সামাজিক মূল্যবোধ বনাম বৈচিত্রময় লিঙ্গপরিচয়। সংবিধান কি বলে?

নগরবালক

গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের, তৃতীয় ভাগে বর্ণিত মৌলিক অধিকার সম্পর্কে নিশ্চয়ই সবাই অবগত আছেন। এই ভাগে ২৬ অনুচ্ছেদ থেকে ৪৭ অনুচ্ছেদ পর্যন্ত সর্বমোট ২৩টি অনুচ্ছেদ আছে, সেখানে আমাদের মানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার বর্ননা করা হয়েছে, মানে ফান্ডামেন্টাল রাইট্‌স অফ সিটিজেন এবং এই অধ্যায়ের ৩২,৩৪,৩৬,৩৭,৩৮,৩৯,৪০ ও ৪১ অনুচ্ছেদে নাগরিকের মানবাধিকার অর্থে মৌলিক অধিকার গুলো স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো এই যে মৌলিক অধিকার তা নিশ্চিত করার দায় কি শুধু মাত্র রাষ্ট্রের? নাকি পাশাপাশি রাষ্ট্রের সকল অঙ্গ, উপাদান, তথা নাগরিকের উপরও বর্তায়?

০১.
৩২ অনুচ্ছেদ বলছে জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার অধিকাররক্ষনের কথা। ব্যক্তি-স্বাধীনতার উপর হস্তেক্ষেপ কে করে তবে? কেবলই কি রাষ্ট্র করে? সাধারণ একজন নাগরিক কি অন্য নাগরিকের ব্যক্তি-স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করতে পারে? কে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন জানি না। আমি বলবো পারে। কারন আমি যখন একজন অবিবাহিত, বিধবা, ডির্ভোসি মানুষকে বারবার তার বিয়ের বিষয়ে অযাচিত প্রশ্ন করি, যখন একজন মানুষকে তার কোনো ব্যার্থতার জায়গা নিয়ে উত্যক্ত করি, যখন কারো বিশ্বাসের জায়গায় বারবার আঘাত করি, কারো জীবন-ধারা নিয়ে কটাক্ষ করি, কারো চাহিদার ভিন্নতা নিয়ে ব্যঙ্গ করি, কারো পোষাকের যথার্ততা নিয়ে প্রশ্ন তুলি, তখন কি তা সেই ব্যক্তির ব্যক্তি-স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ বলে ধরে নিবেন না? যদি নেন তবে এই যে কারো অধিকার আমি ক্ষুন্ন করছি, তা সুরক্ষা কে প্রদান করবে, রাষ্ট্র?

বাংলাদেশের বাস্তবতায় এইযে উদাহরন গুলো উল্লেখ করলাম সেই ইস্যুতে কখনো কোনো মামলা হবে না, হয় না, করতে গেলেও হাস্যকর শোনায় বটে। কিন্তু ভেবে দেখুন তো এই ইস্যুগুলো ব্যক্তি জীবনে একটা মানুষকে ঠিক কতটা কষ্ট দেয়?

০২.
সংবিধানের সংবিধানত্বকে পর্যবেক্ষন করা এবং তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার দায়িত্ব আছে হাইকোর্টের উপর, কিন্তু যতক্ষন এইধরনের ইস্যু গুলো কোর্টের কাছে না যাবে, ততক্ষন পর্যন্ত এই যে মানবাধিকার তথা সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারটি ক্ষুন্ন হচ্ছে, তার অক্ষুন্নতা রক্ষার দায়িত্বটি কে নিবে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে মনে হলো, এর দায়িত্ব আসলে কেউই নিবে না। যার সমস্যা তাকেই সমাধান করতে হবে। অনেক টা এমন তত্ত্ব যে “ না কাঁদলে মা-ও দুধ দেয় না” কিন্তু আমাদের সমাজে যাদের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে তারা কাঁদবে কার কাছে? কাকে বলবে যে আমার সমস্যার সমাধান চাই?

আমাদের সমাজ ব্যবস্থায়, এমন এক সংস্কৃতির সাথে আমরা বড় হই যে, কারো ব্যক্তি-জীবন নিয়ে চর্চা করাটা আমাদের কাছে খুউবই সাধারণ একটা বিষয়, এবং এটাকে আমরা আমাদের ব্যক্তি অধিকার বলেও মনেকরি বটে। কিন্তু কখনো-কি এটা ভেবে দেখেছেন আপনার এই পরচর্চার অভ্যেসটা কতটা হুমকির মুখে ফেলছে অন্য মানুষটাকে? হয়তো কখনো ভাববার প্রয়োজনই বোধ করেন নি, বা ভাবলেও “একা ভেবে কিস্সু করতে পারবেন না” বিবেচনায় ভাবনার খাতাতে লাল ফিতা বেঁধেছেন।

০৩.
যেহেতু আমরা সমাজ বদ্ধভাবে বসবাস করি, এবং সমাজিক কিছু মূল্যবোধ নেই নেই করেও একটু আধটু আমাদের আছে, সেই বিচেনায় অবশ্যই প্রত্যেক নাগরিক তার সামাজিক মূল্যবোধকে শ্রদ্ধা করে চলাই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু সেই সামাজিক মূল্যবোধের জায়গাটা-ই যদি প্রশ্নবিদ্ধ হয়, যদি সামাজিক মূল্যবোধ পরচর্চা, অন্যের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, লিঙ্গ, জাতি কিংবা ভিন্ন লৈঙ্গিক পরিচয় মতো বিষয় গুলোকে নেতিবাচক ভাবে চর্চার জন্য উদ্বুদ্ধ করে তবে, সেই সামাজিক মূল্যবোধ কতটা গ্রহনযোগ্য বলে আপনি মনে করেন?

আদর্শ-সামাজিক মূল্যবোধ কোন গুলো তার কোনো সুনির্দিষ্ট রূপরেখা বা নির্দিষ্ট কোনো উপাদান কেউ কখনো নিরূপন করতে পারবেন না। কারন আদর্শই একটা বিমূর্ত ধারনা এটাকে অনেক ভাবে অনেক বিজ্ঞ-জন সংজ্ঞায়ণ করতে পারেন, তবে কখনোই কেউ এমন দাবি করতে পারেন না যে তার দেখানো উপাদান গুলোই পরিপূর্ন করছে আদর্শের সকল উপাদানকে। যেখানে আদর্শকেই সুনির্দিস্ট ভাবে নিরূপন করা সম্ভব হচ্ছে না সেখানে কি করে আদর্শ-সামাজিক মূল্যবোধ কে নির্ণয় করা সম্ভব? স্থান, সময়, পরিস্থিতি, দেশ সহ নানান বিবেচনায় আদর্শ-সামাজিক মূল্যবোধ ভিন্ন ভিন্ন রূপ উঠে আসবে এটাই স্বাভাবিক। এবং সেই সূত্রে বাংলাদেশেও কিছু আদর্শ-সামাজিক মূল্যবোধ রয়েছে, কিন্তু কেউ কি এমনটা দাবি করতে পারেন, যে, আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধ গুলোর সবগুলোই যুক্তিযুক্ত?

০৪.
যেখানে আমরা হলফ করে কেউ বলতেই পারি না, আমাদের প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধ গুলো আদৌ মানবাধিকার বান্ধব কিনা, তা কি মানুষের মৌলিক অধিকারকে লঙ্ঘন করে কিনা, তাকি একজন মানুষের স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে থাকার অধিকার গুলোকে টুটি চেপে ধরে কিনা। সেখানে সেই সামাজিক মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে কাউকে প্রচলিত মূল্যবোধ গুলোকে লঙ্ঘনের জন্য কিভাবে দোষী সাব্যস্ত করা সম্ভব? সম্ভব অসম্ভবের প্রশ্নে আমরা সাধারণত কমই যাই, আমরা শুধু বিবেচনা করি কোনো কাজ আমাদের সামজের সাথে মিলে আর কোনটা মিলেনা। সেই বিবেচনায় আমাদের যে রায় আসে, তার উপর ভিত্তি করে আমরা একজন মানুষকে প্রচলিত নিয়মের বাইরে যাবার অপরাধে তাকে দোষী হিসেবে চিহ্নিত করে নেই। কিন্তু এমনটা কি মানবিক আচরণ? যেখানে আপনি জানেন-ই-না যে, আপনার সমাজের প্রচলিত মূল্যবোধের গোড়াতেই পঁচন ধরে কিড়া পড়েছে, সেখানে আপনি কি করে সেই সমাজের প্রচলিত নিয়মের আওতায় এনে একজন মানুষকে দোষী সাব্যস্ত করেন?

একজন মানুষ কিভাবে বাঁচবে? কি করবে? কি ভাবে করবে? কেন করবে? কখন করবে? কোথায় করবে? তার সিধান্তটা নেয়ার সম্পূর্ণ অধিকার সেই মানুষের আছে, এবং এটা জন্মগত অধিকার প্রতিটা মানুষের। সেই অধিকারকে আপনি কি দিয়ে আটকে দিতে চান? ধরুন কোনো মানুষ এসেক্সুয়াল মানে তার কোনো প্রকার যৌন চাহিদাই নেই, সে কোনো লিঙ্গের মানুষের সাথে যৌনতায় লিপ্ত হতে চায় না। তাকে আপনি আপনার প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধ দিয়ে কি ভাবে বিচার করবেন? যদি বিচার করতে-ও যান, তবে আপনি সেই মানুষকে হয় ভন্ড বলবেন, বলেন “ভিতরে ভিতরে কারো না কারো সাথে ঠিকই করে”, বা বলবেন সমকামী, ভাববেন ওই মানুষ মনে হয় নিজের সমলিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট, বলতে পারেন হিজড়া, সেই মানুষ হয়তো এক্টিভ কোনো সেক্সুয়াল অর্গান নিয়ে জন্ম নেয়নি, আবার বলতে পারেন অপ্রকৃতস্থ “মাথার কয়টা তার মনে হয় ছিঁড়া কয়দিন পরে ঠিক হয়ে যাবে”।

দেখেন প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধ দিয়ে একজন এসেক্সুয়াল মানুষকে আমি যত ভাবে মূল্যায়ন করলাম তার সবগুলো কিন্তু নেগেটিভ বা নেতিবাচক। মানে আমাদের সামাজের প্রচলিত যে মূল্যবোধ, সে অনুসারে একজন মানুষের অবশ্যই যৌনাকাংঙ্খা থাকতে হবে এবং তা হতে হবে তার বিপরীত লিঙ্গের প্রতি। এসেক্সুয়াল বলে যে কিছু থাকতে পারে, তা কিন্তু আমাদের সমাজ স্বীকৃতিই দেয় না। তাহলে সেই মানুষটি, যিনি এসেক্সুয়াল, তার মৌলিক অধিকার যেটা সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে সেটাকে আপনি কি ভাবে আপনার এই সামাজিক মূল্যবোধ দিয়ে অক্ষুন্ন রাখতে পারবেন? যারা বৈচিত্রময় লৈঙ্গিকতা সম্পর্কে পড়াশোনা করেছেন বা জ্ঞাণ রাখেন, তারা হয়তো এই এসেক্সুয়ালিটিকে স্বীকৃতি দিবেন। কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষইতো এই বিষয়কে স্বীকৃতি দিবেন না। তবে কি এই ধরনের যৌন পরিচয়ের মানুষ আমাদের সমাজে অবস্থান করতে পারবেন না?

০৫.
একটা সমাজে অনেক ধরনের মানুষ থাকবে, এটাই বাস্তবতা। আমাদের গায়ের রং, শরীরের গঠন, ধর্ম, বংশ, উচ্চতা, বিত্ত সবার এক হয় না। এসব ক্ষেত্রে যেমন বৈচিত্রতা থাকে, তেমনি একটি মানুষের যৌন পরিচয়েও বৈচিত্রতা থাকা অপ্রসঙ্গিক বা অবাস্তব কোনো কিছু নয়। বরং তাই স্বাভাবিক বাকি আর দশটা বিষয় গুলোর মতো। এই বাস্তবতা কে কিন্তু আমাদের প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধ স্বীকৃতি দেয় না, তাই কেউ যদি বাংলাদেশের প্রচলিত তথাকথিত সামাজিক মূল্যবোধকে লঙ্ঘন করে এবং তার মতো করে জীবন ধারণ করে, তবে কখনোই আপনার-আমার উচিত নয় তার ব্যক্তি-স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করে তার জীবনকে বিষিয়ে তোলা।

গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ প্রত্যেক নাগরিকের ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিচ্ছে, তাই এখানে সবধরনের মানুষের সমান অধিকার ধারণ করে সমঅবস্থানের পূর্ণ অধিকার আছে। এবং সেই অধিকার যদি কেউ সামাজিক মূল্যবোধের মতো বিমূর্ত ধারণার উপর ভিত্তি করে খর্ব করতে যায়, তবে তা স্পষ্টতই সংবিধান লঙ্ঘনের শামিল বলেই বিবেচিত হবে।

উৎস: রূপবান ব্লগ

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.