লেখকঃ নিরালোকে দিব্যরথ
বিয়ের বছর কয়েকের মধ্যে রসকষ যা ছিল সব শেষ হয়ে সিত বর্ণ ধারণ করল পদ্মাবতী-বাহার দম্পতির জীবনে। অথচ পদ্মাবতীর এই পৌরণিক নামটি একসময় বাহারই দিয়েছিল। তাদের জীবনে কোনও খলজির উপস্থিতিও ছিল না। তারপরও বাহার মনে করেছিল এই সোনাবরণ পদ্মাবতীকে নিয়ে সে বিভিন্ন মহলে ঈর্ষার পাত্র হবে।
তেমন কিছু ঘটার পরিবর্তে নিজেই পদ্মাবতীকে কেবল ভালবাসতে পারল না বাহার। এক পর্যায়ে এমন হল যে একই ঘরে একই বিছানায় শুলেও স্বামীর মনের ব্যক্তিগত রাজ্যে অধিকার বলতে কিছু রইল না সোনালি গড়নের মেয়েটির।
এদিকে কোনও এক স্বাভাবিক বা বিচিত্র কারণে তালাকনামা পাঠানোর কথা মাথায় আনল না বাহার। হয়ত পারিপার্শ্বিক ভূমিকম্প সে এড়িয়ে চলতে চেয়েছে; হয়ত সন্তানের দিকে তাকিয়ে ‘ব্রোকেন ফেমিলি’ শব্দটি এড়াতে! হয়ত!
বাহারের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কথোপকথন শুরু হল এক আগন্তুকের। কথা। প্রকৃত নামধাম, ছবি কিচ্ছু নেই। চ্যাটে শুধু মেয়েটির কথার প্রেমে পড়ল বাহার; আগন্তুক মেয়েটির রূপের বাহার জানতে বিতৃষ্ণ হল না। পদ্মাবতীর প্রতি তার স্বামীর ‘নেগেটিভ রোল’ দেখে যারা ধরে নিয়েছেন- স্বামী একজন পুরুষতান্ত্রবাদী বুদ্ধিহীন পশু- ভুলের রাজ্যে আছেন তারা। এমনও হতে পারে যে স্ত্রীর ‘পিঞ্চ’ এমন বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছেছে- তাতে বাহারের ভেতরে সহানুভূতিপ্রবণ হৃদয়টি হতে পারেনি বিকশিত; মাংস কচলালে সিঁটে। বাইরে বাইরে সে নারীসঙ্গ ধুমসে উপভোগ করছে এমনও নয়। নারীর প্রতিই সে বিতৃষ্ণ হয়ে থাকবে।
এমন সময় চ্যাটের অপরিচিতার জন্য একটা মায়া কাজ করল বাহারের। আকর্ষণ বলা যেতো পারে। এই মেয়ে তার স্ত্রীর চেয়ে আলাদা। অন্যান্য টিপিক্যাল মেয়ের মত নয়। কিন্তু দেখা করার সাহস বাহার পায়নি। পাছে এই সুন্দর কাল্পনিক নায়িকার সাথে বাস্তবের মেয়েটির ১%ও অমিল চোখে পড়ে- নিস্পৃহতা গ্রাস করবে তাকে। চ্যাটের এই মোহিনী সময়গুলোতে সে তার দাম্পত্যখরা কিছুটা পুষিয়ে নিচ্ছে। দার্শনিক ব্যাপার স্যাপার।
বাহার হঠাৎ লক্ষ্য করল – পদ্মাবতীর ঝগড়া-দা-কুমড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে; প্রায় বাহারের মতই উদাসীন সে এখন। ভুল করে হলেও যদি স্বামী কোনও ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে ফেলে- পদ্মাবতী জানায়- উত্তর দিতে সে বাধ্য নয়। ভেতরে ভেতরে খুশি হতে চাইলেও কোথাও একটা খটকা লাগল বাহারের। কিন্তু অনাহূত চিন্তা জোর করে সে মাথা থেকে ঝেরে ফেলল। যেমন আছে চলুক- এমনটাই তো সে চেয়েছি্ল।
চ্যাটের অপরিচিতা এর মধ্যে একদিন বাহারের খুবই গোপন একটি শারীরিক স্থানের বিশেষ চিহ্নের কথা উল্লেখ করে হতভম্ব করে দিল বাহারকে। স্ত্রীর আগে সে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে দুটি মাত্র মেয়ের সঙ্গে, তাও মাত্র একবার করে; তাদের মধ্যে একজন এই চ্যাটের মেয়েটি? বিশ্বাস করতে গিয়ে নিজের চোখে ধূসর দেখল বাহার।
পদ্মাবতী আরেকজনের প্রেমে পড়েছে- এরকম একটি ব্যক্তিগত তথ্য হুট করে জানিয়ে বসল স্বামীকে। এবং জানাল বাহার চাইলে ডিভোর্স নিতে পারে; সে জোর অনুরোধ করবে না। পদ্মাবতী সিদ্ধান্ত স্বামীর হাতে ছেড়ে দিল।
এরকম অদ্ভুত আবদার শুনে কিছু বুঝল না বাহার। তবে কে সেই আরেকজন তাও জানতে চাইল না; কারণ সম্পর্কটা আর ইন্টারফেয়ারের নয়। পাছে আবার অনধিকারচর্চার নিজের তত্ত্বটাই না আবার তার দিকে ধেয়ে আসে।
তবু জানতে ইচ্ছে করছিল; এবং তবু দূরত্ব বজায় রাখছিল; এবং কিছু সময় বাহার চেয়ে নিল দুর্দান্ত সিদ্ধান্তে আসার আগে। বাহারের সামনে এখন দুটি ক্রাইসিস। এক. অপরিচিতা তার কোন্ পরিচিত ললনা- সেই রহস্য প্রকাশ করছে না; জোর করে উত্তর ছিনিয়ে নিতে বাহারেরও ব্যক্তিত্বে বাঁধে। দুই. স্ত্রীকে সে তালাক দিবে বটে; কিন্তু স্ত্রী তালাকের জন্য জোরাজুরি কেন করল না সেই প্রশ্নের উত্তর বের করা।
তার বিয়ের আগে তারই সঙ্গে দৈহিক সম্পর্কে যাওয়া দুই নারীর উদ্দেশ্যে আবার যেচে যোগাযোগ করল বাহার। একজনের দুটো বাচ্চা আছে; বেশ সুখে আছে স্বামী সন্তান নিয়ে। অন্যজন তাকে পাত্তাই দিল না। কেমন অপমানই করল এক প্রকার। তাহলে চ্যাটের অপরিচিতা এদের দুজনের কেউ নয়? কিন্তু তা কী করে সম্ভব! তার গুপ্তাঙ্গের চিহ্নের খবর কী করে পেল মেয়েটি! এই বলদ দুই নারী কিছুতেই তার নায়িকা হতে পারে না- এসব ভাবতে ভাবতে বাহারের পাগল হবার জোগাড়।
স্ত্রীর ব্যাপারে সে চ্যাটকন্যার কাছেই করনীয় কী জানতে চাইল। ওহ্- চ্যাটকন্যার নাম সে দিয়েছিল ‘বিদ্যা’। পুরুষ বিদ্যা খোঁজে, আর নারী খোঁজে… এই নীতিতে সে বিশ্বাস এনেছিল, অন্তত নিজের ক্ষেত্রে। বিদ্যা তাকে জ্ঞান দেয়ার আগে প্রশ্নটি করল- “আপনার মনে হয় কি আপনার স্ত্রী আপনাকে ভালবাসে?”। বাহার জানাল- “হয়ত সে কারণেই তাকে ছেড়ে দেব, এমন ভাবনা নিমিষে নিয়ে দু পা এগোতে পারছি না। হয়্ত!” বিদ্যা এবার জ্ঞান দিল- “করুণা করে কাউকে টিকিয়ে রাখার ফল আদৌ ভাল হবে কী? বন্ধু হিসেবে এটুকু ধারণা দিতে পারি।”
“তা ঠিক বলেছ”- বাহার বলল- “কিন্তু তুমি আর আমি শুধু বন্ধুই নই; তা তুমি ভাল করেই জান।”
চ্যাটকন্যা ‘Her’ নামে সিনেমার গল্পটি শোনাল। একাকিত্ব কাটাতে সিনেমায় হিরো একটি সফটওয়্যার ইন্সটল করে নেয়। একটা ভয়েসই হয় তার প্রেমিকা। রক্তমাংসের কিছু নয়, একটা ডিভাইস বসিয়ে নারীকণ্ঠের সঙ্গে দিনের পর দিন প্রেম করে যেতে হিরোর এক ফোঁটাও মেকি মনে হয় না। দীর্ঘদিন পর ডিভাইস জানায় মেয়াদ প্রায় শেষের পর্যায়ে। হিরো মেনে নেয়। কিন্তু বেদনায় বুক চিরে যেতে চায় তার। তাই নারীকণ্ঠটিকে সে জানায়- “তোমার কি রক্ত ঝরছে না হৃদয়ে?” কৃত্রিম কণ্ঠটি তাকে সান্ত্বনা দিতেই হয়ত জানায়- “ঝরছে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। তবু আমাকে যেতেই হচ্ছে; মাই ডিয়ার।”
কিন্তু মেশিনের কষ্ট বলতে কিছু যে নেই। সব যে প্রোগ্রাম!
চ্যাটকন্যা বাহারকে জানায়- “আমি কি আপনার কাছে এই যন্ত্রটির মতই না?”
বাহার বলে- “তোমাকে আমি জোর করব না। কিন্তু সামনে আসাটা কি একান্তই অপ্রয়োজনীয়?”
বিদ্যা- “সম্ভব নয়। সম্ভব নয় সামনে আসা। ধর- আমি একটি ডিভাইস, রক্তমাংসের মানুষের চেয়ে নিখুঁত। পারফেক্ট। আর পারফেক্ট বলেই আমি মানুষ নই। যন্ত্র।”
দুদিন পর পদ্মাবতী অন্তর্ধান হল। যেন শরীরে দুরারোগ্য ব্যাধি বাসা বেধেছিল, এইটুকুও জানানো খুব প্রাইভেট।
বিদ্যার ভার্চুয়াল আইডি শত চেষ্টা করেও আর খুঁজে পেল না বাহার। কোনও স্পষ্ট জবাব না দিয়ে কোথায় হারিয়ে গেল মেয়েটি কে জানে!
দুদিন পর পদ্মাবতী অন্তর্ধান হল। যেন শরীরে দুরারোগ্য ব্যাধি বাসা বেধেছিল, এইটুকুও জানানো খুব প্রাইভেট।
বিদ্যার ভার্চুয়াল আইডি রহস্যের নিকুচি করে জানাল- আগন্তুক আসলে নারী নয়।