং পরিলক্ষিত। যেমনঃ গে কাপলদের নিয়ে কন্টেন্টগুলো দেখে এই সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছে তাদেরকে খুবই দৃঢ়, আত্মবিশ্বাসী, বুদ্ধিমান, লড়াকু ভূমিকায় দেখানো হয় এবং বেশিরভাগ পুরুষ সমকামীদের নিয়ে তৈরি কন্টেন্ট শুভ সমাপ্তি কিংবা পজিটিভ ভাইবে শেষ হয়৷ পুরুষ সমকামী চরিত্রদের কখনো এরকম জটিলতায় ভুগছেন দেখানো হয়না যে তারা একজন নারীর সাথে থাকবেন কিনা একজন পুরুষের সাথে থাকবেন এই নিয়ে কনফিউজড্! এমনকি পুরুষ চরিত্রটি বাইসেক্সুয়াল হলেও না।

ঠিক তার উল্টো ও ভয়াবহ চিত্র হলো নারীদের ক্ষেত্রে। সচরাচর নারীদের গল্পগুলো সমাপ্তি পায় একটা চরিত্র মরে গিয়ে কিংবা একটা চরিত্রের বিয়ে হয়ে গিয়েছে এভাবে। সমাজের সাথে লড়াই করছেন, আত্মবিশ্বাসী এরকম ভূমিকায় নারীদের পার্সোনালিটি ডেভেলপ করা হয়না। ওয়েব সিরিজগুলোতে দেখানো হয় একজন নারী আরেকজন নারীর সাথে ৪-৫ বছর থাকার পরও এই দ্বিধায় ভুগেন তার আসলে নারী পছন্দ নাকি পুরুষ! না মানে একটা মেয়ে একটা ছেলে ছাড়া আজীবন থাকবে তা আপনাদের হজম হয়ই না, তাই তো? অনুভূতি যত গভীর হোক, একটা মেয়ের উচিত স্বামী-বাচ্চা-সংসারের দিকে যাওয়া, তাই দিনশেষে আমরা এইরূপ এন্ডিং বারবার দেখতে পাই। 

সেলুলয়েডের পর্দায় যখন দুইজন নারী একে অপরকে চুম্বন করে সেই দৃশ্য হয়তো দুইজন পুরুষের চুম্বন দৃশ্যের চাইতে অনেক বেশি সেক্সি অথবা আবেদনময়। তাই তো নারীকেন্দ্রিক কন্টেন্টগুলোর ফোকাস থাকে কীভাবে intense bed scene/kiss scene দেওয়া যায়। অথবা এভাবেও বলা যায় শুধু নারীর কাপড় খোলা দেখেই অনেকে এসব কন্টেন্টের পিছনে খরচ করেন। কুইয়্যার কমিউনিটি কে নিয়ে তৈরি কোনো কন্টেন্টই কুইয়্যার ভোক্তাদের জন্য না। কমার্শিয়াল এসকল কন্টেন্টের ভোক্তা বা ক্রেতা বিশাল হেটারোনর্মেটিভ সোসাইটি যা জন্য ক্যারেক্টর ডেভেলপমেন্ট থেকে এন্ডিং পর্যন্ত এত দুরবস্থা! কোনোমতে দুইটা মেয়েকে কিস করাতে পারলেই হলো – ব্যাস, আর কী লাগে? আমি তো টাকা পাবোই, এবার গল্প পানিতে ঝাপ দেক, এতে আমার কী!

বাংলাদেশি মিডিয়া ও কুইয়্যার কমিউনিটি:

বর্তমান বাংলাদেশের অবস্থা দেখে কখনো কল্পনা করিনি বাংলাদেশের মিডিয়াতে কুইয়্যার রিপ্রেজেন্টেশন নিয়ে ভাববো অথবা লিখবো। কেননা বাংলাদেশের মিডিয়াতে আগে-পরে গে-লেসবিয়ান-বাইসেক্সুয়াল এদের নিয়ে কখনো কোনো কাজ হয়নি। হয়নি মানে হয়-ই-নি! কেউ চেষ্টাও করেনি একটা সমকামী চরিত্রকে পর্দায় নিয়ে আসার। বাংলাদেশের অবস্থা আমরা সকলে জানি তবে পাকিস্তানের মতো দেশ যদি যা-ই পারুক তা নিয়ে ন্যাশনাল টিভি চ্যানেলে লেসবিয়ান রিলেশনশিপ তুলে ধরার একটা প্রয়াস করতে পারে তাহলে আমরা কেন পারলাম না? আমরা কখনো আমতা আমতা করেও গল্প বলার চেষ্টা করিনি। কিছু ডকুমেন্টারি বাদে বাংলাদেশি মিডিয়াতে গে-লেসবিয়ান-বাইসেক্সুয়ালরা একজিস্ট করেননা। তবে কালে ভদ্রে কিছু জায়গায় ট্রান্স ও হিজড়া কমিউনিটির চিত্র উঠে এসেছে। 

নাটকের নাম ‘ছাইয়্যা ছাইয়্যা’। গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অভিনয় করেছেন মোশাররফ করিম ও মিথিলা। নাটকের প্লট হলো মিথিলার পরিবার তার বিয়ের জন্য পাত্র দেখেছে। মিথিলা বিয়েতে রাজি নয় (এটা নাটকের একদম শেষে জানা যায়) তাই বিদেশফেরত সে পাত্রকে আবার বিদেশ পাঠাতে মোশাররফ করিম এক অভিনব ফন্দি আটে। সে ও তার বন্ধু মিলে হিজড়া সেজে যতবার ওই ছেলে মিথিলার সাথে দেখা করতে চায় ততবার তাকে আটকে ফেলে। এক পর্যায়ে ছেলে বিয়ে না করে চলে যেতে বাধ্য হয় ও মোশাররফ করিমের পরিকল্পনা সফল হয়। 

আপনি বলতে পারেন এতে সমস্যা কী? উত্তর হলো আছে, সমস্যা আছে। এখানে একটা কমিউনিটির বিরুদ্ধে প্রচলিত সোশ্যাল স্টিগমাকে ব্যবহার করা হয়েছে হ্যারেজমেন্ট ও ত্রাস সৃষ্টিকারীর ভূমিকায়। প্রথম থেকেই মোশাররফ করিমের অভিনীত হিজড়া চরিত্রের মাধ্যমে সবাইকে এই বার্তা দেওয়া হয়েছে বস্তুত হিজড়া জনগোষ্ঠীকে মানুষের ভয় পাওয়ার বিষয়। তাদের দেখলে আপনাকে দৌড়ে পালাতে হবে কিংবা তারা আপনার ক্ষতি সাধন করতে অভ্যস্ত ও তাদেরকে সমাজে এক্সেপ্ট করা যায়না এরকম ধ্যান-ধারণা পরিচালক তুলে ধরেছেন। এধরণের মিডিয়া কন্টেন্ট বানানোর সময় পরিচালকেরা ধরেই নেন তারা যা করতে চাচ্ছেন এতে দ্বিতীয়বার ভেবে দেখার অবকাশ নেই কারণ হিজড়ারা তো এমনই! ফলে এসকল ভুল রিপ্রেজেন্টেশন উঠে আসে। আবার ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ এর মতো টেলিফিল্ম যে আসলে হিজড়া বা ট্রান্স কমিউনিটিকে নিয়ে লিখা হয়নি তাও এদেশের মানুষ বুঝতে সক্ষম নয়। জোরপূর্বক কাউকে নারী সাজিয়ে তাকে দিয়ে নৃত্য করালেই তার জেন্ডার আইডেন্টিটি বা সেক্সুয়াল প্রিফারেন্স চেঞ্জ হয়ে যায়না। 

২০১২ সালে পরিচালক নোমান রবিন ‘Common Gender’ পূর্ণ-দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এটিই বাংলাদেশের একমাত্র এমন একটি মুভি যেখানে হিজড়া জনগোষ্ঠী নিয়ে বিশদভাবে কাজ করা হয়েছে। তবে এই চলচ্চিত্রটিও মূলত বাংলাদেশী জনগণের হিজড়া জনগোষ্ঠী নিয়ে ভুল ধারণার প্রতিফলনের মতো কাজ করেছে। এই সিনেমা আপনাকে নতুন কোনো বার্তা দিবেনা বা আশার আলো দেখাবেনা। এটা শুধু দেখায় কীভাবে হিজড়া জনগোষ্ঠী প্রতি ক্ষেত্রে বৈষম্য ও লাঞ্চনার শিকার হয়। 

এর প্লট হলো – বাংলাদেশী একটি পরিবারে বাবু নামের একজন শিশু জন্ম নেয় যে আসলে ছেলে বা মেয়ে কোনোটিই নয়। সে যখন বড় হতে থাকে তখন তার এই বৈশিষ্ট্যগুলো পরিবার মেনে নিতে পারেনা ও তাকে বের করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে সে হিজড়া পল্লীতে বড় হয়। অপরদিকে সুস্মিতা নামের একজন হিজড়া একটা বাড়ির অনুষ্ঠানে নাচ দেখাতে গিয়ে তাদের পরিবারের ছেলে সঞ্জয়ের সাথে পরিচিত হয়। সে পরিচয় ঘনিষ্ঠতায় রূপ নেয় যা পরিবার জানতে পারলে মেনে তো নেয়ই না বরং অপমান করে। সুস্মিতা এই অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে। মৃত্যুর পরেও তার প্রতি অবিচার শেষ হয়ে যায়না। সে পুরুষ বা নারী না হওয়ায় তাকে দাফন করতে অস্বীকৃতি জানানো হয়। এদিকে বাবু যে বুবলি নামে পরিচিত তার পরিণতিও আত্মহত্যা হয়। 

এই মুভিকে বিশ্লেষণ করতে গেলে আলাদা একটা আর্টিকেল লাগবে তাই এখানে শুধু সবচেয়ে আপত্তির জায়গা তুলে ধরা হচ্ছে। সম্পূর্ণ সিনেমা জুড়ে পরিচালক ট্রান্সজেন্ডারদের ‘সেক্সুয়াল অব্জেক্ট’ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। মুভিটাতে ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটির মানুষজন নিজেদের দেহকে  লাস্যময়ী করে তুলে ধরেছেন নিজেদের আকর্ষণীয় করার উদ্দেশ্যে, এছাড়াও তাদের মধ্যে প্রচুর গালি-গালাজ এবং অভদ্র ভাষার ব্যবহার দেখানো হয়েছে। সিনেমায় দেখা যায় ট্রাক ড্রাইভার, রিকশা চালক, যুবক সবাই হিজড়াকে দেখামাত্রই শারীরিক সম্পর্কের প্রস্তাব দিচ্ছে এবং শরীরের এখানে সেখানে স্পর্শ করে নিজেদের যৌন বাসনা মেটাতে চাচ্ছে। একবার ভেবে দেখুন একই দৃশ্য কোনো ট্রান্সজেন্ডার চরিত্রের বদলে নারী চরিত্র দিয়ে করানো যেত? বা করলেও তা নিয়ে কি সমালোচনা হত না? তাহলে আমরা এখানে চুপ কেন? তার মানে আমরা ধরেই নিয়েছি এগুলো স্বাভাবিক ঘটনা আর এটাই কুইয়্যার কমিউনিটির ভুল প্রদর্শনীর নির্দেশক! 

২০১৩ সালে ইমপ্রেস টেলিফিল্ম তৈরি করে ‘শিখন্ডী কথা’। এতে দেখানো হয় দুই কন্যা সন্তানের পর পর পুত্র সন্তান জন্ম দেয় রামেলা। ফলে পরিবারে খুশীর জোয়ার আসে তবে একটা সময় তারা বুঝতে পারে তাদের ছেলে রতন আর আসলে নারী-পুরুষ কোনটিই নয়। একসময় রতন এর পরিচয় তার বোনেদের বিয়ের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। এই সমাজ তাকে কখনোই মেনে নিবেনা এই ভেবে সে তার পরিবার ছেড়ে দেয় এবং কালি মাসি নামক একজন গুরুমায়ের কাছে বড় হতে থাকে। পরিচালক এখানে রতনকে এতটা আপত্তিকর বস্তু হিসেবে তুলে ধরেছেন যে তার জন্য তার বোনেদের বিয়ে আটকে যাচ্ছিলো। হিজড়া জনগোষ্ঠী কি এতটাই গর্হিত? পরিচালক এরূপ কন্সেপ্ট তুলে ধরার পর এর কাউন্টার এট্যাক হিসেবে কিছুই আনেননি যার ফলে দর্শক এটাই মেনে নিয়েছে যে হিজড়া জনগোষ্ঠী এতটাই নিকৃষ্ট! ফলে এসকল গাফিলতির জন্য বড় একটা মিসরিপ্রেজেন্টেশন তৈরি হল। এখানে পরিচালকের উদ্দেশ্য ভুল প্রদর্শনী না হলেও এটা অপব্যাখ্যাই হয়েছে৷ 

বাংলাদেশি মিডিয়ায় কুইয়্যার কমিউনিটির যে বেহাল দশা তা না স্বীকার করে থাকা যাচ্ছে না।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.