
প্রায় বছর দুয়েক আগের কথা। শীতের এক দুপুরে বিছানায় শুয়ে আছি। ফেসবুকে লগ-ইন করতেই বিবিসি বাংলার একটা নিউজে চোখ আটকে গেলো। বাংলাদেশের প্রথম সমকামী বিষয়ক ম্যাগাজিন রূপবান-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রকাশক জুলহাজ মান্নানের সাক্ষাৎকার। আমি এর আগেও এই ম্যাগাজিনের নাম শুনেছিলাম। তাই আগ্রহটা একটু বেশিই ছিল।
সাক্ষাৎকার পড়ার পর এবার যথারীতি চোখ গেলো ফেসবুকের কমেন্ট বক্সে। হাজারো মানুষের মন্তব্যগুলো পড়তে শুরু করলাম। নো! আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিনা! প্রায় প্রতিটা কমেন্টেই ছিল ঘৃণা, হুমকি, তাচ্ছিল্য, উপহাস, জঘন্য আর অপমানসূচক কথাবার্তা। আমি স্বাভাবিকভাবেই ভয় পেয়ে যাই এসব মন্তব্যগুলো পড়ে। সাথে সাথে ফেসবুকের একটা গ্রুপে নিউজটা শেয়ার করে ভয়ের কথা জানালাম। এর কিছুক্ষণ পরেই দেখি একজন কমেন্ট করেছেন আমার শেয়ার দেয়া পোস্টে। তিনি আর কেউ নন। সেই সাক্ষাৎকারের কেন্দ্রীয় চরিত্র জুলহাজ মান্নান! আমাকে অভয় দিয়ে বলেছিলেন এগুলো খুবই স্বাভাবিক, এসবে ভয় না পেয়োনা। আমার আশেপাশে এমন অভয় দেয়ার মানুষ খুবই কম ছিল। তাই ভাবলাম ওনার সাথে পরিচিত হওয়া যায়। ফেসবুকে ওনার সাথে যোগাযোগ হোল। মাঝে মাঝে কথা হতো। কোনকিছু জানার থাকলে জিজ্ঞেস করতাম।
কিছুদিন পর উনি আমাকে রুপবানের একটা ইভেন্টে অংশগ্রহণের জন্য বললেন। “রুপবান ইয়ুথ লিডারশীপ প্রোগ্রাম ২০১৫”। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম অংশগ্রহণ করবো। এতে ওনার সাথেও দেখাও হবে পাশাপাশি অনেক বন্ধুদের সাথেও পরিচিত হতে পারবো। তাই আমি আর আমার এক বন্ধু দু’জন মিলে ইভেন্টে অংশগ্রহণের জন্য ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আরেক বন্ধু সে ঢাকাতেই ছিল। সেও অংশগ্রহণ করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ঢাকাতে তো আমাদের থাকার কোন জায়গা নেই। হোটেলে থাকলে অনেক টাকা খরচ হবে। জুলহাজ মান্নানকে বিষয়টা বলায় উনি আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দেবেন বলে নিশ্চিত করলেন।
ঢাকায় পৌঁছেই ওনাকে ফোন দিলাম। উনি আমাদেরকে বললেন আমাদের পিক করার জন্য একজন ভদ্রলোক আসবেন। ওই ভদ্রলোকটিই ছিলেন মাহবুব রাব্বি তনয়। খোশগল্প করতে করতে একটু দূর থেকে তনয় একটা সিএনজি ডেকে আমাদের নিয়ে গেলেন জুলহাজ মান্নানের বাসায়। বাসায় এসেই তনয় ফ্লোরে বসে পরলেন আর আমরা সোফায় । আমাদের সাথে আরো কয়েকজন বসে আছে। তারাও রূপবানের এই প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করতে এসেছে। এর একটু পরেই জুলহাজ মান্নান আসলেন। আমি অপরিচিত কাউকে সাধারণত স্যার বলে সম্বোধন করি। ওনার সাথে যদিও এর আগে কথা হয়েছে কিন্তু তারপরও কেন জানি ‘জুলহাজ ভাই’ বলে ডাকতে লজ্জা পাচ্ছিলাম। হ্যালো স্যার বলে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলাম। পাশে থেকে তনয় হেসে হেসে বললেন স্যার বলতে হবেনা, ভাই বলেই সম্বোধন করো। আমি একটু মুচকি হেসে সায় দিলাম।
সবাই মিলে ড্রয়িং রুমে আড্ডা দিচ্ছি। কেউ গান গেয়ে শুনাচ্ছে, কেউ ডান্স পারফর্ম করেছে। ইতোমধ্যেই অনেকগুলো মানুষের সাথে আমার পরিচয় হয়ে গেছে। এর আগে আমি এলজিবিটি কমিউনিটির এত মানুষের সাথে মিশিনি। তাই স্বাভাবিকভাবেই আমার অনেক ভালোলাগা কাজ করছিলো। অনেক আড্ডা হলো এবার ডিনার করার পালা। রাতের খাবারের জন্য সবাই বের হয়ে গেলাম। পাশেই একটা রেস্টুরেন্টে ডিনার সেরে এলাম। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হবে কারণ সকালে উঠেই প্রোগ্রামে এটেন্ড করবো।
দুই দিনের এই অনুষ্ঠানে আমার অনেক মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে। প্রথমদিনের প্রোগ্রাম শেষ করে সবাই চলে গেলাম শাহবাগ বইমেলাতে। সেখানে রূপবানের কবিতার বই রুপংক্তি’র মোড়ক উন্মোচন হবে। আমি শুদ্ধস্বর স্টল থেকে রুপংক্তি’র একটা বই কিনে নিলাম। দ্বিতীয় দিনের প্রোগ্রাম শেষে সার্টিফিকেট গিভিং সিরিমনিতে অংশগ্রহনের জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে প্রোগ্রামের সমাপ্তি ঘোষনা করেন জুলহাজ মান্নান। তারপর ফেসবুকেই মুলত জুলহাজ মান্নান, তনয় মাহবুবসহ অন্য সবার সাথে যোগাযোগ হতো। আমি নির্ভয়ে জুলহাজ ভাইয়ের সাথে আমার বিভিন্ন বিষয় শেয়ার করতাম। উনি আমার কথাগুলো শুনতেন আর উৎসাহ দিতেন।
এর কয়েকমাস পরেই জুলহাজ ভাই, তনয় মাহবুব ও আরো অনেকেই আমাদের ক্যাম্পাস ঘুরতে আসেন। ফেসবুকে আমাদের জানিয়ে দিলেন যে তারা আসছেন। তাদের নিয়ে ক্যাম্পাসে আমরা কয়েকজন বন্ধু আড্ডা দিলাম, ক্যাম্পাসের আড্ডা শেষে ওনারা যে হোটেলে উঠেছেন সেখানে আমরা গেলাম। সেখানে রুপংক্তি পাঠের আসর বসানো হয়। সবাই একটা করে কবিতা পাঠ করি, গান গাই আর ফাজলামি করি। পানসি রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেয়ে আমরা তাদের বিদায় দিয়ে চলে এসেছিলাম। কিন্তু এটাই যে জুলহাজ ভাই ও তনয় ভাইয়ের সাথে আমাদের শেষ দেখা হবে সেটা কখনও ভাবিনি।
২০১৬ সালের রেইনবো র্যালিতে যাবো বলে আমরা বন্ধুরা মিলে প্ল্যান করি। কিন্তু শেষে শুনি কিছু উগ্র মৌলবাদীদের হুমকির মুখে র্যালীর পরিকল্পনা বাতিল করা হয়েছে। মনটা তখন ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। আমরা আমাদের উদ্বেগের কথা জুলহাজ ভাইকে জানাই এবং তাকে ও তার সহকর্মী বন্ধুদের নিরাপদ থাকার পরামর্শ দেই। এর কিছুদিন পর ২৫শে এপ্রিল সন্ধ্যায় আমি আর আমার বন্ধু ক্যাম্পাসে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ করে আমার বন্ধু বলে উঠলোঃ আমাদের সব শেষ! সবকিছু শেষ হয়ে গেছে! আমি উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম কি হয়েছে? এমন করছিস কেন? ও বলল জুলহাজ ভাই আর তনয় ভাই আর নেই! এটা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না আসলেই কি ও সত্যি বলছে না মিথ্যা। তখন কি করবো বুঝতে পারছিলাম না।
এখন আমাদের আর আগের মত আড্ডা দেওয়া হয়না। কারণ যখনই আমরা একসাথে হতাম ওদের স্মৃতি মনে পড়তো। কিন্তু এটাই যে সত্যি, জুলহাজ ভাই আর তনয় ভাই নেই। তখন নিজেরা নিজেদের সান্ত্বনা দিতাম। নিজের আপন জনের কাছে আমি আমার যে কথাগুলো বলতে পারতাম না সেটা ওদের কাছে বলতাম। তাই অল্প কিছুদিনের পরিচয়েই আমি তাদেরকে আপন করে নিয়েছিলাম। জুলহাজ ভাই ও তনয় ভাই, আমি তোমাদের কাছে কৃতজ্ঞ, যেখানেই থাকো আমার ভালোবাসা নিয়ো।
প্রথম প্রকাশ ধী ব্লগ, একটি বয়েজ অফ বাংলাদেশ-এর উদ্যোগ। কপিরাইটঃ বয়েজ অফ বাংলাদেশ। অনুমতি ছাড়া পুনঃপ্রকাশ করা যাবে না।