
নগরবালক
বাংলাদেশের বৈচিত্রময় লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের মানুষগুলোর জন্য ২৫ এপ্রিল একটি আতঙ্কের নাম। তিন বছরের বেশি সময় আগে ওই দিনে নৃশংস ভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয় বাংলাদেশের প্রথম সমকামী ম্যাগাজিন ‘রূপবান’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব রাব্বী তনয়কে। তারপর বিচারহীনতার দীর্ঘ ৩ বছর অতিবাহিত হলো। এই দীর্ঘ সময় আক্ষরিক অর্থে মুখ থুবড়ে পড়েছে বৈচিত্রময় লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের মানুষগুলোর স্বাভাবিক জীবনব্যবস্থা। অনিশ্চয়তার মাঝে একটি একটি দিন পার করছে এই সম্প্রদায়ের মানুষগুলো।
পাশ্ববর্তী দেশ ভারত যখন ৩৭৭ ধারা অসাংবিধানিক ঘোষিত হবার উৎসব পালন করছে। এই ‘প্রাইড মান্থ’-এ ভুটানেও সমকামীতাকে ফৌজদারী অপরাধ তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়ে, তখন ইসলামিক উগ্রবাদী সংগঠন হেফাজতে ইসলাম সমর্থিত বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারে ক্ষমতাসীন অবস্থায় বাংলাদেশের বৈচিত্রময় লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের মানুষগুলো আক্ষরিক অর্থেই উৎকন্ঠা ও আতঙ্কের মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করছেন। যারা সামর্থ্যবান তাদের সিংহভাগই পাড়ি জমাচ্ছেন বিদেশে; আর যারা এই সম্প্রদায়ের মানুষদের সক্ষমতা নির্মান বৃদ্ধি নিয়ে কাজ করতেন, তারাও সরকারী চাপ, উগ্রবাদীদের ভয়ে তাদের কাজ থেকে নিবৃত হতে বাধ্য হয়েছেন ইতোমধ্যেই। এই বাস্তবতাকে মাথায় রেখেই পাঠকরা আমার লেখা পড়বেন।
এই লেখাটিতে আমি মূলত বাংলাদেশের বৈচিত্রময় লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের মানুষগুলোর নানাবিধ সমস্যা নিয়ে দুটি খন্ডে আলোচনার সূত্রপাত করবো মাত্র। পাঠকরা পাঠ করার সময় মনে রাখবেন এই লেখায় সমস্যা থেকে উত্তরণের কোনো সামাধান পাবেন না। তবে দুটি খন্ডের শেষ খন্ডে আমি এমন একটি অস্তিত্ব বা সত্ত্বা তৈরির রূপরেখা দিবো, যে সত্ত্বা এই নিরূপীত সমস্যা গুলো থেকে উত্তরণের জন্য করণীয় নির্ধারণ করবেন এবং নতুন।
বৈচিত্রময় লৈঙ্গিক ও যৌন পরিচয় ভুক্ত সম্প্রদায়ের সক্ষমতা নির্মাণ ও বৃদ্ধি।
বাংলাদেশের মূলধারার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের একটি সাধারণ সমস্যা হলো অর্থনৈতিক দূর্বলতা। এই দূর্বলতা যে কেবল নিন্মবিত্তরাই অনুভব করেন এমনটা নয়। ১৪ এপ্রিল ২০১৯ এ প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক রিপোর্ট অনুসারে বর্তমান সরকারের আমলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপর করা সমীক্ষায় জানা যায়, বাংলাদেশে অতিধনীর সংখ্যা বেড়েছে আশংকাজনক হারে, এবং আয় কমেছে দেশের মধ্যবিত্ত ও নিন্মবিত্তের মানুষ গুলোর। আর এই বাস্তবতা থেকে বৈচিত্রময় লৈঙ্গিক পরিচয়ের মানুষ গুলো বাদ যাবে এমন ভাবনা নিশ্চয় কেউ ভাবছেন না! সেই বাস্তবতায় এই জনগোষ্ঠীর বর্তমানে যে জিনিস সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হলো সম্প্রদায়ভূক্ত মানুষগুলোর সক্ষমতা নির্মান ও বৃদ্ধি।
এই ক্ষেত্রে প্রথমেই প্রশ্ন আসে, কী ধরনের সক্ষমতা বৃদ্ধি বা নির্মাণ করা প্রয়োজন সম্প্রদায়ভূক্ত মানুষদের জন্য? কি ধরণের সক্ষমতা বৃদ্ধি বা নির্মাণ প্রয়োজন তা জানতে হলে প্রয়োজন সম্প্রদায়ভূক্ত জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানো এবং তাদের কাছেই প্রশ্ন রাখা তাদের কি ধরনের সহায়তা প্রয়োজন। তবে যেটা অনুমান করে বলতে পারি যে, ক্যাপাসিটি বিল্ডিং এর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো
০১. নিজের লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়কে বাংলাদেশের বাস্তবতায় অক্ষুন্ন রেখে কিভাবে পরিবারে, কর্মক্ষেত্রে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সর্বপরী সামাজিক পরিমন্ডলে নিজেকে সুরক্ষিত রাখা যায়?
০২. অর্থনৈতিক যে দুবর্লতা আছে তা থেকে কিভাবে উত্তরণ করা যায়, এবং;
০৩. বাংলাদেশের মতো দেশে কিভাবে বৈচিত্রময় লৈঙ্গিক ও যৌন পরিচয়ের মানুষ গুলো তাদের উপস্থিত জানান দিতে পারে?
এই ৩টি বিষয়কে মাথায় রেখে আমাদের ভাবতে হবে সক্ষমতা নির্মাণ ও বৃদ্ধির বিষয়ে। আমাদের মনে রাখা উচিত অর্থনৈতিক দুবর্লতাকে ডান পাশে রেখে বাম পাশে ফিরে আপনি কোনো কাজই মনোযোগ দিয়ে করতে পারবেন না। অন্য দিকে বাংলাদেশে বৈচিত্রময় লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের মানুষ, তথাকথিত সাধারন জনগোষ্ঠীর সাথেই যুগের পর যুগ থেকে সহ অবস্থান করছে এই ধ্রুব সত্যকে সমাজের মানুষ গুলোর কাছে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে, বৈচিত্রময় লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের মানুষ গুলোর প্রাথমিক গ্রহনযোগ্য সামাজিক ভাবে তৈরি হবে না, এবং সমাজে এই বিষয়টি গ্রহনযোগ্য না হোক অন্তত সহনশীল তৈরি করা না গেলে, একজন সম্প্রদায়ভূক্ত মানুষ কখনোই তার নিজেকে পরিবার তথা নিজমন্ডলে প্রকাশ করতে সাহস পাবে না।
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা
পরনির্ভরশীলতা আমাদের একটা জাতিগত সমস্যা। এই সমস্যা থেকে সর্বাগ্রে উত্তরণ ঘটাতে হবে, কেবল মাত্র উক্ত সম্প্রদায়ভূক্ত মানুষদের জন্য নয় সমগ্র বাংলাদেশি জাতিকে এটা বোঝানো এখন জরুরী যে পরনির্ভরশীল মানুষ কখনো সৃষ্টি করতে পারে না, আর যে জাতি সৃষ্টিশীল না, তারা হয় কালের পরিক্রমায় মুছে যায়, নয়তো কোনো সৃষ্টিশীল জাতির গোলামী করে।
যারা উক্ত সম্প্রদায়ের সক্ষমতা নির্মাণ ও বৃদ্ধিতে ইতোমধ্যেই কাজ করছেন, তাদের উচিত এই সম্প্রদায়ভূক্ত মানুষগুলো অর্থনৈতিক সক্ষমতার জন্য আপনাদের সর্বাগ্রে কাজ করা উচিত। এবং ব্যক্তির যোগ্যতা ভেদের তাদের জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্রটি বাছাই করা উচিত। এই সম্প্রদায় ভূক্ত মানুষ গুলোকে নিয়ে আপনি যে কোনো এক্টিভিজম পরিচালনার পূর্ব আগে নিশ্চিত করা প্রয়োজন যে এক্টিভিজমের সাথে জড়িতদের স্থিতিশীল জীবন। তবে সমস্যা হচ্ছে বৈচিত্রময় লৈঙ্গিক ও যৌন পরিচয়ের মানুষগুলোকে নিয়ে যারা কাজ করেন, বিশেষতঃ যারা এলজিবিটি কমিউনিটি নিয়ে কাজ করেন, তারা এই সম্প্রদায়ের মানুষগুলোকে নিয়ে সেচ্ছাসেবী সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে চান, এবং প্রায়শঃ নেতৃস্থানীয়দের থেকে একটা অভিযোগ শুনতে পাওয়া যায় যে, “সেচ্ছাসেবী যারা, তারা অঙ্গীকারাবদ্ধ না, তারা অন্য কোথাও সুবিধা পেলে তাদের দায়িত্ব থেকে তারা পাশকাটিয়ে যায়”। আবার কেউ বা অভিযোগ করেন, “শুধু মাত্র অর্থনৈতিক লাভের প্রতি সেচ্ছাসেবীরা অধিক আগ্রহী”। কিন্তু আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ নিয়ে আপনারা কাজ করছেন, যার নিজের কোনো আর্থিক সংগতি নেই, এবং যদি থাকেও তাও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল, এই বাস্তবতায় যারা আপনাদের সেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছে, তারা তাদের অর্থনৈতিক সংগতি বৃদ্ধির প্রতি আগ্রহ বেশি থাকবে সেটাই স্বাভাবিক নয় কি?
হয়তো যারা অনেক বছর কাজ করছেন তারা বলতে পারেন, আপনাদের সময় আপনারা কাজ করে এসেছেন। সে ক্ষেত্রে আমি বিনীত অনুরোধ করবো, দয়াকরে ২০১৯-এর বাংলাদেশ আর ১৯৮৯ এর বাংলাদেশকে মিলিয়ে ফেলবেন না যেন, বর্তমানে ঢাকা বিশ্বের অন্যতম ব্যায়বহুল একটি নগরী, সম্ভবত এশিয়াতে, মুম্বাই ও দিল্লীর পরে ঢাকাই তৃতীয় ব্যায়বহুল নগরী। সেখানে একজন অস্থীতিশীল মানুস সেচ্ছাশ্রম দিবে কোনো প্রকার সুবিধা না নিয়ে এমন ভাবাটা অনুচিত। তাই দক্ষতা নির্মান ও বৃদ্ধির ক্ষেত্রে, সর্বোপরী সম্প্রদায়ের অধিকার আদায়ের সাথে সর্ম্পকিত সংগঠ গুলোর সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে আগে সেচ্ছাসেবকদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীল একটি অবস্থান নিশ্চিত করা বাঞ্চনীয়। এই ক্ষেত্রে কেবল শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে নিয়ে ভাবলে হবে না, শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত ও নিরক্ষর সব পর্যায়ের মানুষের জন্য আলাদা আলাদা পরিকল্পনা করা উচিত।
সংগঠকরা হয়তো ভাবতে পারেন যে কারো অর্থনৈতিক উন্নতি আমাদের মূললক্ষ্য নয়। আলবাৎ সেটা আপনাদের মূললক্ষ্য নয়, কিন্তু আপনাদের মূললক্ষ্যে পৌছাতে গেলে, অনেক গুলো ধাপ আপনাদের পার হতে হবে, এবং সম্প্রদায় ভূক্ত মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। আপনারা চাইলে আজকে একজনকে দিয়ে, আগামী কালকে অন্যজন কে দিয়ে আপনাদের কাজ গুলো করাতে পারনে, কিন্তু তাতে কোনো দীর্ঘমেয়াদী ফল আসতে বেশ দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু যদি ধারাবাহিক ভাবে কিছু দক্ষমানুষকে দিয়ে নিরবিছিন্ন ভাবে কাজ করানো যায়, তবে সেই কাজের ফল হবে, দ্রুত সময়ের মাঝে, উত্তম একটি ফল।
আপদকালীন নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র
কিছুদিন আগে একজন আমাকে ফোন দিয়ে জানালো তার কাছে একজন সমকামী তরুণ এসেছে। যে বড় হয়েছে তার পালক পিতা-মাতার কাছে, ছেলেটার বয়স হবে ১৯/২০, তার প্রতিপালক অভিভাবক যখন জানতে পারলো ছেলেটি সমকামী, তাকে তার বাসা থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। তিনি জানতে চাইছিলেন এমন কি কোনো আশ্রয়কেন্দ্র আছে বাংলাদেশে এলজিবিটি কমিউনিটির যারা ছেলেটাকে আশ্রয় দিবে? কিংবা এমন কোনো আইন আছে যাতে ওই ছেলেকে তার পালক পিতা-মাতা ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। প্রথম কথা হলো ইসলামিক আইনে দত্তক নেয়ার কনসেপ্টটাই গ্রহনযোগ্য না তাই আইনগত ভাবে ভিক্টিমের প্রতিপালক অভিভাবককে বাধ্য করার কোনো উপায় নেই। দ্বিতীয়ত, আমার জানা মতে এলজিবিটি সংগঠনগুলো এমন কোনো ব্যবস্থা নেই যে আপদকালীন সময়ের জন্য কোনো সাহায্য প্রার্থীকে শেল্টার দিবে। যেটা আছে, সেটা হলো কোনো বিত্তবান,মধ্যবয়স্ক বা পৌঢ় কোনো মানুষের যদি ছেলেটাকে মনে ধরে, তবে তাকে শেল্টার দিতেও পারে, কিন্তু তার জন্য আশ্রয়প্রার্থী ছেলেটার কি করতে হবে তার ব্যাখ্যায় আর নাইবা গেলাম।
এই পয়েন্টে এসে আমার প্রশ্ন হলো আজ অব্দি বাংলাদেশে যারা ক্যাপাসিটি বিল্ডিং নিয়ে নিয়ে কাজ করেছেন তারা কখনো কি এই জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক সক্ষমতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করেছেন? এবং এমন কি কোনো প্লাটফর্ম আপনারা তৈরি করেছেন বা এমন কারো সাথে কোলাবরেশন করেছেন যে, এই কমিউনিটির কোনো মানুষ যখন আপদকালীন সময় অতিবাহিত করবে তখন তাকে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও শেল্টার দিতে পারবেন? আমি জানি আমি এমন প্রশ্ন তোলাটা অনেকটা অবিবেচকের মতো, কারণ আমি নিজেও জানি বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় এমন কিছু করা আপনাদের জন্য অবশ্যই অসম্ভব। কিন্তু যখন আপনারা আনুপাতিক হারে সুবিধাজনক সময়ে আপনাদের এক্টিভিজমের সময় অতিবাহিত করছিলেন তখনও আপনার এমন কোনো উদ্যোগ নেয়া তো দূরের কথা এমন কিছু নিয়ে ভেবেও দেখেন নি!
বর্তমানে সবচেয়ে অসহিষ্ণু একটি সমাজে বৈচিত্রময় লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের মানুষরা অবস্থান করছে। বাংলাদেশে ভিন্নমতকে কোনো ভাবেই গ্রহন করছে না সরকার ও ধর্মীসংগঠন গুলো। সেই প্রেক্ষাপটে কোনো একজন অধিকারকর্মী কিংবা সম্প্রদায়ভূক্ত মানুষ যদি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে তাদের নিরাপত্তা দেয়ার মতো কেউ নেই। একজন নারীবাদী পুলিশের শেল্টার পাবে, একজন রাজনৈতিক নেতা, পরিবেশবাদীরাও রাষ্ট্রীয় সহায়তা পেতে পারে। কিন্তু একজন বৈচিত্রময় লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের অধিকারকর্মীতো দূরের কথা এই পরিচয়ের একজন মানুষ রাষ্ট্র-সমাজ কারো কাছে নিরাপত্তা পাবে না। তাই সম্প্রদায়ভূক্ত জনগোষ্ঠীর জন্য সল্প পরিসরে হলেও একটা শেল্টার হোম থাকা বাংলাদেশের বাস্তবতায় এখন সময়ের দাবী।
তবে, উল্লেখ্য বৈচিত্রময় লৈঙ্গিক পরিচয়ের মানুষ গুলোর মাঝে একটি বিষয় প্রসংশার দাবি রাখে, কোনো দক্ষ বা যোগ্যতা সম্পন্ন সদস্য কমিউনিটির মধ্যে থাকলে, কমিউনিটির যোগ্য মানুষ গুলো সেই দক্ষ মানুষটির কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় যা করণীয় তা করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু আমি বলছি অদক্ষ যারা তাদের কথা।
শ্রেণী বৈষম্য
এটা বেশ মোটাদাগের ইস্যু, যা নিয়ে কখনোই সম্প্রদায়ভূক্ত মানুষেরা কথা বলেনা, কিংবা হয়তো তারা বোঝোই না যে শ্রেণী বৈষম্য বিষয়টি এই সম্প্রদায়ভূক্ত মানুষগুলোর মাঝেও সমাজের আর দশজন মানুষের মতো প্রবল ভাবে বিদ্যমান। এটা কোনো অস্বভাবিক ইস্যু না, তবে এটা সম্বন্নিত ভাবে সকাল শ্রেণী-পেশার মানুষ গুলোকে নিয়ে অভিন্ন একটি লক্ষ্যে পৌছানোর একটি অন্যতম প্রধান অন্তরায়। আমি বেশি দূরে যাবো না, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম নিয়ে কথা বলি। আমাদের জাতি যখন স্বাধীনতার যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলো, তখন কিন্তু দল-মত-শ্রেণী-বয়স-শিক্ষা-দীক্ষা সবকিছুকে মিলে মিশে একটি অভিন্ন শ্রেণীতে রূপন্তরিত হয়েছিলো। সেখানে রুমীর মতো সোনার চামচ মুখে নেয়া যোদ্ধা যেমন ছিলো, ছিলো গ্রামের অশিক্ষিত কৃষক ইমান আলী, ছিলো আদিবাসী নারী যোদ্ধা প্রিঞ্ছা, ছিলো বিরপ্রতীক তারামন বিবিও। সবাই মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলো, ভূখন্ড রক্ষার লড়াইয়ে।
কিন্তু বাংলাদেশের বৈচিতময় লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের মানুষেরা কি তাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন কিংবা এক্টিভিজমে এমন একাত্মহতে পারছে? মোটেই পারছেনা। একটু বিস্তারিতই বলবো। ধরুন একটি আয়োজন করা হয়েছে কোনো ঢাকা শহরের উন্নত কোনো একটি স্থানে, ধরুন আয়োজনটা হলো কোনো কর্মশালা, মনে করুন কর্মশালার বিষয় নিরপত্তা ও সুরক্ষা বিষয়ক, সেখানে প্রশিক্ষক প্রশিক্ষন দিচ্ছেন ইংরেজিতে, কর্মশালার শিডিউলের নাস্তার বিরতির জায়গায় আপনি নাস্তার বিরত না লিখে, ল্যাটিন ভাষায় লিখে রাখলেন প্রানডিউম সাবসিস্ট। প্রশিক্ষানার্থীদের জন্য রাতের খাবারে তাদের জন্য ভাতের ব্যবস্থা না করে করলেন সালাদ, স্ন্যাক্স আর হার্ডডিংক্সের। আর সেই আয়োজনে অংশ নেয়ার জন্য ধরে নিচ্ছি আনা হয়েছে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের, এবং মনে করুন তারা সরকারী ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। কি মনে হয় পাঠক এই আয়োজন সবাই সমান ভাবে অংশ নিতে পারবে? কখনোই তা সম্ভব নয়। বরং যে ছেলেটা প্রান্তিক পর্যায়ের মেধার জোরে পড়াশোনা করে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের চান্স পেচে, সে বড়জোর আপনার ইংলিশ ল্যাটিন ভাষাটা গ্রহন করতে পারবে, কিন্তু আয়োজনের বাকি অংশগুলো থেকে সে বিছিন্ন হয়ে পড়েব এবং নিজেকে আলাদা অনুভব করে, এক্টিভজমের সাথে জড়াতেই কুন্ঠাবোধ করবে। এটাকে হয়তো অনেকেই শ্রেণী বৈষম্য বলে মনেই করবেন না। যদি তেমনটা করেন তবে তা খুউব অন্যায়। আয়োজন এবং এক্টিভিজম হতে হবে এমন সাধারন জায়গা থেকে, যেখান থেকে সর্বনিন্ম অভিজ্ঞ মানুষটিও নিজেকে সমান ভাবে বাকিদের মত সম্পৃক্ত করতে পারবে। মনে রাখবেন অসমতার জায়গা থেকেই জন্মনেয় বৈষম্য।
এক্টিভিজম করার ক্ষেত্রেও এমন বিষয় গুলো নিয়ে কাজ করা অনুচিত যার সাথে অন্তত একটি নূন্যতম সংখ্যাক সম্প্রদায়ের সদস্যরা নিজেদের অন্তর্ভূক্ত করতে পাবরে না। যেকেউ বলতেই পারেন কাজ হোক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাবে সবাই সব কিছুতে অংশ নিবে এমন তো হয়না। সে ক্ষেত্রে আমি বলবো সুদীর্ঘ সময় এমন উচ্চমার্গীয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাজ হচ্ছে, এবার সাধারণের কাতারে নেমে কাজ করুন। উচ্চমার্গীয় কাজ রাখুন যেমন বিষয়বস্তু বাংলাদেশ ক্রিকেটের মতো সব ধারার মানুষকে আনন্দ-বিনোদন-উত্তেজনা-আশা-সপ্ন দিতে পারবে, তেমন বিষয়বস্তু নিয়ে কাজ করতে হবে।
প্রথমখন্ড এখানেই সমাপ্ত করছি, পরবর্তী খন্ডে অধিকার আদায়ের আন্দোলনের বাকি বাঁধাগুলো কি, সেগুলো দূরীকরনে করনীয়, এবং কি কি বিষয় বর্জন করা প্রয়োজন তা নিয়ে লেখার চেষ্টা করবো, পরবর্তী লেখা পড়ার আমন্ত্রণ রইলো।
উৎস:রূপবান ব্লগ