চরিত্রহীন

লেখকঃ অরিত্র হোসেন

ভূমিকাঃ ছায়ার বয়স মাত্র ১৫, বই পড়তে খুব পছন্দ করে। কিন্তু তার মা খুব অপছন্দ করেন মেয়ের বই পড়ার অভ্যাসকে। বড় হচ্ছে, কদিনপর সংসার করবে। এখন এসব শখ পোষা বেমানান একঅর্থে নিষিদ্ধ। কিন্তু তার বাবার খুব শৌখিন মানুষ। মেয়ে-ছেলেরা নবেল পড়বে, মুক্তচিন্তার অধিকারী হবে, এটাই চান। একদিন ছায়ার বিছানা গুছাতে গুছাতে হঠাৎ তার মা বালিশের নিচে একটি বই পান। বইটির নাম ‘চরিত্রহীন’। মা’র আক্কেল গুড়ুম অবস্থা। এধরণের নবেল পড়ে তো মেয়ে চরিত্রহীন হয়ে যাবে! মা তাড়াতাড়ি বইটি তাড়ানোর ব্যবস্থা করে ফেললেন।

বলছিলাম সমরেশ মজুমদারের লেখা ‘ছায়ার শরীর’ বইটির কথা।

আমরা খুব সহজে, অনায়েসে কোন কিছু সম্পর্কে ধারণা করে তা প্রতিষ্ঠিত করতে উঠে পড়ে লাগি। হয়তো এতে আনন্দ পাওয়া যায়, সুখ পাওয়া যায়।

‘চরিত্রহীন’ নামটা সবসময় আমাকে আকর্ষণ করে। শরৎচন্দ্রের লেখা চরিত্রহীন পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে উপন্যাসের নামও চরিত্রহীন দেওয়া হয়েছে, তা ভাবাটা ভুল হবে না। কিন্তু! কাহিনি অনুযায়ী উপন্যাসের নাম ‘চরিত্রহীন’ যথার্থ।

     পূর্বাহ্ণ

১…

‘আচ্ছা, তোমার বয়স কতো?’

এমন ধরণের প্রশ্ন আমাকে সবসময় ধাঁধায় ফেলে দেয়। বয়স খুব কম হওয়াতে এক অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে। আচ্ছা, বয়সটা শুনে যদি লোকটা আমার সাথে কথা না বলে? পিচ্চি পিচ্চি বলে কান ঝালাপালা করে দেয়?  এতো কম বয়সে এখানে কেন, এমন ধরণের হাজার প্রশ্ন করে? উপদেশ দিতে বাঙালি পটু, নীতি কথা বলাতেই আনন্দ তাদের।

আমি চেয়ারে বসে পা নাচাচ্ছি। বেশিদিনের স্বভাব নয়, এক মাস হবে। একদিন কলেজে পা নাচ্চাছিলাম বেঞ্চে বসে। আমার পাশে বসে ছিল এক ছেলে। সে বিরক্ত গলায় বলল, পা নাচানো বন্ধ করো। পা নাচানো শয়তানী কাজ। আমি কথাটা শুনে মিটিমিটি হাসলাম। কতো যে শয়তানি করি, আমি সে যদি জানতো! আর এতো পা নাচানো! খুব কষ্টে দুটো পা একত্রে করে বসে রইলাম। পাঁচ মিনিট পর আবার সানন্দে শুরু করলাম কিন্তু টের পেলাম না আমি। টের পেল সেই ছেলে। আড়চোখে আমাকে নির্দেশ দিল, বন্ধ করো। আমি মুচকি হাসি দিয়ে আরও দ্রুত নাচানো শুরু করলাম। ছেলে বিরক্ত হয়ে উঠে সামনের বেঞ্চে চলে গেল। আহারে! ক্ষেপেছে! ছেলেটা দেখতে সুন্দরই ছিল। একটু নাদুসনুদুস এই আর কি!

ফেসবুকে চ্যাট করা মহা ঝামেলার ব্যাপার। প্রতিদিন অন্তত ১০জনকে নিজের সম্পর্কে বলতে হয়। নাম কি, কোথায় থাকো, বয়স কতো, রিলেশন ছিল না-কি, কি ধরণের অভিনয়(!) করতে পছন্দ করো। আচ্ছা, আচ্ছা, অভিনয়? Role কথাটার উপযুক্ত ট্রান্সলেশন অবশ্যই এটা নয়। যাইহোক, এধরণের প্রশ্নের সাগরে আমার আর হাবুডুবু খেতে ভালো লাগে না। একদিন বলা যায়, দুই বলা যায়, হয়তো ৩ বা ৪দিনও বলা যেতে পারে কিন্তু পঞ্চম দিনে খুব একগুঁয়েমি লাগে। এখন যার সাথে চ্যাট করছি তিনি ২৭বছরের চাকুরীরত এক যুবক। প্রোফাইলে ছবি নেই, খুব হাস্যকর আইডির নাম। তিনি যখন আমাকে বয়স জিজ্ঞেস করলেন তখন চিন্তায় পড়ে গেলাম। আচ্ছা, যদি ২৭বছর তিনি হন তার তাহলে আমার কি বলা উচিত হবে? ২০? কলেজছাত্র বয়স ২০? তাও ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে? ফেইল করা ছাত্র? আরে না! না! না! বলা যাবে না ২০। তাহলে? ১৭বলা ঠিক হবে? আন্ডার ১৮বলে যদি ক্যানক্যান করে?

হুম্ম!

উফ!

তাতে কি!

তার সাথে তো আমি প্রেম করতে যাবো না। যা ইচ্ছা তাই ভাবুক!

আমি লিখলাম, আমি ১৮বছরের কিশোর।

তিনি জবাবে লিখলেন, হা হা হা। ভালোই। তোমার নাম কি?

আমি ভাবার জন্য একটু সময় নিলাম। আসল নাম বলবো না কি নকল নাম? বানিয়ে কোন নাম বলবো?

আমি লিখলাম, আমার নাম অমিত। আপনার নাম জানতে পারি?

তিনি লিখলেন, আমি প্রান্তিক। তোমার সাথে কথা বলতে ভালো লাগছে। আজ শুক্রবার। আমার অফিস বন্ধ, তোমারও কলেজ বন্ধ। চলে আসো উত্তরা, আড্ডা দিবো। কেমন?

আমি ঝিম মেরে ভাবতে শুরু করলাম। প্রস্তাব ভালোই। বাসায় বসে অলস দিন কাটাচ্ছি। কিন্তু ভয়ও কাজ করছে। চিনি না, জানি না এমন একটা মানুষের সাথে দেখা করতে যাওয়া কি উচিত হবে? আমি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি। ওদিকে প্রান্তিক বারবার ‘?? ?? ?? ??’ চিহ্ন পাঠাচ্ছে। আমি লিখলাম, আচ্ছা আসছি। জসীমউদ্দিন রোডে থেকো।

প্রান্তিক লিখলেন, Great! নাম্বার দাও এখনি কল দিচ্ছি।

নাম্বার টাইপ করে পাঠিয়ে দিলাম। ২মিনিট পর তিনি ফোন দিলেন। আমি কেটে দিলাম। যা কথা হবে সামনা-সামনি, এখন না।

এই জগত, এই কমিউনিটি এসব বলতে আর ভালো লাগে না। গোপন গোপন ভাব কাজ করে। একগুঁয়েমি লাগে। পার্টনার খুঁজো নাহলে বয়ফ্রেন্ড খুঁজো। এছাড়া আর কোন বিষয় নেই। আমি মাঝে মাঝে হাস্যকর পোষ্ট দেওয়ার চেষ্টা করি। মানুষ হাসে কি হাসে না তা জানি না কিন্তু পোষ্টে নানা ধরণের হাস্যকর কমেন্ট আসে। যেমনঃ তুমি অনেক কিউট। তুমাকে আমার লাগে ভালো। ফ্র্যান্ড হবা? প্লেস আছে ব্র?

কমেন্ট দেখলে বুঝা যায় তার ইন্টেশন ঠিকই আছে কিন্তু কামনা ব্যক্ত করার পদ্ধতি খুবই বাজে।

ফিটফাট হয়ে কোন জায়গায় যাওয়ার অভ্যাস আমার নেই। শার্ট, প্যান্ট আর স্যান্ডেল পরে দেই দৌড়। অনেককেই দেখি খুব সুন্দর জামাকাপড় পরে, বাবুসাহেব হয়ে বাইরে বের হয়। আমার ছোট চাচাই তো কি স্মার্ট! ময়ালাওয়ালাকে ময়লা দিতে লুঙ্গি বদলে ঝকঝকে প্যান্ট পরে নামবেন ৪তলা থেকে।

বাসে উঠে সীটে বসলাম। জানালার পাশে বসেছি, কানে হেডফোন। হিন্দি গানের প্রতি মোহ দিন দিন বেড়েই চলেছে। একেকটা ইমোশনাল গান মাত করছে সবাইকে। প্রভাব আমার মধ্যেও পড়েছে। বসেছি আমার হাতের বামদিক সাইডে। ঘাড় কাত করে আছি, আকাশ পরিষ্কার। মার্চ মাসের আকাশ। কখনো থাকবে ঝকঝকে, কখনো থাকবে মেঘলা। বসন্তের বাতাস বইছে। পাগলা বাতাস। আর এই পাগলা বাতাসে কারোর হয় দেহের রোগ, কারোর হয় মনের রোগ।

চিন্তাভাবনা করতে করতে পৌঁছে গিয়েছি গন্তব্যে। খুব ধীরেসুস্থে বাস থেকে নামলাম। কয়েকবার প্রাণ ভরে শ্বাস নিলাম। বুকের ভিতরটাতে ধড়ফড় করছে। এই প্রথম আমি কারোর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। কথাটা ঠিক হল না, এইরকম হবেঃ এই প্রথম ফেকআইডির থেকে যোগাযোগ করে কারোর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। বাহ, এটা ঠিক আছে। আমি ধীরে ধীরে পা বাড়াচ্ছি আড়ং’এর দিকে। ফোন বাজচ্ছে। পকেট থেকে বের করে দেখলাম প্রান্তিক কোল করেছে। আমি একটু ভয়ে কল ধরে বললাম, হ্যালো?

ওপাশ হতে বেশ ভারীগলায় প্রান্তিক বলল, এসে পড়েছ? আমি বিএফসি’র সামনে।

আমি বললাম, জী। আসছি!

আমি যেখানে দাড়িয়ে আছি সেখান থেকে বিএফসি মাত্র ২০কদম দূর। আমি ভালোভাবে বিএফসি’র সামনের রাস্তার দিকে খেয়াল করলাম। সব মানুষজন খুব ব্যস্ত ভঙ্গিতে আসা-যাওয়া করেছে। আমার চোখ পড়ল একটি সাদা টিশার্ট ও কালো শর্টস পরিহিত এক ভদ্রলোকের উপর। তিনি দুটো হাত পিছনে মুষ্টিবদ্ধ করে দাড়িয়ে আছে। আমি আস্তে আস্তে পা ফেললাম। কেন জানি খুব ইচ্ছে করছে দেখা না করে পিছন ফিরে দেই এক দৌড়। ফোন অফ করে ২-৩দিন গুপ্ত হয়ে থাকবো। এমনটা ভাবতে ভাবতে আমি ভদ্রলোকের সামনে এসে দাঁড়ালাম। তিনি আমার দিকে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে হাত বাড়িয়ে বলল, আমি প্রান্তিক। মাঝারি ধরণের এই লোকের চেহারায় বিশেষত্ব নেই কিন্তু নিজেকে তুলে ধরার প্রক্রিয়া আমার বেশ ভালোই লাগলো। গোলগাল চেহারা, ৫ফুট ৫ইঞ্ছির লোকটিকে মনে ধরে গেল আমার। ‘প্রথমে দর্শনদারি তারপর গুণবিচারি’ – এ ব্যাপারটার প্রথম বাস্তব উদাহরণ দেখলাম। অবশ্যই নিজের ক্ষেত্রে!

আমি আমতা আমতা করে বললাম, আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।

প্রান্তিক খুব উচ্চস্বরে হাসতে লাগলো। দেহ কাঁপিয়ে এবং ‘ভুঁড়ি’ কাঁপিয়ে। এতক্ষণ লোকটির সৌন্দর্যগুলো চোখে লাগছিল, কিন্তু হঠাৎ ভুঁড়িটা দেখে একটু না বেশ খানিকটা অস্বস্তিবোধ কাজ করতে শুরু করলো।

প্রান্তিক আমার ঘাড়ে হাত রেখে বলল, চলো হাঁটি!

আমি মাথার চুল ঠিক করতে করতে হাঁটা শুরু করলাম। প্রান্তিক কাঁধ থেকে হাত না সরিয়ে আর একটু কাছে ঘেঁষে আসলো। আমি মনে মনে ভাবলাম, ছেলের ছলাকলা শুরু হয়ে গিয়েছে। ভণিতার অন্তরালে আসল রূপ প্রকাশ পেতে বেশি সময় লাগবে না।

প্রান্তিক বলল, আচ্ছা তোমার সম্পর্কে বোলো! কেমন ছেলে তুমি পছন্দ করো?

আমি বললাম, আসলে সেরকম করে কখনও ভাবা হয়নি।

-কেন? রিলেশন ছিল না আগে?

-নাহ, ছিল না।

-ওহ আচ্ছা বলে প্রান্তিক কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে ফেলল। আমি তারদিকে ভালোভাবে তাকালাম। ছেলের মথিগতি কি ঠিক আছে? আমি কি কোন বড় ভুল করলাম? না জেনেশুনে লোকটার সাথে দেখা করতে চলে এলাম!  

আমি খুব কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা তুমি রিলেশন বলতে বুঝো কি?

প্রান্তিক মাথা উঁচু করে কিছুক্ষণ ভেবে খুব জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব নিয়ে বলল, আসলে বিভিন্ন মানুষের কাছে সংজ্ঞাটা বিভিন্ন রকম। কারোর কাছে রিলেশন মানে ভ্যালিড সেক্স, আর কারোর কাছে ভালোবাসা আর কাম দুটোই।

আমি মুখ কুঁচকে বললাম, সেক্স? ওহ মাই লর্ড!

প্রান্তিক বলল, ওয়্যাট? তোমার ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে সেক্স কখন করওনি!

আমি বললাম, ইয়েস। আমি করিনি।

প্রান্তিক চোখ বড়বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সে কিছু একটা বলতে গিয়ে দম নিয়ে, ডানবাম দিকে তাকিয়ে বলল, সত্যি করো নি?

আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, জী।

প্রান্তিক চোখ টিপ দিয়ে বলল, জানো কিভাবে করতে হয়?

আমি বুঝে উঠার আগেই প্রান্তিক তার ডান হাত দিয়ে আমার কোমর শক্ত করে ধরল। আমি থতমত খেয়ে, মুখ ভার করে হাতটা আমার সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ছাড়িয়ে নিলাম। এরপর গটগট করে সামনে এগিয়ে আসলাম। পিছন থেকে প্রান্তিক দৌড়ে আমার দিকে ছুটে আসছে। আমি হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলাম। বুক ধড়ফড় করছে, আশেপাশের সবকিছু অন্ধকার লাগছে। প্রান্তিক কোমরে হাত রেখে কি কোন বিষ ঢেলে দিলো আমার শরীরে? আমি এইবার দৌড়ে দৌড়ে এগুচ্ছি। পিছন থেকে চিৎকার করে প্রান্তিক বলছে, সবে তো শুরু, বুঝলে! সব বুঝে যাবে, আস্তে আস্তে।

আমরা কথা বলতে বলতে খুব সুনসান রাস্তায় চলে গিয়েছিলাম, সেই সুযোগে প্রান্তিক তার সুপ্ত কামনা ব্যক্ত করা প্রক্রিয়া শুরু করেছিল মাত্র। দৌড়ে মেইন রাস্তায় এসে পড়লাম।

অ্যায় সিএনজি, যাবেন?

যাবেন?

২…

কাকিমা প্রতাপ ঘরে আছে?

কাকিমা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। তিনি মুখ কুঁচকে দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, হা রে অমিত! এমন অভাগা অভাগা লাগচে কেন তোকে? কি করে এসেচিস? কামলা খেটেচিস?

আমি বললাম, কাকিমা কি যে বলেন! আরে! বাইরে বড্ড গরম। বাসে এসেছি। রাস্তায় রিকশা পাইনি তাই হেঁটে হেঁটে এসেছি, এজন্য ওমন লাগছে।

কাকিমা মুখ ভেচকি দিয়ে বললেন, হ্যাঁ গা! সেই। যা সোজা স্নানঘরে ঢুকে পড়। স্নান করে নে।

-না কাকিমা। প্রতাপের ঘরে যাই। একটু ঠাণ্ডা হয়ে তারপর স্নান করবো।

কাকিমা শব্দ করে হাসা শুরু করলেন। তিনি শাড়ির আঁচল দিয়ে আমার কপাল মুছে দিয়ে বললেন,  তুই তো দেখি আজকাল কলিকাতার বাঙাল কথা শুরু করলি রে! দিদি শুনলে, আমার আর রক্ষি নেই!

 -কাকিমা! কিচ্ছু বলবে না মা। ওসব বাদ দাও। আমাকে ঢুকতে দিবে না চলে যাবো?

কাকিমা হাসতে হাসতে বললেন, যা! যা! অ্যাই শুন! প্রতাপকে ভালো ভাবে একটু ঝাড়িস তো! সেই সাতসক্কালে উঠে গিটার নিয়ে বসেচে। প্যান প্যান চলচেই। উফ!

আমি কাকিমাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, তা আমি বলবো। তুমি ভালো আছো?

কাকিমা বললেন, হাঁ রে। ঠাকুর রেখেচে।

-কাকিমা! যাই তাহলে।

-যা।                                                        

আমি প্রতাপের ঘরের দিকে আগাচ্ছি। কাকিমাদের ফ্ল্যাটটা খুব সুন্দর। সবকিছু খুব গোছানো। ফ্ল্যাটের সবচে সুন্দর জায়গা হল বারান্দা। তিনটা রুম পরপর। আলাদা বারান্দা নেই। এক বিরাট বারান্দা তিনটি রুমকে জুড়ে রেখেছে। বারান্দা দিয়ে সহজে যেকোনো রুমে যাওয়া যায়।

বারান্দার সামনে লেক। এ বাড়িতে যখনই আসা হয় তখন আমি হারিয়ে যাই আপন ভুবনে। প্রচণ্ড ভালো লাগে। প্রতাপের রুমের দরজা লাগানো। বাইরে গিটারের টুংটাং শব্দ আসছে। বিশ্রীভাবে তারগুলো উপর-নিচ করা হচ্ছে। যে কেউ শুনলে গিটার ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করবে। আমি জোরে জোরে দরজা থাপড়াতে লাগলাম। কিছুক্ষণ থাপড়ানোর পর গিটারের টুংটাং শব্দ বন্ধ হল। আমি দরজায় কান পেতে শুনতে চেষ্টা করলাম আসলে হচ্ছেটা কি! তারপর খুব কৌশলে দরজার সামনে থেকে সরে পাশের রুম হয়ে প্রতাপের রুমে গেলাম। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলাম, মোবাইলে প্রতাপ হেসে হেসে কথা বলছে। আমি জোরে গলা খাঁকারি দিলাম। এ শব্দে চমকে উঠলো প্রতাপের পিলে। মোবাইলটা হাত থেকে পড়ে সিম, ব্যাটারি ফ্লোরে ছিটকে একটা ওদিক গেল আরেকটা ওদিক।

প্রতাপ বুকে হাত দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, এমন ফাজলামি করে কি মজা পাস অমিত?

আমি রাগান্বিতকণ্ঠে বললাম, ফাজলামি? কতক্ষণ ধরে দরজা ধাক্কাছি। আর তোর কোন বিকার নেই! আচ্ছা এই বিশ্রীভাবে গিটার বাজানোর দরকার কি? আগে শিখেপড়ে নে, তারপর জ্বালাতন করিস।

প্রতাপ খাটের উপর বসলো। গিটারটা পড়ার টেবিলে রাখা। আমি বললাম, দরজা খোল।

প্রতাপ দরজা খুলে আবার খাটের উপর বসলো। আমি রুমে ঢুকে গিটারটা হাতে নিয়ে বললাম, কতো নিলো?

প্রতাপ মুখ গোমড়া করে বলল, তা তোর জেনে কি লাভ?

-প্রতাপ! রাগ দেখাবি না।

প্রতাপ ফ্লোরে পড়ে থাকা মোবাইল উঠালো, তারপর ব্যাটারি আর সিম ঠিকঠাক মতো লাগিয়ে মোবাইল চালু করলো।

-ফোনটা রাখ। তোর সাথে জরুরী কথা আছে।

-বল

-ফোনটা রাখ।

-দেখ অমিত, ছেলেমানুষি করবি না।

আমি গিটারটা রেখে প্রতাপের পাশে যেয়ে বসলাম। কৌতূহলীকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা কাকিমা ওমন কলিকাতার ভাষায় আজকাল কথা শুরু করেছেন কেন? আগে তো কখনো শুনিনি!

প্রতাপ মুখ শক্ত করে বলল, শুরু করবে না আবার? আমার পিসি এসেছি কলকাতা থেকে। এক সপ্তাহ হবে। তিনি অনর্গল কথা বলেই যাচ্ছেন আর আমার মা তা রপ্ত করছেন। এখন তো প্রাথমিক স্টেজ। দেখবি কালে কালে কি অবস্থা হয়ে দাড়ায়।

-ভয়ংকর ব্যাপারস্যাপার!

প্রতাপ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোর এরকম অবস্থা কেন?

-কেমন অবস্থা?

-বিধ্বস্ত লাগছে। কিছু করে এসেছিস নাকি?

আমি অবাকসুরে বললাম, কি করে আসবো?

প্রতাপ নিঃশ্বাস ফেলে ন্যাকামি করে বলল, কি আর করবি! বড় হচ্ছিস এখন নিষিদ্ধ কাজ করবার দিকেই মন ঝুঁকবে।

-এক্সকিউজ মি, প্রতাপ?

প্রতাপ হাসতে হাসতে বলল, কাহিনি বল। কি হয়েছে?

আমি হাত ঘষতে ঘষতে বললাম, আসলে হয়েছে কি… আসলে, আজ একজনের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সে একপর্যায়ে জিজ্ঞেস করলো রিলেশন ছিল কিনা। আমি বললাম না। সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করলো সেক্স করেছো কিনা। এরপর কোমরে হাত রাখল তারপর…

-তারপর তুই বাংলা সিনেমার নায়িকার মতো দুষ্টু লোকের হাত থেকে বাঁচার জন্য ছুটতে ছুটতে চলে এলি?

-দেখ প্রতাপ!

-কি দেখবো? দেখবোটা কি?

-কি করবো বুঝতে পারছিলাম না।

প্রতাপ উঠে গিয়ে কম্পিউটারের সামনে বসলো। সে কীবোর্ড টিপতে টিপতে বলল, শুন বড় হচ্ছিস। Try to handle situations smoothly! এরকম বাচ্চামি স্বভাব না ছাড়লে জীবনেও কিচ্ছু হবে না!

-তাহলে করবো কি?

প্রতাপ হাসতে হাসতে বলল, যা! ছেলেটাকে ফোন দে। আবার দেখা কর। এভাবে নায়িকাদের মতো আচরণ করবি না।

আমি মুখ শক্ত করে বললাম, নাহ! অবশ্যই না!

প্রতাপ বলল, তাহলে সতীসাবিত্রী মতো জীবন কাটা। মাকে বলে তোকে বৃন্দাবন পাঠানোর ব্যবস্থা করি। সেখানে যেয়ে পূজাঅর্চনা করবি…

আমি ক্রুদ্ধ হয়ে বললাম, বিবেকবুদ্ধি লোপ পেয়েছে? আমি বৃন্দাবন যাবো কেন?

প্রতাপ মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, ও! ও! ও! ভুলে গিয়েছিলাম। মাইন্ড করিস না।

-তুই বল কি করা উচিত আমার?

প্রতাপ দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ইঞ্জয় ইউর লাইফ অমিত! সময় শুরু হয়ে গিয়েছে। যখন বুড়িয়ে যাবি তখন আফসোস করা ছাড়া উপায় থাকবে না।

আমি প্রতাপের দিকে তাকালাম। ভুল কোন কিছুই বলেনি সে। বড় হচ্ছি, ম্যাচুরিটি আনতে হবে নিজের মধ্যে। বাল্যকাল শেষ। আস্তে আস্তে দুনিয়ার সাথে তাল মিলিয়ে হাটতে হবে। তাই নয় কি?

প্রতাপ বলল, দেখে যা।

-কি ?

-আমার নতুন প্রেমিক।

আমি দৌড়ে কম্পিউটারের কাছে গেলাম। স্ক্রীনে গোলগাল চেহারার এক ছেলের ছবি। গালভর্তি দাড়ি। হুজুরে দাঁড়ি। আমি থতমত খেলাম। ছেলেকে দেখে মুসলিম লাগছে। আমি অবাকসুরে বললাম, প্রতাপ কে রে এটা?

-আমার নিউ বয় ফ্রেন্ড।

-কি! ছেলের ধর্ম কি?

-উফ! এরকম গাধার মতো কথা বলবি নাতো! মুসলমান ছেলে, দেখতেই তো পাচ্ছিস!

-তুই না মুসলিম ছেলে পছন্দ করিস না!

প্রতাপ বিরক্ত হয়ে বলল, তুই এতো গাধা কেন! বললাম বয়ফ্রেন্ড আর হয়ে গেলো? তোকে বোকা বানানো বেশ সোজা তো দেখছি!

আমি উঠে পড়লাম। প্রতাপ বলল, যাস কই?

-যাই, দেখা করে আসি।

প্রতাপের মুখ খুশিতে জ্বলজ্বল করছে। সে বলল, যা! যা!

নিচে নেমে এসে এতো বড় চমক খাবো তা কল্পনায় ছিল না। প্রান্তিক বাড়ির ঠিক উল্টো দিকে এক চা’এর টঙ এ দাড়িয়ে চা খাচ্ছিল। আমি দেখেও না দেখার ভান করে আগাতে থাকলাম। আমাকে দেখে প্রান্তিক চিৎকার করে বলে উঠলো, এদিকে আসো। চা খেয়ে যাও।

আমি খুব কষ্টে বিরক্তভাব লুকিয়ে রেখে হেসে বললাম, আপনি এদিকে আসেন তো।

প্রান্তিক চায়ের কাপটা রেখে দৌড়াতে দৌড়াতে এপাড়ে চলে এলো। মুখে হাসি লেগে আছে। আমি বললাম, চলেন কোথাও বসি।

প্রান্তিক বলল, চল লেকের সাইডের যাই। ওখানে বাতাস খেয়ে এরপর রেস্টুরেন্টে বসবো।

আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, আচ্ছা।

প্রান্তিক রিকশা ডাকল। ঘড়ি দেখলাম, ৬টা বাজে। কিছুক্ষণ পর আঁধার নামবে। চারদিক অন্ধকার। আমি আর প্রান্তিক লেকের পাশে কি করবো? উফ! অমিত! থিং পজিটিভ! প্রান্তিক আমার হাত টেনে বলল, রিকশায় উঠো! কতক্ষণ ধরে বলছি, শুনচ্ছই না।

আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে রিকাশায় উঠলাম। প্রান্তিকের সাথে গা লেগে যাচ্ছিল তাই আমি একটু দূরত্ব রাখার চেষ্টা করলাম। প্রান্তিক হাসতে হাসতে বলল, আমি আগে জানতাম মেয়েরা এমন করে। ছেলেদের মধ্যে এমন ভাব লক্ষ্যও করা যায় না।

আমি বললাম, আমার মনে হয় আমরা যেসব মানুষদের প্রতি আকর্ষিত হই তাদের কাছ থেকে প্রথম প্রথম দূরে থাকাটাই শ্রেয় মনে করি।

-বাপরে বাপ! ব্যাপারটা মাথার উপর দিয়ে গেলো।

-তো কোথায় কাজ করেন আপনি?

-আমি একটা ব্যাংকে চাকরী করি। ২বছর হবে।

-বিয়েশাদি করাবার ইচ্ছা নেই?

-আরে বিয়েশাদি! ওসব নিয়ে চিন্তা নেই!

-তাহলে কি নিয়ে চিন্তা আছে?

প্রান্তিক চুপ করে রইল। আমি উত্তর আশা করলাম না। আমি চারপাশ দেখায় মন দিলাম। দেখার মতো কিছুই নেই। গাড়ি চলছে, রিকশা চলছে, ভ্যান চলছে। রাস্তাগুলো বেশ প্রশস্ত। অন্তত যানবাহন ঠিকভাবে চলতে পারে। আমরা লেকের পাশে এসে পড়েছি। আমি তাড়াহুড়া করে নেমে পড়লাম। লেকের পাশে প্রশস্ত ফুটপাথ। মানুষজনের আনাগোনা কম। সন্ধ্যার সময় বলে মানুষজন কম? প্রান্তিক ভাড়া চুকিয়ে আমার পাশে এসে দাড়িয়ে বলল, চল হাটি।

আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। আচ্ছা কিসের টানে আমাকে এতক্ষণ এখানে রেখেছে? কিছু বলছিও না, করছিও না। কিন্তু আছি। প্রান্তিক বলল, এখানে থামো। আমি থামলাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তোমাকে ১বছর ধরে চিনি। ফেসবুকে তোমার ছবিগুলো আমার খুব ভালো লাগে। ইউ আর বিউটিফুল। যে কেউ প্রেমে পড়তে বাধ্য হবে।

আমি বললাম, এসব বলার মানে কি?

আমার ডানহাতটা ধরে প্রান্তিক বলল, উই ক্যান বিল্ড অ্যা বেটার ওয়ার্ল্ড!

আমি চোখমুখ কুঁচকে বললাম, আমরা কি বিল্ডার?

প্রান্তিক হাসতে হাসতে বলল, হ্যাঁ। অমিত! আই রিয়েলি লাইক ইউ! আমার বয়-ফ্রেন্ড হবে?

প্রান্তিক আমার হাতটা শক্ত করে ধরে আছে। কোন পুরুষমানুষ আমার হাত ধরলে আমার ভিতরে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হবে, স্বাভাবিক। বিদ্যুৎ প্রবাহিত হচ্ছে। শরীরে শিহরণ দিয়ে উঠছে। মাথা ঝিমঝিম করছে। মনে হয় এক্ষনি মাথা ঘুরে পড়ে যাবো। আমি হাতটা শক্ত করে ধরে বললাম, আমাকে ছাড়ো প্রান্তিক। আমাকে বাসায় দিয়ে আসো।

প্রান্তিক বলল, কি হল? কোন সমস্যা?

আমি বললাম, না না। আমি বাসায় যাবো। আমি বাসায় যাবো।

প্রান্তিক আমার শরীর ঝাকিয়ে বলল, কি হয়েছে?

আমি একটু পাশে সরে এসে বললাম, কেমন জানি মনে হচ্ছে। তুমি যেসব বললে সেগুলো কখনও কেউ আমাকে বলেনি। অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছে।

প্রান্তিক কাঁধে হাত রেখে বলল, চল আমার বাসায়।

আমি প্রান্তিকের দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।

৩…

-অমিত, উঠ।

-উহু, ঘুমাতে দে।

-ঘুমাবি মানে? সারারাত কি করেছিস?

-এতো প্রশ্ন করিস না, ঘুমাতে দে।

রাফিদ অমিতের চুল ধরে টেনে উঠাল। অমিত বেঞ্চে মাথা রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করছিল। আশেপাশের শব্দ আর রাফিদের একনাগাড়ে বলে যাওয়া কথাগুলো সূচের মতো মাথায় বিদ্ধ হচ্ছিল অমিতের। তাই চোখে ঘুম থাকা সত্ত্বেও নিদ্রায় যেতে পাচ্ছে না।

রাফিদ চোখ-মুখ কুচকে বললে, রাতে ঘুমাসনি?

অমিত মাথা কাত করে বসে আছে। একবার ডানদিকে আরেকবার বামদিকে মাথা রাখছে। মাঝেমধ্যে ঝিমাতে ঝিমাতে সামনের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। রাফিদ অমিতের হাতে সজোরে একটা কিল দিল। অমিত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে একদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, কি হয়েছে ? কি হয়েছে?

রাফিদ বলল, রাতে ঘুমাসনি কেন?

অমিত চোখ কচলাতে কচলাতে বলল, সারারাত অনেক চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারিনি। ঘুম আসেনি।

রাফিদ আড়চোখে বলল, সত্যি? না কোন কিছু খেয়েছিস?

অমিত বলল, কি খাবো?

রাফিদ বলল, গাঁজা খেয়েছিস?

অমিত রাফিদের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাল। রাফিদ অমিতের চাউনি দেখে আঁতকে উঠলো। দু’চোখ রক্তলাল, চোখের কোনায় পানি জমে আছে। রাফিদ ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে বলল, নে। পানির ছিটা দে মুখে। ঘুমঘুম ভাব চলে যাবে।

অমিত বোতল ধরে চুপচাপ বসে আছে। ঝিমানো পর্যায় কাটেনি। তাকে দেখে আশেপাশের ছেলেমেয়েরা খারাপ কিছু সন্দেহ করছে। করাটা অবশ্যই স্বাভাবিক।

ক্লাস শুরু হয় ৮টায়। ১ম, ২য়, ৩য় পিরিয়ড শেষ। এখন ৪র্থ পিরিয়ড চলছে। রসায়ন ক্লাস। আজমল স্যার নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে লেকচার দিয়ে যাচ্ছে। ছাত্রছাত্রীরা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছে। অবশ্য রীতিমতো তিন সারির পিছনের দুই বেঞ্চে যারা বসেছে তারা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। স্যার কি বলছেন, কি করতে বলছেন সে ব্যাপারে তাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। শুনতেও ইচ্ছে জাগে না তাদের। দুর্ভাগ্যবশত আজ অমিতকে পিছনের বেঞ্চে বসতে হয়েছে। আজকে সে ক্লাসে আসতে ১৫মিনিট দেরি করেছে । সাধারণত ক্লাসটি সামনে থেকে নয় পিছন থেকে পূর্ণ হতে থাকে। দেরি করে কেউ আসলে অবশ্যই তাকে সামনের বেঞ্চে বসতে হয়।

রাফিদ অমিতকে ঝাঁকি দিয়ে বলল, তুই এক্ষনি টয়লেটে যাবি।   

অমিত বিড়বিড় করে বলল, কোথায় যাবো?

রাফিদ সজোরে বলে উঠলো, স্যার!

রাফিদের দিকে মুহূর্তের মধ্যেই সবাই কৌতূহল চোখে তাকালো। অমিত গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাড়িয়ে বলল, ওয়াশরুমে যেতে পারি?

আজমল স্যার বলল, যাও। যাও। তাড়াতাড়ি যাও ছেলে।

অমিত তড়িঘড়ি করে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো। অমিতের এমন অস্থিরতা দেখে আজমল স্যার হেসে হেসে বললেন, বড়টা চাপসে। বুঝলা? সেজন্য দৌড়াচ্ছে। হাহাহা।

সবাই হো! হো! করে হেসে উঠলো।

অমিত আয়নার সামনে দাড়িয়ে আছে। তার দু’চোখের নিচটা কালো হয়ে আছে। চোখ জোড়া লাল। চুল উষ্কখুষ্ক। ট্যাপ ছেড়ে পানি দিয়ে মুখ ধুতে শুরু করলো। একহাত দিয়ে ক্রমাগত মুছতে মুছতে গতকালের কথা মনে পড়ে গেলো তার। প্রান্তিকের বাসায় যাওয়ার প্রস্তাব পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মাথায় হাজারো প্রশ্ন, ঘটনা ও এর পরবর্তী অবস্থা সব একত্রে ঘুরপাক খেতে লাগল।

প্রান্তিকের হাত শক্ত করে ধরে অমিত বলল, আমাকে দয়া করে একটা সিএনজি করে দিতে পারবে? বাসায় যাবো।

প্রান্তিক বলল, অবশ্যই। আমি তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিচ্ছি।

প্রান্তিক হাঁকডাক করে একটা সিএনজি জোগাড় করে নিয়ে আসলো ৫মিনিটের মধ্যে। অমিতের কোমর জড়িয়ে  সিনএনজি’তে তুলল এবং নিজেও উঠলো। অমিত ব্যাপারটাকে পাত্তা দিলো না। রাস্তায় যাওয়ার পথে দোকান থেকে পানির বোতল কিনে নিলো প্রান্তিক। বোতলের পানি দিয়ে ক্রমাগত মুখে ছিটা দিতে লাগলে অমিত স্বাভাবিক হতে থাকে। প্রান্তিক এখনও অমিতের কোমরে হাত দিয়ে আছে। অমিত কোনরকম প্রতিবাদ করলো না। তার ভালোই লাগছে। পুরুষের ওম তার গায়ে শান্তি দিচ্ছে। অমিত প্রান্তিকের আরেকটু কাছে আসলো। প্রান্তিক অমিতকে জড়িয়ে ধরে আছে। অমিত প্রান্তিকের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজে রইল। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে অমিত বলল, তুমি আমার সাথে সম্পর্কে জড়াতে চাও কেন?

প্রান্তিক অমিতের কপালে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, পছন্দ করি তাই চাই।

-তুমি তো আমাকে ভালোভাবে চিনো না! না জেনেশুনে…

প্রান্তিক অমিতের কোমর থেকে হাত সরিয়ে নিলো। অমিত উঠে বসলো। দু’জন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। কারোর চোখের পলক নড়ছে না। প্রান্তিক অমিতের ঠোঁটে হাত বুলালো। অমিত স্তম্ভিত। প্রান্তিক আলতোভাবে অমিতের ঠোঁটে চুমু খেলো। অমিতের চোখ বন্ধ। প্রান্তিক ঠোঁট সরিয়ে নেওয়ার সময় পমিত প্রান্তিককে শক্ত করে জাপটে ধরল।

সিএনজি চলছে বিশ্বরোড দিয়ে। আশেপাশে গাড়ীর সংখ্যা খুব কম। অন্ধকারচ্ছন্ন এলাকাটি স্ট্রিট লাইটে যথেষ্ট আলোকিত করতে পারছে না। প্রান্তিক আর অমিত চুমু খাচ্ছে। আশপাশে কি ঘটছে তা নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যথা নেই।

টং! টং! টং! টং! টং!

ট্যাপ দিয়ে পানি পড়ছে। অমিতের সারা গা পানির ছিটায় ভিজে গিয়েছে। অমিত ট্যাপ বন্ধ করে টয়লেট থেকে বেরিয়ে পড়লো। টেফিন আওয়ারের ঘন্টা পড়েছে। ছাত্রছাত্রীদের কোলাহলে মুহূর্তেই সুনসান জায়গায়টা কলরবে ভরে উঠলো।

অমিত ধীরে ধীরে পা ফেলচ্ছে। ভিড় তার কাছে অসহ্য লাগে, বরাবরের মতো এখনও লাগছে। সে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠার জন্য পা দিলেই প্রতাপ কপ করে তার হাত ধরে চিকনকন্ঠে বলল, অ্যায় মুখপোড়া যাস কই?

অমিত তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলল, এতো মানুষের সামনে এভাবে কথা বলছিস কেন ?

প্রতাপ খিলখিলিয়ে হাসতে শুরু করলো। মুখে হাত দিয়ে, সারা দেহ দুলিয়ে দুলিয়ে। অমিতের দৃষ্টিতে ব্যাপারটা বেশ কটু লাগলো। প্রতাপ বলল, চল বিবিএ ভবনের দিকটায়।

কথা না বাড়িয়ে অমিত প্রতাপের পিছুপিছু হাটতে লাগলো। দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রী ছাড়া আর কারোর ক্লাস নেই আজকে। তাই তুলনামূলকভাবে অন্যান্য দিনের চেয়ে ভিড় একটু কম। প্রতাপ আর অমিত একটা বেঞ্চে বসলো। বেঞ্চটা ভিজা। গতকাল অনেক বৃষ্টি হয়েছে। টানা ৪০দিনের পর বৃষ্টি নেমেছিল। চারদিক শান্ত করে আবহাওয়া এখন বেশ ঠাণ্ডা। আকাশের অবস্থা এখনও ভালো না। যেকোনো সময় আবার বৃষ্টি নামতে পারে। অমিত বেঞ্চে বসে মাথা নিচু করে পা নাচাচ্ছে। প্রতাপ উঠে তার সামনে দাঁড়ালো। প্রতাপের দৃষ্টি আকাশের দিকে। সে বলল,

আজ আকাশটা খুব সুন্দর, তাই না অমিত?

-হু।

-বৃষ্টির পানিতে সব রাস্তাঘাট পানিতে একাকার! বন্যা হওয়ার আশংকা করছিলাম।

-হু

-এমন হু হু করছিস কেন? কি হয়েছে?

-কিছু হয়নি।

-অমিত। গতকাল তোর কি হয়েছে প্রান্তিকের সাথে?

-কি আর হবে। তেমন কিছুই হয়নি।

প্রতাপ উৎসুককণ্ঠে বলল, ও! তারমানে কিছু না কিছু হয়েছে! এখন বল হয়েছেটা কি?

অমিত শক্তকন্ঠে বলল, চুমু খেয়েছি। এর বেশি আর কিছু হয়নি।

প্রতাপ সুর করে বলল, অ্যায়! শুধু চুমু খেয়েছিস?

অমিত ম্লানকণ্ঠে বলল, হু।

প্রতাপ ধমক দিয়ে বলল, মুখ এমন গোমড়া করে ঘুরছিস কেন? গতকাল কি ভার্জিনিটি হারিয়ে এসেছিস? মনে হচ্ছে এই দুঃখে তুই সাদা কাপড় পরে মাতম করছিস। হায় ভগবান!

অমিত বলল, আসলে চুমু খাওয়ার পর থেকে একধরণের অপরাধবোধ কাজ করছে আমার মধ্যে। সারাক্ষণ ধরে ভাবছি, কাজটা ভুল করেছি আমি। খুব ভুল।

-প্রথম প্রথম অমন মনে হয় রে। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যায়। বুঝলি?

-হুম

-তো চুমু খেয়ে মজা পেয়েছিস?

অমিত মুখ বাঁকিয়ে বলল, মজা? সিগারেটের গন্ধে সারা মুখ ভকভক করেছিল।

প্রতাপ হাত কচলাতে কচলাতে বলল, আমি সবসময় এ ব্যাপারে খুব সাবধান।

অমিত বলল, আমি ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছি না। বারবার মনে হচ্ছে, কাজটা ঠিক হয়নি।

প্রতাপ বলল, উঠ। হাটতে হাটতে কথা বলি।

-আচ্ছা।

অমিত উঠে দাড়িয়ে প্রতাপের সাথে হাটতে শুরু করলো। একই সঙ্গে তাল মিলিয়ে মিলিয়ে কদম ফেলছে। দুপাশে গাছের সারি স্পর্ধা নিয়ে দাড়িয়ে আছে। প্রতাপ বলল, আসলে কি জানিস? এই যে প্রথম চুমু খাওয়া, প্রথম প্রথম প্রেমে পড়া ব্যাপারগুলো স্বাভাবিক। যেহেতু প্রথমবার হচ্ছে সেহেতু খুব অস্বস্থিকর লাগবে। কিন্তু দেখবি সময়ের সাথে খাপ খেয়ে যাবি। এগুলো করা খারাপ, লোকে কি বলবে না বলবে ওসবে কান দিবি না। তোকে তো আর কেউ এসে দেখছে না কি করছিস। তাই না? আর এখন যা হবে তা সব বয়সের দোষ। বয়স কচি, দেখতে ভালো আছিস, সবাই নজর দিবে। সবাই পেতে চাবে। অনেকে এক রাতের জন্য আর অনেকে অনেক রজনী কাটানোর জন্য। কেউ চাবে দৈহিক চাহিদা মিটানোর জন্য, কেউ চাবে মানুসিক স্বস্থি লাভের জন্য। এখন এগুলো বুঝে বুঝে খুঁজে বের করা তোর একান্ত দায়িত্ব। সবকিছু আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া যায় না। কিছুকিছু জিনিস উপলব্ধি করতে হয়। তুই যদি চাস সেক্স করবি, তাহলে করবি। তার সঙ্গে ইমোশনাল কোন সম্পর্কে জড়াবি না। তুই যদি চাস মনের মতো মানুষ খুঁজে তার সাথে কাম, প্রেম সব করবি, তাহলে করবি। তুই যেটা চাস, সেটা করবি। কারোর কথায়, কারোর ইশারায় অন্তত উঠা-বসা করবি না। আমি যেমন অনেকের সাথে দেখা করতে পছন্দ করি, ভালো সময় কাটাতে পছন্দ করি। তারমানে এ না যে তাদের সাথে দেখা করা মানে শোয়া হয়ে গেলো। সবাই ভিন্ন, সবাই।

অমিত বলল, আমি দ্বিধায় আছি।

প্রতাপ মুচকে হেসে বলল, প্রান্তিকের সাথে একবার শুয়ে করে আয়। তোর দ্বিধাদ্বন্দ্ব সব দূর হয়ে যাবে। হাহাহাহা।

টং! টং! টং! টং!

অমিত কাক ভেজা হয়ে বাসায় ফিরল। রাস্তায় কোন রিকশা না পেয়ে হেঁটে হেঁটে আসতে হয়েছে। শুকনো রাস্তা হলে একটা কথা ছিল কিন্তু অল্প বৃষ্টিতেই পুরো রাস্তা পানিতে একাকার। নোংরা পানি পারিয়ে বাসায় ঢুকার সাথে সাথে অমিতের মা বীণা রহমান তীক্ষ্ণকণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন, কতবার বলেছি অমিত এরকম কাকভেজা হয়ে ফিরবি না বাসায়। সিএনজি করে চলে আসতি।

অমিত বলল, আজ ভিজতে ইচ্ছা করছিল মা।

-ওসব ঢঙের কথা বলবি না। সবসময় এসব কথা বলে পার পেতে চাস। দেখেছিস জুতার অবস্থা? এটা পড়ে কাল কলেজ যাবি কি করে? যা বাথরুমে ঢুক! গোসল না করে বের হবি না।  

অমিত গোসল সেরে বের হয়েছে। কোমরে টাওয়াল জড়িয়ে আছে, চুল থেকে টপ টপ করে এক দু ফোঁটা পানি পড়ছে। অমিত আয়নার সামনে দাঁড়ালো। আহামরি দেখতে সে? নিজেকে প্রশ্ন করে। সাধারণ দেহের অধিকারী অমিত। চেহারায় আভিজত্য নেই। কোন বিশেষ আকর্ষণ বিন্দুও নেই। অমিত হাত দিয়ে সারা শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে। আয়নার সামনে দাঁড়ালে সে ভাবুক হয়ে যায়। তার ভাবনায় ভাটা পড়লো, মোবাইল বাজচ্ছে। সে পড়ার টেবিলের প্রথম ড্রয়ার খুলল। সেখানে থেকে মোবাইল ফোন বের করলো। অপরিচিত নাম্বার। আজকাল অপরিচিত নাম্বার থেকে অনেক ফোন আসে। কে যে নাম্বারটা দিয়ে বেড়াচ্ছে সেটা অমিত বুঝে উঠতে পারছেনা। কল ধরে বলল, কে বলছিলেন?

ওপাশ থেকে ভারী গলায় একজন পুরুষ বলল, অমিত?

-জী, বলছি।

-অমিত! চিনতে পারছ আমি কে?

-জী না। দয়া করে পরিচয় দিন।

-আমি শাফিন। আমেরিকার শাফিন। চিনতে পারছ?

নাম শুনেই অমিতের বুক ধকধক করা শুরু হল। শাফিন? ও? ও কেন ফোন দিয়েছে? কেন? কি দরকারে?

অমিত কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল, তুমি? এতদিন পর?

-হ্যাঁ। আসলে কি দেশে এসেছি পরশুদিন। মামার বাসায় উঠেছি। রংপুরের বাসায় যাবো সামনের সপ্তাহে। তাই ঢাকায় যেকদিন আছি ভাবছি পরিচিত সবার সাথে দেখা করবো। 

-ও আচ্ছা।

শাফিন বলল, কবে ফ্রি আছো তুমি? দেখা করবো। তোমার সাথে দেখা করবো ভাবতেই অসম্ভব ভালো লাগছে!

অমিত আমতা আমতা করে বলল, ঠিক বলতে পারছি না। কবে… হুম… আমি তোমাকে কিছুক্ষণ পর ফোন করে জানাচ্ছি। মাত্র গোসল সেরে বের হলাম তো।

শাফিন হাসতে হাসতে বলল, কোন সমস্যা নেই। ফোন দিও কিন্তু!

-আচ্ছা।

অমিত কলটা কেটে মূর্তির মতো দাড়িয়ে আছে। আজ থেকে দুই বছর আগে যে অধ্যায় জোর করে বন্ধ করা হয়েছে সেটা কেন আবার খুলল?

শাফিনের সাথে অমিতের পরিচয় ফেইসবুকে। প্রথম প্রথম তারা কথা বলতো পড়াশুনা নিয়ে। শাফিন তখন সদ্য বিলেত গিয়েছে আর অমিত এসএসসি পরীক্ষার্থী। মাসখানেক কথাবার্তা বলার পর শাফিন অদ্ভুত আচরণ শুরু করে। মাঝেমধ্যে তাকে ‘বাবু’, ‘জান’ বলে ডাকতো। অদ্ভুত আচরণ বলার কারণ সে জানতো শাফিন ওরকম না। অর্থাৎ শাফিন যে ছেলেদের পছন্দ করে সেটা অমিত জানতো না। একদিন শাফিন নিজ থেকেই ব্যাপারটা খোলাসা করে। অমিত শুনে খুব বেশি আনন্দিত হয়। শাফিন দেখতে অসম্ভব সুন্দর। মুখের গড়নটা অমিতের বেশ প্রিয়। স্মার্ট, মাথায় বুদ্ধিও আছে ভালো। যখন দু’জন দু’জনের অবস্থা পরিষ্কার করে তখন অমিত খুশিতে টইটুম্বুর। হঠাৎ একদিন শাফিনের বন্ধু কাইয়ুম অমিতকে ফোন করে শাফিনের গুণগান গেয়ে অনেক কথা বলে। অমিত তার মনের কথা অকপটে বলে দেয় আর ওদিকে কাইয়ুম তা শুনে হাসতে হাসতে বলে সে শাফিনের মনের কথা বলতেই ফোন করেছে। অমিত চোখ বড় বড় করে সব শুনে এবং সাথে সাথে আনন্দে ফেটে পড়ে। তার জীবনের সবচে বড় সুখ পেয়েছে এ ভাবতেই অমিতের অজ্ঞান হয়ে যাওয়া অবস্থা । শাফিন অমিতকে প্রপোজ করে এবং অমিত সাদরে তা কবুলও করে। শাফিনকে স্বাগত জানালো তার জীবনে। শুরু হল শাফিন আর অমিতের প্রণয়নামা। আমেরিকার সময় অনুযায়ী অমিত সবসময় শাফিনের সাথে যোগাযোগ রাখতো ভাইবার আর স্কাইপির মাধ্যমে। অমিতের তখন টেস্ট পরীক্ষা চলে। অমিত বেশ খুশি। সুখের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে এমন অবস্থা। পড়াশুনায় মন বসে না। কখন শাফিন ফোন দিবে সে আশায় তার মন উৎলা হয়ে থাকে। দুর্ভাগ্যবশত, প্রণয়নামা বেশিদিন চলেনি! ৯দিনের দিন শাফিন কল, মেসেজ এর রিপ্লাই দেওয়া বন্ধ করে দেয়। অমিতের  মন আনচান করা শুরু করে। সে শাফিনকে ল্যান্ডফোন সহ অন্য অনেকগুলো নাম্বার থেকে ফোন দেয় কিন্তু তাও কোন রেসপন্স নেই। সারাটা দিন অমিত দুশ্চিন্তা করে কাটায় । ১০দিনের দিন শাফিন তাকে ফেইসবুকে বিশাল এক মেসেজ পাঠায় যেটাতে স্পষ্ট লেখা ছিল, তাদের সম্পর্ক আসলে কাজ করছে না। রিলেশনে যাওয়া ঠিক হয়নি। এটা কাজ করবে না ভবিষ্যৎ এ।  অমিত মেসেজ পড়ে কান্নায় ফেটে পড়ে। তার পরেরদিন ছিল বাংলা ২য় পত্র পরীক্ষা। কোন পড়া অমিতের মাথায় ঢুকে না। দুঃখে দুঃখে ৫দিন কাটিয়ে ৬দিনের দিন ফেইসবুকে দেখে শাফিন খুলনার এক ছেলের সাথে রিলেশন স্ট্যাটাস দিয়েছে। অমিত ভেঙ্গে পড়ে। সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ে।

অবশ্য শাফিন অমিতকে জবাবদিহি করতে বাধ্য হয়।

অমিত দয়াশীল। কারোর প্রতি রাগ পুষে রাখতে পারে না। সে শাফিনকে ক্ষমা করে বলেছিল, এমনটা কখনও করো না শাফিন। কখনও কারোর সাথে করো না। 

১০দিনের সম্পর্কের স্মৃতি আজও অমিত ধারণ করে সময় পার করছে। এখনও কাঁদে অমিত, এখনও তার বুক হাহাকার করে দুঃখে।

সব তো ঠিকঠাক হওয়ার পথেই ছিল, কিন্তু বিধাতা আবার কি খেলা শুরু করলেন অমিতের সাথে?    

৪…

প্রান্তিক মোজা খুঁজে পাচ্ছে না। এই ঘর ওই ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজেছে কিন্তু পায়নি। সকাল ৭টা বাজে। তার অফিস ৯টা থেকে। বেসরকারি নামি এক ব্যাংকে বেশ ভালো পোস্টে চাকরি করছে সে। মাইনে বেশ ভালো। সারামাস ফুর্তিতে কাটে। আনন্দে কাটে। প্রান্তিকের বাবা মাহবুবুর রহমান অবসরপ্রাপ্ত আর্মি অফিসার। মা গৃহিণী। ছোটবেলা থেকে বিনা অভাবে বড়লোকি হালে কেটেছে প্রান্তিকের। বাবার নানা জায়গায় পোস্টিং ছিল বলে তাঁকে কাছে পাইনি বেশি কিন্তু এতে দূরত্ব তেমন একটা তৈরি হয়নি। প্রান্তিকরা তিন ভাই। সে মেজো। তার বড় ভাই আর্মি ডাক্তার, ছোট ভাই রাজউক কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। উত্তরায় পাঁচ কাঠা জায়গার উপর পাঁচতলা বাড়ি। প্রান্তিকরা থাকে তিনতলায়। ছিমছাম কলাহলমুক্ত বাড়ি। কলাহল অবশ্য বাড়বে সামনে, বড় ভাই ও তার বউ-বাচ্চা অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বাড়িতে আসবে। একটি মিশনে বড়ভাই উগান্ডায় গিয়েছিল। রীতি অনুযায়ি স্ত্রী শ্বশুরবাড়ি থাকবে কিন্তু তিনি থাকেননি। বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে যায় স্বামী বিদেশ যাওয়ার পরপরই। শ্বশুর-শাশুড়ি খারাপ সেটা ঠিক নয় কিন্তু বউ থাকবে না। আসলে কি কারণে থাকছে না, সেটার একটি প্রগাঢ় কারণ আছে।

আজ সোমবার। সকাল সকাল প্রান্তিকের এমন তাড়াহুড়ো করে এই ঘর, ওই ঘর যাওয়া-আসা দেখে মাহবুবুর সাহেব বিরক্ত হলেন। বাসায় বেশিরভাগ ছেলেমানুষ। অন্য কারোর মোজা পরলেই কিন্তু হয়। না! তা কি পড়বে? এরকম হলে চলবে নাকি? মাহবুবুর সাহেব ডাইনিং টেবিলে বসে চা খাচ্ছেন। সকাল ৫টায় হাঁটতে যান, ফিরেন ৬:৪৫ এ। সময়ের ব্যাপারে তিনি খুব সচেতন। এক মিনিট হেরফের করেন না। আজ ওয়ার্কিং ডে। প্রান্তিকের ছোটভাই নিহালেরও কলেজ আছে আজ। ডাইনিং টেবিলে মাহবুবুর সাহেব আর নিহাল বসে আছে। ওদিকে প্রান্তিক খোঁজাখোঁজি করেই যাচ্ছে। প্রান্তিকের মা জাহানারা রহমান ছেলের কাণ্ড দেখে যথেষ্ট অবাক হচ্ছেন। তিনি বললেন, তোর বাবারটা পরে গেলে কি হয় প্রান্তিক! খুঁজে যখন পাচ্ছিস না…

মাহবুবুর রহমান স্ত্রীকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আহা সাত সকালে ওর সাথে তর্ক করতে যেয়েও না। মেজাজ খারাপ করে অফিসে যাবে।

জাহানারা বললেন, তাই বলে এর একটা সমাধান করা উচিত না?

প্রান্তিক তাড়াহুড়ো করে টেবিলে ছুটে আসলো। একবার মাহবুবুর রহমানের দিকে তাকিয়ে নিহালের দিকে তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলল, দেখি তোর পা!

নিহাল বিরক্তকণ্ঠে বলল, পা দেখবে কেন? আমি আমার মোজাই পরেছি। তুমি ভুল করছ।

-দেখাতে বলেছি, দেখা!

নিহাল খুব অলসভঙ্গিতে প্যান্ট সামান্য উঠিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। সে তার ভাইয়ের মোজা পরেছে। অপরাধী চোখে প্রান্তিকের দিকে তাকিয়ে বলল, ভাইয়া সরি।

প্রান্তিক দাঁত কিড়মিড় করে বলল, খোদার ত্রিশ দিন একই কথা বলতে তোর অসহ্য লাগে না নিহাল? এক্ষনি খোল পা থেকে।

জাহানারা প্রান্তিকের পাশে এসে পিঠে হাত দিয়ে বললেন, বাবা খেতে বস। সকাল সকাল মেজাজ করতে হয় না।

প্রান্তিক চেয়ার টেনে বসলো। জাহানারা বেগম প্রান্তিকের প্লেটে দু’পিস পরোটা এবং প্লেটের কিনারায় সবজি দিলেন। প্রান্তিক আস্তে আস্তে টুকটুক করে খেতে লাগলো। মাহবুবুর সাহেব চা খাচ্ছেন এবং চশমার নিচ দিয়ে ছেলেকে দেখছেন। তিনি সুযোগ বুঝে গলা খাঁকড়ি দিয়ে বললেন, তোর সাথে জরুরী কথা ছিল।

মাথা নিচু করে প্রান্তিক খেতে খেতে বলল, বলো বাবা।

মাহবুবুর সাহেব বললেন, এই বৃহস্পতিবার তোর ভাইয়া আসবে।

প্রান্তিক বলল, আর ভাবী?

-তোর ভাবীও চলে আসবে তার পরের দিন।

-হুম

-তোর কোন সমস্যা নেই তো?

প্রান্তিক খাবার খাওয়া বন্ধ করে মাহবুবুর সাহেবের দিকে তাকালেন। তার বাবার চোখেমুখে  অনুরোধের স্পষ্ট ছায়া ভেসে উঠেছে। প্রান্তিক বাবা মায়াবী চেহারায় নরম হয়ে যায়। নিঃশ্বাস ফেলে দু’বার। ডানপাশে রাখা পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল,  আমাকে পাঁচতলায় শিফট হতে হবে?

মাহবুবুর সাহেব অবাক হয়ে বললেন, তুই ৫তলায় যাবি কেন! তোর বাসা, তুই থাকবি!

-ভাবী যদি ঝামেলা করে?

-ভাবী ঝামেলা করবে মানে! আমার মেজো ছেলে বাড়িতে থাকবে না থাকবে সেটা ছেলের ব্যাপার, ওর তো কোন …

-সে তো বলেই দিয়েছে আমি যেন তার ছোট বোনের সাথে বিয়ে বসি।

মাহবুবুর সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, খারাপ কিন্তু বলেনি। মেয়ে ওয়েল কোয়ালিফাইড! ডাক্তার মেয়ে…

-তো? সে তো আমার চেয়ে আরও ভালো ছেলে পাবে। আর ডাক্তার মেয়ে তো ডাক্তার ছেলেকে বিয়ে করে। আমার সাথে ওকে একদম মানাবে না।

-মানাবে না মানে! আমার তিন ছেলের মধ্যে তুই দেখতে বেশি সুন্দর।

নিহাল প্রতিবাদকন্ঠে বলল, তারমানে আমি দেখতে পচা? ভাইয়াকে দেখেছো? কোথায় প্যান্ট পরে? আংকেল আংকেল লাগে!

প্রান্তিক কর্কশকণ্ঠে বলল, আমি অফিস করতে যাই, মডেলিং করতে না। বুঝলি?

মাহবুবুর সাহেব বললেন, চুপ কর তোরা। প্রান্তিক বাবা আমার কথাটা শুন…

-দেখো বাবা! শাহানা ভাবী শুধুমাত্র তার বোনকে এ বাড়িতে ঢুকানো জন্য আমার সাথে বিয়ে দিতে চাচ্ছে। সে চায় না আমার বউ অন্য পরিবারের কোন মেয়ে হউক। এগুলো তার চালবাজি, কূটবুদ্ধি। ভালো করে জানো প্রথম থেকেই আমি উনাকে পছন্দ করি না। আর উনার বোন ? উনাকে তো আরও না! তার এই চ্যাঁচামেচির আর ঘ্যানঘ্যানানির জন্য আমি ৫তলায় থাকতে শুরু করেছিলাম। তুমি কি চাও আমি আবার উপরে চলে যাই? চাও সেটা?  

মাহবুবুর সাহেব দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আচ্ছা! আচ্ছা! তোকে শাহানার ছোট বোন শাকিলাকে বিয়ে করতে হবে না। কিন্তু তোর পছন্দের কোন মেয়ে আছে?

প্রান্তিক বলল, না।

-বয়স কিন্তু থেমে নেই। ২৭ হয়েছে। বিয়ে করা এখন ঠিক নয় কি?

প্রান্তিক নির্লিপ্তকণ্ঠে বলল, না।

-তাহলে কি করবি?

প্রান্তিকের মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেলো। সে ফোঁসফোঁস করতে করতে বলল, আমি বিয়ে করবো না। আমি বিয়ে করবো না। আমি বিয়ে করবো না। এই আমার শেষ সিদ্ধান্ত!

মাহবুবুর রহমান ঠাণ্ডাগলায় বললেন, বিয়ে না করলে এ বাসায় থাকতে পারবি না তুই।

প্রান্তিক গ্লাসে পানি ঢালল। গদগদ করে পুরো গ্লাসের পানি শেষ করে বলল, মা!

জাহানারা রহমান অস্থিরকন্ঠে বললেন, বল বাবা!

-তোমার বারিধারার ফ্ল্যাটটায় কি আমি থাকতে পারবো?

জাহানারা রহমান ক্ষীণকণ্ঠে বললেন, কেন পারবি না। ওটা তো তোরই…

প্রান্তিক নকল হাসি দিয়ে বলল, আমি আপনার বাসায় থাকতে আগ্রহী না কর্নেল মাহবুবুর রহমান। আমি সামনের মাসেই বারিধারাতে চলে যাবো! ওহ আচ্ছা মনে করো না যে ভাড়া দিবো না! আমার মা’কে হাত খরচ তার পুত্র দিবে। তোমার এই ছোট ছেলে আছে না? তাকে ভালোভাবে পড়াও, তারপর বিয়ে দিও। অবশ্যই বিয়েতে নাচতে নাচতে আসবো!

মাহবুবুর সাহেব বললেন, এটাই তোমার শেষ কথা?

প্রান্তিক বলল, জী!

মাহবুবুর সাহেব বললেন, তাহলে আমার কথা শুনে রাখো। তুমি যদি বিয়ে না করো তাহলে তোমার এই মুখ আমি দেখতে আগ্রহী না। মরো-বাঁচো, অ্যাই ডোন্ট কেয়ার!

-ফাইন! অ্যায় অ্যাম লিভিং।

-এখন অফিসে যাও। ধীরে সুস্থে সামনের মাসে নিজের গন্তব্যে যেও। আমি খারাপ, কিন্তু অতও না।

প্রান্তিক নিজের রুমে চলে গেলো। মাহবুবুর সাহেব চা শেষ করলেন। জাহানারা রহমান বললেন, তুমি কেন এসব কথা এখন তুলতে গেলে?  

মাহবুবুর সাহেব নিহালকে বললেন, কি রে। এখানে এরকম চুপটি মেরে বসে আছিস কেন? সময় দেখেছিস? যা! তাড়াতাড়ি দৌড় দে! কলেজ মিস হয়ে যাবে।

নিহাল উঠে গেলো। মাহবুবুর সাহেব আয়োজন করে নাস্তা খেতে শুরু করলেন। আজ তার জন্য নাস্তায় আছে দুটো রুটি, একটা ডিমের ভাজি, বেগুন-আলুর সবজি এবং আধা কাপ কমলার রস। তিনি কমলার রস খেয়ে বললেন, উহু! লবণ দিয়েছ বেশি! ব্লাড পেশার বেড়ে যাবে তো!

জাহানারা কাপটা মাহবুবুরের কাছ থেকে নিয়ে ঢকঢক করে রস খেয়ে ফেললেন। আড়চোখে বললেন, খেতে ইচ্ছে করছে না মুখ দিয়ে বলতেই পারতে। এতো ভণিতা করবার দরকার ছিল?

মাহবুবুর রহমান হাসতে হাসতে বললেন, তুমি তো জানোই প্রান্তিকের স্বভাব। ও বদমেজাজি হলেও জেদি না। বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারে না। ফুট করে রাগ নেমে পড়ে। ওর আলাদা হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটাকে আমি সম্পূর্ণ পজিটিভলি নিচ্ছি। কারণ আমি জানি ও জেদ করে ১মাস থাকতে পারবে কিন্তু ২মাসের মধ্যেই সে ব্যাক করে বলবে, বাবা! সরি!

জাহানার রহমান দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, আল্লাহ্‌ যেন তোমার কথা শুনেন, এই দুয়া করি।

জাহানারা রহমানের বুকটা কেঁপে উঠলো। মাহবুবুর রহমান তো প্রান্তিকের আসল সত্যটা জানে না। যদি কোনোদিন টের পায় প্রান্তিক ছেলেদের পছন্দ করে, এজন্য বিয়ে করবে না! জানলে কি হবে? তিনি সহ্য করতে পারবেন না। হার্ট অ্যাটাকে নির্ঘাত…! এগুলো ভাবতেই জাহানারার গা ছমছমিয়ে উঠলো।

প্রান্তিক মোজা না পরেই অফিসের উদ্দেশ্য রওনা হল। প্রান্তিককে নিচে নামতে দেখে ড্রাইভার গাড়ি বের করতে উদ্যত হলে তাকে হাত দিয়ে থামিয়ে দিলো। কড়াকন্ঠে বলল, গাড়ী বের করা লাগবে না।

 -স্যার, তাহলে!

প্রান্তিক দ্রুত হাঁটতে লাগলো। ঘড়ি দেখল। ৮টা বাজে। গতকাল সারারাত খুব বৃষ্টি হয়েছে। রাস্তা কর্দমাক্ত নয় কিন্তু কিঞ্চিৎ পিছলা। ফুটপাথ দিয়ে এবার আস্তে আস্তে কদম ফেলছে প্রান্তিক। আজ এরকম রাগান্বিত হয়ে যাওয়াটা কি ঠিক হল তার? অবশ্য রাগ হবার পিছনে শক্ত কারণও আছে। আজই কি মাহবুবুর সাহেব বিয়ের কথা প্রথম তুললেন? অবশ্যই না! বাসায় যতক্ষণ থাকেন ততক্ষণ নানা বাহানায় বিয়ের প্রসঙ্গ তুলবেনই। আর এ’কদিন এতই বলছিলেন যে বাধ্য হয়ে প্রান্তিককে আজ চিৎকার করতে হল। প্রান্তিকের আজ অফিসে যেতে ইচ্ছে করছে না। তার ইচ্ছে করছে রাস্তায় অনন্তকাল ধরে হাঁটতে। কোন টেনশন নেই। কোন ঝামেলা নেই। আশপাশের গাছগাছালি দেখে খুব ভালো লাগছে প্রান্তিকের। হেসে দিলো প্রান্তিক। অমিতের কথা মনে পড়ে গেলো। এই প্রথম কাউকে দেখে সরাসরি বিছানায় নিয়ে যেতে ইচ্ছে করলো না। ছেলের সারল্যতা, বিচক্ষণতা তার কাছে খুব আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। বয়স অনুযায়ী ছেলেমানুষি মনোভাব অনেকাংশ কম। চুম্বনরত অবস্থায় প্রান্তিকের অসাধারণ অনুভূতি জাগ্রত হয়েছিল। অনেকদিন পর কাউকে চুমু খেয়ে তার আত্মা পরিশুদ্ধি লাভ করেছে। সে তার সঠিক ভালোবাসার মানুষ পেয়ে গিয়েছে। প্রান্তিক ভাবছে, সে আর অমিত। একসাথে কতই না ভালো মানাবে। ছোট্ট একটা সংসার, অমিত কলেজে যাবে আর প্রান্তিক চাকরিতে। দিনশেষে একই ছাদের নীচে দেখা হবে তাদের, গভীর চুম্বনে স্বাগত জানাবে দু’জন দুজনাকে। স্বর্গীয় মিলনে মিলিত হবে। প্রান্তিক ফিক করে হেসে ফেলল। আশেপাশে তাকিয়ে রাস্তা পার হয়ে সিএনজি ডাকল। দরদাম করে চড়ে বসলো। খোঁচা-খোঁচা দাড়িতে হাত বুলাতে-বুলাতে বিড়বিড় করে বলল, অমিত আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। আমাকে বিয়ে করবে?

৫…

চিনি লাগবে?

আমি মাথা ঝাঁকিয়ে মানা করলাম। শাফিন সাবধানে কফির কাপটা আমার দিকে এগিয়ে দিলো। আমি হালকা ফুঁ দিয়ে খুব সাবধানে চুমুক দিলাম। ভয়ংকর তিতা! চিনি নেওয়া উচিত ছিল। আমি শাফিনকে চিনি কৌটা দেওয়ার জন্য বলতে গিয়েও বললাম না। শাফিনের কাছে চিনের কৌটা। আমি উপুড় হয়ে তা নিজের কাছে নিয়ে আসলাম। শাফিন ফিক করে হেসে ফেলল। আমি চশমার ফাঁক দিয়ে তার দিকে তাকালাম। শাফিনকে ছবির চেয়েও সুন্দর লাগছে। ফকফকে তরতাজা চেহারা। চোখ দুটো বড় বড়, স্বচ্ছ। পাতলা ঠোঁট।  আমি এক চামচ চিনি দিলাম কাপে। শাফিন বলল, কফি খাচ্ছো নাকি শরবত?

আমি বললাম, বেশি চিনি ছাড়া চা-কফি খেতে পারি না।

-ও।

আমি কৌতূহলীকন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার বয়ফ্রেন্ড কেমন আছে?

শাফিন দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলল, জানি না। ওর সাথে যোগাযোগ হয় না।

আমি অত্যন্ত অবাক হলাম। যোগাযোগ হয় না মানে কি? আমি আড়চোখে বললাম, নতুন কাউকে পেয়েছ নাকি?

শাফিন কপালকুঁচকে বলল, আমাকে কি তোমার প্লে বয় মনে হয়?

আমি হাসতে হাসতে বললাম, আমার কাছে তোমার ক্লিয়ারেন্স চাচ্ছ শাফিন? আমার কাছে?

শাফিন কফির মগের চারপাশে আঙ্গুল দিয়ে অদৃশ্য আঁকাবুকি করতে লাগলো। আমি কফির মগে চুমুক দিলাম। এখন খাওয়া যায়। স্বাদ মোটামোটি। কফির প্রতি আমার আকর্ষণ কোন সময় ছিল না। এখনও নেই। কিন্তু  মাঝেমধ্যে খাই।

শাফিন বলল, আসলে তোমার সাথে আমি খুব অন্যায় করেছি।

আমি বললাম, ২বছর পর টনক নড়ল তোমার?

-তা না। আমি সবসময় অনুশোচনায় ভুগি।

-তা ভালো। এতে অন্তত আত্মা পরিশুদ্ধ হবে।

শাফিন চেয়ার টেনে আরও কাছে এসে বলল, ক্যান ইউ গিভ মি জাস্ট ওয়ান মোর চ্যান্স?

আমি শাফিনের দিকে তাকালাম। স্বচ্ছ দুটো চোখ দেখে আমার গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো। আমি আজও তাকে দেখলে দুর্বল অনুভব করি। কিন্তু শাফিন যা করেছে আমার সাথে সেসব মনে পড়লেই আমার রক্ত গরম হয়ে উঠে। তার জন্য আমি অনেক রজনী দুঃখে-কেঁদে কাটিয়েছি। তার অপরাধের বিচার হবে না?   

আমি কড়াকন্ঠে বললাম, চ্যান্স নিয়ে করবেটা কি?

শাফিন বলল, মানে বুঝতেছো না? তুমি কলেজ কয়েকদিন পর পাশ করবে। তোমার বাবার অবস্থা ভালোই আছে। পাশ করে আমেরিকা চলে আসো। সেখানে আমরা…

-ওয়েট! ওয়েট! শাফিন। কি বলছ এসব?

শাফিন কোমল গলায় বলল, আমরা ওখানে বিয়ে করতে পারি।

আমি চোখমুখ শক্ত করে, একটা ভিলেন হাসি দিয়ে বললাম, আগেরবার আমাকে পটানো অনেক সোজা ছিল শাফিন। বাট! নট নাউ। অ্যাই অ্যাম স্ট্রঙ্গার দ্যান বিফর।

শাফিন বলল, একটা মানুষ ভুল করতেই পারে। তুমি তো আমাকে মাফ করে দিয়েছিলে। তাহলে এখন এসব…

আমি কফির মগ ঠেলে পাশে দিয়ে বললাম,  তোমাকে আসল ব্যাপারটা বলি? তুমি এখন শুধুমাত্র টাইমপাসের জন্য আমাকে এসব বলছ। তোমার একটা মাত্র উদ্দেশ্য বিছানায় নিয়ে যাওয়া। বয়ফ্রেন্ডকে পারোনি তাই আমাকে আবার পটিয়ে বিছানায় নেতে চাচ্ছো। হা হা হা!  

শাফিন রাগান্বিতস্বরে বলল, কি আবোল তাবোল বকছ! আমি সত্যি…

-আগে আমাকে বোলো, You want to sleep with me?

-অমিত তুমি কেন…

-I want answer. Say Yes or No!

-অমিত, কি ধরণের কথা…

-Say Yes or No!

শাফিন কড়াগলায় বলল, ইয়াস! আমি চাই। অবশ্যই চাই। এরমানে এই না…

আমি মুচকি হাসলাম। কফির মগটা হাতে নিয়ে বললাম, আমাকে এখন পটিয়ে বিছানায় নিবে। সেক্স করবে। তারপর যতদিন দেশে থাকবে ততদিন পুতুপুতু করে যাবে। এরপর যখনই বিদেশে পা দিবে, অমিত নামটাই ভুলে যাবে। হা হা হা!  

শাফিন দাঁত কিড়মিড় করে বলল, You are a dirty minded guy!

আমি মুচকি হেসে বললাম, আজকে জানলে?

শাফিন উঠে দাঁড়ালো। আমি আমার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বললাম, খুবই ভালো লাগলো তোমার সাথে দেখা করে। আশা করি তোমার এবারের বাংলাদেশ ভ্রমণ আনন্দদায়ক হবে। শাফিন কিছু না বলে হনহনিয়ে চলে গেলো। আমি কফির মগে তাকালাম। এখনও অর্ধেক বাকি। মগে চুমুক দিলাম। বেশ ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে।

হঠাৎ আমার মুঠোফোন বেজে উঠলো। মুঠোফোন হাতে নিয়ে দেখলাম, প্রান্তিকের ফোন। আমি হাসতে হাসতে কল রিসিভ করে বললাম, এতক্ষণে আমাকে মনে পড়লো?

প্রান্তিক হন্তদন্ত কন্ঠে বলল, তুমি কোথায়?

আমি জানালার পাশে তাকিয়ে বললাম, এইতো বনানীতে।

-বনানীর কোথায়?

-১১তেই আছি। কেন?

-আমি ১০মিনিটের মধ্যে বনানী আসছি। প্লিজ মোড়ে থাকো।

আমি বললাম, সরি প্রান্তিক আজকে না। আমি ফ্যামিলির সাথে এসেছে। আজ আসতে পারবো না।

প্রান্তিক কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, আচ্ছা। মাই ব্যাড লাক।

-বাই প্রান্তিক! পরে কথা হবে!

আমি ফোনটা রেখে দিলাম। আচ্ছা, মিথ্যা বললাম কেন? দেখা তো করতেই পারতাম। আমি দূরে সরে যেতে চাচ্ছি কেন? মানা করে কি ভুল করলাম? আবার ফোন দিবো?

ফোন নাড়াচাড়া করছি। সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। ফোন করবো? না, দরকার নেই।

ফোন টেবিলে রেখে কফির মগ হাতে নিলাম।

কফি দ্রুত শেষ করা উচিত।

৬…

প্রায় ১৫মিনিট ধরে উত্তরার কবর স্থানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে প্রতাপ। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। চারদিকে পাখির কিচিরমিচির। প্রতাপ ঘড়ি দেখল। ৬:৩০ বাজে। কারোর সাথে দেখা করতে আসা অবশ্যই উত্তেজনামূলক কিন্তু যার সাথে দেখা করতে আসা হয় সে যদি অপেক্ষা করায় তাহলে তো বিরক্ত হবারই কথা। প্রতাপ কপাল কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে। তার দু’টি কারণে মেজাজ গরম। এক, কবর স্থানের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। দুই, লোকটি আসতে দেরি করছে। প্রতাপের সাথে লোকটির যোগাযোগ হয়েছে মানজ্যাম এ। দেখতে ভালোই। প্রতাপের টাইপ। কিন্তু, লোকটার বুদ্ধিসুদ্ধি কিছুই নেই বুঝা যাচ্ছে। কবর স্থান কি কখনও দেখা করার জায়গা হয়? পাশে অতগুলো কবর আছে ভাবতেই গা শিরশিরিয়ে উঠে।

প্রতাপ মোবাইল বের করে ফোন দিতে গেলে একটি লোক তার কাঁধে টোকা দেয়। পিছন ঘুরে দেখে লোকটি দাঁড়িয়ে আছে। প্রতাপ বিরক্তিভাব ঢেকে হাসি দিয়ে বলল, এতো দেরি করেছেন কেন আসাদ?

আসাদ মুচকি হেসে বলল, আরে আজ তো অফিস ডে ছিল তাই ফিরতে ফিরতে দেরি হয়ে গেলো। তুমি কিছু খেতে চাও?

প্রতাপ মুচকি হেসে বলল, খেতেই তো এসেছি জনাব।

আসাদ হো! হো! করে হেসে উঠলো।

প্রতাপ বলল, তো কোথায় যাচ্ছি আমরা?

আসাদ বলল, ম্যানজ্যামে যা বলা হয়েছে সেটাই করতে যাচ্ছি। হা হা হা।

প্রতাপ এবং আসাদ একটি রিকশায় উঠলো।

মেঘ ডাকছে। সারাদিন কড়া রোদ ছিল। সন্ধ্যা হওয়া শুরু করলে মেঘ জমতে থাকে আকাশে। গুম গুম করে আকাশ ডেকেই যাচ্ছে। কথায় আছে, যত গর্জে তত বর্ষে না। আজকে হয়তো বৃষ্টি পড়বে না কিন্তু মেঘ তার আপন মনে ডেকেই যাবে।

প্রতাপ একটা চাদর জড়িয়ে বিছানা থেকে নামলো। পুরো ঘর অন্ধকার। মাথা একটু ঝিম ঝিম করছে। দুর্বলও লাগছে। সে মাথায় হাত দিয়ে বলল, লাইট জ্বালাও তো।

আসাদ হাত-পা ছড়িয়ে নগ্ন হয়ে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। প্রতাপের কথা কানে গেলেও উত্তর দিতে ইচ্ছা করলো না। প্রতাপ এবার গম্ভীর গলায় বলল, লাইটটা জ্বালাও।

আসাদ বিড়বিড় করে বলল, আলমারির পিছনে সুইচ। জ্বালিয়ে নাও।

প্রতাপ ধীরে ধীরে আলমারির পিছনে গেলো। হাত দিয়ে খুব কষ্টে সুইচ টিপ দিলো। অনেকগুলো সুইচ। ৩-৪টা টিপার পর বাতি জ্বলল। এনার্জি বাল্ব। চোখ কড়মড় করছে প্রতাপের। হাত দিয়ে চোখ ডলতে ডলতে আলমারির সামনে গেলো। আলমারির দরজার দুটো ভাগ। এক ভাগে আয়না আছে। সে নিজেকে আয়নায় দেখতে লাগলো। ফর্সা শরীর লাল হয়ে গিয়েছে। প্রতাপ ভালো করে লক্ষ করলে তার গলার ডানদিকে বিশাল এক কামড়ের দাগ। প্রতাপ দেখে চিৎকার করে উঠলো। চিৎকার শুনে আসাদ আঁতকে উঠে ধপাস করে নগ্ন অবস্থায় মেঝেতে পড়ে গেলো। কোমরে একটু ব্যথা বিরক্তস্বরে বলল, কি হয়েছে তোমার?    

প্রতাপ কাঁদতে কাঁদতে বলল, এই দাগ নিয়ে যাবো কি করে?

আসাদ মেঝেতে পড়ে থাকা প্যান্ট উঠিয়ে পড়লো। খুব ধীরে উঠে দাড়িয়ে আলমারির কাছে যেয়ে দেখল প্রতাপ একটি চাদর কোমরে জড়িয়ে আয়নার সামনে গলায় হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে। আসাদ হাত সরাল। বিরাট কামড়ের দাগ। কালো হয়ে আছে। এমন জায়গায় দাগটা যে জ্বলজ্বল করছে। প্রতাপ আসাদের পেটে হালকা ঘুষি মেরে বলল, দুষ্টু লোক।

আসাদ প্রতাপের মিষ্টি স্বর শুনে হালকা হাসি দিয়ে বলল, আরও দুষ্টামি করবো কি?

প্রতাপ আসাদকে জড়িয়ে ধরল। আসাদ প্রতাপের কোমরে জড়ানো চাদর মাটিতে ফেলে দিলো। তাদের দু’জনের দেহ আবার উত্তেজিত হয়ে উঠলো।

হঠাৎ আসাদের ফোন বেজে উঠলো। প্রতাপ আসাদের কোমরে হাত দিয়ে বলল, ধরতে হবে না।

আসাদের কোমর থেকে হাত সরিয়ে বলল, হবে। জরুরী ফোন।

আসাদের হন্তদন্ত করে বিছানা গেলো। বালিশের পাশে রাখা ফোন উঠিয়ে কল রিসিভ করে বলল, হ্যাঁ বোলো।

-কোথায় তুমি?

-এইতো বাসায়।

-বের হবে?

আসাদ ঘড়ি দেখে বলল, রাত ৮টা বাজে।

-হুম। আমি উত্তরায় এসেছিলাম এক ফ্রেন্ডের বাসায়।

-আচ্ছা। তুমি ১০মিনিট অপেক্ষা করতে পারবে?

-কোথায়?

– ৭নম্বর সেক্টরের লা-বাম্বার সামনে?

-আচ্ছা। ১০মিনিটের মধ্যে আসো।

আসাদ ফোন রেখেই উত্তেজিতকণ্ঠে বলল, কাপড় পরো প্রতাপ।

প্রতাপ চাদর মাটি থেকে উঠে গায়ে জড়িয়ে বলল, নাহ… ইচ্ছা…

আসাদ কড়াকণ্ঠে বলল, পরো কাপড়।

প্রতাপ রাগান্বিতস্বরে বলল, এরকম করে কথা বলছ কেন? আর কেই বা আসছে? তার জন্যে তুমি এমন তাড়াহুড়া করছ?

-সেটার তোমার ব্যাপার না।

-বাহ, সেক্স শেষ এখন ঝাঁজ দেখাচ্ছো! ছি!

আসাদ দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, সরি। প্রতাপ সরি। আসলে এই ছেলেটাকে আমি খুব পছন্দ করা শুরু করেছি।

প্রতাপ বলল, ও! আমি মনে করেছিলাম…

আসাদ বলল, উই হ্যাড অ্যা রিয়েলি গুড টাইম প্রতাপ। ইউ আর অ্যা নাইস পারসন।

প্রতাপ চাদর ফেলে কাপড় পরা শুরু করলো। প্রতাপ শো শো করে শব্দ করছে। আসাদ শার্ট-প্যান্ট পরে প্রতাপের দিকে তাকাল। প্রতাপের মন খারাপ করেছে। আসাদ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তুমি কি এক্সপেক্ট করেছিলে?

প্রতাপ প্যান্টের বোতাম লাগিয়ে বলল, সত্যি বলতে আমি মনে করেছিলাম তুমি সিঙ্গেল আর হয়তো… ওসব বাদ দাও।

আসাদ প্রতাপের কাঁধে হাত রেখে বলল, আমরা খুব ভালো বন্ধু হতে পারবো।

প্রতাপের চোখ ছল ছল করছে। সে আসাদের ঠোঁটে আলতোভাবে চুমু খেলো। আসাদ চোখ বন্ধ করে প্রতাপের পিঠে ধীরে ধীরে হাত বুলাতে লাগলো।

লা-বাম্বার কাছাকাছি এসে আসাদ ফিসফিসিয়ে প্রতাপকে বলল, এখানে নেমে যেতে পারবে?

প্রতাপের খুব মাথা ধরেছে। মাথার ভিতরটা সাই সাই শব্দ করছে। সে মাথা টিপতে টিপতে বলল, আচ্ছা। বামপাশে সাইড করতে বোলো।

রিকশা লা বাম্বা থেকে বেশ দূরে থামল। প্রতাপ সাবধানে রিক্সা থেকে নেমে বলল, দেখা হবে আবার। ভালো থেকো।

আসাদ হাত নাড়তে নাড়তে বলল, আল্লাহ হাফেজ।

প্রতাপ মাথা নিচু করে হাঁটতে শুরু করল। লা বাম্বার বিপরীত পাশ দিয়ে হাঁটছে। হঠাৎ মাথা এলো আসাদ যাকে পছন্দ করে তাকে এক ঝলক দেখলে কেমন হয়? সে দ্রুত হাঁটতে লাগলো। লা বাম্বার উলটো পাশে একটি আইসক্রিম শপ। প্রতাপ মৃদু পায়ে হেঁটে শপের সামনে আসলো। শপের সামনে একটি গাড়ির পিছনে দাঁড়ালো। আসাদের রিকশা লা-বাম্বার সামনে দাঁড়ানো। সে রিকশায় বসে আছে। সে এদিক-ওদিক তাকাতাকি করছে। হঠাৎ ভিতর থেকে একজন লম্বামত ছেলে বেরিয়ে আসলো। প্রতাপ তার চোখকে বিশ্বাস করতে পারলো না। সে-কি সত্য দেখছে? আরও কাছে এগিয়ে আসলে চেহারা স্পষ্ট হয়ে আসে। দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ল প্রতাপ।

অমিত ও আসাদ পাশাপাশি দাড়িয়ে হাসছে।

অমিত চুল ঠিক করতে করতে বলল, প্রান্তিক তোমাকে খুব দুর্বল লাগছে। কাহিনি কি?

প্রান্তিক হো! হো! হেসে উঠলো।

প্রতাপ দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ল। আসাদের আসল নাম তাহলে প্রান্তিক। সে অমিতকে পছন্দ করে। অমিতও প্রান্তিককে বেশ পছন্দ করে বলে নানান কথা বলেছিল তার কাছে। ওহ, তাহলে সেদিন প্রান্তিকের সাথেই সে দেখা করতে গিয়েছিল। হুম

সজোরে ‘ওহ আচ্ছা’ বলে প্রতাপ পিছনে ঘুরে হাঁটতে লাগলো। 

অমিত প্রান্তিকের দিকে ঘাড় কাত করে বলল, রিকশা ছেড়ে দাও।

প্রান্তিক ভাড়া দিয়ে রিকশা বিদায় করল। প্রান্তিক অমিত পাশাপাশি রাস্তার সাইড দিয়ে হাঁটতে শুরু করল। প্রান্তিক বলল, তো কি খবর তোমার?

অমিত বলল, তেমন ভালো না। কেমন কেমন জানি লাগে।

প্রান্তিক হাসতে হাসতে বলল, প্রেমে পড়েছ নাকি?

অমিত মুচকি হেসে বলল, ওসব আমার হজম হয় না।

-তাহলে কি হজম হয়?

অমিত ঠোঁট চেপে হাসল।

প্রান্তিক বলল, আমি সামনের মাস থেকে নতুন ফ্ল্যাটে উঠছি।

অমিত অবাককণ্ঠে বলল, কেন? বাসায় কোন ঝামেলা হয়েছে?

-আরে না। ভাবছি বিয়েশাদি করবো।

অমিত বলল, বাহ। তাই।

প্রান্তিক মুচকি হেসে বলল, করবা আমাকে বিয়ে?

অমিত হাসতে হাসতে বলল, নাহ বাবা। কিন্তু বিয়েতে অবশ্যই হেল্প করবো।

-সত্যি আমাকে বিয়ে করবে না?

অমিত বলল, দুষ্টামি করো না প্রান্তিক।

প্রান্তিক হাসতে লাগলো।  

অমিত আর প্রান্তিক হেঁটে চলছে।

প্রতাপ হাঁটছে।

কিন্তু সবার পথ ভিন্ন।

সবার চাহিদা ভিন্ন।

সবার মন ভিন্ন।

৭…

সম্পূর্ণ নতুন একটি ফ্ল্যাট সাজানো চাট্টিখানি কথা নয়। প্রয়োজনীয় থেকে শুরু করে বিলাসী জিনিসপত্র সবকিছু মিলেই পূর্ণতা পায় একটি বাড়ী। আজকাল অমিত আর প্রান্তিক বেশ কাছাকাছি চলে এসেছে। সপ্তাহে অন্তত ৪দিন দেখা করে, এই-ওই রেস্তোরাঁ চেখে বেড়ায়। নিজেদেরকে ভালোভাবে নাহলেও কিছুটা জানতে সক্ষম হয়েছে দু’জন। পছন্দ-অপছন্দ এসব ব্যাপারে ধারণা হয়ে গিয়েছে এক মাসের মধ্যে। অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে বুঝা যাচ্ছে, প্রেমের পূর্ববর্তীকাল চলছে। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেম এখনও শুরু হয়নি।

আজ শুক্রবার। সকাল ৭টায় অমিত চলে এসেছে প্রান্তিকের নতুন ফ্ল্যাটে। গোছগাছ করছে। কোন রুমে কোন ফার্নিচার কিভাবে বসবে তা নির্ধারণ করছে অমিত। ১৬০০স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট। বিশাল তিনটা রুম তার সাথে তিনটা বাথরুম। কিচেন ও ডাইনিং একসাথে। বিশাল ড্রয়িংরুম। অমিতের ফ্ল্যাটটা খুব পছন্দ হয়েছে। ফ্ল্যাটটি মোটামোটি সাজানোই ছিল, অমিত সেগুলো রি-আরেঞ্জ করছে এই আর কি! কাপড়চোপড় গোছানো, ইন্টারনেট-ডিসের লাইন নেওয়া, বিছানাপাতি তোলা- বদলানো ইত্যাদি আরও বিভিন্ন কাজ করতে করতে রাত ১১টা বেজে গেলো। প্রান্তিক আর অমিত দু’জনই খুব ক্লান্ত হয়ে সোফায় বসে আছে। সামনের টেবিলে দুটো গ্লাস রাখা। একটাতে গ্লুকোজ আরেকটা হুইস্কি। প্রান্তিকের মদ্যপানের অভ্যাস আছে। মাঝেমাঝে বিশেষ বিশেষ সময়ে একটুআধটু খায়।

অমিত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে বলল, ১১টা বাজে! বাসায় যেতে হবে এক্ষুনি!

প্রান্তিক অমিতের হাতে হাত রেখে বলল, আজ থেকে যাও অমিত। আগামীকাল যেও।

অমিত প্রান্তিকের হাতের উপর হাত রেখে বলল, আজ না। আব্বু রাগ করবে। আমি বাসার বাইরে থাকতে পারি না।

প্রান্তিক মুখ গোমড়া করে বলল, আচ্ছা।

অমিত উঠে দাঁড়ালো। প্রান্তিকের পা ডিঙিয়ে জুতো পড়ল। প্রান্তিক বলল, আমি রেখে আসবো তোমাকে ?

অমিত প্রান্তিকে কাছে এসে হাত দিয়ে গাল স্পর্শ করে বলল, দরকার নেই। তুমি আজ অনেক ক্লান্ত। আরাম করো। আমি আগামীকাল আসবো। কেমন?

প্রান্তিক ম্লানকণ্ঠে বলল, মিস করবো তোমাকে।

অমিত প্রান্তিকের গালে আলতোভাবে চুমু খেলো। প্রান্তিক হেসে ফেলল।

রাত ১২টায় অমিত বাসায় পৌছালো। রিকশা পাচ্ছিলো না, নাহলে আধা ঘন্টা আগেই এসে পড়তো। অমিতদের বাড়িটি ২তলা। নিজেদের বাড়ি। একতলা ভাড়া দেওয়া আর ২তলার পুরোটা নিয়ে তারা থাকে।

মেইন গেট তালাবদ্ধ। অমিত তার বড় বোন শায়লাকে ফোন দিলো। রিং হচ্ছে কিন্তু ধরছে না সে। ৪-৫বার কল করলো। নো রেসপন্স। অমিত এবার চিৎকার করে ডাকা শুরু করলো, আম্মু! আম্মু! আম্মু! আম্মু! আম্মু!

অমিতের চিৎকার শুনে বড় বোন শায়লা বের হয়ে আসলো। দৌড়ে ২তলা থেকে নেমে গেটের কাছে আসলো। তালা খুলতে খুলতে শায়লা বলতে লাগলো, আজ তো সর্বনাশ হয়ে গেলো!

অমিত ফিসফিস করে বলল, বড়সড় ঝগড়া হয়েছে নাকি?

গেট খুলে শায়লা ম্লানকণ্ঠে বলল, ঝগড়া হয়নি। হয়েছে, মহাযুদ্ধ!

অমিত বলল, কি! সব খুলে বল তো।

শায়লা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, উপরে চল।

অমিত দৌড় দিয়ে উপরে উঠে আসলো। দরজা দিয়ে ঢুকেই দেখল তার মা বীণা রহমান ডাইনিং টেবিলে বসে ঝরঝর করে কেঁদেই যাচ্ছে। অমিত ধীরে ধীরে মা’র কাছে যেয়ে পিঠে হাত রেখে বলল, কি হয়েছে মা?

বীণা রহমান কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আমি উনার সাথে সংসার করবো না। মানুষ এতো খারাপ কিভাবে হয়?

অমিত মায়ের চোখ মুছে দিতে দিতে বলল, শায়লা আপু! তুমি বলতো কি হয়েছে?

শায়লা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমরা সবাই ডাইনিং টেবিলে খেতে বসেছিলাম। বাবা তোর কথা জিজ্ঞেস করলে আম্মু উত্তরে বলে তুই তোর এক ফ্রেন্ডের বাসায় গিয়েছিস। সে বাসা বদল করছে তো তাই হেল্প করার জন্য… কথাটা শেষ না হতেই বাবা শ তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। চিৎকার করে বললেন তার ছেলে কেন অন্যের কামলা খাটতে যাবে। এই এক কথা দু কথা করে লাগলো ঝগড়া। এক পর্যায়ে গ্লাস মাটিতে ছুড়ে ফেলে মাকে বলল এক্ষণই তিনি যেন বেরিয়ে যান। আম্মু তর্ক করতে লাগলে তার হাত খুব জোরে করে ধরে আব্বু। আমি তৎক্ষণাৎ চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেই। ভাড়াটিয়ারা সবাই উপরে উঠে আসে। কি বিচ্ছিরি অবস্থা হয়েছিল তখন। ছিঃ।

কথাগুলো শুনে অমিত তার রাগ সামলাতে পারলো না। সে ফোঁসফোঁস করতে করতে তার বাবার ঘরের দরজায় জোরে থাপড়াতে লাগলো। ৩-৪ থাপড়ানোর পর অমিতের বাবা জাহিদুর বের হয়ে আসলেন। ক্রুদ্ধকণ্ঠে বললেন, তোর এত্ত বড় সাহস! আমার রুমের দরজা এভাবে ধাক্কাছিস!

অমিত চিৎকার করে বলল, তুমি আমার মা’র সাথে এমন জঘন্য ব্যবহার করেছ কোন সাহসে?

কথাটা হজম না করতে পেরে জাহিদুর ঠাস করে ছেলের গালে থাপ্পড় মেরে বসে। অমিত চড় খেয়ে হতবিহবল হয়ে যায়। গালে হাত দিয়ে পাশে থাকা চেয়ারে বসে পড়ে। জাহিদুর চিৎকার করে বলতে লাগলেন, বের হয়ে যা আমার বাসা থেকে। আমার বাসা থেকে এক্ষনি বের হয়ে যা। তোর মতো বেয়াদব ছেলে আমি আমার বাসায় রাখব না।  পড়ালেখার বেলায় ঠনঠন কিন্তু আড্ডাবাজির বেলায়…। যত্তসব!

অমিত চিৎকার করে বলল, আমিও থাকতে চাই না এই জাহান্নামে। চেয়ার থেকে উঠে শব্দ করে দরজা খুলে ঠাস করে লাগিয়ে গটগট করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসলো। গেট দিয়ে বের হয়ে রাস্তায় হাঁটতে লাগলো। রাগে ফোঁসফোঁস করছে অমিত।  বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর সে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ালো। হাত ঘড়িতে সময় দেখল, সাড়ে ১২টা বাজে। নিঃশ্বাস ছেড়ে মোবাইলটা বের করে ক্রমাগত টিপতে লাগলো। কি করবে, কি করবে বলে প্রশ্ন করেই যাচ্ছে নিজেকে। উত্তর না পেয়ে সে ফোন করল প্রান্তিককে। ৪বার কল করলো। ধরল না। অমিত আশা ছাড়ল না। ক্রমাগত করেই যাচ্ছে। ১৩বারের বেলায় প্রান্তিক ফোন ধরে বলল, ঘুমাচ্ছি। ক্লান্ত খুব, কাল কথা বলি?

অমিত কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি বাসা থেকে বের হয়ে গিয়েছি।

প্রান্তিক কথাটা শুনে বেশ অবাক হল। হড়মড় করে বিছানা থেকে উঠে বসলো। কাঁপাস্বরে বলল, কি হয়েছে বাসায়? এতো রাতে কেন তুমি বাইরে বের হলে?

অমিত বলল, এখন আমি কি করবো?

প্রান্তিক কিছুক্ষণ ভাবল। ছেলেটা এতো রাতে বেরিয়ে গেছে নিশ্চয় এর পিছনে কোন কারণ আছে। প্রান্তিক বলল, দেরি না করে আমার এখানে চলে আসো। সিএনজী নাও। টাকা পয়সা সাথে আছে তো?

অমিত ক্ষীণস্বরে বলল, আছে অল্প।

-ভাড়া হয়ে যাবে?

-হ্যাঁ হবে।

প্রান্তিক কোমলকন্ঠে বলল, দেরি করো না।

অমিত প্রান্তিককে জড়িয়ে ভেউভেউ করে কাঁদা শুরু করলো। বাসায় যা ঘটনা ঘটেছে তা কাঁদতে কাঁদতে সব উগড়ে ফেললো। প্রান্তিক অমিতকে তার রুমে নিয়ে আসলো। বিছানায় বসিয়ে বলল, মাঝেমধ্যে এমন ঝগড়া হয়?

প্রান্তিক হেঁচকি তুলে বলল, হ্যাঁ হয়। সবসময় তার রাগ উঠলে বলে বাসা থেকে বেরিয়ে যাও। অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে। একদিন বের হয়ে গিয়েছিলাম সুটকেস বেঁধে। থাকতে পারিনি বেশিক্ষণ। বাসায় চলে গিয়েছিলাম।

প্রান্তিক সাইড টেবিলে রাখা জগ তুলে গ্লাসে পানি ঢালল। গ্লাসটি অমিতের দিকে দিয়ে বলল, পানি খাও। হেঁচকি তুলছ।

অমিত কেঁদেই চলছে। জোর করে প্রান্তিক অমিতকে পানি খাইয়ে দিলো। অমিত কাঁদছে। হেঁচকি তুলে কাঁদছে। প্রান্তিক কখনও একটা ছেলেমানুষকে এতোটা অসহায় ভাবে কাঁদতে দেখেনি। তার বুক মুচড়ে উঠলো। বাথরুমে নিয়ে যেয়ে মুখ ধুয়ে ফ্রেশ করিয়ে অমিতকে বিছানায় শুইয়ে দিল। বাতি নিভিয়ে প্রান্তিক বিছানায় গেল। প্রান্তিক ডানদিকে এবং অমিত বামদিকে। বিছানার শেষ প্রান্তে কুকড়িয়ে শুয়ে আছে অমিত। শ্বাস তুলে তুলে কাঁদছে। প্রান্তিক অমিতকে কাছে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলো। অমিত প্রান্তিকের বুকে মাথা গুজে ঘুমাতে চেষ্টা করলো। অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছে। যেন সে দুনিয়ার সবচে সুখের জায়গায় ঘুমানোর সুযোগ পেয়েছে। প্রান্তিকের গায়ের সব ওম তার দেহকে শান্তি দিচ্ছি। মনে হচ্ছে তার সবচে আপন মানুষ তাকে জড়িয়ে আছে।

অমিত ঘুমিয়ে পড়লো।  

৮…

দিনটি ছিল শনিবার। আজ প্রান্তিকের অফিস নেই তাই বেলা পর্যন্ত ঘুমাল। অবশ্য সে আজ একা নয়, অমিত আছে। গত সপ্তাহের ঘটনার পর অমিত নিজেকে খুব একটা বেশি সামলিয়ে উঠতে পারেনি। এক সপ্তাহ ধরে সে প্রান্তিকের বাসায়। তার বাবা একবারও ছেলের খবর নেয়নি। অমিতের তার মা’র সাথে কথা হয়েছে। ঝগড়ার পরদিন তিনি অমিতের নানার বাড়িতে চলে গিয়েছেন। বাসা থেকে তাকেও ফোন দেওয়া হয়নি। তিনিও করেননি। বীণা রহমান অনেকবার অমিতকে বলেছেন নানুর বাড়িতে চলে আসতে কিন্তু অমিতের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও প্রান্তিক বাঁধা দিচ্ছে বারবার। সে তাকে যেতে দিবে না। বারবার বলছে পরে যেও।পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হতে দাও। অমিতের এই সপ্তাহ তেমন আলস্যে কাটেনি। রান্নাবান্না শখের বশে শিখেছিল সেটার উপযুক্ত ব্যবহার সারা সপ্তাহ জুড়ে করেছে। প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন একটা ডিশ তৈরি করেছে। এতে অন্তত তার মন খারাপের ঘনত্ব কমেছে। প্রান্তিকের অমিতের তৈরি করা খাবারগুলো খুব পছন্দ হয়েছে। প্রথমদিন প্রান্তিকের কাছে ঘুমালেও পরদিন থেকে অমিত পাশের ঘরে থাকা শুরু করে। প্রান্তিকের কাছে ব্যাপারটা খারাপ লাগলেও  ব্যাপারটাকে পুরোপুরি ধামাচাপা দিয়ে সানন্দে অমিতের সাথে কথা বলে যাচ্ছে।

দুপুর ১টা বাজে। প্রান্তিকের ফোন বাজচ্ছে। ফোনের শব্দে তড়িঘড়ি করে উঠে পড়লো। আশেপাশে তাকিয়ে দেখল অমিত নেই। চুল ঠিক করতে করতে ফোন রিসিভ করে বলল, হ্যাঁ দোস্ত বল।

ওপাশ হতে আদিব বলল, তুই বলে বারিধারাতে চলে এসেছিস?

 ঘাড়ে হাত দিয়ে বলল, হ্যাঁ  এসেছি। কেমন আছিস বল!

-ওসব কথা পরে হবে। আমি আর শোয়েব আসছি তোর বাসায়। খানা পাওয়া যাবে তো?

প্রান্তিক হাসতে হাসতে বলল, আরে দোস্ত পাওয়া যাবে। টেনশন করিস কেন! চলে অ্যায়!

প্রান্তিক ফোন রেখে দ্রুত খাট থেকে নামলো। পাশের রুমে যেয়ে দেখল অমিত রুমে নেই। ড্রয়িং রুম থেকে টিভির সাউন্ড শুনা যাচ্ছে। সে পা টিপেটিপে ড্রয়িং রুমে গেলো। সোফায় শুয়ে শুয়ে অমিত টিভি দেখছে। নকল কাশি দিয়ে প্রান্তিক বলল, কি করছ অমিত?

অমিত ঘুরে তাকিয়ে বলল, এইতো টিভি দেখছি। লর্ড অফ দ্যা রিং’স এর লাস্টের পার্টটা দেখছি। অসাধারণ সিনেমা!

প্রান্তিক বলল, ওহ আচ্ছা।

অমিত দাড়াতে দাড়াতে বলল, পরোটা এবং ভাজি আছে। বুয়া সকালবেলা বানিয়ে দিয়ে গিয়েছে। খাবে?

প্রান্তিক বলল, না এখন খাবো না। ১টা বাজে। তুমি কি চট করে বিরিয়ানি হাউজ থেকে ৪টা বিরিয়ানি কিনে নিয়ে আসতে পারবে? বেশিদূর না। কাছেই।

অমিত কৌতুহলীকন্ঠে বলল, ৪টা কেন?

-ওহ আসলে হয়েছেটা কি, আম, আমার ২জন বন্ধু আসবে আধাঘন্টার মধ্যে।  সেজন্যে…

-ঠিক আছে। নিয়ে আসছি।

প্রান্তিক বলল, তোমার কোন সমস্যা হবে না তো?

-আরে বিরিয়ানি আনতে কিসের সমস্যা!

প্রান্তিক মৃদুকণ্ঠে বলল, না না। মানে আমার ফ্রেন্ডরা আসবে…

অমিত মুচকি হেসে বলল, তোমার বাসায় তোমার ফ্রেন্ডরা আসবে, এতে আমার সমস্যা হবে কেন?

প্রান্তিক নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো অমিতের দিকে। অমিত মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেলো।

আরে! দোস্ত! কি খবর!

প্রান্তিককে দেখে তার দুই বন্ধু উল্লাসে ফেটে পড়লো। এক এক করে বুকে জড়িয়ে ধরল। তারা সবাই ড্রয়িং রুমে বসেছে।

শোয়েব বলল, দোস্ত! কি কামটা করলি! একা বাসা নিয়ে থাকা শুরু করলি! তোর তো মামা লটারি লেগে গেসে। এখন যখন তখন এনে ধুসধাস! হাহাহা!

সবাই গলা ছাড়িয়ে হাসতে শুরু করলো। শোয়েব আদিবকে বলল, কথা বলছিস না কেন তুই?

প্রান্তিক বলল, কি করে কথা বলবে বল? যাকে ছেড়ে দিয়েছিল তার সাথে একটু শুইতে চেয়েছিল। আর সেই ছেলে বলে রাগারাগি করে অপমান করে ওকে বিদায় করে দিয়েছে!

আদিব কপালকুঁচকে বলল, ওসব কথা রাখ তো। মানুষের তো ভুল হতেই পারে তাই না? আর এখনকার পিচ্চি পোলাপানগুলো এতো সিয়ানা হয়েছে কি আর বলবো! কি সহজে ধরে ফেললো! হারামজাদা।

শোয়েব উঠে দাড়িরে ঘুরে ঘুরে বাসা দেখতে শুরু করলো। এক পর্যায়ে বিকট এক চিৎকার করে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে বলল, শয়তান! কাকে ঘরে রেখেছিস তুই? নতুন বাচ্চা নাকি? হা!হা!হা!

আদিব সজোরে প্রান্তিকের পিঠে চাপড় দিয়ে বলল, দোস্ত বল কে রে? কোন টুইঙ্ক নাকি ? বল বল!

প্রান্তিক মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলল, আরে না। তা না। আমার ফুফাতো ভাই। কলেজে পড়ে…

ওওওওওওও… বলে আদিব আর শোয়েব বিকট চিৎকার করে হাসতে শুরু করল। হাসি থামিয়ে বলল, হাংকি-পাংকি টাইপ কথা বলবি না আমাদের। তুই টুইঙ্ক অ্যাডেক্টেড সেটা আমরা জানি। তো কাল রাতে কেমন ব্যাং-ব্যাং হল? মাল ভালো? নিতে পারে ভালো?

প্রান্তিক বিরক্তগলায় বলল, কি শুরু করলি তোরা।

আদিব বলল, সাধু সেজো না বাবু। তোমার স্বভাব আমাদের জানা আছে। ঢাকার সব সুন্দর সুন্দর বাচ্চা ছেলে খাও তুমি।

শোয়েব সোফায় বসে এক পা আরেক পায়ের উপর তুলল। হাত দুটো মাথার কাছে নিয়ে বলল, কালকে একটারে খাইসি দোস্ত। দু’জনে মিলে। জোস ছিল! ছেলের নেওয়ার শক্তি। মাই গড! মারা খাইতে খাইতে হল লুজ হয়ে গেসে। আর যা শব্দ করে। হা হা হা। এখনকার পোলাপান পর্ণ দেখে দেখে ভালোই ট্রেনড হচ্ছে।  

আদিব মুখ ভেঙচি দিয়ে বলল, হ মিয়া! আনালাম আমি আর খাইলা তুমি!

শোয়েব বলল, পছন্দ করসে তো আমাকে। বুঝতে হয়।

প্রান্তিকের পায়ে জোরে বাড়ি মেরে আদিব বলল, চল দোস্ত। তোর সাথে কখনও গ্যাংব্যাং করা হয় নাই। ওই ছেলে কই? তাড়াতাড়ি ডাক। মাল নিশ্চয় ভালো হওয়ার কথা। তোর চয়েস বলে কথা!

প্রান্তিক উঠে দাঁড়ালো। দ্রুত কদম ফেলে ড্রয়িং রুম থেকে বের হওয়ার সময় অমিতের সাথে মুখোমুখি দেখা। অমিত মুখ শক্ত করে বলল, নিয়ে এসেছি। আমার বাসায় যেতে হবে।

অমিতের কথা শুনে আদিব আর শোয়েব চুপ করে গেলো। আদিব ফিসফিস করে শোয়েবকে বলল, কিছু বলিস না। দেখিস প্রান্তিক ওই ছেলেকে ঠিকই পটিয়ে নিয়ে আসবে। ওয়েট কর।

আদিব বলল, দোস্ত আজকেও তাহলে…

শোয়েব ফিসফিস করে বলল, হ মামা! হ!   

প্রান্তিক আমতা আমতা করে বলল, বাসায় যাবে কেন? বললাম না…

অমিত কড়াকন্ঠে বলল, আমি তোমাদের খাবার হতে পারবো না। আমি চলে যাবো এক্ষণি।  

অমিতের চোখ ছলছল করছে। প্রান্তিকের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। অমিতকে সে ভয়ংকর পছন্দ করে। পছন্দ না। ভালোবেসে ফেলেছে তাকে। নিয়মিত সেক্স করা তার স্বভাব। এটা সত্য  কিন্ত এই প্রথম কাউকে সে খুব গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলেছে। কি করবে এখন প্রান্তিক? অমিত তো মনে হয় তাকে আর পছন্দ করবে না। তার এই নোংরা অতীত কিভাবে অমিত গ্রহণ করবে?

প্রান্তিক অমিতের হাত ধরে বলল, আসো দেখা করো। ওরা ফাজলামি করতে খুব পছন্দ করে তো তাই…

অমিত প্রান্তিকের হাত সরিয়ে বলল, সামনে হাঁটো।

প্রান্তিক সামনে, পিছনে অমিত। ড্রয়িংরুমে অমিত ঢুকতেই আদিবের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। আদিব মনে মনে বলে, অমিত! এই ছেলে এইখানে কি করে!

অমিত আদিবকে দেখে বিচলিত হয়নি। গলার স্বর শুনেই সে আন্দাজ করে ফেলেছিল এটা সেই। প্রান্তিক বলল, এই হল অমিত। আর অমিত এ হল আদিব আর ও হল শোয়েব।

অমিত হাসতে হাসতে বলল, উনাকে আমি চিনি শাফিন হিসেবে। তারমানে শাফিন নামটাও নকল?

আদিব মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। অমিত হাসতে হাসতে বলল, মাথা উঁচু করে হ্যান্ডশেক করুন আদিব ওরফ শাফিন। ছেলে খাওয়া, টুইঙ্ক খাওয়া – বাহ! কি কথাবার্তা এদের! মানে গে বললেই মুখ ভেচকি দিয়ে বলা হয় ওসব আমরা না কিন্তু খাওয়ার বেলায় সবগুলোর মূলদন্ড খাড়া হয়েই থাকে! বাহ!

প্রান্তিক বলল, তুমি এভাবে কথা বলছ কেন ওদের সাথে। ওরা তোমার বড়…

অমিত তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলল, আদিব আমি কিছু বলবো?

আদিব ঘড়ি দেখে বলল, দোস্ত আমাদের আসলে বের হতে হবে। তোর বাসায় আজ খেতে পারবো না। মজা করছিলাম। দোস্ত প্লিজ মাইন্ড করিস না! অ্যায় শোয়েব চল তো!

আদিব শোয়েবের শার্ট ধরে জোর করে টেনে নিয়ে গেলো। প্রান্তিক রাগান্বিত অবস্থায় তার রুমের দিকে ছুটে গেলো। অমিত পিছন পিছন গেলো। প্রান্তিক ক্রুদ্ধকন্ঠে বলল, এমন আচরণ করা তোমার ঠিক হয়নি।

অমিত চিৎকারকণ্ঠে বলল, আদিব যে ছেলেটার কথা বলছিল সেটা আমি! বুঝেছ?

প্রান্তিক আড়চোখে বলল, মানে কী?

-মানে হল, আদিবকে যে ছেলে মানা করেছে সেটা আমি। বুঝলে ? আমি!

কথাগুলো বলে অমিত কাঁদতে শুরু করলো। তার সাথে কি হচ্ছে এসব? বিন্দুমাত্র শান্তি নেই তার জীবনে। যেখানেই সে যায় সেখানেই ঝামেলা। অশান্তি! অশান্তি!

প্রান্তিক ভাবলেশহীন অবস্থায় বসে পড়লো। অমিত বলল, আমি আজকে চলে যাচ্ছি। আমার পক্ষে তোমার বাসায় থাকা সম্ভব না। আমার কারণে তুমি নামীদামী –সুন্দর টুইঙ্ক খেতে পাচ্ছ না। অ্যায় অ্যাম এক্সট্রেমলি সরি। আমাকে ১সপ্তাহ আশ্রয় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

প্রান্তিক অম্লানকন্ঠে বলল, চলে যাবা?

অমিত চোখ মুছতে মুছতে বলল, হ্যাঁ।

প্রান্তিক অমিতের কাছে এসে শক্ত করে কোমর জড়িয়ে ধরল। অমিতের চিবুক উঁচু করে বলল, আমি তোমাকে যেতে দিবো না।

অমিত হেঁচকি তুলে বলল, কেন?

প্রান্তিকের ঠোঁট কাঁপছে। সে কি তার মনের কথা আজ বলবে? প্রান্তিক আরও শক্ত করে অমিতকে জড়িয়ে ধরল। অমিত বলল, ছাড়ো প্রান্তিক।

-নাহ ছাড়বো না।

-বেশি বেশি হচ্ছে।

প্রান্তিক চোখ বন্ধ করে বলল, আমি তোমাকে ভালোবাসি।

অমিত অবাক চোখে তাকাল। প্রান্তিক চোখ বন্ধ করে আছে। অমিত বলল, চোখ খুলো।

প্রান্তিক ধীরে ধীরে চোখ খুলল। অমিতের মুখে মায়াবী হাসি।

অমিত বলল, আবার বোলো।

প্রান্তিক দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।

অমিত খুব জোরে প্রান্তিক হাত ছুটিয়ে নিলো। সে দূরে সরতে সরতে বলল, ভালোবাসা কতক্ষণ থাকবে? সেক্স পর্যন্ত?

প্রান্তিক কপাল কুঁচকে বলল, তুমি কি বলছ এসব?  

-যা বলছি তাই সত্য। আমি কাউকে বিশ্বাস করি না। আমি কাউকে বিশ্বাস করি না।

অমিত ছুটে পাশের রুমে চলে এলো।

অস্বস্থি লাগছে। খুব বেশি হয়রাণ লাগছে। মনে হচ্ছে এক মুহূর্তেই তার জীবন পাল্টে তছনছ হয়ে যেতে যেতে টিকে আছে। একদিকে প্রান্তিকের নোংরা সত্য, আরেকদিকে তার ভালোবাসা। কোনটাকে সে প্রাধান্য দিবে? সে নিজেও প্রচণ্ড পছন্দ করা শুরু করেছে প্রান্তিককে। এখন কি করবে সে?

মোবাইলটা নিয়ে প্রতাপকে কল করলো অমিত। ২বার রিং হয়ে প্রতাপ কল রিসিভ করে বলল, বল।

অমিত কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, প্রান্তিক র‍্যান্ডোমলি সেক্স করে।

প্রতাপ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, তো?

-তো মানে? সে আমাকে বলেছিল…

প্রতাপ বলল, সে তো এমন বলেনি যে আগে কখনও সেক্স করেনি। সেক্সকে এতো খারাপভাবে দেখার কি আছে? এটা ফিজিক্যাল নিড।

অমিত বলল, প্রান্তিক আমাকে প্রপোজ করেছে।

প্রতাপ হেসে বলল, গাধা হ্যাঁ বল। তুই ওকে পছন্দ করিস, ও করে। ব্যস!

অমিত আমতা আমতা করে বলল, তাহলে যে…

-কেউ সতীসাধ্বী না রে। কেউ না। আর এমন মূর্খদের মতো কথা বলবি না। যা প্রান্তিকের কাছে যেয়ে নিজের মনের কথা বল।

-হুম। যাচ্ছি।

প্রতাপ হেসে বলল, যা!

অমিত ধীরে ধীরে প্রান্তিকের ঘরে ঢুকল। প্রান্তিক দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কুঁজো হয়ে বসে আছে বিছানায়। অমিত গলা খাঁকড়ি দিলো। প্রান্তিক হাত সরিয়ে অমিতের দিকে তাকাল। অমিত ধীরে ধীরে কাছে গেলো। প্রান্তিকের হাতটা শক্ত করে ধরে অমিত তাতে চুমু খেলো।

প্রান্তিক অমিতকে জড়িয়ে ধরল।

অমিতের গলা কাঁপছে। কাউকে নিজের মনের কথা বলতে গেলে কি এতই অস্বস্থিরতা কাজ করে?

৯…

আমি স্বপ্ন দেখছি না। আমার চোখের সামনে যা ঘটছে তা সত্য। আমার চারপাশে যা ঘটছে তা সত্য। আমি সত্যি স্বপ্ন দেখছি না।

আজ, আজ হল আমার বিয়ে। আর ১০টা বিয়ের মতো সাধারণ নয়। স্বপ্নে যেমন ভেবেছিলাম সেরকমটাই হচ্ছে। আমি ভেবেছিলাম, আমার মনের মানুষটির সাথে সাগর পাড়ের পানিতে পা ভিজিয়ে দাঁড়াবো। তারপর দু’জন দুজনার দিকে তাকিয়ে আংটি বদল করবো এবং গভীর চুমু খেয়ে নিজেদের বরণ করবো।

আজ তাই হচ্ছে। আমি আর প্রান্তিক দু’জন সাদা রঙের সুতি পাঞ্জাবী পরেছি। সূর্য মাত্র ডুবছে। হালকা লাল-হলুদ মিশানো আভা আকাশে লেগে আছে। ভাটা চলছে। মনে হচ্ছে আমাকে পানি টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সাগর পাড়ের সবচে সুনসান জায়গায় আমরা দাঁড়ানো। কোন মানুষের চিহ্নমাত্র নেই। শুধু আমি আর সে। আমার হাতে দুটো আংটি। একটি আংটি প্রান্তিকের হাতে দিয়ে বললাম, তোমাকে আজ রাজপুত্রের মতো দেখাচ্ছে।

প্রান্তিক মিষ্টি করে হাসল। আমাত হাত টেনে নিজের কাছে নিলো। আংটিটা পরাল। আমিও তার হাত টেনে নিলাম। কিন্তু, আমি সময় নিলাম। অল্প অল্প করে আঙ্গুলে ঢুকালাম। আংটি পরানো পর্ব শেষে আমরা বুক ভরে শ্বাস নিলাম। একসাথে শ্বাস ছেড়ে বলল, আমরা আজীবন একসাথে থাকবো।

প্রান্তিকের সম্ভবত তড় সইছিল না। সে আমাকে জড়িয়ে চুমু খেতে লাগলো। ঠোঁট কামড়ে একাকার। আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, আস্তে আস্তে। আমার ঠোঁটটা খেয়ে ফেলবে নাকি?

প্রান্তিক হাসল। তার হাসি দেখে আমার বুকটা খুশিতে ভরে উঠলো। হাত ধরে সমুদ্রের দিকে তাকালাম।

আমি প্রান্তিকের কাছে ঘেঁষে কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজলাম। মনে হচ্ছে সব চাওয়া-পাওয়ার হিসাবনিকাশ আজ শেষ হল।    

    অপরাহ্ণ

১০…

তারপর কি হল?

অমিত মুচকি হাসলো। সোফা থেকে উঠে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো। বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির ছাঁট গায়ে এসে পড়ছে। আজ সকাল থেকে একটা চাদর জড়িয়ে ঘুরছে। খুব শীত শীত করছে আজ। বৃষ্টির দিনে কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুমানোর অভ্যাসের কথা মনে পড়ে গেলো। এখন অবশ্য ঘুমানো যায় না। কাজ থাকে অনেক।

অমিত মৃদুস্বরে বলল, তারপর আর কি হবে? দেখতেই পাচ্ছ কি হচ্ছে…

প্রশ্নকর্তা উঠে দাড়িয়ে অমিতের পাশে এসে দাঁড়ালো। পকেট থেকে সিগারেট বের করলো। আগুন ধরিয়ে আয়োজন করে ফুঁ দিল। জানালার দিকে তাকিয়ে অমিতকে বলল, কি হল এরপর?

অমিত চোখমুখ শক্ত করে বাইরে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টি কমে গিয়েছে। কয়েক ফোঁটা, কয়েক ফোঁটা পড়ছে। প্রশ্নকর্তার সিগারেট শেষ। তিনি জানালা খুলে খুব জোরে অবশিষ্ট অংশ বাইরে ছুড়ে মারল। অমিত দেখে অত্যন্ত অবাক হয়ে বলল, এটা কি করলে? অ্যাস্ট্রে ঘরেই ছিল। আর তুমি…

প্রশ্নকর্তা হাসতে হাসতে বলল, তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করাই আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল। এখন বল, সম্পর্কের ঝামেলা কবে থেকে শুরু হয়?

অমিত মুচকি হেসে বলল, মিলনের গল্প শুনবে না?

প্রশ্নকর্তা আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, না না! ওসব শুনে নিজেকে উত্তেজিত করতে চাই না। প্রেমহীন এই জীবনে ওসব শুনে রাতে কাটবে না। হাহাহাহা!

কলিংবেল বাজচ্ছে। অমিত প্রশ্নকর্তার দিকে তাকিয়ে বলল, খুলে আসছি।

প্রশ্নকর্তা সিগারেট আরামে ফুঁকছেন।

অমিত দরজা খুলে দেখল প্রান্তিক এসেছে। ভিজে এসেছে সে। অমিত ভিতর থেকে একটা টাওয়াল নিয়ে এলো। প্রান্তিক চেয়ারে বসে জুতো খুলছে। অমিত টাওয়ালটা দিয়ে খুব যত্নে মাথা মুছে দিলো প্রান্তিকের। প্রান্তিক একটু বিরক্ত হয়ে বলল, আহা করছ কি। আমি করে নিব।

প্রশ্নকর্তা সিগারেট শেষ করে প্রান্তিকের দিকে এগিয়ে গেলো। প্রান্তিক প্রশ্নকর্তাকে দেখে বলল, আরে রাকিব! কি খবর!

-এইতো ভালো। অনেকদিন পর দেশে আসলাম তো, তাই ভাবলাম অমিতের সাথে দেখা করে যাই।

-ও। কবে দেশে ফিরলে?

-এইতো দুইদিন হবে।

-আমারও আজ ছুটি ছিল। কিন্তু বাবার কাছে একটা জরুরী কাজে যেতে হয়েছে। বৃষ্টির দিনে বের হওয়াই ঝামেলা!

রাকিব বলল, ওহ আচ্ছা।

অমিত প্রান্তিককে জিজ্ঞেস করলো, কিছু খাবে ?

প্রান্তিক বলল, নাহ কিছু খাবো না।

-ঠিক আছে।

প্রান্তিক টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বলল, শুনো আমি আজ রাতের ফ্লাইটে চিটাগাং যাচ্ছি। ফ্যামিলির কাজে।

অমিত আড়চোখে বলল, হঠাৎ চিটাগাং? কিছু হয়েছে?

-বললাম তো ফ্যামিলির কাজে। এতো জেরা করার কি আছে।

রাকিব বলল, কইদিনের জন্য যাচ্ছ?

প্রান্তিক বলল, এইতো ৩-৪দিন।

-ওহ আচ্ছা। অমিত থাকতে পারবে একা একা?

অমিত বলল, আমি কি ছোট খুকী যে থাকতে পারবো না?

প্রান্তিক অমিতকে বলল, চাদর পরে ঘুরাঘুরি করছ কেন? আজ ইউনিভার্সিটিতে যাওনি?

অমিত মলিনকন্ঠে বলল, শরীর ভালো ঠেকছিল না তাই…

-ওসব ভোগাস কথা।

অমিত দাঁত কিড়মিড় করে বলল, আজকাল আমার সব কথাই ভোগাস লাগে।

প্রান্তিক বিরক্তকন্ঠে বলল, শুনো! মেয়ে মানুষের মতো আচরণ করবে না। তুমি আমার স্ত্রী না। বুঝছ? ছেলে মানুষ ছেলে মানুষের মতোই থাকবে।

প্রান্তিক মাথা মুছতে মুছতে রুমে চলে গেলো। অমিত জমিনের দিকে তাকিয়ে আছে। রাকিব বলল, প্রান্তিক অনেক বদলে গিয়েছে।

অমিত কটূক্তি সুরে বলল, ৩ বছর সংসার করছি, বদলাবে না!

রাকিব হাত নাড়াতে নাড়াতে বলল, এখন সত্যিই ভোগাস কথা বলছ। আলভী আর অংশু ১০বছর ধরে সংসার করছে আর ওদিকে সুজন আর শাইখ করছে ৬বছর ধরে। তাদের তো সমস্যা হচ্ছে না। কি সুন্দর মানিয়ে চলছে!

অমিত দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, কপালে আমার বেশিদিন নেই সুখ, রাকিব।

-কেন?

-ওকে বাসা থেকে বিয়ের জন্য অনেক চাপ দিচ্ছে। প্রান্তিকের বাবা ছেলেকে বাসায় আনতে মরিয়া। অসুস্থ হয়ে আছেন অনেকদিন। কি বাজে অবস্থা।

-তাই নাকি?

-হ্যাঁ।

অমিত পা দিয়ে মাটিতে আঁকাবুকি করতে করতে বলল, আমার সংসার টিকবে না। যার জন্য সবকিছু ছেড়েছুড়ে আসলাম সে এখন আর আগের মতো নেই। ঢের পার্থক্য। আমার কেউ নেই রাকিব! আব্বু তো আমাকে এখন দেখতেই পারে না। আম্মু মাঝেমধ্যে আমাকে ফোন দেয়। আমার একমাত্র বোনের বিয়ে সামনের মাসে। আর আমি সবকিছু থেকে বিছিন্ন।

রাকিব বলল, আস্তে বল অমিত। প্রান্তিক শুনলে মন খারাপ করবে।

অমিত তিরস্কারস্বরে বলল, করলে করুক। আমার তাতে কি?

প্রান্তিক কাপড় ছেড়ে গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো। অমিতকে অশ্রুসিক্ত দেখে প্রান্তিক বলল, কি ব্যাপার? মেয়েলি সব স্বভাব ঢুকে গিয়েছে তোমার মধ্যে? কাঁদছ কেন?

রাকিব বলল, আরে হঠাৎ বাবা-মা’র কথা মনে পড়ে গিয়েছে তাই…

প্রান্তিক বলল, ও! সো কল্ড বাবা-মা! ছেলেকে ফেলে দিয়েছে…

অমিত গলা কাঁপিয়ে বলল, তারা আমাকে ফেলে দেয়নি প্রান্তিক। আমি সবকিছু ছেড়ে এসেছি।

প্রান্তিক মুখ ঘুরিয়ে বলল, ওসব বাদ দাও। চা বানাও তো।

-আচ্ছা।

প্রান্তিকের ফোন বাজচ্ছে। সে ফোন নিয়ে বারান্দায় চলে গেলো। রাকিব অমিতের সাথে রান্নাঘরে গেলো। অমিত চা বানানো শুরু করছে। রাকিব বলল, তোমার কথা শেষ করো নি। কিভাবে কি ঝামেলা হল…

অমিত ঠাণ্ডাগলায় বলল, প্রান্তিক প্রতি সপ্তাহে আমার অবর্তমানে একটা করে ছেলে বাসায় আনে।

রাকিব আঁতকে উঠে বলল, মানে? তুমি জানলে কি করে? আর প্রান্তিককে কিছু বলোনি?

-কোন অধিকারে আমি ওকে বলবো বোলো? সে তো আমার আশ্রয়দাতা। কতো বলীয়ান কন্ঠে বলতাম প্রান্তিকের মতো মানুষ হয় না। আর এখন? সাগরের পাড়ে বিয়ে, সেটা তো হাস্যকর ঘটনা প্রান্তিকের কাছে।

-বাবার বাড়ি চলে যাও।

অমিত দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, যতবার যেতে চাই ততবারই প্রান্তিক নানা ধরণের ইমোশনাল কথাবার্তা বলে আমাকে থেকে যেতে বাধ্য করায়। জড়িয়ে আদর করে।

রাকিব বলল, তোমাদের সেক্স লাইফ কেমন চলে?

-খুব বাজে। মাসে একবার।

রাকিব লাজুককণ্ঠে বলল, তুমি কিন্তু দিনদিন সুন্দর হচ্ছ!

অমিত মুচকি হেসে বলল, হ্যাঁ। হচ্ছি। কিন্তু নতুন পন্য তো হতে পারছি না! রাকিব সবাই এক রকম হয় না। আমি কোন সময় ওপেন রিলেশনের পক্ষে ছিলাম না। প্রান্তিক আমাকে আশ্বাস দিয়েছিল সে আমাকে নিরাশ করবে না। কিন্তু…

-হুম। কমপ্লিকেটেড ব্যাপার।

-আমি বড়জোর আর ১মাস ওর অ্যাক্টিভিটিস দেখবো। তারপরও যদি ও ঠিক না হয়, ওকে খুন করে বাসা ছাড়বো। ও আমাকে পেয়েছি কি? যখন ইচ্ছা ভালবাসবে আর যখন ইচ্ছা ফেলে দিবে?

-হুম

-আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি কেন ম্যাঞ্জামে ছেলে খুঁজো। সে উত্তর দেয়নি।

রাকিব ঠাণ্ডাগলায় বলল, চলে যাও অমিত। আর একটা দিন থেকো না।

অমিত অম্লানকণ্ঠে বলল, ৩ বছরের সংসার ভাঙতে ইচ্ছা করে না রাকিব। আমি ওকে অনেক ভালোবাসি। অনেক।

রাকিব অমিতের কাঁধে হাত দিয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগলো। ওদিকে প্রান্তিক ফোনে কথা বলেই যাচ্ছে।

চিটাগাং প্লানিং চলছে!

প্রান্তিক বারান্দার গ্রিলে হাত দিয়ে ফোনে কথা বলছে। বৃষ্টি কমে গিয়েছে। এক-দু ফোঁটা গায়ে আসছে। প্রান্তিক বলল, দেরি কর না।

ওপাশ থেকে প্রতাপ বলল, আমাকে কেন নিয়ে যেতে হবে?

-একা একা যেতে ভালো লাগবে না।

-তাহলে অমিতকে নিয়ে যাও।

প্রান্তিক বিরক্তস্বরে বলল, নাহ। ওহ অনেক ঢং করে।

প্রতাপ অবাক হয়ে বলল, এটা কেমন কথা? সে তোমার পার্টনার। তুমি ওকে ভালোবাসো…

প্রান্তিক বলল, আরে বুঝছি। বুঝছি। ওর সাথে তো সবসময়ই যাই। এবার তোমার সাথে যাই। অনেকদিক তোমার সাথে…

-ওহ! তারমানে অনেক কিছু হয়নি বলেই নিয়ে যেতে চাচ্ছ?

-আরে তা না। তুমি সব কথা উল্টাও।

প্রতাপ বলল, আচ্ছা। যাবো।

প্রান্তিক আনন্দের সাথে বলল, গ্রেট। কলাবাগান ৯:৩০টা দেখা হচ্ছে। কেমন?

প্রতাপ বলল, আচ্ছা।

প্রান্তিক কল কেটে বারান্দা থেকে বের হল। খাটের পাশের টেবিলে চায়ের কাপ রাখা। অমিত নিঃশব্দে কাপ রেখে চলে গিয়েছে। ও কি সব শুনে ফেলেছে? সর্বনাশ!

প্রান্তিক তড়িঘড়ি করে ঘর থেকে বের হল। ডাইনিং টেবিলে অমিত বসে কাগজপত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছে। প্রান্তিক কোমল গলায় বলল, কি করছ?

অমিত কাগজ থেকে মুখ না তুলে বলল, ব্যাগ গুছগাছ করেছ?

-উহু করিনি।

-করে ফেলো।

-তুমি কি করছ?

অমিত মাথা তুলে বলল, সেটা তোমার জানার প্রয়োজন নেই।

প্রান্তিক অমিতের মুখে এ কথাটা শুনে রেগে গেলো। সে মুখ কুঁচকিয়ে বলল, এটা আবার কেমন কথা? সব সময় ত্যাড়া ত্যাড়া কথা বলতে হবে?

অমিত কোন জবাব না দিয়ে কাজ করায় মনোযোগ দিল।  প্রান্তিক গটগট করে ঘর দিকে চলে গেলো।

অমিত চশমা খুলে কপালে হাত দিল। সে প্রান্তিকের সবকথা শুনেছে। ৩-বছরের সম্পর্ক যে শেষ হতে চলছে সেটা আগেই টের পেয়েছিল কিন্তু ব্যপারটা যে এতো জঘন্য পর্যায়ে চলে যাবে ভাবতেও পারেনি।

তার ৩বছরের সংসারের অবসান ঘটতে যাচ্ছে।

অমিত চশমা পরে কাজ করা শুরু করলো।  

১৩…

বাড়িটির নাম ‘উত্তরণ’। নামটা বেশ পরিচিত পরিচিত লাগছে। শব্দটা শুনেছি, কিন্তু অর্থ জানি না। উত্তরার বাড়ির নাম উত্তরণ হবে সেটা অবশ্য আমার কাছে স্বাভাবিক ঠেকছে না। ১০মিনিট হল দাঁড়িয়ে আছি এ বাসার সামনে। ছয়তলা বাড়ি। দেখেই বুঝা যায় ৯০সালের দিকে বানানো। অবশ্য এখন বেশ ঘষেমেজে ঠিক করা হয়েছে। প্রকাণ্ড হাসনাহেনা গাছ গেটের পাশে। ফুল থেকে গন্ধ বেরুচ্ছে না। রাত হলে তীব্র গন্ধ হয়। ঘ্রাণটা আমার তেমন ভালো লাগে না।

গ্যারেজে টয়োটা প্রিমিও নতুন মডেলের গাড়ি রাখা। তারমানে বাসার লোকজন সবাই আছে এ ধারণা করা যেতে পারে। আমি খুব আস্তে আস্তে গেটের ভিতরে ঢুকলাম। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম গাড়ির পাশে একজন লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পান চিবুচ্ছে। আমি বললাম, আচ্ছা প্রান্তিক কি বাসায় আছেন?

লোকটা তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত খিলিয়ে বলল, হ আছেন। আপনি কে?

আমি বিনয়ের সাথে বললাম, আমি প্রান্তিক ভাইয়ের বন্ধুর ছোট ভাই। দয়া করে উনাকে একটু ডেকে দিবেন?

লোকটি পান চিবুতে চিবুতে বলল, ৩য় তলায় যান।

আমি দুই কদম পিছনে চলে এলাম। আমি তিনতলায় উঠবো না। ১০দিন আগে প্রান্তিকের বাবা মারা গিয়েছেন, হার্ট অ্যাটাক এ। যেদিন চিটাগাং যাওয়ার কথা ছিল সেদিনই দুঃসংবাদটা আসে। আমাকে কোন কিছু না বলে দৌড়ে বের হয়ে যায় সে। আজ ১০দিন হল ফোন ধরছে না, যোগাযোগও করছে না। বাধ্য হয়ে এই বাসায় আসতে হল। আমি উঁকিঝুঁকি দিচ্ছি, লোকটি ছাড়া আর কেউ নেই।

আমি বিরক্তকন্ঠে বললাম, প্রান্তিক ভাইয়াকে ডেকে নিয়ে আসেন তো।

আমার কথা শুনে যেন লোকটির পিলে চমকে উঠলো। ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, আইচ্ছা যাইতাছি।

লোকটি ৫মিনিটের মধ্যে প্রান্তিক সহ আমার সামনে হাজির হল। আমি চোখমুখ শক্ত করে বললাম, ভাইয়া বাইরে আসুন। কিছু কথা ছিল।

প্রান্তিকের চেহারা মলিন। পরনের কাপড় এলোমেলো। চুলগুলো ফুলে আছে। কয়দিন গোসল করেনি কে জানে!

গেটের বাইরে রাস্তায় আমি আর প্রান্তিক মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি।

প্রান্তিক বলল, টাকা লাগবে?

আমি কপালকুঁচকে বললাম, টাকার জন্য তো আমি আসেনি। তুমি ফোন ধরছ না কেন?

-ফোনটা যে কোথায় রেখেছি…

-মিথ্যা! ওয়েটিং পেয়েছে বেশ কয়েকবার।

-আসলে হয়েছেটা কি…

আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম, দয়া করে ভণিতা ছাড়ো। তিন বছর ধরে সংসার করছি তোমার সাথে। তোমার স্বভাব-চরিত্র আমার ভালোভাবে চেনা আছে ।

প্রান্তিক ক্রুদ্ধকন্ঠে বলল, তুমি কি মানুষ না জানোয়ার? আমার বাবা মারা গেছে! আমি শোকে আছি…

-আচ্ছা। মেনে নিলাম তুমি শোকে আছো। হুম… যাইহোক, এসেছিলাম তোমার খবর নিতে। আমি কেমন আছি না আছি সেটার খবর তো রাখবে না …

প্রান্তিক আমার হাত ধরে বলল, তুমি ভালো আছো?

আমি আকুতি স্বরে বললাম, নাহ নেই। তুমি বাসায় আসবে কবে?

-এই এক-দুই দিনের মধ্যেই চলে আসবো।

প্রান্তিক!!

হাত ছেড়ে আমরা দুজন দূরে সরে এলাম। তিন তলার বারান্দার দিকে প্রান্তিক তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ মা!

আমি মাথা নিচু করে টিপটিপ পায়ে দ্রুত এগুতে লাগলাম। প্রান্তিকের মা জাহানারা হোসেন বললেন, ওকে নিয়ে আসো তিনতলায়।

আমি প্রান্তিকের দিকে ফিরে তাকালাম। প্রান্তিক ভয়ার্তকণ্ঠে বলল, আচ্ছা!

আমি ভাবলেশহীন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছি। আমার মস্তিষ্ক কাজ করছে না। কি করা উচিত এ অবস্থায় সেটা ভাবতেই চারদিকে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। প্রান্তিক দ্রুত হেঁটে আমার কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল, উপরে চল।

আমি বললাম, না প্রান্তিক।

প্রান্তিক রাগান্বিতকণ্ঠে বলল, মা যখন বলেছেন উপরে তোমাকে যেতেই হবে।

-আমি কারোর কাছে বাধ্য নই।

-আমার কাছে অবশ্যই! এ বলেই হাত টেনে আমাকে গেইটে ঢুকালো প্রান্তিক। যেহেতু আমি কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে পারছি না এখন তাই কোন বিরোধিতা করলাম না।

ঘরটা পরিস্কার-পরিছন্ন। বিশাল ঘরের প্রধান আকর্ষণ খাট। পুরনো কালের শক্ত মজবুত বিশাল খাট। ঘরের অর্ধেক জায়গা খাট দখল করে আছে। আমি বসে আছি চেয়ারে। বারান্দার ঠিক উলটো দিকের চেয়ারটিতে। আমার ডানদিকে কোণাকোণিতে বসে আছেন প্রান্তিকের মা জাহানারা হোসেন। পা ঝুলিয়ে খাটে বসেছেন। আমি কাচুমুচু করে বললাম, ভালো আছেন?

জাহানারা হোসেন আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। এ মানুষটার ১০দিন আগে স্বামী মারা গিয়েছে তা বুঝাই যায় না। একদম স্বাভাবিক।

আমি মাথা নিচু করে বসে আছি। ঘরে সুনসান নীরবতা। পাশের ঘরে প্রান্তিক হালকা ভলিউমে গান শুনছে। মিউজিকের প্রবাহ কিছুটা কানে আসছে। হাতের পাশে রাখা বইটি হাতে নিয়ে বললেন, বই পড়তে ভালোবাসো?

আমি সোজা হয়ে বসে বললাম, জী। ভালোবাসি। একসময় কবিতা লিখতাম, এখন আর হয় না।

-এমন একটি বইয়ের নাম বোলো যেটা তুমি কিছুদিন আগে পড়ে শেষ করেছো।

আমি আমতা আমতা করে বললাম, প্রথম-আলো।

জাহানারা হোসেন মুচকি হেসে বললেন, সুনীলের বইয়ের মান অনেক ভালো। কিন্তু অতি দীর্ঘ। আমি শীর্ষেন্দু, সুচিত্রা এদের বই পড়তে ভালোবাসি।

-হু

-তো, সংসার কেমন চলছে?

আমি হতভম্ব হয়ে জাহানারা হোসেনের দিকে তাকিয়ে আছি। আমার চাউনি দেখে তিনি বললেন, কেন প্রান্তিক কি কিছু বলেনি আমার সম্পর্কে?

আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, না তো!

-ওহ আচ্ছা! আমি তোমাদের সম্পর্কে সবই জানি অমিত। সব।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, প্রান্তিক আমাকে কিছু বলল না কেন?

-বলেনি, হয়তো কোন এক কারণে। হয়তো বলেনি ইচ্ছা করেই। আমার এই ছেলেটার লুকোচুরির অভ্যাস আছে।

-হুম।

জাহানারা হোসেন বললেন, আচ্ছা আসলেই কি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা আছে?

আমি থতমত খেয়ে বললাম, ৩বছরের সংসার…

-সে তো অনেকেই করে। সমাজের খাতিরে ভান করে সংসার চালিয়ে যায় ।

-তা ঠিক।

-তুমি আমার ছেলেকে ভালোবাসো?

আমি শক্ত কন্ঠে বললাম, জী ভালোবাসি অ্যান্টি।

জাহানারা হোসেন উঠে দাঁড়িয়ে আমার হাত ধরে বলেন, আমাকে মা ডাকলে খুব খুশি হবো।

আনন্দে চোখ ভিজে উঠলো, আমার।

জাহানারা হোসেনের ঘর থেকে বেরুতেই প্রান্তিককে দেখলাম। সে তার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মোবাইল টিপছিল। আমি অতি সাবধানে তার পাশে দাঁড়ালাম। গ্রাইন্ডার নামে কোন এক সাইটে চ্যাট করছে সে। আমি গলা খাকরি দিয়ে বললাম, কি করো?

প্রান্তিক চমকে উঠে মোবাইলটা পকেটে ঢুকিয়ে বলল, কিছু না। তোমার এতো জানবার শখ কেন?

আমি মুচকি হেসে বললাম, বাসায় যাচ্ছি। নিজের খেয়াল রেখো।

প্রান্তিক মেঝের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার সাথে আমার কিছু জরুরী কথা আছে। ভিতরে আসো।

আমি পিছন পিছন গেলাম। রুমটা বেশ বড় না, আবার ছোটও না। আমি বারান্দায় দাঁড়ালাম। দুটো চেয়ার এনে প্রান্তিক বলল, বস।

-আচ্ছা। প্রান্তিক, তুমি কি জরুরী কথা বলবে?

প্রান্তিক হাত কচলাতে কচলাতে বলল, আচ্ছা তোমার মনে হয় না আমাদের সম্পর্কের Charm হারিয়ে গিয়েছে?

আমি ঠাণ্ডা গলায় বললাম, নাহ যায়নি। শুধুমাত্র তুমি বদলে গিয়েছ।

-কিভাবে?

-প্রথম কয়েক বছর আমার সাথে সঙ্গম করা তোমার কাছে ছিল অতি আকর্ষণীয় ব্যাপার। কিন্তু ধীরে ধীরে আমার সাথে করতে করতে তুমি এখন মজা পাও না। এজন্য বাসায় মানুষ নিয়ে আসো।

প্রান্তিক ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলল, কি যা তা বলছ!

-আমাকে বোকা ভেবো না প্রান্তিক। আমি সব জানি। প্রত্যেক শনিবার আমার ইংলিশ ক্লাস থাকে, সেটা শেষ করে টিউশনি করে আমার আসতে আসতে প্রায় সন্ধ্যা হয়। আর সেদিন তুমি মহাআনন্দে কাজ চালাও।

-ওসব ফাউ কথা। তুমি আমার সম্পর্কে…

আমি বললাম, দারোয়ানের সাথে আমার কথা হয়েছে।

প্রান্তিক মুখ শক্ত করে বসে রইল। প্রচণ্ড জিদ হচ্ছে তার। মনে মনে ভাবছে দারোয়ান বেটা সব তথ্য ফাঁস করে দিলো কেন!

আমি বললাম, সেদিন ফোনটাও চেক করেছিলাম আমি।

প্রান্তিক চোখ বড় বড় করে বলল, হাউ ডেয়ার ইউ!

আমি হেসে বললাম, যখন তুমি আমার ফোন চেক করে মানুষকে উল্টাপাল্টা হুমকি দাও, সেটা কিছু না?

প্রান্তিকের রাগ ক্রমশ বেড়েই যাচ্ছে। সে কড়া গলায় বলল, আসলে ৩বছরের সম্পর্ক দেখে যা বুঝলাম তোমার সাথে সংসার করা সম্ভব না। এসব ছেলে ছেলে সংসার হয় না, আমার বয়স বাড়ছে আমার বিয়ে করার দরকার।

আমি অবাক কণ্ঠে বললাম, তুমি আমাকে বিয়ে করেছিলে!

-আরে দুর ছাই! সমুদ্রের পাশে দাঁড়িয়ে নিজের মন মতো করে আংটি পরালেই বিয়ে হয়?

-সমাজের বানানোর রীতিতে তুমি খুব বিশ্বাসী তাই না?

-তা না….. তোমার বয়স কম, আমার সাথে তোমার ভাগ্য জড়ানোর প্রয়োজন নেই। বাসায় ফেরত যাও। ঠিকঠাক করো। সামনে অনেক সময় পার করতে হবে। বিয়েশাদি করতে হবে…

আমি নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি প্রান্তিকের দিকে। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, আমি তোমাকে ভালোবাসি প্রান্তিক।

প্রান্তিক উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমিও বাসি কিন্তু সম্ভব না…

আমি রাগান্বিতস্বরে বললাম, ৩বছর পর তোমার আক্কেল হল? আমি আমার সবকিছু বিসর্জন দিয়ে এসেছি সংসার করতে আর তুমি? তুমি কি হারিয়েছ বোলো? বোলো?

-ঠিক হয়ে যাবে। আর যদি ঠিক করতে না চাও আমার ফ্ল্যাটটা তোমার নামে করে দিতে আমি রাজি আছি।

আমি চিৎকার করে বললাম, এ ছিল তোমার মনে? আমাকে পণ্যের মতো ব্যবহার করে এখন ছুড়ে ফেলে দিচ্ছ? এই তোমার ভালোবাসা?

প্রান্তিক আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল, মেয়েদের মতো ডাইলগ দিবে না। আর কন্ঠস্বর নিচে। এটা আমার বাসা, যাত্রামঞ্ছ না! বুঝলে?

আমি কষিয়ে প্রান্তিকের দুই গালে দুটো চড় বসালাম। তারপর টিশার্ট ধরে বললাম, আমাকে তুমি চিনো না ! আমি প্রতিশোধ অবশ্যই তুলবো। ইউ অ্যাসহল!

প্রান্তিক শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অভিমান, দুঃখ ও তাগ্যের মিশ্রনে আমার চোখে জ্বলছে প্রতিশোধের আগুন।

১৪…

সব গোছগাছ শেষ?

অমিত মুচকি হাসল। রাকিব এই প্রথম দেখল অমিত হাসলে তার গালের দু’পাশে টোল পড়ে। প্রান্তিক কি এই টোলের দেওয়ানা হয়ে অমিতের প্রেমে পড়েছিল? পড়তেও পারে! যার হাসি সুন্দর, তার মন সুন্দর। হয়তো!

ড্রয়িং রুমে মোট ৬টা কার্টুন। বিশাল। বর্গাকার কার্টুন। রাকিব উঁকি দিয়ে দেখল একটা কার্টুন। বইপত্তর ছাড়া কিছুই নেই। অমিত সোফার উপরে উঠে পর্দা নামাচ্ছিল। রাকিবকে উঁকিঝুঁকি  দেখে সজোরে বলল, ৬টা কার্টুনে বই ছাড়া আর কিছুই নেই। আমার সম্পত্তি বলতে ওগুলোই। হাহাহাহা!

রাকিব অমিতের কাছে যেয়ে বলল, পর্দা নামাতে সাহায্য করবো?

-আরে না! কাজ তো শেষই।  

-কবে যাচ্ছো?

অমিত রাকিবের দিকে তাকিয়ে করুণার হাসি দিয়ে বলল, কোথায় যে যাবো সেটাই ঠিক হয়নি।

অবাক হয়ে রাকিব বলল, তাহলে গোছগাছ?

পর্দাগুলো যত্ন করে গুছাতে গুছাতে বলল, আস্তে আস্তে গুচ্ছাছি সবকিছু। গোছগাছ শেষ করতে  করতে একটা না একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে।

রাকিব বলল, তোমাদের রুমের ফার্নিচার কি সব বিক্রি করবে না যেভাবে আছে সেভাবেই থাকবে?

অমিত হতবাক হয়ে বলল, ওটা প্রান্তিকের রুম। আমি জানি না সে কি করবে।

-তোমরা একই রুমে থাকতে…

-নাহ, রাকিব। না। আমি গত ছয়মাস পাশের ঘরে থাকি।

-কেন?

-মনে করো না সবকিছু হঠাৎ করে হয়েছে। সংসার ভাঙনের আভাস ৭মাস আগে থেকেই পেয়েছি।

-আলাদা রুমে থাকতে। হুম। প্রান্তিক কাছে ব্যাপারটা পছন্দীয় ছিল না মনে হয়… 

-প্রথম এক সপ্তাহ রাগ করে ছিলাম। তারপর নিজেই টের পেয়েছে। প্রাইভেসি দরকার। নিজের সুবিধার কারণেই আর আমাকে ডাকেনি।

রাকিব দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, তোমরা পারও!

অমিত সোফা থেকে নামলো। স্যান্ডেল পরে প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে ডাইনিং রুমে এসে ফ্রিজ খুলল। পেপসির বোতল বের করে বড় এক গ্লাসে পূর্ণ করে ঢালল। বরফ বের করে তাতে ২টা কিউব দিলো। গ্লাস এনে রাকিবের সামনে দিয়ে বলল, খাও। কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছো।

রাকিব গ্লাসটি হাতে নিয়ে বলল, ধন্যবাদ। একটু পর তোমাকে পানির জন্যে বলতাম। হে হে হে।

অমিত বলল, কোকের মধ্যে কিছু মিশিয়ে খাবে না কি? প্রান্তিক সবসময় কিছু না কিছু মিশিয়ে খেত।

-বুঝলাম না, কি মিশিয়ে খেত?

-ওয়াইন কোকের সাথে মিশিয়ে খেত, আমাকেও বলতো কিন্তু! না বাবা! ওসব আমার জন্যে নয়।

অমিত কার্টুনগুলো একে একে দেয়ালের দিকে সাইড করে রাখা শুরু করলো। রাকিব আয়েশ করে কোকের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, তোমাকে একটা খবর দিতে এসেছি।

অমিত মাথা তুলে রাকিবের দিকে তাকিয়ে বলল, প্রান্তিকের বিয়ে ঠিক হয়েছে?

রাকিব মুখ শুকনো করে বলল, না। এখনও না। কথাবার্তা চলছে। ওর ভাবীর ছোট বোনের সাথে…

অমিত হাসতে হাসতে বলল, বেটি এখনও বিয়ে করেনি? প্রান্তিকের জন্য বসে আছে? বাহ, প্রান্তিকের কি দেখে তার পছন্দ হয়েছে যে ওকেই বিয়ে করতে হবে! আমার কাছে পাঠিয়ে দিক, সব খোলাসা করে দিবো।

অমিত গা কাঁপিয়ে হো হো করে হেসে উঠলো। রাকিব সরু দৃষ্টিতে অমিতের দিকে তাকিয়ে বলল, একটা খারাপ খবর আছে।

অমিত হাসি থামিয়ে মুখ চেপে ধরে বলল, কি খবর?

রাকিব গ্লাসটি টেবিলে রেখে সোফায় আরাম করে বসলো। হাত ঘড়ি খুলতে খুলতে বলল, প্রান্তিকের কিছু মূল্যবান জিনিস চুরি হয়ে গিয়েছে।

অমিত মুখ থেকে হাত সরিয়ে আড় চোখে বলল, সেক্স করতে গিয়ে?

রাকিব গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, কেন ভাবলে সেক্স করতে গিয়ে?

অমিত মুখ থেকে হাত সরিয়ে বলল, কারণ এই কাহানী ৩জনের কাছে ৩ভাবে শুনেছি। প্রথমজন বলেছে, প্রান্তিক জোর করে সেক্স করাতে এমনটা হয়েছে। যেটা খুব অবিশ্বাস্যযোগ্য। জোর করে সেক্সের সাথে চুরির কি সম্পর্ক! দ্বিতীয়জন বলেছে, ব্যাপারটা মিথ্যা। প্রান্তিক সবার সহমর্মিতা পাওয়ার উদ্দেশ্যে এই কাজ করছে। তৃতীয়জন বলছেন, আমিই এই কাজটি করেছি প্রান্তিককে শিক্ষা দেওয়ার জন্যে। কাহানীগুলো শুনে মনে হচ্ছিল, সবগুলোর দেহে বেয়নেট চার্জ করি।

রাকিব বলল, কিন্তু আমি আসল কাহানীটা জানি।

-প্রমাণ কি? আর তোমার কথা কেনই বা আমি বিশ্বাস করবো?, কথাগুলো বলে হাসতে লাগলো অমিত।

রাকিব পায়ের উপর পা তুলে বলল, কারণ আমি জানি তুমি আমার কথায় বিশ্বাস করবে।

অমিত মিষ্টি করে হাসল। আচ্ছা, হাসি মিষ্টি বা টক হয় কিভাবে? রাকিব আগে মনে করতো যে মিষ্টি খেয়ে হাসে সেটাই মিষ্টি হাসি। কিন্তু, না! আজকে সে বুঝল, মিষ্টি হাসি ব্যাপারটা অনুভূতির সাথে সম্পর্কযুক্ত বিষয়।

অমিত বলল, প্রতাপ আমার নামে কি ধরণের কথা বলে বেড়াচ্ছে সেটা শুনবে?

-কি বলছে?

-ওমা! তোমার এখনও কানে আসে নি?

-না, তো!

অমিত দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, আমি ভুজংভাজং করে ফ্ল্যাটটা আমার নামে করিয়ে নিয়েছি। আর, এখন সময় বুঝে প্রান্তিককে ছুড়ে ফেলে দিয়েছি। এ কথা শুনার পর থেকে, কতো যে মানুষ ফোন করলো। মাই গড! মানুষের কাজ-কাম নাই?

-তুমি কি বললে?

-শুনে হেসেছি। যতই দিন যাচ্ছে আমার হাসির রোগ বাড়ছে। অতি দুঃখে থাকতে থাকতে, হাসতে শিখেছি। এখন মনে হয় তোমার মৃত্যুর খবর পেলেও আমি হো! হো! করে হেসে উঠবো।

রাকিব শান্ত গলায় বলল, তুমি জানো কি তা জানি না কিন্তু গত ২মাস ধরে এক ছেলের সাথে প্রান্তিকের বেশ ভাব বিনিময় হচ্ছিল। সে ছেলে এক হোটেলে চাকরি করে। থাকে মেসে। একদিন প্রান্তিককে তার মেসে নিয়ে যায়। যখন সেক্সে প্রথম পর্যায়ে তারা তখন দরজায় ঘা পড়ে। তাড়াহুড়া করে ছেলেটা দরজা খুলে দেয়। পাশের রুম থেকে ৪জন পুরুষ ভিতর আসে। তারা প্রান্তিক নগ্ন দেখে চিৎকার শুরু করে দেয়। তারপর তারা টাকাপয়সা ডিম্যান্ড করে। প্রান্তিক উপায় না পেয়ে হাতঘড়ি, ওয়ালেট, মোবাইল দিয়ে কোনোমতে ছাড়া পেয়ে বের হয়ে আসে। রাতে আমার বাসায় উঠেছিল। বাবা! কি ভয়ানক ব্যাপার! তাই না?

অমিত কপাল কুঁচকে বলল, ভয়ানক না তো! খুবই ইন্টারেস্টিং কাহানী। টুইস্টওয়ালা কাহানি। সিনেমা-নাটক বানালে দারুণ হিট খাবে!

-আহা! এভাবে বোলো কেন…

-বলবো না কেন? তোমার বন্ধুকে কি জিজ্ঞেস করেছো সে আমার নামে কি ছড়াচ্ছে?

-না তো!

-যেদিন থাপ্পড়টা দিলাম সেদিনকার রাতের কথা। আলভী হঠাৎ ফোন করে বলল, অমিত এ কি করলি! ও তোর কতো বড়। বন্ধুদের সামনে কান্নাকাটি করে ভাসিয়ে দিয়েছে ছেলেটা। এসব শুনে রাগে গা জ্বলছিল আমার। ফোন কেটে দিয়েছি।

রাকিব হেসে বলল, এ পর থেকে তোমার নাম হল দেমাগি চরিত্রহীন?

ফিক করে হেসে অমিত বলল, ও! নামখানা ভালোই প্রচার হচ্ছে। পরশুদিন শুনলাম… আচ্ছা কমিউনিটিতে কথা ছড়াতে তো দেখি বেশি সময় লাগে না। মনে হয় একটা বডিস্প্রে যেমন পুশ করলে মুহূর্তেই ঘর গন্ধে ভরে উঠে ঠিক সেভাবে কথা এখানে ছড়ায়!

রাকিব বলল, কখনও কি ভেবে দেখছ কেন তোমাকে তারা চরিত্রহীন বলে?

অমিত মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ একটা শক্ত কারণ আছে। এক ১৮বছরের ছেলে বাবা-মা’র কাছ থেকে আলাদা হয়ে বয়ফ্রেন্ডের সাথে বসবাস শুরু করে।  লোকজনের কাছে ব্যাপারটা কটু দেখাবেই, স্বাভাবিক না? আর যার এক পয়সা আয় করার মুরাদ নেই সে কিনা বারিধারার বিশাল ফ্ল্যাটে থাকার মহাসুযোগে বয়ফ্রেন্ডের টাকায় আয়েশ করছে।

-কিন্তু তুমি তো আয়েশ করছ না।

-সেটা তো তুমি জানো। অন্য মানুষরা তো জানে না। তারা যা ভাবে সেটাকেই অগ্রাধিকার দেয়। কে কেমন, তা বিচার করার সময় নেই তাদের। কিন্তু! নিজের মতো মতবাদ তৈরি করে অনায়াসে মানুষজনকে বলে বেড়ায়। আমি তো এখন কোন সোশ্যাল গ্যাডারিং এ যাই না। যেয়ে কি করবো বোলো? সামনে এতো সুন্দর করে কথা বলে। আর। হুম…  আড়াল হলেই জঘন্য জঘন্য মন্তব্য করে। শুনলেই আঁতকে উঠি!

-তারা যে বাজে মন্তব্য করে সেটার প্রমাণ পেয়েছ ?

-কষ্ট করে প্রমাণ জোগাড় করতে হয়নি। প্রান্তিক একদিন কথায় কথায় বলেই ফেলেছিল, আমার মতো কমবয়সী ছেলেকে নিয়ে কোথাও গেলে অনেকের কাছে অনেক বিদ্রূপ মন্তব্য শুনতে হয়। আমি সেদিন কড়াকন্ঠে ওকে নিষেধ করেছিলাম, আমাকে কোথাও নিয়ে যেতে চাইবে না।

রাকিব বলল, অমিত। মাথা শান্ত করো। শান্ত হও।

অমিত দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, রাকিব আজকে কেন এসেছ?

রাকিব আমতা আমতা করে বলে, আসলে হয়েছেটা কি…

-আমার ভালো লাগছে না হঠাৎ করে। আজকে তুমি কি থাকবে ?

-নাহ।

-আচ্ছা। হুম… তাহলে আজকের মতো কথা এখানেই শেষ।

-তুমি কি আমাকে উঠে যেতে বলছ অমিত?

অমিত বলল, না। যতক্ষণ ইচ্ছা ততোক্ষণ থাকো কিন্তু প্রান্তিক সম্পর্কিত একটা কথাও বলবে না। আমি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি। ও তোমাকে পাঠিয়েছে।

রাকিব বলল, পাঠালে দোষ কি? হয়তো সে…

-ওকে বোলো তার ইগো যেন গ্লাসের পানির সাথে মিশিয়ে রোজ দু’বেলা করে খায়। তার ইগো দেখার সময় আমার নেই। আর যদি পারে ইগো ছাড়তে তাহলে আমার সাথে কথা বলতে পারবে সে। দূত পাঠানোর প্রয়োজন নেই।

রাকিব অবাক দৃষ্টিতে অমিতের দিকে তাকিয়ে আছে। অমিতের মুখ লাল হয়ে উঠেছে। সে ক্রমাগত মুখে হাত দিচ্ছে। রাকিব বলল, আমি উঠছি।

অমিত জবাব না দিয়ে উঠে চলে গেলো।

১৫…

প্রান্তিক বিছানায় মুখ গোমড়া করে বসে আছে। গত ৪দিন যাবত ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটাচ্ছে। চাকরী ছেড়ে দিয়েছে। বাসায় অলস সময় কাটায়। দুর্ঘটনা ঘটার পর বেশ কয়েকদিন সে চুপচাপ ছিল। বাসার সবাইকে বলেছে, ছিনতাই হয়েছে। তাঁর বড় ভাই তাকে বাইরে যাওয়ার জন্য নিষেধ করেছেন। আর মাত্র ২০দিন পর তার বিয়ে। এখন কোন প্রকার ঝামেলায় না জড়ানোই উত্তম। বিয়ে সম্পর্কিত সব ধরণের কার্যক্রম থেকে প্রান্তিককে আলাদা রাখা হয়েছে। তার কাজ বাসায় বসে স্বাস্থ্য ও চেহারার উন্নতি করা। হলুদের দিন হলুদ মাখবে, বিয়ের দিন কবুল বলবে, বৌভাতের দিন হাস্যজ্বল চেহারায় সবাইকে জানান দিবে সে কত্ত খুশি বউয়ের সাথে। বাড়ির সবাই খুশি। শুধুমাত্র একজন বাদে। তিনি হলেন জাহানারা হোসেন। প্রান্তিক যে খুশি তাও না। কিন্তু সে বেজার সেটাও চেহারায় প্রকাশ করছে না। মৌন ভাব ধরে বসে আছে।  

জাহানারা হোসেন ছেলের দরজায় টোকা দিয়ে বললেন, উঠেছিস?

প্রান্তিক আড়মোড়া ভেঙ্গে বলল, হ্যাঁ মা। উঠেছি। ভিতরে আসো।

দরজা আধা খোলা ছিল। তিনি পা দিয়ে ঠেলে দরজা খুললেন। বিছানায় বসে বললেন, ভালো আছিস তো?

-হ্যাঁ! ভালো থাকবো না কেন? ২০দিন পর বিয়ে। মেজাজ তো ফুরফুরেই থাকবে!

জাহানারা হোসেন মুখ শক্ত করে বললেন, তাহলে অমিতের কি হবে?

প্রান্তিক হো হো করে হেসে উঠলো। সে বলল, কি হবে মানে? সে কি আর মেয়ে মানুষ যে সমাজে আর চেহারা দেখাতে পারবে না? কেউ তাকে বিয়ে করবে না? সে আর কি করবে! তার আগের জীবনে ফেরত যাবে!

-ছেলেটা সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে তোর কাছে চলে এসেছিল।

প্রান্তিক বলল, দেখো মা! কেউ সাধু না। আমি ওকে জোর জবরদস্তি করে আমার কাছে রাখিনি।

জাহানারা হোসেন বললেন, কিন্তু সে সময়ে তোর যে অবস্থা হয়েছিল তা দেখে মনে হচ্ছিল তুই ওকে না পেলে বুঝি মরেই যাবি। আর এখন এই কথা?

-মা তুমি সবসময় কথা বাড়িয়ে বোলো, ওরকম কিছু হয়নি…

জাহানারা হোসেন মুখ নিচু করে রইলেন কিছুক্ষণ। তার ছেলে এমন অমানুষ হল কেন? ছেলে হোক আর মেয়েই হোক এইভাবে কাউকে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার কি কোন বিবেকবান মানুষের কাজ?

তিনি কর্কশকন্ঠে বললেন, তুই আমার ছেলে না। আসলেই না। আমি তোকে পেটে ধরিনি। রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনেছি। রাস্তার বস্তিদের স্বভাব যার সে বস্তিতেই জন্ম নিয়েছে সেটাই ভাবাটা ঠিক।

প্রান্তিক অবাককন্ঠে বলল, তুমি একটা পরের ছেলের জন্য নিজের ছেলেকে…

-আমি ওরকম মা না যে ছেলে খুন করে আসবে আর সেটাকে অবলীলায় মেনে নিয়ে বলবো, আমার ছেলে নির্দোষ। খুনিকে গলা ধাক্কা দিয়ে জেলে পাঠাবো। সে আমার ছেলেই হোক না কেন।

-তোমার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছ।

জাহানারা হোসেন চিৎকার করে বললেন, খবর্দার! আমার সাথে বেয়াদবির চেষ্টা করবি না। গলা ধাক্কা দিয়ে বাসা থেকে বের করে দিবো। অসভ্য। মা’কে বলে মানসিক সমস্যা আছে! নিজের দিকে তাকা! প্রশয় দিতে দিতে মাথায় উঠে পড়েছে। এক লাত্থি দিয়ে নামিয়ে দিবো! তখন জমিন পাবি না নিচে।

প্রান্তিকের চোখ ছলছল করছে। জাহানারা হোসেন কখনও তার ছেলের সাথে এমন আচরণ করেননি। জাহানারা শান্ত হলেন। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তুই বিয়ে করবি না। ঠিক আছে?

প্রান্তিক কিছুই বলল না। মাথা নিচু করে আছে। জাহানারা জোরে বললেন, কি বলেছি কানে ঢুকেছে?

-না। ঢুকেনি।

-না ঢুকলে, ঢুকিয়ে নে।

প্রান্তিক কাতর কন্ঠে বলল, মা! আমি বিয়ে করতে চাই।

জাহানারা হাসতে হাসতে বললেন, এই এখন বললি বিয়ে করবি আবার দু’মাস পর বলবি ডিভোর্স নিবি। তারপর বলবি, নতুন একটা ছেলে পেয়েছিস সংসার করবি। এইভাবে চলতেই থাকবে। তোর তো লজ্জা-শরম নাই। তাই এগুলো করতে তোর বিবেকে বাধে না।

প্রান্তিক চোখ মুছল। জাহানারা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, জীবনটা তোর। যখন তুই আমাকে অমিত সম্পর্কে সবকিছু খুলে বলেছিস তখন আমি বলেছিলাম এসব ছেলে-ছেলে সম্পর্ক টিকবে না। তুই আমাকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলি অবশ্যই টিকবে। এই তোর সম্পর্ক টেকা?

প্রান্তিক বলল, সেজন্যই তো আলাদা হয়ে গেলাম। মা! আমার বয়স বাড়ছে। আমারও ইচ্ছা করে বাচ্চা নেওয়ার। একটা ছোট সংসার পাতা।

-ওহ আচ্ছা। তুই তাহলে একটি মেয়ের সাথের সংসারকে আসল সংসার বলছিস?

-হ্যাঁ!  ৩ বছর পর আমি বুঝতে পারলাম। আসলে …

-তারমানে একটা মেয়ের উপর তুই যেরকম চাপ সৃষ্টি করতে পারবি সেরকম চাপ ছেলের উপর করতে পারবি না বলেই এই থিউরি কপচাচ্ছিস?

প্রান্তিক মুখ হা করে তাকিয়ে থাকল। জাহানারা বলেন, আমি তোর মা। বুঝলি? আর তুই যে সেদিন কোন ছেলের সাথে কুকর্ম করতে গিয়ে ধরা খেয়েছিস, সব বিসর্জন দিয়ে এসেছিস সেটা আমি জানি।

-মা!

-নিজেক ভালো রাখ, কিন্তু ভালো সাজার চেষ্টা করবি না।

-মা তোমাকে এসব কে বলছে?

-যেই বলে থাকুক না কেন তোর তাতে কি?

প্রান্তিক উঠে দাঁড়িয়ে বলল, মা আমার বয়স হচ্ছে। আমার লাইফটা আমি আর কমপ্লিকেটেড করতে চাচ্ছি না।

-যদি না করতে চাস প্রপার ওয়েতে কর। এভাবে একটা ছেলেকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে তুই সুখে থাকতি পারবি বল? কাউকে দুঃখ দিয়ে নিজে সুখে থাকা যায়? অবশ্যই যায় না।

-আমাকে তাহলে কি করতে বোলো? পা ধরে মাফ চাইব?

জাহানারা শক্ত কণ্ঠে বললেন, অমিতের ৩টা বছর ওকে ফিরিয়ে দে।

প্রান্তিক নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।

– তুই না বুঝে কি বড় ভুল করতে যাচ্ছিস সেটার চুল পরিমাণ ধারণা নেই তোর। আমি আমার শেষ সিদ্ধান্ত বলে দেই, আমি চাই না কোন মেয়ের জীবন নষ্ট হউক। তুই বিয়ে করবি না।

-মা?

-আমার লাস্ট ডিসিশন।

প্রান্তিক জাহানারা হোসেনের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে। জাহানারা বললেন, সংসার করবি কি করবি না তোর ব্যাপার। কিন্তু ভাঙতেই যদি চাস তাহলে ভালোভাবে বুঝেশুনে ভাঙ্গ। অমিতকে বুঝা কেন তুই আর তার সাথে থাকতে চাচ্ছিস না। বুঝলি?

-বুঝলাম।

জাহানারা হোসেন বেরিয়ে যাওয়ার সময় বললেন, আজ সকালে অমিত ফ্ল্যাটের চাবি রেখে গিয়েছে। ছেলেটার অবস্থা যদি একবার দেখতি! থাক। ওসব তোকে বলে কি লাভ! তুই তো মাংসাশী প্রাণি। মাংসের পূজারী। যতদিন খাবি ততদিন পূজ্যবস্তু করে কাছে রাখবি। খাওয়া শেষ, ফেলে দে !

-মা! তুমি এমন কথা বলতে পারলে?

জাহানারা হোসেন মুচকি হেসে বললেন, এইটা অমিত আমাকে তোকে বলতে বলেছে। আচ্ছা কথাগুলো সত্যি না?

প্রান্তিক নিজের শরীরের দিকে চোখ বুলিয়ে নিলো, তাকে কি পশুর মতো দেখা যাচ্ছে কি?

১৬…

বাগানবিলাস গাছটা ৩বছরে বিরাট হয়েছে। গেটের উপরের জায়গা তো দখল করেছেই,  দারোয়ানের ঘর পর্যন্ত ঝাঁকড়া হয়ে ঝুলে আছে রাস্তার দিকে। অসংখ্য ফুল ফুটেছে। গাঢ় লাল। অমিত লাফ দিয়ে কয়েকটা ফুল ছিঁড়ল। ফুলগুলো ধরলেই তার মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। বীণা রহমানের অত্যন্ত অপছন্দের গাছ বাগানবিলাস। তার কাছে গাছটি আর্টিফিশিয়াল লাগে। কাগজের মতো ফুল বলে তাচ্ছিল্য করেন। অমিত ফুলগুলো পকেটে গুঁজে বিশাল গেটের পকেট দরজা খুলল। অমিতের সঙ্গে বিরাট জাম্বো সাইজের দুটো সুটকেস। ভ্যানে ১ডজন টবসহ গাছ আর বড় বড় ৭টা কার্টুন। সে বুঝতে পারছে না আদৌ বাড়িতে ঢোকা ঠিক হবে কিনা। ৩বছর আগে যে কিনা বিনা দ্বিধায় চলে গিয়েছিল তাকে কি এ বাড়ি আবার আশ্রয় দিবে? আসার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত অমিতের ওটুট বিশ্বাস ছিল আর কোথাও জায়গা হোক না হোক তার নিজের বাবার বাড়িতে সে যেকোনো সময় ফিরতে পারবে। কিন্তু গেটের সামনে প্রায় ১৫ মিনিট দাঁড়িয়ে অমিত গভীর চিন্তায় পড়লো। ঢুকবে কি ঢুকবে কিনা। মা’কে ফোন দিয়ে জানাতে পারতো সে আসছে। কাজটা সে করেনি। ইচ্ছা করেই।

প্রান্তিকসহ তার আশপাশের সব বন্ধুরা জানে অমিতের বাবা-মা অমিতকে ত্যাজ্য করেছে। কিন্তু এটা সত্য নয়। অমিতের মা’র সাথে তার সবসময় যোগাযোগ ছিল। এখনও আছে। বীণা রহমান অনেক চেষ্টা করেছিলেন ছেলেকে বাসায় আনতে কিন্তু অমিতের একটাই কথা বাবাকে বলতে হবে। অমিতের বাবা কঠিন টাইপের লোক। তিনি বলেই দিয়েছে অমিত বাড়িতে যেকোনো সময় আসতে পারবে কিন্তু একটাই শর্তঃ অবশ্যই তাকে বাড়ির নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হবে। অমিত কড়াকন্ঠে মা’কে বারণ করে দিয়েছিল। তার বাবা শুনে বলেছিলেন, তিনি অমিতের চেহারা বাকি জীবন দেখবেন না। সে বাড়িতে আসতে পারবে না।  

অমিতের বাবা জানেন অমিত তার নানার বাড়িতে থাকে। জাহিদুর রহমান তার শ্বশুরবাড়ির সাথে সব যোগাযোগ ছিন্ন করে দিয়েছেন। কারণটা খুবই হাস্যকর। ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও শ্বশুরসাহেব যখন বাড়ি বানানোর কাজ হাতে নেয় তখন তিনি তার জামাই এর কোন সাহায্য চাননি। এতেই জাহিদুর রহামানের পিত্তি জ্বলে ছারখার। কত্ত স্পর্ধা! জামাইকে অপমান করা হল! অপমানের শোধ উঠানোর জন্য বাড়ির সকলকে কড়াভাবে বলে দেন, কেউ ওই বাড়িতে পা রাখবে না। যোগাযোগও করবে না। বীণা রহমান কোন প্রকার বিরোধিতা করলেন না। তার মনে হল বাবা ঠিক করেননি। তিনি নিজেও জাহিদুর রহমানের কথা কিছুটা সঠিক মনে করলেন। নিষেধাজ্ঞার কারণে বীণা রহমান বাবার বাড়ির সাথে লুকিয়ে লুকিয়ে যোগাযোগ করেন, এখনও।  

যেহেতু নিজেকে অতিরিক্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মনে করেন জাহিদুর রহমান সেহেতু অবস্থা যতই বাজে হউক না কেন তিনি নিজ থেকে আপন ছেলেকে শ্বশুরবাড়ি থেকে নিয়ে আসবেন না। বীণাকে তিনি তিরস্কারকন্ঠে বলেছিলেন, নিজ থেকেই আসবে। না এসে যাবে কই?

৩বছরেও তার অভিমান ভাঙেনি। অবশ্য পিতার দায়িত্ব তিনি যথাযথ না হলেও, করেছেন। প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণের টাকা বীণার হাতে তুলে দিতেন। বীণা বেশীরভাগ সময় টাকাটা শায়লাকে দিয়ে অমিতের কাছে পাঠাতেন। তাই প্রান্তিকের কাছ থেকে একটাকাও হাতখরচা নিতো না অমিতের। প্রান্তিক জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতো, লাগবে না। প্রান্তিকের আত্মসন্মানে ব্যাপারটা বেশ লাগতো। সে একদিন এই নিয়ে তুমুল ঝগড়া লাগিয়ে দিয়েছিল। অমিত একদম চুপ থেকে শুনে গিয়েছে। কিন্তু মুখ খুলেনি। বাসা থেকে সে যে প্রতি মাসে হাত খরচা পায়, এ কথাটা সে যে কেন প্রান্তিককে বলেনি সেটা অমিত নিজেই জানে না।

কলিংবেল টিপল অমিত। দু’বার টিপার পর দরজা খুলল। অমিতের বাসার কাজের লোক নিলুফা অমিতকে দেখে চিৎকার করে বলল, আরে অমিত ভাইজান!

বীণা রহমান ডাইনিং টেবিলে বসে পান চিবুচ্ছিলেন। নিলুফার চিৎকার শুনে ছুটতে ছুটতে দরজায় এলেন। অমিতকে আপাদমস্তক দেখে বিস্ময়ের সাথে বললেন, বাবা তুই এসেছিস?

অমিত গলা কাঁপিয়ে বলল, হ্যাঁ। আমাকে ঢুকতে দিবে না?

বীণা রহমান তার ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন।

অমিত তার ঘর দেখে চমকে উঠলো। ঠিক ৩বছর আগে যেমনটা সে রেখে গিয়েছিল ঠিক তেমনটাই আছে। টেবিলের উপর গোটাখানেক ডায়রি এলোমেলোভাবে সাজানো ছিল সেগুলো এখনও ঠিক সেভাবেই আছে। অমিতের চোখ ভিজে উঠলো। মনে হচ্ছে কিছু বদলাইনি শুধু তার বয়স বেড়ে গেছে। ব্যাগ রেখে সে ডাইনিং টেবিলে এসে বসলো। অমিতের মা বীণা রহমান খাবার রেডি করছেন। প্লেট উল্টে ভাত নিলো অমিত। বীণা রহমান সবজির বাটি এনে বললেন, তুই যে আসবি আগে বলবি না? এভাবে হুটহাট করে চলে আসে কেউ?

অমিত সবজি নিতে নিতে বলল, আব্বু কোথায়?

-খেয়েই দৌড় দিয়েছে। আড্ডাবাজি যে দুপুরের পর থেকে শুরু হয় সেটা তোর আব্বাকে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। আসতে আসতে রাত ১০টা বাজাবে।

-আব্বু যেন কবে রিটায়ার্ড করলেন?

-এইতো দু’মাস হল। এখন তো ফুর্তি করে উড়ে বেড়াচ্ছে। কাজকাম নাই। সারাক্ষণ বাসায় থেকে জ্বালিয়ে মারে। একদিন রান্না করতে গিয়ে আমার চৌদ্দটা বাজিয়ে দিয়েছিল। বাপ রে বাপ!

অমিত ডাল নিয়ে ভাত মাখতে মাখতে বলল, আমাকে আব্বু থাকতে দিবে?

বীণা রহমান দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, সব সময় বলিস তুই তোর বাপের মতো না। কিন্তু এটা সত্য না। তোর বাবার যেমন দাট-ফাট ঠিক তোরও।

-আম্মু উত্তর দাও।

বীণা বললেন, তোর বাড়িতে তুই থাকবি কি, থাকবি না তোর সিদ্ধান্ত।

অমিত মুচকি হেসে বলল, কথায় কথায় আমার বাড়ি বোলো কেন? সম্পত্তির ব্যাপারে আমার কোন কালেই আগ্রহ ছিল না।

-তোর এই অনাগ্রহই আমাদের কাছ তোকে থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। যেহেতু সম্পত্তি দরকার নেই সেহেতু আমাদেরও দরকার নেই তোর। তারচে সম্পত্তির প্রতি আগ্রহ থাকাই ভালো, তাহলে অন্তত যতদিন বেঁচে আছি মিছামিছি হলেও ছেলে কাছে থাকতো।

অমিত আবেগআপ্লুত কণ্ঠে বলল, আম্মু তুমি জানো আমি তোমাকে কতটুকু ভালোবাসি।

-হুম।

অমিত ভাত নাড়াচাড়া করে বলল, নিচে কয়েকটা কার্টুনে কিছু জিনিস আছে। টবও আছে। কাউকে দিয়ে উপরে তুলতে পারবে?

-আগামীকাল ময়লাওয়ালা আসলে বলবো নে। ও তুলে দিবে। কিছু টাকা দিলে খুশি হয়ে যাবে।

-হুম।

বীণা রহমান পান চিবুতে চিবুতে বলল, তোকে একটা প্রশ্ন করবো?

-করো।

বীণা কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, তুই যার বাড়িতে থাকতি তার সাথে তোর সম্পর্কটা কি ছিল?

অমিত ভাত নাড়াচাড়া বন্ধ করলো। মায়ের দিকে তাকাল। বীণা পান চিবুচ্ছেন। কপাল খানিকটা কুঁচকানো। কাঁপাকাঁপা গলায় অমিত উরর দিলো, কেন তোমাকে তো বলেছিলামই আমার বন্ধুর বড় ভাই…

-বন্ধুর বড় ভাইয়ের সাথে তুই কেন থাকবি?

-মা! ৩বছর পর হঠাৎ এই প্রশ্ন?

বীণা রহমান গালে হাত দিয়ে বললেন, উনার সাথে কি তোর কোন বিশেষ সম্পর্ক ছিল?

-বিশেষ সম্পর্ক বলতে কি বুঝাচ্ছ?

-দেখ কথা পেঁচাবি না। আমি শুনেছি ছেলেটা এখনও বিয়ে করেনি।

অমিত কোমল কণ্ঠে বলল, মা! আজ বাদ দাও।

-ওই লোক কি তোকে ব্যবহার করতো?

-মা!

-উত্তর দে অমিত। তুই আমার ছেলে হয়ে কিভাবে এসব করতে পারলি?

অমিত উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি কোন কিছু ভুল করিনি। আর শুনো! সময় হলে সব বলবো। ধৈর্য ধরো। আরেকটা কথা…

-কি?

-তোমার ছেলে এমন কিছুই করেনি যে তোমাকে লজ্জা পেতে হবে।

বীণা রহমান কর্কশকণ্ঠে বললেন, তুই কি জানিস তোর নামে যে একটা জঘন্য কথা উড়ে বেড়াচ্ছে গত ৩বছর ধরে?

অমিত স্বাভাবিককণ্ঠে বলল, কি?

-তুই এক মেয়ের সাথে পালিয়ে গিয়ে একটা ফ্ল্যাটে লিভ-টু-গেডার করিস। তোর অনেক কলেজের ফ্রেন্ড আমাকে ফোন করে এগুলো বলেছে। আমি বিশ্বাস করেনি। এই কথা তোর বাবার কানে গেলে কি হবে তা জানিস রে অমিত? আমি ৩টা বছর ধরে মিথ্যা বলে এসেছি। তোর বাবা জানতে পারলে কি হবে বল তো?

অমিত বীণা রহমানের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ ছলছল।

অমিত কি ভুল করলো বাসায় ফিরে?

বীণা রহমান বললেন, ভাত শেষ কর।

অমিত চেয়ার সরিয়ে উঠলো। বীণা বললেন, তুই ওই মেয়েকে বাসায় নিয়ে অ্যায়। ওর বাবা-মা’র সাথে কথাবার্তা বলে বিয়ের ব্যাপারটা চুকিয়ে ফেলবো।

অমিত চোখ বড় করে বলল, কোন মেয়েকে নিয়ে আসবো? আর বিয়ে? মানে?

-হ্যাঁ। বিয়ে। তুই তো ওমন ছেলে না অমিত। কি শান্তশিষ্ট, ভদ্র ছিলি! এগুলো করতে তোর রুচিতে বাঁধল না?

অমিত শক্ত কণ্ঠে বলল, মা আমি কোন মেয়ের সাথে থাকতাম না।

-ভুল। মিথ্যা বলছিস। এতদিন থেকেছিস এখন বিয়ে করতেই হবে। আত্মীয়স্বজনদের কাছে মুখ দেখাতে পারি না। কি লজ্জা! বিয়েটা দিলে তো একটু হলেও সন্মান রক্ষা হবে।

অমিত নিঃশ্বাস জোরে ছেড়ে বলল, হায় রে! কি ঝামেলায় পড়লাম!

বীণা বললেন, তোর মাথায় কবে থেকে এ সমস্যা দেখা দিয়েছে বল তো? ১৮বছর বয়সে বাসা থেকে পালিয়ে গেলি, একটা মেয়ের সাথে বসবাস করা শুরু করলি। তারপর ইউনিভার্সিটিতে উঠলি। প্রথমে নিলি ইকনোমিক্স তারপর ঠিক ১বছর পর সাব্জেক্ট চেঞ্জ করে নিলি সমাজবিজ্ঞান। এমন পাগলকে আমি পেটে ধরেছি, ভাবতেই মাথা ঘুরায়!

অমিত বলল, মা শান্ত হও।

-নাহ! পরশুদিন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো তোকে। আর শুন! ওই মেয়েকে ফোন দিয়ে বল আমাদের বাসায় আসতে। বাবা-মা ছাড়া মেয়ে নাকি? পরিবার নেই?

অমিত গটগট করে ঘরে চলে গেলো। সশব্দে দরজা লাগিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। মনে মনে বিড়বিড় করে বলল, কিসের পাল্লায় পড়লাম!

১৭…

সাধারণত গাড়ি—বাস-সিএনজী এড়িয়ে চলে রাকিব। রিকশায় যাতায়াত করতে খুব ভালো লাগে তার। গাড়িতে দম বন্ধ হয়ে আসে, বাসে মানুষজনের ধাক্কাধাক্কিতে মাথা ঘুরে, সিএনজীতে উঠলে মনে হয় এক্ষণই সে পড়ে যাবে। কিন্তু সবসময় তো আর মন মতো হয় না। অনিচ্ছার সত্ত্বেও তাকে গাড়ি নিয়ে বের হতে হয়। মা’র আদেশ! সেটা কি অমান্য করা চলে?

রাকিব গাড়িতে বসে মোবাইল টিপছে। আন্ড্রয়েড মোবাইলগুলোর দাম সস্তা হওয়ার কারণে মানুষজন ঝাঁপিয়ে কিনছে। যার কিনা মাসিক বেতন মাত্র ৫০০০ টাকা সেও সানন্দে পুরো টাকাটা দিয়ে মোবাইল কিনছে। কিনতে মোটেও গায়ে বাঁধছে না! রাকিবের বিলাসিতার অভ্যাস নেই। হয়তো কিছু কিছু ধনকুবেরদের ছেলেমেয়েরা একটু ভিন্ন হয়। অবশ্য বেশীরভাগ ছেলেমেয়ে তো টাকা উড়ানোর জায়গা পায় না বরং টাকার সাগরে নেচে নেচে সাঁতার কাটে।

রাকিব অবশ্য সাঁতার কাটার টাইপ ছেলে না। দানশীল, দয়াশীল স্বভাবের। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় যে কটা ভিক্ষুকের সাথে দেখা হবে সবগুলোকে কিছু না কিছু দিবে। তাড়িয়ে দিবে না। অবশ্য ছেলের এমন দানশীল স্বভাব বাবা-মা’য়ের পছন্দের না। কষ্টে উপার্জিত টাকা নামীদামী রেস্তোরাঁয় অবলীলায় খরচ করতে পারবেন কিন্তু দান করার ক্ষেত্রে হিসাব কষতে বসবেন। বাবা-মা’র সাথে কথায় বনীবোনা হয় না রাকিবের। তাই সে চেষ্টা করে যত সম্ভব তাদের কাছ থেকে দূরে দূরে থাকা। অতি প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া সচরাচর কোন আলাপচারিতায় নিজেকে জড়ায় না। রাকিব মনে করে তাদের সাথে যত কম কথা বলা যায়, ততই ভালো।

মোবাইলের স্ক্রিনে একনাগাড়ে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মাথা ঝিমঝিম করে। রাকিব মোবাইলটা পাশে রেখে বাইরে তাকাল। আকাশ পুরো পরিষ্কার। জুলাই মাসের আকাশ সাধারণত পরিষ্কার থাকে না। মেঘলা মেঘলা হয়ে থাকে। এ বছর বৃষ্টি খুব কম হচ্ছে। অবশ্য রাকিবের মোটেও পছন্দ নয় বৃষ্টিবাদলা দিন। বৃষ্টি দেখলেই অমিতের কথা মনে পড়ে যায়। ছেলেটা ভয়ানক ভালোবাসে বৃষ্টি। যেদিন অমিত তার দুঃখগাঁথা তাকে শুনাচ্ছিল সেদিন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছিল। অমিতের করুণ মুখখানি হঠাৎ ভেসে উঠলো। ঠিক ১৮বছর বয়সে যেমনটা ছিল ঠিক তেমনটাই আছে অমিত, তা সত্য না। মুখের মধ্যে কঠিন্যত্ব এসেছে। কিশোর থেকে যুবক হয়েছে।

একটা ব্যাপার খুব ভাবিয়ে তুলছে রাকিবকে। অমিতের কাহিনি শুনার পর থেকে তার বুকে একপ্রকার আহাজারি শুরু হয়েছে। এতো সৎ, এতো সরল ছেলেটার ভাগ্যে প্রান্তিকের মতো অসভ্য জীবনসঙ্গী পড়লো কেন? কথায় আছে অতি সুন্দরীরা বর পায় না, এখন বলতে হয় অতি সুন্দরেরাও বর পায় না। রাকিব চোখ নামিয়ে নিলো জানালার কাছ থেকে। অমিতের প্রতি তার ভালো-লাগা আবার প্রকট হচ্ছে। হয়তো ভালো-লাগা ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে বা হচ্ছে। সে কি আজ থেকে পছন্দ করে অমিতকে? গত ৫বছর ধরে ভালো-লাগাকে ধামাচাপা দিয়ে রেখেছে। প্রান্তিকের সাথে সম্পর্কের কথা শুনে রাকিবের বেশ মন খারাপ হয়েছিল। দুঃখে, রাগে, ক্ষোভে ২বছরের জন্য বিদেশ চলে যায়। কিন্তু সেখানে গিয়ে থাকতে পারেনি।

আচ্ছা, অমিতের প্রতি তার ভালোবাসাকে কি এখন ব্যক্ত করা প্রয়োজন? আচ্ছা, অমিত এগুলো শুনে যদি বিরক্ত হয় তাহলে কি হবে? কথা বন্ধ করে দিবে? ও যদি ভুল বুঝে?

দেখতে রাকিব কিন্তু বেশ নয় ভয়ানক ভালো। ৬ফিট লম্বা। কাঁধ চওড়া, মুখ গোলগাল। ফর্সা। ঘন চুল। পিটানোর শরীর, পেটে মেদ নাই। এক সময় জিমে যেতো তখন শেইপ অনেক আকর্ষণীয় ছিল। ছেলেরা টাকার পিছনেও ঘুরে, রূপের পিছনেও। রাকিব বড়লোক। অতি সুন্দর। ছেলেরা জ্বালাবে স্বাভাবিক। রাকিব উগ্র নয় তাই সবসময় এড়িয়ে চলতো। এক মেয়ের সাথে কয়েকদিনের জন্য সম্পর্ক হয়েছিল। মূলত অমিতকে ভুল থাকার জন্য সম্পর্কে গিয়েছিল। কিন্তু, সম্পর্ক টিকেনি!

ললাটের আজব লিখন তো বটেই!

অমিতের প্রতি রাকিবের ভালোলাগা বলা হউক বা ভালোবাসা, তা একপাক্ষিক।অবশ্ অবশ্য রাকিব এ’কথাটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে গিয়েছে।  

গাড়ি থামল বনানী ৪নাম্বার রোডের এক বিশাল ৯তলা বাড়ির সামনে। বাড়িটা রাকিবের। উহু, রাকিবের বাবার। বাবার কোন কিছু জিনিস নিজের বলতে রাকিবের অস্বস্থিবোধ হয়। রাকিব গাড়ি থেকে নেমে লিফট চড়ে ৬তলায় উঠলো। কলিংবেল টিপতেই দরজা খুলল গৃহকর্মী রাবেয়া। রাকিবকে দেখে রাবেয়া নিচুস্বরে বলল, ভাইয়া আপনার রুমে তারা বসে আছেন।

-খেতে কিছু দিয়েছেন?

-জী, দিয়েছি।

-আম্মু বাসায় আছেন?

-নাহ, উনি আজ সকাল সকাল বেড়িয়ে গিয়েছেন। আপনি কি কিছু খাবেন?

রাবেয়ার দিকে রাকিব তাকিয়ে বলল, আচ্ছা আপনি আমার চেয়ে কতো বড় হবেন?

রাবেয়া ইতস্তত করে বলল, সেটা ঠিক করে বলতে পারবো না।

রাকিব হেসে বলল, আপনি আমার চেয়ে অনেক বড় আপু। আমাকে আপনি ডাকা বন্ধ করুন। আমি একজন মানুষ। ভগবানকে ভয় করুন, মানুষকে নয়।

রাবেয়া বলল, কিছু খাবেন ভাইয়া?

-হুম, ফ্রিজে বোরহানি আছে?

-জী আছে। কিন্তু ম্যাডাম বলেছেন ওটা বাসি।

রাকিব অবাক হয়ে বলল, গতকালই তো নিয়ে আসলাম!

রাবেয়া বলল, ওটা এখনও ফেলে দেই নি।

-ভালো করেছো, এখন এক গ্লাস নিয়ে আসো দ্রুত।

রাবেয়া বোরহানি আনতে চলে গেলো।

রাকিবের রুমে মোট ১০জন বসে আছে। সবই তার বন্ধু-বান্ধব। কমিউনিটির বন্ধু-বান্ধব। আজ সবাই এখানে একত্রিত হয়েছে একটি বিশেষ কারণে। আজ শুভ্র আর সুজনের বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পর্কিত কথাবার্তা হবে। সবার মুখে হাসি ফুটে আছে। দেখতে খুব ভালো লাগছে রাকিবের।

রাকিব চেয়ার টেনে বসে বলল, তো শুরু করা যাক।

সুজন শুয়ে ছিল। সে উঠে বসলো। শুভ্রর হাত ধরে বলল, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না ৬বছর একসাথে থাকার পর বিয়ে করছি।

রাকিব মুচকি হেসে বলল, বিয়ে করলেই সব শেষ।

শুভ্র মুখ গোমড়া করে বলল, সবাই কি আর প্রান্তিক-অমিতের মতো?

রাকিবের কপাল কুঁচকে বলল, এটা কি ঠিক বললি ?

মারুফ হাত ঝাঁকিয়ে বলল,  ঝগড়াঝাঁটি শুরু করিস না তোরা। আমি কিছু জিনিস ঠিকঠাক করেছি। একে একে বলছি। শুন।

সবাই একসঙ্গে বলল, আচ্ছা!

মারুফ বলল, আমরা বেশি বড় অনুষ্ঠান করতে চাচ্ছি না। ৫০জনের ছোট একটা অনুষ্ঠান। ভেন্যু, প্রান্তিকের ফ্ল্যাট।

রাকিব অবাকসুরে বলল, আমার ছাদে হওয়ার কথা ছিল না?

সুজন বলল, ওই বাড়িতে তো এখন কেউ থাকে না। আর ফ্ল্যাটটা অনেক বড়। অনুষ্ঠান করে আরাম পাবো।

রাকিব বলল, আচ্ছা।

রাবেয়া দরজা টোকা দিয়ে বলল, ভাইয়া আপনার…

রাকিব উঠে গিয়ে গ্লাসটা নিয়ে দরজা বন্ধ করলো। সবাই গুনগুণ করে একে অন্যের সাথে কথা বলছে।

-প্রান্তিক তো ওই ছেলেটার সাথে ডেট করছে জানিস? পারেও বাবা! ধরা খেয়ে ওই ছেলের প্রতি ভালোবাসা বেড়ে গিয়েছে!

-অমিতের খবর জানিস না? সে তো আধাপাগল হয়ে গিয়েছে। শুনলাম বাসায় যাওয়ার পর পাগলের মতো ট্রিট করছে বাসার লোকজন।

-আহা, কম বয়সী পোলাপানগুলো যে কেন প্রেম করে! সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে আসতে হবে কেন?

-আসবে না! টাকা পয়সা সবসময় কথা বলে। আনন্দ-ফুর্তি করে ৩বছর কাটিয়েছে!

-কি ডাঁট বেড়েছিল অমিতের! মাটিতে পা পড়তো না। বড়োলোকি জামাই পেয়ে দাম বেড়ে গিয়েছিল। শুধু রূপ থাকলেই হল? মাথায় কিছু থাকতে হয়।

-আহা, অমিতের দোষ কি! প্রান্তিকই তো। হঠাৎ কথা নাই বার্তা নাই, সম্পর্ক ভেঙ্গে ফেলল।

-হে! আমরা বুঝি জানি না! নিশ্চয় কোন লোকের সাথে শুতে গিয়ে ধরা খেয়েছে। কমবয়সী ছেলে। শারীরিক চাহিদা থাকবেই! আর কতদিন একজনকে নিয়ে থাকবে?

-এটা কেমন কথা? তাহলে কি আমাদের মধ্যে কেউ নেই যে কমবয়সী কিন্তু একজনকে নিয়ে কমিটেড? একজন অন্যরকম হলে, সবাই কি ওরকম?

-এসব ছেলেগুলোর ক্যারেক্টার নেই। চরিত্রহীন। দেখিস কয়েকদিন কান্নাকাটি করে বুড়ো কাউকে বাগীয়ে নিবে। রূপ আছে ভালোই। বেশি ঝামেলা পোহাতে হবে না।

-উহু, অমিতকে দেখেছি আমরা সবাই। ছেলেটা পরিষ্কার।

-ক্যান তোর ভালো লাগতো?

রাকিব ঘরে উপস্থিত সবার কথাবার্তা খুব মনোযোগ সহকারে শুনছে। বেশীরভাগই অমিতের বিপক্ষে কথা বলছে। অমিত আর প্রান্তিকের সম্পর্কটা সবার কাছে ঈর্ষনীয় ছিল। কারণ একটাই- অমিত খুব কম বয়সে মনের মানুষের সাথে সংসার করতে সক্ষম হয়েছে। বয়স কম হলেও অমিত খুব দ্রুত সবার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। একজন বিবাহিত পুরুষের সব দায়িত্ব পালন করেছে। রাকিব অবাক হয় অমিতের আচরণ দেখে। সে নিজে ২৮বছর বয়সী কিন্তু অমিতের ব্যবহার দেখে মনে হয় সে তার ছোট। এতো শান্তশিষ্ট- ধৈর্যশীল ব্যক্তিত্ব রাকিব আগে দেখেনি। মাত্র ২১বছর বয়সী ছেলেটার দিকে তাকালে মনে হয় ছেলেটা ২০বছর বয়সী কিন্তু তার মন ৩০বছর বয়সী। অমিতের কথা ভাবতেই তার চোখের কোণায় পানি চলে এলো। সে আবারও গল্পে মনোযোগ দিতে লাগলো।

-দোষ দুপক্ষেরই আছে। অমিত তো নিজেকে অনেক সিয়ানা মনে করে, তাই জামাইকে আগলে রাখতে পারেনি। প্রান্তিকের স্বভাব সে চাইলে ঠিক করতে পারতো। ইচ্ছা করে করেনি।

– আচ্ছা, প্রান্তিকের বাসায় অনুষ্ঠান হলে অমিত আসবে তো? ৩বছর যে বাসায় সে সংসার করেছে। ওই বাসায় আসতে চাইবে কি?

-সুজন, তোর তো খুব ভালো বন্ধু অমিত। আসবে কি?

রাকিব জোরে বলল, এজন্য চাচ্ছিলাম আমার বাসায় অনুষ্ঠান হউক।

মারুফ বলল, একজনের জন্য পুরো প্ল্যান চেঞ্জ?

শুভ্র বলল, তা তো হবেই। অমিত যে কতো জনের উপর তার ছড়ি ঘুড়ায় তা কি গুনে শেষ করা যাবে? হা!হা!হা!

রাকিব চোখমুখ শক্ত করে বলল, অমিত কি তোমাদের একজনেরও জীবনে ধানে মই দিয়েছে?

সবাই একদম চুপ করে রইল। মারুফ আমতা আমতা করে বলল, ওই যে প্রতাপ…

রাকিব বলল, প্রতাপের সব কথায় কান দিতে হবে? তোমরা তো জানোই ও অমিতকে দেখতে পারে না। বানিয়ে বানিয়ে কথা ছড়ায়।

শুভ্র দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, অমিতকে আসলে কেউই দেখতে পারে না।

সবাই একজন আরেকজনের দিকে তাকাতে শুরু করলো। সুজন করুণ কণ্ঠে বলল, আমার বন্ধুটার নামে একটাও বাজে কথা শুনতে চাই না।

রাকিব উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তোমাদের আলাপচারিতা শেষ হয়েছে সম্ভবত। আমার কিছু কাজ আছে। আমি চললাম।

সুজন বলল, রাগ করলি?

রাকিব হেসে বলল, কার উপর রাগ করব? যাইহোক, তোমরা থাকো।

রাকিব গ্লাস নিয়ে বের হয়ে আসলো। দুই হাত দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ডাইনিং টেবিলের জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো। পরিষ্কার আকাশে চিল উড়ছে।  ৬তলা থেকে উঁচু দালানগুলোকে খুব বেমানান লাগছে। আচ্ছা দালানগুলো না থাকলে কেমন লাগতো এই পুরো জায়গাটা? ঘন জঙ্গল? চুপচাপ নগরী? রাকিব হাতের গ্লাসটার দিকে তাকাল। তার হাত কাঁপছে। বুক কাঁপছে। খুব অন্যরকম অস্বস্থি লাগছে।

আচ্ছা, অমিতকে সবাই ভুল বুঝচ্ছে কেন?

১৮…

-চোখের নিচে কালি পড়েছে কেন?

-জানি না।

-রাত জাগেন?

-হুম।

-কয়টা পর্যন্ত?

-২টা বা ৩টা

-রাত জেগে কি করেন?

-কিছুই না।

-শুয়ে থাকেন?

-জী।

-বিছানায় কয়টায় জান?

-১২:৩০টায়

-এতক্ষণ শুয়ে শুয়ে কি ভাবেন?

-এলোমেলো চিন্তাভাবনা। যুক্তিসঙ্গত ভাবনা নয়।

-ওহ। দিনে কয়বার নিজেকে আয়নায় দেখেন?

-গুনে রাখিনি।

-চেহারায় পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন?

-জী।

-মোটা না চিকন হয়েছেন?

-চিকন।

-ফর্সা হয়েছেন না কালো?

-কালো।

-পছন্দের একটা সিনেমার নাম বলুন।

-ব্ল্যাক সোয়ান।

-কে অভিনয় করেছেন?

-নাটালি পোর্টম্যান।

-তিনি ইসরাইলী, জানেন?

-জী।

-তাও তার ছবি পছন্দ করেন?

অমিত কঠিন চোখে তাকাল প্রশ্নকর্তার দিকে। প্রশ্নকর্তা হেসে দিলেন। লোকটি মধ্যবয়স্ক। মাথায় চুল নেই, ছোটোখাটো মানুষ। চোখে বিরাট চশমা। চেহারায় ডাক্তারভাব প্রকট। আচ্ছা, কিছু কিছু মানুষকে দেখলেই বুঝা যায় তারা ডাক্তার। কেন? এই প্রশ্নটা অমিতের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।

-আপনি কিছু ভাবছেন?

-জী।

-কি, বলা যাবে?

-না।

ডাক্তার সাহেব চেয়ার থেকে ছেড়ে উঠলেন। কেবিনটা বেশ বড়। মোট ১০টার মতো লাইট জ্বলছে।  অমিত বসে থাকা অবস্থায় চট করে লাইটগুলো গুণে নেয়। মাঝেমধ্যে এধরণের কাজকর্ম করতে খুব ভালোবাসে। যখন সে ক্লাস ফোর এ পড়তো তখন ভ্যানে করে স্কুলে যেতো। ক্লাস শুরু হতো সাড়ে ১২টায়। ভ্যান তাকে নিতে আসতো ১০টায়। বাসা থেকে স্কুল বেশ দূরে ছিল, তাই আগেভাগে বেড়িয়ে যেতো। মেইন রাস্তা দিয়ে ভ্যান যখন যেতো তখন অমিত একটা খাতা বের করে বাইরে তাকিয়ে থাকতো। একটা বাস চোখে পড়লেই সে বাসের নম্বর টুকে রাখত। বেশ কয়েকটার নাম্বার টুকতে পারতো, আর কয়েকটা দ্রুত চলে যেতো। তখন শুধু নাম্বার টুকত। আর স্কুল থেকে ফেরার পথে খাতায় টুকা নাম্বারের সাথে রাস্তায় যে বাসগুলো চলছে সেগুলোর সাথে নাম্বার মিলিয়ে দেখত। সকাল আর বিকালের বাসের সাথে মিল একটাও পেতো না। কিন্তু এতে অমিত দুঃখবোধ করতো না, অন্যরকম উত্তেজনা কাজ করতো। ঠিক কোন ক্লাস পর্যন্ত এ কাজটা সে করেছে, ঠিক মনে নেই তার।

অমিত একটা লাইটের দিকে তাকিয়ে আছে। সাদা এনার্জি বাল্ব। একনাগাড়ে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মাথা ঘুরে। মাঝেমধ্যে একটা লাইট থেকে এক বা একাধিক লাইট চোখে পড়ে। তার মাথা খানিকটা ঝিমঝিম করছে। চোখ নামিয়ে ডাক্তারের দিকে তাকাল। ডাক্তারসাহেব চেয়ারে বসে একদৃষ্টিতে অমিতের দিকে তাকিয়ে আছেন। অমিত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, কিছু বলবেন?

-নাহ। আপনাকে পর্যবেক্ষণ করছি।

-ওহ

-আপনি ধূমপান করেন?

-নাহ।

-ড্রাগ নেন?

অমিত ভুরু কুঁচকে বলল, অবশ্যই না।

ডাক্তার সাহেব গাল চুলকাতে চুলকাতে বললেন, মদ্যপানের অভ্যাস তো নিশ্চয়ই আছে।

অমিত দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, নেই।

ডাক্তার সাহেব কপাল কুঁচকে বললেন, তাহলে আমার কাছে কি করতে এসেছেন?

অমিত খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, মা নিয়ে এসেছেন জোর করে।

-ও! মায়ের সব কথা কি শুনেন আপনি?

অমিত চিন্তা করে বলল, নাহ।

-তাহলে এটা শুনলেন যে?

-আমি আসলে…

ডাক্তার সাহেব হাত বাড়িয়ে বললেন, আমি ডাঃ আশেকুল খান।

অমিত হ্যান্ড শেক করে বলল, আমি অমিত।

আশেকুল এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল, আচ্ছা আমি কি একটা সিগারেট ধরাতে পারি?

অমিত শান্ত গলায় বলল, জী না। আমি সিগারেটের ধোঁয়া সহ্য করতে পারি না।

-ওহ আচ্ছা। ঠিক আছে।

আশেকুল খান চেয়ার থেকে উঠে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালেন। পর্দা দিয়ে ঢাকা, তিনি আস্তে আস্তে সরিয়ে দিলেন। অমিত খুব সূক্ষ্মতার সাথে ডাক্তারের কার্যক্রম লক্ষ্য করছে। হাবসাব বুঝা যাচ্ছে না, কিন্তু বুঝা যাচ্ছে তার মা ডাক্তারকে সব কিছু বলে দিয়েছেন।

-আপনার কোন ধরণের বদ অভ্যাস আছে?

অমিত স্বাভাবিক গলায় বলল, মাস্টারবেশন।

জানালা থেকে চোখ সরিয়ে কৌতূহলীকন্ঠে আশেকুল বললেন, এটা বদ অভ্যাস না। কিন্তু কন্ট্রোল না করলে, বাজে অভ্যাস পরিণত হয়।

অমিত হাসতে হাসতে বলল, যাহা লাউ, তাহাই কদু।

আশেকুল টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, আপনার মা আমাকে সবকিছু বলেছেন। আমি জানি ব্যাপারটা বেশ জটিল। কোন খারাপ অভ্যাস আপনার মধ্যে নেই, তাও কেন আপনি এতো কম বয়সে বাড়ি ছেড়েছেন। একজন মেয়ের জন্যে? কেন?

অমিত বলল, এটাকে খারাপ অভ্যাস বলছেন কেন? প্রেম করে বাড়ি ছাড়া বাজে স্বভাব?

-তা হতে যাবে কেন বলে? আসলে…

-আসলে, বিজ্ঞান আমাদেরকে পলিশ করলেও সেই পুরনো যুগের রীতিনীতি নিয়ে পড়ে আছি।

আশেকুল খান গম্ভীরগলায় বললেন, আপনি কি আসলেও মেয়েটির সাথে ৫বছর যাবত একই ফ্ল্যাটে থেকেছেন?

অমিত মাথা নিচু করে তার ঘড়ি দেখতে দেখতে বলল, আমি উঠতে চাই।

আশেকুল খান জানালার কাছ থেকে সরে এসে অমিতের পাশের চেয়ারে বসলেন। তিনি টেবিলে টোকা দিয়ে বললেন, আপনি কি কিছু বলতে চান?

অমিত মাথা উঁচু করে বলল, না তো।

-উহু, আসার পর থেকেই আমি আপনাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। খুব ভালোভাবে। আপনার বসার ভঙ্গি, কথা বলার ভঙ্গি, সবকিছুই লক্ষিত করেছি।

-তো?

-তো? আপনি কিছু লুকাচ্ছেন। আপনি আপনার মায়ের কথায় এখানে আসেন নি। আপনি নিজের কথায় এসেছেন, নিজের মস্তিষ্কের কথায় এসেছেন। আপনার মনের ভিতর কিছু কথা জমে আছে, যেটা আপনি কাউকে বলতে পারছেন না।

অমিত দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, কথা সত্য।

-এখন বলুন, মেয়েটির সাথে ৫বছর থেকেছেন?

অমিত বলল, থেকেছি। ৫ বছর থেকেছি।

-হুম।

অমিত টেবিলে রাখা একটা প্যাডে আঁকিবুঁকি করতে করতে বলল, কিন্তু একটা অসত্য তথ্যকে আপনারা প্রশয় দিচ্ছেন।

-সেটা কি?

-আমি কোন মেয়ের সাথে থাকিনি। আমি একটা ছেলে, হুম ছেলেও না এক লোকের সাথে ৫বছর থেকেছি।

আশেকুল খান কপাল চুলকাতে চুলকাতে বলল, ওহ। আচ্ছা। তাহলে এই নিয়ে এতো ঝামেলা হচ্ছে কেন? আপনি তো আপনার মূল্যবোধের বাইরে কোন কাজ করেননি। লোকটির সাথে আপনার সম্পর্ক কি ছিল?

অমিত আশেকুল খানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, সেটা জানা কি খুব জরুরী?

-বলতে চাইলে বলতে পারেন।

-আপনাকে আমার মোটেও ডাক্তার মনে হচ্ছে না। কি মনে হচ্ছে জানেন?

-কি?

-গোয়েন্দা। এমনভাবে প্রশ্ন করছেন যেন বিরাট অপরাধী আমি।

আশেকুল খান হাসতে হাসতে বললেন, ডাক্তাররা এইরকমই হয়।

-আপনি জানতে চান, তার সাথে আমার সম্পর্ক কি ছিল?

-হুম।

-আপনি কি গেস করছেন? কি হতে পারে?

আশেকুল খান বললেন, ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলা ডাক্তারদের কাজ। আপনার না।

অমিত হাত দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল, সে আমার স্বামী ছিল।

আশেকুল খান চোখ বড় বড় করে বললেন, আমি ঠিক শুনতে পারিনি। কি বললেন?

অমিত সামনে রাখা গ্লাস হাতে নিয়ে বলল, ডাক্তারদের শ্রবণশক্তি প্রবল হওয়া উচিত। তাই নয় কি?

অমিত ঢক ঢক করে পুরো গ্লাসের পানি শেষ করে ফেলল।

আশেকুল খান একটা কলম ক্রমাগত হাত দিয়ে ঘুরাচ্ছেন। তিনি বললেন, ছাড়াছাড়ি হল কবে?

 অমিত বলল, এইতো ১মাসের মতো হবে।

-কারণ?

অমিত বলল, জানি না।

আশেকুল খান বললেন, ভাবুকদের মতো কথা বলবেন না। অবশ্যই সম্পর্ক বিচ্ছেদের পিছনে কারণ আছে।

-আচ্ছা, আপনি কি কখনও এর আগে কোন হোমোসেক্সুয়াল কেস হ্যান্ডেল করেছেন?

-একটা করেছিলাম। মাই ফার্স্ট এক্সপেরিয়েন্স। ছেলেটা বিবাহিত ছিল। ২বাচ্চার বাবা হওয়া সত্ত্বেও বয়ফ্রেন্ডকে ভুলতে পারেনি। কিন্তু বয়ফ্রেন্ড তাকে দেখতেই পারে না এমন অবস্থা। খুব ক্রিটিক্যাল কেইস ছিল। ওসব বাদ দিন। এখন বলুন কেন এসেছেন আমার কাছে?

অমিত আঁকিবুঁকি করতে করতে বলল, আচ্ছা মানুষের মন কি পরিবর্তনশীল?

-জী। পরিবর্তনশীল। মানুষের একটা জিনিস এখন ভালো লাগলে, কিছুসময় পর সেটার উপর থেকে আকর্ষণ চলে যায়। আকর্ষণের তীব্রতা নির্ভর করে চাওয়া-পাওয়া উপর।

-তাহলে এতো যে হেটেরোসেক্সুয়াল ক্যাপল আছে তারা কিভাবে সাড়া জীবন একসাথে থাকে?

আশেকুল খান বললেন, এটার খুব একটা সোজা উত্তর আছে। সমাজ! যে সমাজের যে নিয়ম। আর সমাজ মানুষের পুরো চিন্তাকে নিয়ন্ত্রন করে।

-হুম

আশেকুল খান বললেন, আমি কিছু কেইস স্টাডি করেছি। একটা ভুল ধারণা হোমোদের মধ্যে আছে, তাদের সম্পর্ক টিকে না। এটার পিছনে কয়েকটা সুনির্দিষ্ট কারণ আছে। বলবো?

-বলেন!

-প্রথম কারণ সমাজে স্বীকৃতি নেই। আর মানুষ সমাজকে ভয় পায়। তো, ভেঙ্গে গেলেও মনের মধ্যে অনুশোচনা কাজ করে হয়তো কিন্তু সমাজকে প্রতারিত করার পাপ থেকে নিজেকে মুক্ত করে এমন একটা ভাব চলে আসে। এর বিপরীতেও একটা কথা প্রযোজ্য হয়। যেমন অনেক ছেলে-মেয়ে রিলেশন করে, তাই না? তাদের মধ্যে অনেকের মাস খানেক টিকে, তারপর আরেকটা। তাহলে ওরা কি সমাজকে ভয় পায় না? এজন্য আমি কোন কারণকেই পাত্তা দেই না। আমি সব সম্পর্কে একই রকম দেখি।  কিন্তু আমি তাও বলবো, স্বীকৃতি অনেক বড় একটা ফ্যাক্ট।

অমিত বলল, ডাক্তার সাহেব! আমার করনীয় কি?

আশেকুল খান বললেন, আমি এখন কি একটা সিগারেট ধরাতে পারি?

অমিত মাথা নেড়ে বলল, অবশ্যই না!

আশেকুল খান মুখ গোমড়া করে বললেন, আচ্ছা।

অমিত উঠে দাড়াতে দাড়াতে বলল, আপনার সাথে কথা বলে খুব ভালো লাগলো। আশা করি আবারো দেখা হবে।

-এতো তাড়াতাড়ি কথা শেষ?

অমিত হেসে বলল, আমি আমার উত্তর পেয়ে গিয়েছি। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ডাক্তার সাহেব!

আশেকুল খান বললেন, একটা কথা মনে সবসময়। সমাজ পরিবর্তনশীল। আগামী ২০বছরের মধ্যে বিরাট পরিবর্তন দেখবেন। পরিবর্তন ইতিবাচক হবে নাকি নেতিবাচক হবে কিনা সেটা সময়ের ব্যাপার।

অমিত বলল, ২০ বছর পর্যন্ত বাঁচলেই হল!

-সবই সম্ভব।

-স্যার?

-বলুন!

-আমার প্রেসক্রিপশন ?

আশেকুল খান হো হো করে হেসে উঠলেন। তিনি কাগজে কিছু লিখে ভাঁজ করে বললেন, বাসায় গিয়ে খুলবে। কেমন?

কাগজটি হাতে নিয়ে খুব ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে কেবিন থেকে বের হল অমিত। অনেকদিন পর একটু হালকা লাগছে নিজেকে। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে হাটতে শুরু করলো। যখন সে কলেজে পড়তো তখন নানা কারণে এই জায়গাটায় আসা হতো। কোন সময় কোচিং করতে, কোন সময় বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে। বাসা থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার পর অমিত নিজেকে সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। কলেজে খুব কম যেতো। গেলেও ক্লাস শেষে দ্রুত বাসায় ফিরত। কলেজের শেষ সময়গুলো অমিতের বেশ বাজে কেটেছিল। সবাই তাকে নিয়ে উদ্ভট কথাবার্তা বলতো। অমিত পাত্তা না দেবার ভান করলেও ব্যাপারগুলো তাকে বেশ জ্বালাতন করতো। রাস্তা পার হয়ে সে রিকশা খুঁজা শুরু করলো। আকাশে মেঘ ডাকাডাকি করছে, তবুও অনেক গরম। গা পুড়ে যাচ্ছে, এমন গরম। অমিত এদিকওদিক তাকিয়ে দেখল কোন রিকশা ফাঁকা নেই। রাস্তার ওপারে একটা লাইব্রেরী দেখা যাচ্ছে। স্কুলে থাকতে এই লাইব্রেরীতে খুব আসা হতো। নানা ধরণের গল্পের বই পাওয়া যেতো, তখন নেশাই অন্যরকম ছিল। বই পড়া, মাছ পালা আরও কতো কি! আজ কেন জানি ইচ্ছে করছে ওই লাইব্রেরীতে যেতে। অমিত রাস্তা পার হয়ে লাইব্রেরীর সামনে আসলো। লাইব্রেরীর ঠিক পাশে একটি মুদির দোকানে কিছু ছেলে জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওখানকার একজনকে খুব চেনা চেনা লাগছে অমিতের। সে এগিয়ে গেলো। অমিতকে আগাতে দেখে তাদের মধ্যে একজন ফর্সা করে চিৎকার করে বলল, আরে অমিত! কি খবর?

অমিত লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। স্কুলে থাকা অবস্থায় এই ছেলেটার প্রতি তার বেশ আকর্ষণ ছিল। নাম সাব্বির। সে সবসময় অমিতের পেট হাতাত। ক্লাসে বসে থাকার সময় গায়ের সাথে গা লেগে সুড়সুড়ি দিতো। অমিত প্রতিবাদ করতো না।

সাব্বিরের চিৎকার শুনে আশেপাশের ছেলেগুলো হইহই করে উঠলো। এগুলো সব অমিতের স্কুল-কলেজের বন্ধু। অমিত কাছে যেয়ে বলল, কি খবর তোদের? কতদিন পর!

সাব্বির বলল, কতদিন পর তো অবশ্যই! কি খবর তোর বল?

-এইতো বেঁচে আছি। আর তোদের? কি রে আকিব? চিনতে পারিস?

আকিব বলল, তোকে চিনতে পারবো না আবার? আমাদের বয়েজ স্কুলের ওয়ান অ্যান্ড অনলি অমিত আপা! হা হা হা!

সবাই হো! হো! হো করে হেসে উঠলো। অমিতের একটু খারাপ লাগলো।

আকিব বলল, তুই তো দেখি আগের চেয়ে আরও বেশি আপা হয়ে গিয়েছিস। কি ফিটফাট রে!

অমিত বলল, ফিটফাটের কি দেখলি?

সাব্বির অমিতের কাঁধ জড়িয়ে বলল, দেখ আমার বউকে নিয়ে বাজে কথা বলবি না!

সবাই আবারও হো! হো! করে হেসে উঠলো। স্কুলে থাকতে সাব্বির অমিতকে বউ বলে ডাকতো। আর অমিত হাবার মতো শুনত, প্রতিবাদ করতো না। তার মধ্যে ভয় ছিল প্রতিবাদ করলে তাকে মার খেতে হবে।

অমিত হাত সরিয়ে বলল, আচ্ছা আমি যাই, দেরি হচ্ছে।

কবির মুখ কুঁচকে বলল, আচ্ছা শুনলাম তুই বলে আবার বাপের বাসায় ফিরে এসেছিস?

সাবিরসহ সবাই অবাক হয়ে অমিতের দিকে তাকাল। কবির বলল, এতো কম বয়সে বিয়েশাদি করে আলাদা থাকা শুরু করেছিস।

অমিত বলল, না তো! আমি তো…

সাব্বির বলল, হ্যাঁ আমিও শুনেছি। কিন্তু আমি জানি ও একটা মেয়ের সাথে থাকতো। অ্যায় কলেজে থাকতে ও না আলাদা হয়ে গেলো?

আকিব দাঁত খিচিয়ে বলল, তোকে তো কখনও একলা পাইনি তাই বলা হয়নি। তুই আমাদেরকে নিয়ে এতো কথা বলতি! আমরা স্কুলে থাকতে যখন স্মোকিং করতাম তখন সেটা নিয়ে কি রে লেকচার! বাপ রে বাপ! আর তোর অবস্থা দেখেছিস? লজ্জা করে না?

অমিত অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। সে কি বলবে বুঝতে পারছে না।

সাব্বির বলল, আহা বাদ দে তো!

আকিব বলল, বাদ দিবো কেন? এরকম ক্যারেক্টারলেস পোলাপানকে শিক্ষা দেওয়া উচিত।

অমিত কড়াকন্ঠে বলল, আমি ক্যারেক্টারলেস না।

আকিব হাত পকেটে গুঁজে বলল, তুই ক্যারেক্টারলেস না। তুই চরিত্রহীন। খুশি?

অমিত স্তম্ভিত। এতোগুলো মানুষের সামনে আকিব এধরণের বাজে কথা বলছে আর সে কিছুই বলতে পারছে না? অমিত মাথা নিচু করে বলল, একজন মানুষের সম্পর্কে না জেনে কথা বলবে না। দয়া করে। দয়া করে।

সাব্বির বলল, তোরা অমিতের ব্যাপারে যা শুনেছিস তা মিথ্যাও হতে পারে।

অমিত সাব্বিরের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি বাসা থেকে চলে গিয়েছিলাম সেটা সত্য কিন্তু কোন মেয়ের সাথে থাকেনি। আর যদি থেকেও থাকি, সেটা অন্য মানুষের মাথা ব্যথার বিষয় হতে পারে না। দয়া করে, আমার জীবন আমাকেই সামলাতে দাও।

আকিব কিছু একটা বলতে গেলে অমিত বলল, খারাপ কিছুই বলিস নি আকিব। ঠিক বলেছিস। একদম ঠিক। পারলে আমাকে মাফ করে দিস।

অমিত গটগট করে হেঁটে চলে এলো। সে প্রতিবাদ করলো না কেন? সত্যটা কেন বলল না? সে কি নিজেকে নিয়ে এখনও ভয় পায়? নিজের সত্ত্বাকে এখনও সে অস্বীকার করে? এখনও সে দায়বদ্ধ? কবে সে নিজের আসল পরিচয় দিয়ে মাথা তুলে চলতে পারবে? কবে?

অমিত প্রেসক্রিপশনটা খুলল। ডাক্তার সাহেব লিখেছেন,

নিজেকে প্রকাশ করো, তুমি যা তাই পৃথিবীকে দেখাও।

আফসোস। আজ সে ব্যর্থ হয়েছে।

১৯…

রাকিব উত্তেজনায় ছটফট করছে। পুরো বাড়ির এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মুখে হাসি হাসি ভাব নিয়ে একবার সোফায় বসছে, আরেকবার ফ্রিজ খুলছে, রান্নাঘরে ঢুকে থালাবাসনে হাত দিচ্ছে। উত্তেজনা কাজ করছে কেন বলা যেতে পারে। অমিত ১০মিনিট আগে রাকিবের বাসায় এসেছে। সে এখন রাকিবের বাথরুমে গোসল করছে। গোসল করার আগে বলে দিয়েছে পরনের কোন কাপড় থাকলে বের করে দিতে। রাকিব আকাশ থেকে পড়ল। তার ব্যবহৃত কাপড় তাকে পরতে দিবে? না, না! নতুন কাপড় কিনতেই হবে। রাকিব সিদ্ধান্ত নিলো নতুন কাপড় কিনতে এখনি বের হবে। সে রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে রুমে ঢুকে ম্যানিব্যাগ নিলো। রুম থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অমিত জোরে চিৎকার করে বলে উঠল, কই জামাকাপড় দাও! রাকিব চিৎকার শুনে দিশেহারা হয়ে গেল। কি করবে সে? রাকিবের মাথায় কোনোকিছু কাজ করছে না। সে দৌড়াতে দৌড়াতে নিজের আলমারির কাছে গেল। গত পরশুদিন সে কিছু কাপড় কিনেছিল। কাপড়গুলো প্যাকেট করাই আছে, সে আনন্দে তা দেখে তড়িঘড়ি করে বের করলো। একটা সুন্দর হালকা নীল রঙের শার্ট, কুটকুটে কালো রঙের প্যান্ট। রাকিব মুচকি হাসতে হাসতে দরজা টোকা দিয়ে বলল, কাপড় নাও। ওপাশ থেকে কোন জবাব এলো না। রাকিব আরেকবার টোকা দিলো। অমিত তোয়ালে পেচিয়ে বেরিয়ে আসলো। লম্বা লম্বা চুলগুলো কপালের কাছে, তা থেকে চুইয়ে চুইয়ে পানি পড়ছে। রাকিবের নজর পড়ল অমিতের শুভ্র বুকের দিকে। একদম পিটানো। উঁচুনিচু খাদ নেই। মেয়ে মানুষের মতো কোমর। পেট দেখলে মনে হবে এ পুরুষ মানুষ নয়, এ নারী।  রাকিবকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অমিত খানিকটা লজ্জা পেলো। সে রাকিবকে ডিঙিয়ে আয়নার কাছে চলে যায়। চুলগুলো কপালের কাছ থেকে নিয়ে পিছনে সরাল।

রাকিব ইতস্তত করে বলল, রাতে কি খাবে?

হাতপা’য়ে লোশন লাগাতে লাগাতে অমিত বলল, ক্ষুধা নেই। কিছু খাবো না।

অমিত শার্টটা হাতে নিয়ে বলল, আমি কি বিয়ে বাড়িতে বেড়াতে যাবো রাকিব?

-তা হবে কেন!

-না, যে শার্ট দিয়েছ সেটা তো বাইরে পড়ে যাওয়ার। আমাকে একটা সুতি টিশার্ট আর একটা শর্টস দাও।

আলমারি থেকে বেশ কয়েকটা বের করলো রাকিব। অমিত চিন্তিতমুখে একেকটা পর্যবেক্ষণ করে দেখতে লাগলো। অনেকক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করে একটা কালো রঙের হাতকাটা গেঞ্জি এবং নীল রঙের শর্টস নিলো। রাকিব বোকার মতো তাকিয়ে আছে অমিতের দিকে। আচ্ছা, প্রিয়মানুষকে নগ্ন শরীরে দেখলে অস্বস্থিকর লাগে কেন? তখন কি ভালোবাসা উপচে উঠে না ভিতরে লুকায়িত যৌন কামনা তীব্রভাবে জ্বলে উঠে? অমিতকে আপাদমস্তক দেখে নিলো রাকিব। কাঁধের ডানপাশে একটা তিল দেখা যাচ্ছে। মুখ অপেক্ষা শরীর বেশি শুভ্র। সারা শরীরে বিন্দু বিন্দু জল। অমিত রাকিবের দিকে তাকিয়ে বলল, বাইরে যাও তো।

-কাপড় বদলাবো।

রাকিব মুচকি হেসে বলল, সামনেই বদলাও।

অমিত জোরে হাসতে শুরু করলো। তোয়ালের ভিতর দিয়ে কায়দা করে শর্টস পরে, তোয়ালে রাকিবের দিকে ছুড়ে মেরে বলল, জনাব। সবুরে মেওয়া ফলে। বুঝলেন?

রাকিব উঠে জানালার গ্লাস লাগাল। পর্দা টেনে এসি ছেড়ে দিলো। অমিতের ততোক্ষণে জামা-কাপড় পরা পর্ব শেষ হয়ে গিয়েছে। রাকিব বলল, ঠাণ্ডা হও। আমি আসছি।

অমিত অবাককন্ঠে বলল, কোথায় যাচ্ছ?

রাকিব স্বাভাবিককণ্ঠে বলল, এইতো বনানী ১১তে যাবো। কফি খেতে ইচ্ছে করছে।

-বাসায় খাও।

-নাহ।

-রাত ১টা বাজে রাকিব!

রাকিব মাথার চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল, আমি রাত-দিন বুঝি না। ইচ্ছা হলেই ছুটে যাই কফি খেতে।

বিছানা ঠিক করতে করতে অমিত বলল, আজকে যেয়েও না।

-নাহ, তুমি আরাম করো। আজকের দিনটা তোমার ভালো কাটেনি। রেস্ট দরকার।

অমিত লাইট বন্ধ করে, সাইড ল্যাম্প জ্বালাল। হালকা হলুদ আলোয় সারা রুমে একপ্রকার রহস্যতা তৈরি হল। অমিত ড্রেসিংটেবিলের কাছে গেলো। রাকিব আয়না থেকে মুখ ঘুরিয়ে অমিতের দিকে তাকাল। অমিত রাকিবের হাতটা শক্ত করে বলল, বিছানায় চল।

রাকিবের শরীরের উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পেলো। অনেক পুরুষের সাথে শুয়েছে সে, কিন্তু আজ অন্যরকম লাগছে। ৭বছর যার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে সে নিজেই আজ ধরা দিচ্ছে?

রাকিবকে টেনে বিছানায় নিয়ে আসলো অমিত। দুজন শুয়ে দুজনের দিকে তাকাল। অমিত করুণ চোখে রাকিবকে বলল, আমার বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে না রাকিব।

-কেন?

-এই যে, এতো ঝামেলা। এতো যন্ত্রণা। চারপাশের পরিস্থিতি আমাকে অসুস্থ করে দিচ্ছে।

রাকিব অমিতের চুলগুলো সুন্দর করে হাতাতে লাগলো। কপালে হালকা স্পর্শ করলো। অমিত হেসে উঠল। রাকিব বলল, হাসছ কেন?

-আমি একটা কথা শুনেছি তোমার ব্যাপারে।

-কি?

-তুমি কি আমাকে পছন্দ করো রাকিব?

রাকিব শক্তকণ্ঠে বলল, হ্যাঁ।

অমিত মুচকি হেসে বলল, ভণিতা অনেক করতে পারো তুমি। হা হা হা!

রাকিব অমিতের চিবুক ধরে বলল, তাই?

অমিত রাকিবের আরও কাছে চলে এলো। রাকিব অমিতকে শক্ত করে জাপটে ধরল। অমিতের সারা শরীর শিহরণ দিয়ে উঠল। প্রায় ৫বছর পর প্রান্তিক বাদে অন্য একজন পুরুষের সাথে সে আজ মিলিত হচ্ছে। রাকিবের সাথে প্রান্তিকের অনেক মিল পাচ্ছে। প্রথম প্রথম প্রান্তিক এভাবেই দারুণ উত্তেজনায় ছটফট করতো।

আচ্ছা, সব পুরুষ মানুষ কি একই রকম? হ্যাঁ। হয়তো! সে নিজেও সেরকম। তারা সবাই হয়তো একই রকম। কাম উত্তেজনায়। সবাই পশু, সবাই দেবতা।

দুই পুরুষের দেহ ঘামে ভিজে উঠেছে।

২০…

প্রান্তিক বিছানায় আধাশোয়া অবস্থায় সিগারট ফুঁকছে। পাশে শুয়ে আছে প্রতাপ। গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। প্রান্তিকের গা খালি। বুকের ডানপাশে খানিকটা ঘাম জমে আছে। রুমের বাতি নিভানো। আয়েশ করে সিগারেটে মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে। তার মস্তিষ্ক ব্যস্ত। একটা বিষয় নিয়ে খুব ভাবছে সে। প্রতাপের স্বভাব চরিত্র একদম ভালো ঠেকছে না তার কাছে। সারাক্ষণ হুজুর হুজুর করে মাথা নত করে থাকে। উঠতে বসলে উঠবে, বসতে বললে বসবে। কথায় আছে ‘অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ’। অবশ্য এতে বেশ ক্ষ্যাপা না সে। অমিতের সাথে তার বনিবনা না হওয়ার পিছনে একটাই কারণ ছিল, অমিত নাছোড়বান্দা। ত্যাড়া। ঘারত্যাড়া। প্রান্তিকের সব কথাতেই তর্ক করবে। মোটেও ভালো লাগত না তার। বয়সে তার চেয়ে কতো ছোট! তাও ছেলের এতো দেমাগ! একদিন তর্কাতর্কি চলতে চলতে গালে সজোরে চড় বসিয়ে দিয়েছিল প্রান্তিক। অমিত চড় হজম না করতে পেরে প্রান্তিকের বেশ কয়েকটা শার্ট ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেছিল। ওসব ভাবতেই প্রান্তিকের গা ছমছমিয়ে উঠল। যাইহোক, সংসারে ঝগড়াঝাঁটি হয়। স্বাভাবিক। ছাড়াছাড়ি হওয়াটা কি এতই জরুরী ছিল তাদের? ৩বছর এক সাথে থাকতে থাকতে অভ্যাস হয়ে গিয়েছে, কথায় কথায় অমিত চলে আসে। আত্মা নয়, পুরো শরীরটার সাথে অমিত জুড়ে গিয়েছিল। তাদের শেষ সহবাসের কথা মনে পড়ল। মারামারি ঝগড়াঝাঁটি করে দুজন দুপাশে শুয়ে ছিল। প্রান্তিকের কান্না পাচ্ছিলো অমিতকে আঘাত করার কারণে। সে থাকতে না পেরে জাপটে ধরল অমিতকে। কোন প্রতিবাদ করলো না অমিত, বুকের ভিতর ঢুকে হাঁপাতে লাগলো।

আচ্ছা, সে ঘুরে ফিরে প্রতাপের সাথে সেক্স করছে কেন? ৩বছর ধরে তাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। কিন্তু বিছানায় দুজনই ভালোভাবে উপভোগ করে। অমিতের সাথে প্রান্তিকের বিছানার সম্পর্ক বেশ বাজে। অনেক রাত মতের অমিল হওয়া কারণে কিছুই হয়নি। দু’জন দু’দিকে গোমড়া করে রাত কাটাত। আর এদিকে প্রতাপের সাথে প্রান্তিক ঘন্টার পর ঘন্টা কাটায় কিন্তু মনে হয় এইতো মাত্র শুরু হল।

প্রান্তিক বিছানা ছেড়ে বারান্দায় আসলো। চারদিক স্তব্ধ। কিছু দালানকোঠায় হালকা আলোর বাল্ব জ্বলছে। বারান্দায় এক কোণে কাঠগোলাপ গাছ। পানি না পেয়ে শুকিয়ে আছে। অমিতের লাগানো। পুরো বাড়িটি অমিতের সাজানো। তার কর্ম আছে, কিন্তু সে নেই। মাঝেমধ্যে তার জন্যে হাহাকার করে বুকটা। মাঝেমধ্যে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য মন তাগিদ দেয়। প্রচণ্ড জেদি অমিত। হয়তো এখন তাকে দেখলে হিংস্র পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে। খাবলিয়ে খাবলিয়ে মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে তচনচ করবে। প্রান্তিক প্রতাপের দিকে তাকাল। ২১বছরের যুবকটি দেখতে সুন্দর হলেও কিছু যেন একটা নেই এমন লাগছে। কি নেই? ভালোবাসা? মিলনের সময় যতক্ষণ যৌন আক্রশ থাকে ততোক্ষণ দুনিয়ার সবকিছু ভুলে যেয়ে এক অজানা শক্তির জোরে সারা শরীর কার্যক্রম করে যায়। তারপর…? শেষে, দুনিয়াতেই ফিরে আসতে হয়। বাস্তবতাগুলো গাঢ় ভাবে দেখা দেয়।

আকাশ আস্তে আস্তে পরিষ্কার হচ্ছে। কাক ডাকা শুরু হয়েছে। হালকা ঠাণ্ডা বাতাস বইছে।

অমিত গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে বারান্দায় সকাল হওয়া দেখছে। ঠোঁটটা খানিকটা ব্যথা করছে। রাতে যা ঘটনা ঘটেছে সেটা অমিত হজম করতে পারছে না। রাকিবের সাথে যৌন মিলন? কিভাবে পারলো অমিত? এক বছর যাবত শারীরিক চাহিদা মিটাতে পারেনি বলে, আজ এমনিভাবে তাকে মেটাতে হল? রাকিবের সাথে সে আর কখনও কথা বলতে পারবে? যে ছেলে প্রান্তিককে এখনও ভালোবাসে বলে দাবি করে, নিজেকে সৎ দাবি করে সে কিনা  শারীরিক চাহিদা মেটানোর জন্য অন্যের কাছে দ্বারস্থ হতে হল? মানসিক চাহিদা কি শারীরিকের চেয়ে অধিক বড়? অমিত বুঝে উঠতে পারছে না। কিন্তু অমিত অস্বীকারও করতে পারছে না, সেই রাত ছিল স্বর্গীয় রাত। স্মরণীয় রাত। সুখের অনেক প্রকার হতে পারে, কিন্তু সুখের সংজ্ঞা সে রাতে টের পেয়েছে।

অমিতের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করছে। শুধুমাত্র তার শারীরিক চাহিদার জন্য রাকিবের ভালোবাসা ব্যবহার করেছে? ছিঃ!

অমিত রুমে ঢুকে চাদর ফেলে দিল। রাকিব নগ্ন অবস্থায় বিছানায় শুয়ে আছে। চাদর উঠিয়ে রাকিবের গায়ে জড়িয়ে দিলো অমিত। মনে মনে বিড়বিড় করে বলল, আমি তোমাকে ভালোবাসি না রাকিব। কিন্তু আমি তোমাকে শ্রদ্ধা করি, তোমাকে পছন্দ করি। প্রতারণার জন্য মাফ করে দিও।

দ্রুত কাপড় পরে খুব আস্তে দরজা খুলল অমিত। ৫:৩০ বাজে। বাসার কাজের বুয়া ঘুম থেকে উঠেছে। সদর দরজা খোলা। সম্ভবত বাইরে ঝাড়ু দেওয়া চলছে। অমিত বাতাসের বেগে বের হয়ে গেলো।

সুনসান রাস্তা। রিকশা নেই।

দৃপ্ত পায়ে চলছে অমিত।

বাতাস বইছে। পাখির ডাকে চারদিক মুখরিত।

রাকিব বারান্দায় দাড়িয়ে অমিতকে যেতে দেখল। রেলিং ধরে বিষাদ চোখে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল।   

প্রান্তিক সিগারেট ফুঁকেই যাচ্ছে।

২১…

আয়নার সামনে দাড়িয়ে আছে অমিত। আয়নটা বেশি বড়ও নয়, ছোটও নয়। মাঝারী। অমিত আয়নার সামনে সোজা বরাবর দাঁড়ালে তার মুখ থেকে কোমর পর্যন্ত দেখা যায়। কিছুটা দূরে দাঁড়ালে তলপেটও দেখা যায়। অমিত তার কোমর পর্যন্ত আয়নায় দেখতে অভ্যস্ত। কিন্তু আজ বেশ দূর থেকেই বিছানায় বসে আয়নায় নিজেকে দেখছে। কুঁজো হয়ে বসে আছে। অমিত লক্ষ্য করলো তাকে চিকন লাগছে। মেরুদণ্ডের জয়েন্টগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। হাত দিয়ে বুলিয়ে বুলিয়ে সে তার শরীরে শিহরণ জাগিয়ে দিল। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। সবগুলো চুল একদিকে করে মাথা বাঁকিয়ে দাঁতগুলো সব বের করে হাসতে লাগলো। তাকে দেখতে পিশাচ লাগছে। তাহলে এটাই কি আসল রূপ? ফিক করে হেসে ফেলল অমিত। আজ কেমন জানি মাতাল মাতাল লাগছে নিজেকে। রাকিবের বাসা থেকে আসার পর থেকেই হঠাৎ নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। ডান কোমরে বিশাল কামড়ের দাগ। দাগটার মাঝখানটা লাল এবং চারপাশে কালো হয়ে আছে। হাত দিয়ে চমকে উঠল। ব্যথা লাগছে। অন্যরকম ব্যথা। দুঃখের নয়, সুখেরও নয়। তাহলে কিসের? অমিত দাঁত বের করে হাসতে লাগলো।

অমিতের বিছানার বামদিকে একটা সাইড টেবিল আছে। টেবিলে একটা ল্যাম্প আছে। কিছু ছবি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আর আছে কিছু সাদা রঙের সাদা ট্যাবলেট। এলোমেলোভাবে ছড়ানো। ট্যাবলেটগুলো আকারে বেশ ছোট। পুরোপুরি সাদাও নয়, হালকা হলুদ ছাপ বিদ্যমান। অমিত উঠে দাঁড়ালো। তার নগ্ন শুভ্র শরীরটা উত্তেজিত হয়ে আছে। পড়ার টেবিলে রাখা ‘ফ্রুটিকা’ জুসের বোতলটা হাতে নিলো। বেশ কিছুক্ষণ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে বোতলের মুখ খুলল। নাক দিয়ে গন্ধ শুঁকল। বোতলটা নিয়ে কম্পিউটারের সামনে বসলো। অমিত একটি বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। সে নিজের আত্মাকে মুক্তি দিবে। কিভাবে? আত্মহত্যা করে। সারা জীবন যে ছেলে আত্মহত্যাকে গভীরভাবে ঘৃণা করতো সেই ছেলে আজ এই পথকে তার সমস্যার সমাধান হিসেবে সমুচিন মনে করছে। রাস্তা দিয়ে আসার সময় প্রত্যেক ঔষধের দোকান থেকে ১০টি করে মাথা ধরার ওষুধ কিনেছে সে। ৬-৭টা দোকান ঘুরে ৬০টি ওষুধ জোগাড় করতে পেরেছে। একেকটা ১০গ্রাম করে। মনের মধ্যে খুঁতখুঁত লাগছে। কাজ করবে তো? যদি না করে তাহলে তো খুব অপমানের ব্যাপার হবে! যে ছেলে শক্তিমান ছেলে হিসেবে গলা চরিয়ে বেড়াতো সে আত্মহত্যা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে, মানুষজন তো শুনলে হাসতে হাসতে মরে যাবে!

অমিত কম্পিউটার টেবিলে রাখা কার্ডটা হাতিয়ে দেখছে। সুজনের বিয়ের কার্ড। গত পরশু হাতে এসেছে। অনেকবার বলছিল সুজন যেন বিয়েতে মিত যায়। অমিত চিন্তিত। সে কি যাবে? তার মন বলছে, অবশ্যই যাওয়া উচিত। প্রান্তিককে অন্তত শেষ বারের মতো দেখে আসা উচিত। রাকিবের কাছেও মাফ চাওয়া উচিত। কার্ডটি বেশ সুন্দর। লাল আর সাদা মিশ্রনের। সোনালি অক্ষরে লেখা। অমিত জায়গার নাম দেখে চমকিত হল। প্রান্তিকের বারিধারার ফ্ল্যাটে বিয়ে হচ্ছে। চোখমুখ শক্ত করে ফেলল অমিত। উঠে দাড়িয়ে হেঁটে গিয়ে ট্যাবলেটগুলো হাতে নিলো। তার মস্তিষ্ক চিন্তিত। খাবে কি, খাবে না এই দ্বিধায় ভুগছে। চট করে মনে পড়ল তার মোবাইলট থেকে সব তথ্য মুছা হয়নি। সে দ্রুত মোবাইলটা তুলে তথ্য মুছার জন্য অপশন খুঁজতে লাগলো। হঠাৎ চোখে পড়ে গেলো তার আর প্রান্তিকের ছবিখানা। অমিতের চোখ অশ্রুতে ভিজে উঠল। নাহ, সে শেষ বারের মতো প্রান্তিককে দেখতে চায়। প্রিয়মানুষের মুখ দেখে মৃত্যু, স্বর্গ! অন্যমনস্ক হয়ে মোবাইল টিপতে টিপতে ই-মেইল চেক করা শুরু করলো অমিত। নিচে নামতে নামতে চোখ আটকে যায় একটি মেইল দেখে। মোবাইলটা রেখে দ্রুত কম্পিউটারে ইন্টারনেট ব্রাউজ শুরু করে। মেইল খুলল। অস্ট্রেলিয়ার ‘ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি’ অমিতের লেটার এক্সসেপ্ট করেছে। স্কলারশিপও হয়েছে। হতবাক হয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে অমিত। অবাক কাণ্ড! সে আজ থেকে ৫মাস আগে আবেদন করেছিল। নিশ্চিত ছিল, হবে না! কিন্তু! আয়হায়! সারা জীবনের স্বপ্ন ছিল, বাইরে যেয়ে পড়ালেখা শেষ করে কিছু একটা হবে সে। কিছু একটা বলতে, সবার চেয়ে অনেক ভিন্ন।

মেইল এসেছে গতকাল। আগামী দুইদিনের মধ্যে রিপ্লাই দিতে হবে। অমিত চেয়ারে বসে পা নাচাচ্ছে। একবার ওষুধের দিকে তাকাচ্ছে, আরেকবার মেইলের দিকে। কেন সবসময় তাকে হতাশায় সাঁতার কাটতে হয়?

অমিত ওষুধগুলো একটা পলিথিন ব্যাগে ভরে ড্রয়ারে রেখে তালা দিলো। মনে মনে ভাবছে, সুজনের বিয়েতে সে সবার সাথে দেখা করে বিদায় নিবে।

কিন্তু কিসের বিদায়?

দুনিয়া থেকে নিজের অস্তিত্ব মুছবার জন্য না বিদেশে পড়ালেখার করার জন্য ?

অমিত স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। মাউসের তীর চিহ্ন রিপ্লাই বোতামে রাখা। টিপ দিতেও ইচ্ছে করছে না, আবার না দিলেও সমস্যা আছে। অমিত বাকরুদ্ধ।

২২…

সানাইয়ের শব্দে পুরো বাড়ি গমগম করছে। অল্প শব্দে সানাই বাজচ্ছে কিন্তু কানে চট করে লাগছে। প্রান্তিক ঘুরে ঘুরে সারা ফ্ল্যাট দেখছে। ড্রয়িং রুমে ফার্নিচার সরিয়ে ষ্টেজ করা হয়েছে। হলুদ-লাল সংমিশ্রণে সারা বাড়ি সাজানো হয়েছে। গোলাপ ফুলে সারা বাড়ি সৌন্দর্যে ঝলমল করছে। প্রান্তিকের নিজের বিয়ের কথা মনে পড়ে গেলো। মাত্র গুণে গুণে ১০জনকে ডেকেছিল বাসায়। খুব ঘরোয়া অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে কাজ শেষ হয়েছিল। অমিতের আক্ষেপ ছিল, কিন্তু বয়সে ছোট ছিল বলে প্রান্তিক ঢাকঢোল পিটিয়ে বলার সাহস পাইনি। হলুদের কাজকর্ম চুকে এখন বিয়ের প্রস্তুতি চলছে। মেহমান আসা শুরু করেছে। দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে প্রতাপ। সে অতি আনন্দে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু, কারোর পাত্তা পাচ্ছে না তেমন। অন্যান্য সকল মানুষ অমিতকে খুবই মিস করছে। হয়তো পিছনে পিছনে অমিতের নামে অনেক কথা বলে তারা কিন্তু সামনাসামনি সবাই খুব আদর করে তাকে। পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখার ক্ষমতা আছে অমিতের। টুকটুক করে কথা বলবে, বাচ্চামো করবে এতেই সবার মন খুশি হয়ে যায়। অমিতকে আজ সবচে বেশি মনে করছে, প্রান্তিক। অমিত থাকলে কাজের তদারকি মহা আনন্দে করতে পারত। অনুষ্ঠানের প্রতি ওর অনেক আগ্রহ।

প্রতাপ প্রান্তিকের হাত ধরে বলল, দেখেছ ফ্ল্যাটটা কি সুন্দর লাগছে!

প্রান্তিক বলল, হুম।

প্রতাপ নরম স্বরে বলল, তোমার তো বিয়ে হচ্ছে না। কোন সমস্যা নেই এখন। আমরা একসাথে এখানে থাকতে পারি।

প্রান্তিক শান্ত গলায় বলল, উহু। না। আমরা শুধু বন্ধু, অন্য কিছু না। সেটা আমি তোমাকে আগেই বলেছি।

প্রতাপ মুখ শক্ত করে বলল, বোলো ফাক-মেইট।

প্রান্তিক অবাক চোখে প্রতাপের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রতাপের মুখ শক্ত। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। প্রান্তিক বলল, যাও গেটে দাড়াও।

প্রতাপ চলে গেলো। প্রান্তিক দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ল।

অবশেষে সুজন ও শুভ্র’র বিবাহ পর্ব শেষ হল। দু’জন আজীবন একসাথে থাকবে এক সাক্ষ্য দিয়ে আংটি পরিয়ে নিজেদের বরণ করে নিলো।

রাকিব টইটই করে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে আজ স্যুট পরেছে। যেহেতু আঁটসাঁট শরীর সেহেতু সবার চোখে এখন সে খাদ্যবস্তু। নতুন অনেকেই এসেছে, তারা শুধু একবার রাকিবের স্পর্শ পাওয়ার জন্য নানা টালবাহানা করছে। রাকিবের মন আনচান আনচান করছে। অমিত কি আসবে আজ?

রাকিব যখন তন্নতন্ন করে অমিতকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, তখন প্রান্তিকও ভিড়ের মধ্যে অমিতের চেহারা খুঁজছে। আজ হঠাৎ অমিতের জন্য মনটা খুব কাঁদছে।

দু’জন মাতালের মতো অমিতের খুঁজছে আর অমিত নিজে দরজার সামনে প্রায় ১০মিনিট দাড়িয়ে ভাবছে ভিতরে ঢুকবে কি ঢুকবে না। কান্নায় ভেঙ্গে পড়বে এমন ভাব হচ্ছে তার। ৩বছর সংসার করেছে সে এখানে, টান অন্যরকম থাকবে অস্বাভাবিকের কিছুই নয়। সুজন হাঁটাহাঁটি করতে করতে দরজার বাইরে অমিতকে দেখল। সে দেখে চিৎকার দিয়ে বলল, তুই এসেছিস!

অমিত কালো রঙের ভেলভেটের একটা শেরওয়ানী পরেছে। খুব সুন্দর লাগছে। এক দিকে চুলগুলো সিঁথি করা, মুখ চকচক করছে। হাত ধরে টেনে সুজন ড্রয়িং রুমে নিয়ে এলো অমিতকে। লজ্জায় অমিতের মাথা নত হয়ে গেলো। সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ার পর এই প্রথম এতো বড় গ্যাডারিং এ এসেছে সে। অমিতকে দেখে আশেপাশের মানুষ বেশ অবাক হল। তাও, একে একে এসে অমিতের সাথে কথা বলল। অমিত মুখ টিপে হাসি দিয়ে সবাইকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করলো। ড্রয়িং রুমে হৈহুল্লোড় শুনে দ্রুত ছুটে গেলো প্রান্তিক।  অমিতকে নিয়ে সবাই মেতে আছে। একে একে খোঁচা মেরে উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে জিজ্ঞেস করছে, কেমন আছে সে। কিভাবে দিন কাটছে। প্রান্তিক অমিতের দিকে এগিয়ে গেলো। প্রান্তিককে দেখে সাথে সাথে অমিত জরিয়ে ধরল তাকে। এ দৃশ্য দেখে সবাই অবাক। কি হচ্ছে! সার্কাস নয়তো? না, পুরনো প্রেমিকদের মিলনগাঁথা?

অমিত প্রান্তিককে ছেড়ে দিয়ে বলল, আছো কেমন?

প্রান্তিক চুপ। একটা কথাও বলল না। প্রতাপ চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখছে।

রাকিবের প্রবেশ ঘটলো ঘরে। অমিতকে দেখে সে ফিট হয়ে যাবে এমন-অবস্থা। কি ব্যাপার, অমিত আর প্রান্তিক একসাথে? কোন কাহিনি হচ্ছে নাকি?

অমিত মুচকি হেসে বলল, যাইহোক। যা হয়েছে ভুলে গিয়ে সামনে আগানো উচিত। তাই না? সম্পর্কে চড়াই-উৎরাই থাকবে স্বাভাবিক।

প্রান্তিক বিড়বিড় করে বলল, আমি তোমাকে অনেক মিস করি অমিত।

অমিত ঠাণ্ডা গলায় বলল, আমিও করি তোমাকে।

প্রান্তিক অমিতের হাত ধরল।

অমিত একটু জোরে বলল, সম্পর্ককে জটিল করলে কি হয় জানো? জটিলতা বাড়ে। আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। মানুষের মন পরিবর্তনশীল, আমি জানি।

প্রান্তিক বলল, তাহলে কি আমরা…

অমিত মুখ ভেটকিয়ে বলল, ভুলেও সে কথা উচ্চারণ করো না প্রান্তিক। আমি চাই তুমি যার সাথেই থাকো সুখে থাকো। আর, শুনো!

-বোলো?

-আমার জন্য দু’য়া করো। আগামী মাসে আমি অস্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছি। আর হয়তো দেখা না হতেও পারে, আবার হয়তো নিয়তির জোরে দেখা হতে পারে।

প্রান্তিক চোখ বড় বড় করে বলল, সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে যাবে? আমাকে অন্তত একবার সুযোগ দাও!

অমিত প্রান্তিকের কাঁধে হাত রেখে বলল, সম্পর্ক ছাড়া কি দুনিয়াতে আর কাজ নেই? হাহাহাহা! সুখে থাকো!

অমিত হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসলো। সবার মুখে অন্যরকম আনন্দ, বেদনা কাজ করছে। দুটোর মিশ্রনে অনুভূতি অন্য রঙ ধারণ করেছে।

রাকিবকে দেখে অমিত বলল, চল রাকিব। বাইরে হেঁটে আসি। যাবে?

রাকিব অমিতকে অনুসরণ করে রাস্তায় এলো।

আকাশের দিকে তাকাল অমিত। লাল হয়ে আছে। বৃষ্টি নামবে। রাকিব অমিতের পাশে দাড়িয়ে বলল, আমিও কি যেয়ে পারি তোমার সাথে অস্ট্রেলিয়া?

অমিত রাকিবের হাত ধরে বলল, মানুষ প্রেমে এতো পাগল হয় জানতাম না।

-কিন্তু তুমি তো আমার প্রেমকে পাত্তাই দিচ্ছ না!

অমিত হেসে বলল, প্রেম ছাড়া আরও অনেক কিছু আছে জীবনে। আমি আমার কিছু স্বপ্ন পূরণ করতে চাই। প্রেম- সম্পর্ক এগুলো বাধা সৃষ্টি করছে। আমি এসবে আমার জড়াতে চাই না।

রাকিব মুখ মলিন করে বলল, তাহলে?

-আমরা আজীবন বন্ধু হয়ে থাকবো। তোমার মতো বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।

অমিত রাকিবের গালে হালকাভাব চুমু খেলো। রাকিব ঠোঁট টিপে হাসল।

ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। অমিত আর রাকিব আস্তে আস্তে পা ফেলাচ্ছে।

জোরে বাতাস বইছে।

প্রান্তিক বারান্দায় উদাসিন হয়ে দাড়িয়ে আছে।

সুজ-শুভ্র হাত ধরে সোফায় বসে আছে।

প্রতাপ প্রান্তিকের পাশে দাড়িয়ে দেখছে।

ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হল।

অমিত দু’হাত দুদিকে মেলে বৃষ্টিতে ভিজছে।

মনে হচ্ছে সব দুঃখ বৃষ্টির পানিয়ে ধুয়ে যাচ্ছে।

গ্লানির অবসান ঘটছে, অবশেষে।

সমাপ্তি।   

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.