
নগরবালক
আসবার কালে কি জাত ছিলে? এসে তুমি কি জাত নিলে? কি জাত হবা যাবার কালে? সে কথা ভেবে বলো না। লালানসাঁই-এর বিখ্যাত গানের চরণ।
যদি খুব সাধারণ ভাবে দেখি এই শব্দ গুলো, তবে শুধু একটা গান। তবে যদি প্রতিটা অংশের মর্মার্থ বোঝার চেষ্টা করি, তবে বিশাল এক প্রশ্ন, এক অর্থ লুকানো শব্দ গুলোতে। জন্মসূত্রে আমি বাঙালী, আমি মুসলিম, আমি বাংলাদেশি, আমি পুরুষ। এই বিষয় গুলো আমি আমার ইচ্ছাতে নয় জন্মসূত্রে পেয়েছি। কোনও কারণে যদি সৃষ্টিকর্তা আমাকে ভারতে দক্ষিণাঞ্চলে জন্মদিতেন, তবে হয় আমি এই বাঙালী,বাংলাদেশি আর মুসলিম পরিচয় নিঃসন্দেহে ধারণ করতাম না। আর লিঙ্গও হয়তো ভিন্ন হতে পারতো। কিংবা আমাকে যদি জন্ম নেয়ার আগে অপশন দেয়া হতো, শুধু আমাকে কেন অন্য যে কোনও কাউকে যদি সুযোগ দেয়া হতো তার জাতীয়তা,ধর্ম,বর্ণ,লিঙ্গ, নাগরিকত্ব বেছে নেয়ার তবে নিশ্চয়ই কেউ বাংলাদেশের মতো গরবী দেশে জন্ম নেওয়ার খায়েশই করতো না। জন্মের সাথে ওতোপ্রোত ভাবে জড়িত জাতীয়তা এবং নাগরিকত্ব, এবং তারপর তৃতীয় পর্যায়েই আসে ধর্ম পরিচয়, আমরা বাংলাদেশের যারা বর্তমানের মুসলমান সমাজ আছি, তাদের মাঝে ধর্মান্তরিত মুসলমানের সংখ্যা ০.০৫% ও আছে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে, মানে আমি বলতে চাইছি আমাদের দেশের ৯০% মুসলমানের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী বিশ্বাসের ভিত্তিতে নয়, জন্মের ভিত্তিতে মুসলমান। আমাদের মাঝে কয়জন শিক্ষিত আলেম, ক্বারি কিংবা ইসলামী স্কলার অন্যধর্মের সাথে তুলনা করে ইসলামকে সর্বোত্তম ধর্ম পেয়ে, তারপর তা পালনে সচেষ্ট হয়েছে তাও ভাববার বিষয়। আর জাতি হিসেবে আমারা শংকরজাতের তাই বর্ণ নিয়ে আমাদের মাঝে তেমন একটা উচ্চবাচ্য না থাকলেও, বিয়ের ক্ষেত্রে ফর্সা মেয়ে চাই।
০১.
বাকি থাকে লিঙ্গ পরিচয়। স্রষ্ঠা বাই ডিফল্ট দুটো লিঙ্গ বানিয়ে দিয়েছেন এবং এই দুই লিঙ্গের জীবন যাপনের যাবতীয় আইন-কানুন ধর্মভেদে প্রত্যেক ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত ও করে দিয়েছেন। কিন্তু এই দুই লিঙ্গের বাইরে অন্য কোনও লিঙ্গ নিয়ে কথা বলেন নি তাই আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় তাদের গ্রহণ যোগ্যতা বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ। স্রষ্ঠা যদি নর ও নারী কে সৃষ্টি করে থাকেন, তবে হিজড়া নামক জনগোষ্ঠীকে কে সৃষ্টি করলো? এটা একটা প্রশ্ন বটে? বিভিন্ন ধর্ম, বিভিন্ন ভাবে হিজড়া ইস্যুকে গোজা মিল দেয়ার চেষ্টা করেছে। সৃষ্টি যারা দ্বারাই হোক এমন একটা লিঙ্গ যে আছে তা অস্বীকারের উপায় নেই, এবং এরা যে নিজের ইচ্ছায় হিজড়া নয় তাও অস্বীকার করতে পারেন না কেউ। এই তো গেলো দৈহিক গঠন বিবেচনায় লিঙ্গ, আমাদের সমাজে আরও অনেক ধরনের লিঙ্গ আছে যা প্রকাশের কোনও সুযোগ আমাদের সমাজ ব্যবস্থায়ই নাই। যে সমাজে দৈহিক ভাবে স্পষ্ট পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও হিজড়া জনগোষ্ঠীকে তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি বছরের পর বছর লেগে যায়, সেই সমাজে, মানসিক ভাবে ভিন্ন লিঙ্গের মানুষের স্বীকৃতি কল্পনাতীত।
০২.
গতবছর জানুয়ারিতে বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে পরোক্ষ ভাবে ভারতের বিখ্যাত ফিল্ম ডিরেক্টর করণ যোহর, নিজেকে সমকামী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন এবং রেফারেন্স হিসেবে ব্যাবহার করা হয়েছে তার লেখা আত্মজীবনীকে। করণ যোহর এক বিখ্যাত মানুষ নিঃসন্দেহে, এবং তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত পরিচালক ও বটে, কিন্তু তার জৈবিক-চাহিদা কোন মুখী তা নিয়ে কারো কোনও আগ্রহ থাকার কথা না, কিন্তু তারপরও কেন একজন মানুষের Sexual Orientation বা যৌন আকাঙ্খা নিয়ে কেন এতো বিতর্ক আমাদের সমাজে। বিতর্কের মূল গোড়া ২টা আছে বাংলাদেশ তথা ভারত উপমহাদেশে, যার একটা বিশ্বব্যাপী আছে। আসছি সে বির্তকে, একটু পরে। তার আগে শেষ করি, এখন বলছি কলকাতার বিখ্যাত চিত্রপরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের কথা, ভদ্রলোক কয়েক বছর আগে মারা গেছেন, ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন এমন Transgender যার বাংলা মানে ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায় দৈহিক ভাবে পুরুষ কিন্তু মানসিক ভাবে নারী হবার ফলে, অস্ত্রোপচারের মধ্যমে নিজের লিঙ্গকে পরিবর্তন করা। এই গুণী চিত্রপরিচালকের যতগুলো সিনেমা রয়েছে তার সব সিনেমা গুলোই নির্ঘাত রুচি-স্নাত সংস্কৃতির মাত্রাকে স্পর্শ করে গেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিবিসির ওই প্রতিবেদন বলা হলো “ভারতে এই প্রথম তার মাপের কোনও তারকা নিজেকে সমকামী বলে ঘোষণা করলেন”, সূক্ষ্ম ভাবে বিবিসির রিপোর্টারও একজন গতানুগতিক মানুষের মতো আচরণ করলেন। ঋতুপর্ণা ঘোষকে তিনি করণ যোহরের কাতারে ফেলতে নারাজ। কারন হলও ঋতুপর্ণা ঘোষ নিজেকে আগে সমকামী ঘোষণা করেছেন, তারপর প্রতিকূল পরিবেশে থেকে সফল চিত্রপরিচালক হয়েছেন, কিন্তু করণ যোহর একার্থে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তা স্বীকার করলেন।
প্রশ্ন আসে কেন এই লুকোচুরি। আগেই বিতর্কের ২টি কারণ বলছিলাম যাতে বিতর্ক উষ্কে না ওঠে তার জন্যই এই লুকোচুরি। বিতর্কের প্রথম ও বিশ্বময়ব্যপ্তি গত বিষয়টি হলও, ধর্মীয় অগ্রহণ যোগ্যতা। আরেকটি হলো ব্রিটিশদের তৈরি করা ১৮৬০ সালের সাবস্টেন্টিভ ল “পেনাল কোড” এর ধারা ৩৭৭ এ, এই ধারার শিরোনাম হলো “প্রকৃতিবিরুদ্ধ অপরাধ” যেখানে বল আছে “কোন ব্যক্তি যদি স্বেচ্ছায় কোন পুরুষ, নারী বা পশুর সাথে প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে যৌন সঙ্গম করে, তবে তাকে আজীবন কারাদণ্ড দেয়া হবে, অথবা বর্ণনা অনুযায়ী নির্দিষ্ট কালের কারাদণ্ড প্রদান করা হবে যা দশ বছর পর্যন্ত বর্ধিত হতে পারে, এবং এর সাথে নির্দিষ্ট অঙ্কের আর্থিক জরিমানাও দিতে হবে।আইনের ব্যাখ্যায় বলা আছে ধারা অনুযায়ী অপরাধ প্রমাণে যৌনসঙ্গমের প্রয়োজনীয় প্রমাণ হিসেবে লিঙ্গ-প্রবেশের প্রমাণ যথেষ্ট হবে।৩৭৭ ধারার ব্যাখ্যায় পায়ুসঙ্গমজনিত (Anal Sex) যে কোন যৌথ যৌন কার্যকলাপকে এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। একারণে, পরস্পর সম্মতিক্রমে বিপরীতকামী(Heterosexual) মুখকাম (Oral Sex) ও পায়ুমৈথুনও উক্ত আইন অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হতে পারে।ধারা ৩৭৭ নিয়ে মোটামুটি সবাই জানেন তবে জানে না যে বিষয়, তা হলও এই
ধারা ৩৭৭ কিন্তু বিপরীতকামী লোকজনের উপর ও সমান ভাবে প্রযোজ্য কিন্তু আমরা তা কেবলই সমকামীদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য ভাবি।
০৩.
শুরু করেছিলাম একটা গানের লাইন দিয়ে সেই গানেরই অংশ “গোপনে যে বেশ্যার ভাত খাই/ তাতে ধর্মের কি ক্ষতি হয়?”
সত্যি বলতে কি আমাদের সমাজে নানান অপ্রকৃতিক কর্ম থাকলেও তা গ্রহণ যোগ্য, এমন অনেক আইন আছে এবং চর্চা আছে যা ধর্মকে লঙ্ঘন করে প্রতিনিয়ত চর্চাও হচ্ছে কিন্তু, সমকামীতার মতো মানবিক বিষয় গুলো সামনে আসলেই আমরা ওই মানুষগুলো টুটি চেপে ধরি ধর্মের দোহাই দিয়ে। কিছু দিন আগে জেন্ডার বিষয় এক কর্মশালায় অংশ নিয়েছিলাম। সেখানে একজন বক্তা বললেন হোমোফোবিয়া বা সমকামী-ভীতি মূলত কাজ করে তাদের উপর যারা কোনো না কোনো ভাবে এমন অভিজ্ঞা কিংবা মানসিকতার সাথে সম্পৃক্ত। ভাবলেও তাই মনে হয়। কিন্তু কেউ যদি তার ইচ্ছা বিরুদ্ধে কোনও ব্যক্তিকে এমন কর্মে বাধ্য করে তবে আক্রান্ত ব্যক্তি যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ তো আইনে রয়েছেই কিন্তু তা না করে ঘৃণা ছড়ানোর কি প্রয়োজন ! কোনও মানুষ যদি সমকামী হয় কিংবা সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে তবে সমাজের আপত্তি কোথায়? যখন দিনের পর দিন বিবাহিত মানুষ গুলো বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক বহন করে, তা আমাদের সমাজে আলোচনার জন্মদিলে-ও একটা সময় সবাই মেনেই নেয় কিন্তু সমকামিতা এমন এক ট্যাবু আমাদের সমাজে যাকে আমরা মানতেই রাজি না। দুবছর আগে ২জন অধিকার কর্মী হত্যা করা হয়েছে, কারন তারা সমকামীতার পক্ষে কথা বলতেন। চরমোনাই দেওয়ানবাগী, কুতুববাগীর মতো ভন্ডপীর কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করছে, প্রতিনিয়ত ধর্মকে ধর্ষণ করছে, তাদের নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যথা নেই কিন্তু এইসব নিরিহ নিভৃত মানুষ গুলোকে তুচ্ছ কারণে হত্যা করা হচ্ছে কিন্তু বাকরুদ্ধ করে দেয়া হচ্ছে মানুষের চিন্তা চেতনার।
০৪.
সমকামীতার সমস্যায় পতিত অনেক সন্তান কে মা-বাবা’রা প্রায়শই মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যান, আর ব্যবসায়ী মানসিকতার ডাক্তার গাদি গাদি ঔষুধ লিখেদেন, কেউবা ধার্মিক জীবন যাপনের পরামর্শই দেন, কিন্তু এই অনুভূতি কোনও পেন্সিলের কালির দাগ না যে রাবার দিয়ে কেউ মুছে দিতে পারবেন। কোনো মানুষই চায় না এমন কিছু করতে যাতে করে সমাজ তাকে বর্জন করে, কিন্তু তারপর ও যখন কেউ এমন কাজ করে, তবে ভাবতে হবে কেন করছে এমন কাজ। আজকে যদি কোনও ব্যক্তিকে ৩৭৭ধারাএর অধীনে শাস্তি দেয়াই হয় ১০বছরের তবে দশ বছর পরে তার যৌন-চাহিদা পরিবর্তন হয়ে যাবে এমন কি কেউ দাবি করতে পারেন ? যে আইন ব্রিটিশ সরকার আর বহু বছর আগেই বাদ দিয়ে দিয়েছে, যেই ব্রিটিশদের আমরা আরও প্রায় ৭০বছর আগেই খেদিয়েছি দেশ থেকে, সেই দেশের সেই আইন আমরা আজও বলবৎ রাখছি কেন তা এখন একটা প্রশ্ন বটে? এবং ৩৭৭ ধারা আমাদের সংবিধানের ৩য় অনুচ্ছেদের সাথে কতটা সংগতিপূর্ণ তাও ভেবে দেখার সময় এসেছে। শুধু মাত্র ফেইসবুক কিংবা ইন্টারনেট চালিয়ে আধুনিক হওয়া যায় না। সমকামীতা আকাশ থেকে আসা কোনও বিষয় নয়, এর চর্চা যুগে যুগে ছিলও, আজো আছে এবং ভবিষ্যৎও থাকবে। তাই যৌনাকাঙ্ক্ষার নিরিখে কোনও বিতর্কে গুরুত্ব না দিয়ে বরং প্রয়োজনীয় বিষয় গুলো নিয়েই আমাদের ভাবা উচিত।
শেষ করছি একটা প্রশ্ন দিয়ে,
আপনি কি কখনো কোনও ডাক্তার, আমলা, ছাত্র, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ কিংবা অন্যকারো কাছে, অথবা বিয়ের পাত্র-পাত্রী দেখতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেন বা জানতে চান তার যৌন কামনা কোন মুখী? সম? উভ ? নাকি বিপরীত ?
উৎস: রূপবান ব্লগ