ফেরা (পর্ব -৪)

Kolpo86

এই কয়দিন রনির কথা তেমন মনে পড়ে নাই। আসলে নিজের শরীরের চিন্তায় ছিলাম এই কয়দিন। আমি ঠিক করলাম পরেরদিন চলে যাবো। কিন্তু জামালের কথা ভাবতেই মন খারাপ যাচ্ছিলো। ওর সাথে আবার কবে দেখা হবে। সেই দিন রাতে জামাল আর আমি বসে আছি পুকুর ঘাটে। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ।জোনাকি পোকা জ্বলছে নিভছে। মিটিমিটি। কেউ নেই জায়গাটা নীরব। জামাল গান ধরলও-
“নিশা লাগিলো রে
বাঁকা দুই নয়নে নিশা লাগিলও রে—-”
এমন সুন্দর পূর্ণিমা আর জামালের ভরাট কণ্ঠে এই গান শুনে মনে হচ্ছিলো আমি যেন পৃথিবীতে নেই। অন্য কোন জগতে।সেই জগতে শুধু আমি আর জামাল।গান শেষ হল। আমরা কেউই কথা বলছিনা।একসময় জামাল আমাকে জড়িয়ে ধরলো। জামালের শরীরের ঘামের গন্ধ। কিন্তু আমার খারাপ লাগছে না। আলতো করে তার জিভ দিয়ে আমার ঠোঁট চাটলো সে। তার পর তার ঠোঁট আমার ঠোঁটে স্পর্শ করালো। কি আশ্চর্য আমার একবারও রনির কথা মনে পড়ছে না। বরং জামালের কাছ থেকে আদর পেতে ইচ্ছা করছে। চাঁদ-টা মেঘের আড়ালে চলে গেল। চারিদিক অন্ধকার। আমরা প্রেম লীলায় মেতে উঠলাম।
একসময় দুইজনের শারীরিক চাহিদা পূরণ হল। নিস্তেজ হয়ে আসলো শরীর। দুইজন পাশাপাশি শুয়ে আছি। আমার কেমন জানি বিষণ্ণ লাগছে। কাল চলে যাবো সেইজন্য নাকি অন্য কোন কারন। কোন ভাবেই স্বস্তি পাচ্ছি না। কিছুক্ষণ পর বুঝলাম কেন খারাপ লাগছে। আমি খুব বড় অন্যায় করেছি। রনির প্রতি অন্যায় করেছি। তাকে ভালবাসি আর সেক্স করলাম জামালের সাথে। আমার অপরাধ-বোধ তীব্র হল। বুকের কাছে কেমন জানি চিন চিন ব্যথা অনুভব করছি। রনি শুনলে কি কক্ষনো আমাকে মাফ করতে পারবে?
আমি উঠে কাপড় পরে রওনা দিলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। পিছন পিছন জামাল আসতে লাগলো। সে বিস্মিত কি হল আমার। আমি বেশ কড়া করে জামাল কে বললাম
– তুমি আমার পিছন পিছন আসবা না। আমি একাই যাবো।
জামাল কিছু বললো না। হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে রইলো। আমি বাড়ি পৌঁছে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। ঠিক করলাম কাল ভোরেই পালইকান্তা চলে যাবো।জামাল বেশ কয়েক বার দরজা ধাক্কালো। কিন্তু খুললাম না। কি উত্তর দিবো তাকে? ভাবলাম জামাল কে কড়া করে কিছু বলা উচিত হয় নাই। আমি তো রাজি ছিলাম। আমার সম্মতি ছাড়া তো কিছু হয় নাই। নাহ ওকে সরি বলতে হবে। মুখে বলতে পারবো না। চিঠি তে সব বলবো। আর আমি জামালের কাছে কৃতজ্ঞ । অসুখের সময় সে আমার জন্য অনেক করেছে।
সারা রাত ঘুমাতে পারলাম না। এপাশ ওপাশ করলাম।মাঝে মাঝে তন্দ্রা মত আসছে। কিন্তু চমকে চমকে উঠে পড়ছি। ফজরের আযান দিতেই উঠে পড়লাম। ব্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে গেলাম। কাউকে কিছু বললাম না। বললে হাজার প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। শুধু মাত্র জামালের ঘরে চিঠি টা রেখে গেলাম।
কাঁচা রাস্তা ধরে হাঁটছি। নদীর ঘাটে যেয়ে নৌকা নিতে হবে। মন খুব খারাপ। রনি কে কি সব বলবো ? বললে সে কি মেনে নিবে?তাহলে কি বলবো না? না আমার সৎ  থাকতে হবে। ভালবাসার প্রতারণা আমি করবো না। হাঁটতে হাঁটতে অবাক হয়ে দেখি সামনে ছোটকাকু। আমাকে দেখে হাত নাড়ছে।আমি নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি দৌড়ে গেলাম ছোট কাকুর কাছে।ছোট কাকু আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন
– কই যাস?
– বাড়ি যাই।
– তোর তো তিন দিন থেকেই চলে আসার কথা। বাবা তো চিন্তায় চিন্তায় অস্থির।
– কাকু আমি খুব জ্বরে ভুগেছি। আসতে পারি নাই তাই। কাউকে দিয়ে যে খবর দিবো সেই উপায় নেই।
ছোট কাকু খালা কে দেখতে যেতে চাইলেন। কিন্তু আমি না করলাম।আবার জামালের মুখোমুখি হওয়ার কোন ইচ্ছা নাই। ছোট কাকু আমাকে নিয়ে ঘাটের দিকে রওনা দিলেন।

গ্রামে ফিরে একটা খবর পেয়ে আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো ।বাচ্চু মিয়া রনি আর রনির বোন ২ জন কেই মেরে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। মুখে মুখে তালাকও দিয়ে দিয়েছে।(যখনের কথা বলছি তখন গ্রামে এটা খুব স্বাভাবিক।)আর বাচ্চু মিয়ার তো আগেই এক স্ত্রী রয়েছে। কেউ বলতে পারছে না রনি কোথায় চলে গিয়েছে। সম্ভবত ঢাকায়। রনির বাবা মা কেউ বেঁচে নাই। মামার বাসায় থাকতো। হয়তো মামার বাসায় ফিরে গিয়েছে। কিন্তু আমাকে কিছু বলে গেলো না? বলবেই বা কি করে ? আমি তো ছিলাম না বাড়িতে। আমার খুব অসহায় লাগছে। কি করে খুঁজে পাবো রনি কে? ঢাকার ঠিকানা তো আমি জানি না। আর কি যোগাযোগ করবে রনি আমার সাথে? আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে বুকের উপর কেউ এক মণ ওজনের পাথর বসিয়ে দিয়েছে। কান্না আসছে। কাউকে এই কথা গুলো বলতে পারলে ভাল লাগতো । কিন্তু কাকে বলবো ?
প্রতিদিন প্রতীক্ষায় থাকি আজ বোধহয় রনি ফিরে আসবে। কিন্তু সে আশায় গুঁড়ে বালি। ভাবি চিঠি আসবে। কিন্তু কোন চিঠি না। সারা দিন বাসায় থাকি। কিছু ভাল লাগে না। মন মরা হয়ে থাকি। বিকেলে নদীর ধারে হাঁটি একা একা। মনে পড়ে যায় রনির হাত ধরে হাঁটার দিন গুলোর কথা। কিভাবে ভুলবো। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় গুলো তো তার সাথেই।

সময় বয়ে যায়। দাদাজান আগে থেকে বুড়িয়ে গিয়েছেন। আগের মত রংমহলে আর আসর বসে না। আমরা আগের থেকে গরীব হয়েছি। সকলের নিষেধ অগ্রাহ্য করে ছোট কাকু কাপড়ের ব্যবসা করছেন। শুধু মাত্র বড় চাচার কোন পরিবর্তন নেই। এখনো বিলাসী জীবন যাপন করছেন। ইলেকশন করবেন। জমি বিক্রি করে দেদারসে টাকা খরচ করছেন। এই ইলেকশন ই আমার জীবনে শনি ডেকে আনলো ।
নির্বাচনে টাকা যোগাড়ের এক অদ্ভুত পরিকল্পনা করলেন বড় চাচা। তা হল যৌতুক । কিন্তু নিজে বিয়ে করবেন না।কেন করবেন না কে জানে! বিয়ে ঠিক করলেন আমার। এই বয়সে। তিনি ভাবলেন আমাকে বিয়ে দিয়ে আমাকে শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়ে দিবেন শহরের ভাল স্কুলে পড়ানর নাম করে। আবার যৌতুক পাওয়া যাবে। মন্দ কি?
যে মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক করলেন তার নাম রূপা। তার বাবা একটা ঘর জামাই চায় । তার বিনিময়ে মোটা অঙ্কের যৌতুক দিবে। তিনি গফরগাঁও শহরের এর অন্যতম ধনাঢ্য ব্যক্তি। রাজনীতিতেও যথেষ্ট প্রভাব প্রতিপত্তি আছে। রূপার বয়সও আমার মতই।
ঘটক মন্টু মিয়া বিয়ে ঠিক করলেন। আমার হবু শ্বশুর রইসুদ্দিন এক কথায় রাজি। এমন পাত্র খুঁজছিলেন তিনি নিজের মেয়ের জন্য । অল্প বয়স। গড়ে পিঠে মানুষ করা যাবে। তার উপর ভাল বংশের ছেলে। এদিকে আমি কোন ভাবেই বিয়ে করতে রাজি হলাম না। ছোট কাকু ও প্রতিবাদ করলেন। কিন্তু বড় চাচার এক কথা বিয়ে না করলে আমাকে তাড়িয়ে দিবেন বাড়ি থেকে। দাদাজান বুড়ো হয়ে গিয়েছেন। তিনি সম্পূর্ণ বড় চাচার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। যে কোন সিদ্ধান্ত এখন বড় চাচা নেন। তার মুখের উপর কেউ কথা বলে না। সবাই তাঁকেই অলিখিত পরিবারের প্রধান হিসেবে মেনে নিয়েছে।
এক সন্ধ্যায় রইসুদ্দিন সাহেব আসলেন আমার হাতে আংটি পরাতে । আমাকে দেখে রইসুদ্দিন সাহেব খুশি। এমন ছেলেই নাকি খুঁজছিলেন তার মেয়ের জন্য।
সেদিন রাতে বড় চাচার সাথে ছোট কাকুর ঝগড়া হয়ে গেলো। সব কথোপকথন আমি আড়াল থেকে শুনলাম।
-ভাইজান আপনি এসব কি করছেন?
– কি করছি ?
– এই বয়সে সবুজের বিয়ে ঠিক করলেন? ও বিয়ের কি বুঝে? আইএ পাশ করুক তারপরে না হয়?
– কেন সবুজের বাবা তো এই বয়সেই বিয়ে করেছেন
– সেতো অনেক আগের কথা। এখন কি আর এই বয়সে বিয়ে হয়?
– কেন ভালই তো । ছেলে টা কে বিয়ে দিলে আমরা মোটা অংকের যৌতুক পাবো। তার উপর আমাদের সম্পত্তি তেও উত্তরাধিকার কমবে। রইসুদ্দিন সাহেব বলেছেন বিয়ে হলে সবুজ কে দিয়ে জমি সম্পত্তি সব সাইন করিয়ে দিবেন।
– ছিঃ ভাইজান
– ছিঃ বলছিস কেন? সবুজ কি কম পাবে? রইসুদ্দিন সাহেবের এক মাত্র মেয়ে কে বিয়ে করছে। কম পাবে সম্পত্তি? আমাদের থেকে অনেক বেশি সম্পত্তির মালিক হবে সে।
– সে তো তার স্ত্রীর সম্পত্তি।
– ওই এক ই কথা। স্ত্রীর সম্পত্তি স্বামীর সম্পত্তি।আমার সিদ্ধান্তে আব্বাজানের আর মেঝোর সম্মতি আছে। তোর আপত্তি থাকলে আব্বাজান রে বল।
এর পর ছোট কাকু আর কিছু বললেন না। বুঝলেন বলে লাভ নেই। বড় চাচা তার সিদ্ধান্তেই অটল থাকবেন।
বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসছে। কেউ আমার সিদ্ধান্ত জানতে চায় নাই। এমন কি মেয়ের ছবিও আমাকে দেখানো হয় নাই। জমকালো উৎসব করে বিয়ের আয়োজন করা হবে। ঢাকা থেকে বাবুর্চি আসছে। বিয়ের বাজার করা হয়েছে ময়মনসিংহ থেকে। বড় চাচা নিজে গেলেন ময়মনসিংহ । অবশ্য সব টাকাই রইসুদ্দিন সাহেব দিলেন। পুরো বাড়িতে খুশির আমেজ। কতদিন পরে একটা বিয়ে হচ্ছে। হোক সেটা বাল্য বিবাহ। আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। জানি একটা মেয়ে কে নিয়ে আমি সুখী হব না। তার উপর ঘর জামাই হয়ে থাকার কোন ইচ্ছা আমার নাই। আর আমি বিয়ে করলে রনি কে কি বলবো? আমরা ২ জনই তো ঠিক করেছিলাম আমরা ২ জন বিয়ে করবো না। সারা জীবন একসাথে থাকবো । কিন্তু রনির সাথে আর দেখা হবে তো ? নিশ্চয়ই রনির সাথে আমার দেখা হবে।
আমি গোপনে ছোট কাকু কে অনেকবার বললাম যে আমি এখন বিয়ে করবো না। তিনি শুধু দীর্ঘ শ্বাস ফেলেন। তিনি যা প্রতিবাদ করার করেছেন। কিন্তু এর বেশি কথা বলার সাহস তাঁর ও নেই।
বিকেলে আমাকে ডাকা হল বিয়ের বাজার দেখতে। আগামী শুক্রবার আমার বিয়ে। রূপার জন্য লাল বেনারসি কেনা হয়েছে। দাদির কিছু গহনা পলিস করে আনা হয়েছে। আমার জন্য পাজামা পাঞ্জাবি। এসব দেখে আমার মেজাজ গরম হয়ে গেলো । পুকুর ঘাঁটে বসে থাকলাম। মুষড়ে পড়েছি। এই বিয়ে থেকে বাঁচার উপায় কি? আর তো হাতে সময় নেই। নিজের জীবনের সাথে সাথে তো আরেকটা মেয়ের জীবন নষ্ট হবে। ভাবলাম একটাই উপায় আছে। তা হল বাড়ি থেকে পালানো। কিন্তু কই যাবো পালিয়ে? সাহসও পাচ্ছি না। কিন্তু ছোট কাকু কিভাবে যেন আমার মনের কথা ঠিক বুঝে ফেললেন।

উৎস: রুপবান ব্লগ

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.