
শান্তনু সূর্য
প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়সী নীলাভ সাহেবকে হয়তো আপনারা অনেকেই চিনবেন। দশ এগারো বছর হলো তিনি এই মফস্বল শহরের একটি স্বনামধন্য কলেজে শিক্ষকতা করছেন। নীলাভ সাহেব বেশ বিপদে পড়েছেন। তার ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন বেশ চাপ দিচ্ছে বিয়ের জন্য। অন্তত বংশরক্ষার খাতিরে হলেও এবার নীলাভ সাহেবকে বিয়ে করাবেই। পঞ্চাশ বছর বয়সেও এমন সুদর্শন ব্যক্তি কেন বিয়ে করছে না সেটা আত্মীয়স্বজনদের মাথায় কোনোভাবেই ঢুকছে না। কলকাতা শহর থেকে সপ্তাহে দুবার করে আত্মীয়স্বজনেরা কনের ছবিসহ বায়োডাটা পাঠায়। নীলাভ সাহেব বিরক্তি নিয়ে ছবিগুলো না দেখেই ড্রয়ারে ফেলে রাখেন।
দিব্যেন্দু সবে দিল্লীতে একটা সরকারি চাকুরীতে জয়েন করেছে। ছেলে সরকারি চাকরী পেয়েছে। বাবা মা পরম আনন্দে ছেলের জন্য সুন্দরী, ফুটফুটে বউ খুঁজছে। দুমাস যেতে না যেতেই দিব্যেন্দু কিছু না বলে লাপাত্তা হয়ে গেল। বন্ধুবান্ধব এমনকি পরিবারের কেউও তার খোঁজ জানে না! তার আরো দুমাস পর মুখভর্তি গোঁফ-দাড়ি নিয়ে তার নিজের সেই মফস্বল শহরে ফিরে এলো। বাবা-মা সহ পরিবারের সবাই হতাশ হয়ে দিব্যেন্দুর দিকে চেয়ে থাকে। মাঝে মাঝে মা বোঝানোর চেষ্টা করে।
“বাবা চাকরী না করলে তোকে কে বিয়ে করবে? “
দিব্যেন্দু নির্লিপ্ত সুরে উত্তর দেয়,
“তুমি তো চাকরী করতে না। আমার বাবা তোমাকে বিয়ে করে নি?”
“তুই কি মেয়ে মানুষ বলদ? তোকে তোর বউ ঘরজামাই করে পালবে নাকি?”
“সমস্যা কী? ঘরজামাই ব্যাপারটা খারাপ না। ওই যা একটু সমস্যা তা হল পাড়া প্রতিবেশি। ও নিয়ে আমার তেমন সমস্যা নাই। “
“তোর সমস্যা না থাকলে কী? আমাদের সমস্যা আছে। মানসম্মানটা কোথায় গিয়ে ঠেকবে চিন্তা করেছিস? “
দিব্যেন্দু এবার মায়ের চোখের দিকে শান্ত ভঙ্গিতে তাকায়।
“মানসম্মান কী জিনিস মাতাশ্রী? এ জিনিস কি খায় না মাথায় দেয়? “
মাতাশ্রী তখন মাথায় হাত দিয়ে রান্নাঘরে চলে যায়। আর দিব্যেন্দু তার চিন্তার জগতে হারিয়ে যায়।
বর্তমানে খাওয়া আর বিছানায় বসে খাতায় আঁকাবুকি করা ছাড়া দিব্যেন্দুর বিশেষ কোনো কাজ নেই। মাঝে মাঝে কী নিয়ে যেন গভীর চিন্তায় ঢুকে যায়। ঈশ্বর বিলুপ্ত হওয়ায় তার চিন্তার বিষয় সম্পর্কে সে ছাড়া আর কেউ জানে না!
দিব্যেন্দুর কথা নীলাভ সাহেবের কানে গেলো। নীলাভ সাহেব ঠিক করলেন পরের রবিবার কলকাতা না গিয়ে দিব্যেন্দুর সাথে দেখা করবেন। দশ বছর আগে যে ঘটনাই ঘটুক দিব্যেন্দু এখনো তার প্রিয় ছাত্রই রয়ে গেছে।
প্রায় দশ বছর আগের মত ঠিক স্নান করতে যাওয়ার আগের মুহূর্তে দরজায় ঠোকা পড়ল। নীলাভ সাহেব স্নান করতে যাচ্ছিলেন। দরজা খুলতেই দেখতে পেলেন উষ্কখুষ্ক চুল, দাড়ি-মোচ ভর্তি উজ্জ্বল চোখওয়ালা এক যুবক। নীলাভ সাহেব কিছুটা চমকে উঠে নিজেকে সামলে নিলেন।
” দিব্যেন্দু না ? এসো ভিতরে এসো।” দিব্যেন্দু অসংকোচে ভিতরে ঢুকল।
“আমি ভেবেছিলাম আজ তুমি আসবে। আমি যেদিন ঠিক করি তোমার বাসায় যাব সেদিনই তুমি আগেভাগে হাজির হয়ে যাও! “
“একবারই তো যেতে চেয়েছিলেন। পরে অবশ্য আমিই বাসা ছেড়ে কলকাতা চলে যাই। “
” তা ঠিক। শুনলাম তোমার বিয়ের কথাবার্তা চলছে? “
“আপাতত বন্ধ আছে। বেকার ছেলের হাতে কে তার মেয়েকে তুলে দেবে?”
” তাহলে চাকরীটা ছাড়লে কেনো?”
দিব্যেন্দু এবার কেন যেন চুপ করে যায়। নীলাভ সাহেবের মুখের দিকে তাকায়।
“মনে হচ্ছিল স্যার কিছু একটা হারিয়ে ফেলছি। দেরী হয়ে গেলে আর কখনো হয়তো পাবার আশাও থাকবে না। ওই চাকরী করলে হয়তো সুন্দরী বউ পাব। কিন্তু সেই মেয়েকে নিয়ে আমি সারাজীবন থাকব কীভাবে যদি তাকে ভালবাসতেই না পারলাম? ভালবাসার অভিনয় নাটক সিনেমাতেই চলে। বাস্তবে না। “
নীলাভ সাহেব কোনো উত্তর দিলেন না। কথার খেই হারিয়ে ফেলেছেন। তার মাথা হঠাত ভার হয়ে গেল। গলার মাঝে শক্ত কিছুর উপস্থিতি টের পাচ্ছেন। তিনি উঠে দাড়ালেন। গলা খাঁকারি দিয়ে পরিষ্কার করে বললেন, ” তুমি থাকো। আমি স্নানটা সেরে আসি। দুপুরের খাবার খেয়ে যেও। “
নীলাভ সাহেব চাচ্ছেন যেন ঠিক দশ বছর আগের মত দিব্যেন্দু পালিয়ে যায়। তার মাথা কাজ করছে না ঠিকমত। দিব্যেন্দুকে কী উত্তর দিবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। স্নান শেষে বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখেন দিব্যেন্দু নাই।
সে আবারো চলে গেছে।
বিছানায় চোখ পড়তেই একটা চিরকূট দেখতে পেলেন।
“স্যার, মাপ চেয়ে নিচ্ছি বারবার আপনাকে বিব্রত করার জন্য। কলেজে থাকতে ভেবেছিলাম এ হয়তো ক্ষণিকের মোহ, কেটে যাবে কয়দিন পরে। বিশ্বাস করুন স্যার সেই দশ বছর আগের মোহ এখনো কাটে নি। হাজারো অনুভূতির এই গভীর সংমিশ্রণকে কি মোহ বলা যায়? এটাই হয়তো ভালবাসা! আজ রাতে ভরা পূর্ণিমা। অনেকবছর আগে আমাদের নদীর ধারের ভাঙ্গা স্কুলঘরের দেয়ালে বসে জ্যোছনা দেখতে যেতাম একা একা। আজও যাবো। অনেকদিন পর। আপনি আসবেন? “
নীলাভ সাহেবের বুকে চিনচিনে ব্যথা করছে। ঠিক তারই বিয়ে না করার কারণগুলো নিয়ে আরো একজন বেঁচে আছে। সে আজ হাতছানি দিয়ে তাকেই ডাকছে। নীলাভ সাহেব বুঝতে পারছেন না কী করবেন।
সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত হতে চললো। পূব-আকাশের লালচে চাঁদ হলুদ হয়ে যাচ্ছে একপাশ থেকে। নীলাভ সাহেবের সামান্য ভয় করছে কোনো কারণে। যদিও ভাঙ্গা স্কুলঘরটার দিকে কেউ আসে না সন্ধ্যার পর। তার হাতে একটি কবিতার বই। এই ভরা জ্যোছনায় দুয়েকটা কবিতা পাঠ আর হয়তো দুয়েকটা গান হতেই পারে। দিব্যেন্দুর গলাটা চমৎকার সুন্দর।
………………………………………………
স্বীকারোক্তিঃ লেখাটি অমিতাভ সরকারের “অসামাজিক ভালবাসা”গল্পের দুইমাত্র চরিত্র নীলাভ ও দিব্যেন্দুকে নিয়ে লেখা। বাস্তবে না হোক গল্পে অন্তত হ্যাপি এন্ডিং থাক!
উৎস: রুপবান ব্লগ