নিরাপত্তাহীন এই সমকামী প্রাইডের প্রয়োজন কার?

নীলয় নীল

নিরাপত্তাহীন এই সমকামী প্রাইডের প্রয়োজন কার ?

“বাংলাদেশে সমকামীদের আন্দোলন এবং গৌরব পদযাত্রা” নামে একটি প্রাইডের আয়োজনের কথা জানতে পারি ১৩ জুনে । আরও সঠিকভাবে জানার জন্য সেই ইভেন্টের লিঙ্কে গিয়ে জানতে পারলাম ২৮ জুন ২০১৯ ইং তারিখে TSC তে এই প্রাইডের আয়োজন করা হচ্ছে । আর এই প্রাইডের আয়োজক হচ্ছেন শাম্মী হক নামে জার্মান প্রবাসী এক নারী সাংবাদিক । ওনাকে আমরা তেমন কেউ চিনতাম না । কারণ এই নামে এর আগে কেউ সমকামী জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কাজ করেছেন বলে আমার জানা নাই এবং এই প্রাইডের আয়োজন নিয়েও কেউ বিস্তারিত কিছু জানেন না । সমকামীদের জনগোষ্ঠীকে নিয়ে দীর্ঘ দিন কাজ করেছেন এরকম কয়েকজন সমকামী অধিকার কর্মীদের সাথে কথা বলে “এই প্রাইড করা ঠিক হবে কি না ” এই মর্মে পাঁচটি গ্রুপে মতামত জরিপ করে সম্মিলিত সিদ্ধান্তে দেখা সবাই এই প্রাইডই আয়োজনের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। এর অনেকগুলো কারণের মধ্যে মূল কারণগুলো তুলে ধরছি:

১.নিরাপত্তাহীনতা : বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের মতো একটি রক্ষণশীল পরিবেশে এভাবে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে প্রাইড করা যে একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত এ নিয়ে প্রকৃত কোন সমকামী অধিকার কর্মীর দ্বিমত নেই । ঘরের মধ্যে কিংবা নিরাপদ কোন দেশে অবস্থানকারী তথাকথিত কিছু অ্যাক্টিভিস্টদের স্বপ্নের জোয়ারে ভেসে বাংলাদেশের TSC চত্বরকে সমকামীদের জন্য নিরাপদ ভাবতে পারেন । কিন্তু প্রকৃত সত্য এটাই যে একশত জন সমকামী সেখানে উপস্থিত হলেও জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী এবং পুলিশ মিলে এক জনকেও ঘরে ফিরতে দেবে না । চাপাতির কোপ খেয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে নয়ত সারা জীবন জেলে বসে কাঁটাতে হবে ।

২. ফলাফল হীনতা : নিরাপত্তা হীনতা নিয়েও এই প্রাইড করা হলে এ থেকে কি ফলাফল পাওয়া যাবে তা ভেবে দেখা হলে এই প্রাইডকে বর্তমান সময়ে অপ্রয়োজনীয় মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক । ২০১৫ সালের প্রাইড এবং ২০১৬ সালের প্রাইড আয়োজনের চেষ্টা আমাদেরকে কিছু দিয়েছে কিনা জানি না তবে বিশাল কিছু যে কেঁড়ে নিয়েছে এ নিয়ে সবাই একমত । জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব রাব্বি তনয় এর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সমকামী সম্প্রদায়কে কতটা পিছিয়ে দিয়েছে তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না । কোন রকম ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আমরা আর পিছিয়ে যেতে চাই না । কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমরা প্রাইড করতে চাই না কিংবা অধিকার চাই না । প্রাইড কিংবা কাঙ্ক্ষিত অধিকার আদায়ের জন্য প্রয়োজন ব্যাপক প্রস্তুতি । সদ্য ভূমিষ্ঠ একটি শিশুকে একদিনের মধ্যে বড় করার জন্য অতিরিক্ত খাবার খাওয়ানো যেমন সেই শিশুর জন্য মঙ্গলজনক নয় তেমনি ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে সদ্য উঠে দাঁড়ানো একটি দুর্বল গোষ্ঠীকে রাতা-রাতি অধিকার আদায়ের নামে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া কখনই মঙ্গলজনক নয় ।

বর্তমান সময়ে আমাদের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কাজ হচ্ছে সংঘবদ্ধ একটি জনশক্তি গড়ে তোলা । শুধু সমকামী নয় বরং বিষমকামীদেরও আমাদের পাশে দাড় করানো । সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মন থেকে সমকামী বিদ্বেষী মনোভাব দূর করিয়ে সমকামী জনগোষ্ঠীর প্রতি সহানুভূতিশীল করে তোলা । আর এই লক্ষ্যে আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি । আমাদের এসব কাজের মাধ্যমেই হয়ত স্টোনওয়াল রায়ট এর মতো যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটানো সম্ভব । কিন্তু এসব হচ্ছে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা । তাই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌছাতে হলে সময়ের প্রয়োজন । এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া কিংবা রাতা-রাতি আলোচিত হয়ে ওঠা সম্ভব নয় । আর আমাদের লক্ষ্যও এটা নয়।

৩.আয়োজকের অদূরদর্শিতা : ইভেন্টের দাবি সমূহে সরকার এবং মৌলবাদী গোষ্ঠীকে বিরোধী পক্ষে রাখা হলেও এই দুই দলের কাছ থেকে নিরাপত্তার ব্যাপারে আয়োজকের অগ্রিম কোন প্রস্তুতি ছিল না । যা কিছু মাধ্যম দ্বারা জানতে পারি । আয়োজনে আগত সমকামীদের নেতৃত্ব উনি দেবেন নাকি কাউকে পাঠাবেন সে সম্পর্কেও কোন যথাযথ উত্তর পাওয়া যায় নি । জুলহাজ মান্নান সহ কয়েকজন ২০১৫ সালেই প্রাইডে নিজেরা উপস্থিত থেকে সব কিছু পরিচালনা করেছিলেন এবং ২০১৬ সালে পুলিশী বাধার দায়ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন । তার পরেও জঙ্গিগোষ্ঠীর হাতে নিজের জীবন হারিয়েছেন । কিন্তু এই প্রাইডের আয়োজক শাম্মী হক নিজেই প্রাইডে উপস্থিত থাকবেন না তা স্পষ্ট ছিল । বেশ কয়েক দিন ইভেন্টের আমন্ত্রণ তালিকা ছিল উন্মুক্ত । যেখান থেকে সবার তথ্য সংগ্রহ করা জঙ্গি এবং পুলিশ দুই দলের জন্য বেশ সুবিধাজনক ছিল । অথচ এসব ব্যাপারে আমাদের দেশের সমকামীরা জানতেই পারবেন না । কারণ ডিজিটাল নিরাপত্তা নিয়ে কোন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার সুযোগ সবাই পায় নি । কেউ গ্রেফতার কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত হলে এগিয়ে আসার মতো বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত কোন প্রতিষ্ঠান নাই এটা আমি ভাল করেই জানি । এমনকি কেউ হয়ত গা বাঁচানোর জন্য টু শব্দটিও করবে না । উপরোক্ত কারণগুলো বিবেচনা করে নব প্রভাত, অবয়ব, রূপবান, এবং মুক্ত আকাশ, নামক পাঁচটি গ্রুপের পক্ষ থেকে একজন প্রতিনিধির মাধ্যমে শাম্মী হককে এই প্রাইড স্থগিত করতে বলা হয় । কিন্তু উনি এটাকে ব্যক্তি স্বাধীনতা বলে স্থগিত না করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন । একটি জনগোষ্ঠীর ভাল-মন্দ কিভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা হতে পারে তা আমার এখনও বোধগম্য নয় । আমাদের সিদ্ধান্ত জানানোর এক দিন পর উনি এটাকে ভার্চুয়াল প্রাইড করার ঘোষণা দেন । যে কারণেই এই ঘোষণা দিয়ে থাকুন, তবে এই ঘোষণা আমাদের উদ্বেগকে কিছুটা হলেও প্রশমিত করেছে । কিন্তু কারও কোন পরামর্শ ছাড়াই কেন এবং কাদের স্বার্থে এরকম একটি কার্যক্রমের সিদ্ধান্ত নিলেন তা আমরা ভাবতে বাধ্য হচ্ছি । শাম্মী হক দাবি করেন যে এই প্রাইডের মাধ্যমে সমকামিতা বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে । কিন্তু বাস্তবে বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রুপ, পত্রিকা এবং পেজে এই প্রাইডকে কেন্দ্র করে যেভাবে সমকামী বিদ্বেষ ছড়িয়ে যাচ্ছে তা দেখে বলতেই হয় এরকম আলোচনা হওয়ার চেয়ে না হওয়াই বরং মঙ্গল । এদেশে তথাকথিত হুজুররা রস-কস দিয়ে মিথ্যা বললেও আমজনতা তাই গিলবে । তাই বর্তমান সময়ে আমরা সমকামী বিদ্বেষী তথাকথিত সেই হুজুরদের এই সুযোগ দিতে চাই না । আমরা সবাইকে নিয়ে একটি শক্তিশালী স্বনির্ভর মানবতাবাদী সম্প্রদায় গড়ে তুলতে চাই। তাই প্রকৃত অর্থে সমকামীদের জন্য কিছু করতে চাই শুধু মাত্র নিজ স্বার্থের জন্য নয় বরং সবার ভাল-মন্দ বিবেচনা করে করার জন্য সবিনয় অনুরোধ জানাচ্ছি। (দ্বিতীয় পর্বে ইস্টিশন ব্লগে প্রকাশিত শাম্মী হক এর লেখা নিয়ে আলোচনা করা হবে। )

নীলয় নীল একজন এলজিবিটি+ অ্যাক্টিভিস্ট এবং এলজিবিটি+ সংগঠন ‘নবপ্রভাত’ এর প্রতিষ্ঠাতা

উৎস: রূপবান ব্লগ

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.