
নগরবালক
আমরা বাংলাদেশিরা যে সামাজিক রীতিনীতি গুলো মেনে চলি, তার কিছুটা আমরা পেয়েছি আমাদের সংস্কৃতি থেকে, কিছুটা আমাদের প্রথা থেকে, কিছুটা বা আমাদের ধর্মথেকে, সবকিছু মিলে মিশে আমরা পূর্নাঙ্গ বাংলাদেশি। আমরা যেমন মঙ্গলশোভা যাত্রায় অংশনেই, তেমন প্রভাত ফেরিতে অংশ নেই, আবার তাজিয়ামিছিলেও আমাদের উপস্থিতি থাকে, আমরা যেমন শহীদ মিনারে, স্মৃতিসৌধ শ্রদ্ধানত শীরে দাঁড়াই, তেমনই দূর্গাপূজাঁ বা দোলপূর্নিমায় আনন্দে মেতে উঠি, কিংবা শব-ই-বরাতের রাতে বাজি ফোটানো, ইফতার বা সেহিরে পার্টি করা সবই আমাদের সংস্কৃতির অংশ। যে চর্চা গুলোর কথা আমি বললাম, এই চর্চা গুলো দলমত, ধর্ম, জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে আমরা বাংলাদেশিরা সবাই পালন করি, এখানে আমাদের জন্য ধর্ম মুখ্য বিষয় নয়, মুখ্য বিষয় হলো আমাদের প্রথা বা কাস্টম। এটার সাথে যদি কেউ ধর্মী অনুভূতিকে গুলিয়ে ফেলে কাউকে নাস্তিক বা আস্তিক আখ্যা দিতে চান তবে তা চরম পর্যায়ের সেচ্ছাচারীতা ছাড়া আর কিছুই নয়। কারন আমাদের বর্তমান বাংলাদেশে অধিকাংশ মানুষই ধর্ম ভীরু হলেও আস্তিকতা বা নাস্তিকতা নিয়ে তরুণ প্রজন্ম মাথা ঘামাতে মোটেই আগ্রহীয় নয়
০১.
হালকা-পাতলা ব্লগিং করি বলে, ব্লগে থাকা পোষ্ট গুলো কম বেশি পড়া হয় প্রতিদিনই, এই অভ্যাসটা অনেকটা দৈনিক পত্রিকা পড়ার অভ্যাসের মতো আমার জন্য। যখনই সমকামিতা নিয়ে কোনো পোষ্ট কেউ করে, আমি খুটিয়ে খুটিয়ে আদ্যপান্ত পড়ি। সাম্প্রতিক দুইটা ওয়েব সাইটে একটা বিষয়ে আমার চোখে পড়লো, একই ধাঁচের লেখা দেখতে পাচ্ছি সমকামিতা নিয়ে, কিন্তু ভিন্ন নামে ভিন্ন থিমে। এই লেখা গুলো পড়ে আমি যথেষ্ট বিভ্রান্ত হচ্ছি। এই লেখা গুলোতে একটা কমন থিম দেখতে পাচ্ছি যে ধর্মে অপব্যাখ্যা দিয়ে নাকি সমকামীদের মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নেয়া হচ্ছে, মানুষের মাঝে ঘৃণার জন্মদেয়া হচ্ছে। আসলেই কি তাই? আমার বেশ জানার ইচ্ছা ধর্ম-সুব্যাখ্যাটা কি সমকামিতা সম্পর্কে যা সমকামীদের বেঁচে থাকার অধিকার দিবে? মানুষের মাঝে ভালোবাসার জন্মদিবে সমকামীদের জন্য?
এই বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলাম সংশ্লিষ্ট একজনকে তিনি বলছিলেন লূতের ঘটনা নিয়ে নাকি দুটি বর্ননা আছে, প্রথমটি সমকামীতা দ্বিতীয়টি পুরুষ ধর্ষণ, তো দ্বিতীয়টি গ্রহন করলে নাকি তা অনেকটাই গ্রহনযোগ্য হয়, আমি ঠিক বুঝলাম না তিনি ঠিক কিসের ব্যাখ্যা কথা আমাকে বলেছিলেন, কিন্তু ইসলামের সবচেয়ে বড় রেফারেন্স হলো কোরআন, সেখানে সূরা হুদ সহ ১৫,২৬,২৯ এবং ৬৬নং সূরা গুলো ভালোভাবে পড়লেই বোঝা যাবে সমকামিতাকে ইসলামের প্রধান ধর্মগ্রন্থ তথা আসমানী কিতাব কিভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তারপরও কিসের ভিত্তিতে এইসব লেখকেরা ধর্মীয় অপব্যাখ্যার দোহাই দিয়ে ধর্মদ্বারা সমকামীতাকে সহীশুদ্ধ দেখানো চেষ্টা করছেন আমার বিষয়টি ঠিক বোধোগম্য নয়। যাই হোক থাক সেসব আলোচনা।
০২.
বাংলাদেশে সমকামী সম্প্রদায় হচ্ছে অন্য যে কোনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মাঝে সব চেয়ে বেশি বিক্ষিপ্ত একটি গোষ্ঠী, এদের মাঝে নেই কোনো সম্বন্নয়, নেই কোনো কর্মপরিকল্পনা, নেই কোনো সুদৃঢ় নেতৃত্ব। মজার কথা হলো এখানে যারা আছেন মানে সমকামীদের অর্ন্তভূক্ত, অধিকাংশই সবাই নিজেই নেতা, এবং অন্যের মতের প্রতি খুব বেশি দিন শ্রদ্ধা ও সম্মান ধরে রাখতে পারে না। এর অবশ্য যুক্তিযুক্ত কারণও আছে, কারণটা হলো সমকামী গোষ্ঠীর মাঝে এক্টিভিজমের সাথে সম্পৃক্ত মানুষগুলো সহ আমরা দেখা প্রত্যেক সমকামী অত্যন্ত বিচক্ষন, সৃষ্টিশীল এবং সহজাত নেতৃত্বদানের গুনাবলী সম্পন্ন। এটা কিন্তু খুউবই ইতিবাচক একটা দিক, তারপরও এই নেতৃত্বদানের গুনাবলি সবার মাঝে থাকার কারনে বেশ একটা বিক্ষিপ্ততা সবার মাঝে লক্ষ্য করা যায়। এর ফলে সংঘবদ্ধ হয়ে একটি ছাতার নিচে বাংলাদেশের সকল সমকামীদের কিছুই করা হয়ে উঠে না। মাঝে মাঝে ভাবি, এই সৃষ্টিশীল মানুষ গুলো যদি সমন্নিত প্রক্রিয়া বেশি না ৫টা বছর তাদের এক্টিভিজম চালিয়ে যেতে পারতো, তবে হয়তো বাংলাদেশে তাদের গ্রহন যোগ্যতার বিষয়টি সুগম হতো একটু বেশি তাড়াতাড়ি। মানে যা ২০বছরে হতো তা হয়তো ১৫বছরেই করা সম্ভব। কিন্তু হায়, তাদের একসাথে সম্বন্নিত হয়ে কাজ করতে ভাবাটা বড়ই আকাশ কুসুম ভাবনা। এবং এইসব বিষয়ে খোলাখুলি লিখাটাও তাদের জন্য এক প্রকার বিরক্তির কারন। অনেকটা এমনই একটা বিষয় নিয়ে প্রায় ২বছর আগে লিখে, এখনো চক্ষুশূল হয়ে আছি অনেকের।
প্রশ্ন হচ্ছে যে এই যে বিক্ষিপ্ত ভাবে কাজ গুলো করা হচ্ছে, এর সুফল আসলে কারা ভোগ করছে? কেন করা হচ্ছে? উদ্দেশ্যই বা কি? আমি যদি শুধু লেখা লেখির দিকটা ধরি, তবে এখানেও বেশি কয়েকটি প্লাটফর্মে লেখা হচ্ছে, এবং এক প্লার্টফর্মের লেখার সাথে অন্য প্লার্টফর্মের লেখার কোনো মিল খুঁঝে পাচ্ছি না। কেউ বা দেখছি ধর্ম দিয়ে সমকামিতাকে জাস্টিফাই করতে চাইছে, অথবা কেউ বলছেন ৩৭৭ ধারা বিলুপ্ত করার করার কথা। এখানে একটা বিষয়ে বলা উচিত, বাংলাদেশের মামী-চাচী বিয়ে করা নাতো ধর্মে নিষিদ্ধ না আইনে নিষিদ্ধ, কিন্তু কেউ যদি তা আপন মামী বা চাচীকে বিয়ে করে, তবে তার অবস্থানটা সমাজে কি হবে ভেবে দেখেছেন? এখানে তো ধর্মের কোনো তথা কথিত অপব্যাখ্যা নেই বা ৩৭৭ ধারার মতো কোনো ধারা নেই তাহলে কেন এমন বিয়ের আমাদের সমাজে গ্রহন যোগ্য নয়? উত্তরটা কিন্তু সবার জানা, তাও কিছু লোক থাকেই তর্কের খাতিরে ত্যানা প্যাচাবে। এই সমাজে ধর্ম অনেক বিষয়কেই স্বীকৃতি না দিলেও, সামাজিক চর্চার কারনে তা হয়ে আসছে, যেমন ধরুন জন্মনিয়ন্ত্রণ, মাওলানা সাবের বউ ও করেন কিন্তু।
তাই সব কিছুকে ধর্ম দিয়ে জাষ্টিফাই যারা করতে চায় তাদের আমি উন্মাদ ছাড়া আর কিছুই বলতে চাই না। এবং যারা মনে করে ৩৭৭ ধারা বিলুপ্ত করা গেলে সমকামীদের জন্য রাস্তাটা আরেকটু মসৃন হবে, তাদেরকেও আমি উন্মাদই বলবো। কারন ৩৭৭ ধারা বাংলাদেশের সমকামীদের উপরে আক্ষরিক অর্থে কখনো প্রয়োগই হয় নি। ওটা শুধু একটা কাগুজে আইন মাত্র, ওই ধারাকে বিলুপ্ত করার চেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো বাংলাদেশের তরুন জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে, তাদেরকে সমকামীতার বিষয়ে বৈজ্ঞানিক ভাবে শিক্ষিত করে তোলার নিমিত্তে কাজ করা। বিজ্ঞানই এখন এক মাত্র জিনিস যাকে সামান্যতম সন্দেহ করার অবকাশ কারো নেই। যারা লিখছেন এই বিষয় গুলো নিয়ে, তারা কিন্তু সমকামীতার বিষয়ে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা গুলো বেশি করে উপস্থাপন করলেই অনেকটা সুবিধা হয়, কিন্তু তা না করে ধর্মের অপব্যাখ্যা, বা আইনী বাধা টাইপের পুরান কাসুন্দি নিয়ে ঘাটাঘাটি শুরু করলে আদৌতে কোনো উপকারই পাবেন না। ফেইসবুকে আমার জানামতে একটি গ্রুপ আছে, যারা সমকামীকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি কোণ থেকে ব্যাখ্যা করে লেখালিখি করে, এবং লেখা গুলো বেশি মানসম্মত।
০৩.
বাংলাদেশে যেহেতু ইস্যুটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর তাই অন্তত প্রচার ভিত্তিক এক্টিভিজম গুলোতে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আসা বর্তমানে সময়ের দাবী। চাইলে যে কেউ যে কোনো কিছু, যে কোনো জায়গায় লিখতে পারে ইস্যুটি নিয়ে, কিন্তু তার ইপ্যাক্টটা কি আসবে সামগ্রিক ভাবে তা কিন্তু ভাববার বিষয়ে আছে। নিশ্চয়ই বাংলাদেশের সমকামী গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য রাষ্ট্র বা সমাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা নয়, বরং রাষ্ট্র বা সমাজকে সমকামিতার প্রশ্নে সহনশীল করে তোলো। আর সেটা যদি কোনো সুসংগঠিত রূপরেখা প্রনয়ণ না করে বিক্ষিপ্ত ভাবে চলতে থাকে তবে সমকামী জনগোষ্ঠীর অবস্থা হবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মতো, তাদেরও কোনো নেতৃত্ব নেই, সংঘবদ্ধ না তারাও, নেই কোনো চেইন অফ কমান্ড।
ধরুন আমার মতো ক্ষ্যাপাটে কোনো একজন মানুষ নিজেকে সমকামী হিসেবে দাবী করে, ধর্মের বিষয়ে বেশ উত্তেজনা মূলক কথা বার্তা বলে শুরু করে দিলো, এবং তার কার্যক্রমের দ্বারা উগ্রবাদীদের তো ক্ষেপালোই, সাথে সাথে সাধারণ ধর্মান্ধ মানুষও সমকামীদের বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠলো তাতে কিন্তু ওই ক্ষোভের প্রতিফলন না সামগ্রিক ভাবে সকল সমকামী জনগোষ্ঠীর উপর সমানভাবে বর্তাবে।
আর তাই, অন্তত লেখালেখি বা প্রচার ভিত্তিক এক্টিভিজমের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সমকামী গোষ্ঠীর প্রতিটা সংগঠন, পক্ষ, নেতৃস্থানীয় সকলের উচিত একটা টেবিলে বসে কিছু নীতিমালা করা, যে তারা কি লিখবে? কিভাবে লিখবে? কোন ধরনের লেখাকে প্রমোট করবে? এবং লেখা গুলো কিভাবে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে অভিন্ন উদ্দেশ্যকে প্রকাশ করবে, কিভাবে কোনো লেখা বুমেরাং হবে না সমকামীদের জন্যই। এবং কোনো কোনো বিষয় গুলো কখন কখন ক্রমান্বয়ে সাধারণ জনগোষ্ঠীর সামনে তুলে ধরা হবে।
এটা একান্তই আমার প্রস্তাবনা এটাকে কেউ পাগলের প্রলাপ ভাবতে পারেন, কেউ সিরিয়াসলি নিতে পারেন, তবে একটু ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখবেন আসলেই কি প্রচার ভিত্তিক এক্টিভিজমের ক্ষেত্রে একটি সম্বন্নয় সাধন বর্তমান বাস্তবতায় জরুরী নয়?
উৎস: রুপবান ব্লগ