
সময়টা ২০০৭। প্রায় নয় বছর। কিন্তু এখনো দিন গুলো খুব কাছের মনে হয়। মনের ক্যানভাসে আঁকা রঙিন স্মৃতি গুলো এত দিনেও ফ্যাকাসে হয়ে যায় নাই। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় সেই মানুষটা এখন আর নেই। মনে হয় এই তো সেই মানুষ টা কে এখন ফোন করলেই তার কণ্ঠ শোনা যাবে।কোন পার্টি ,পিকনিক অথবা ট্যুরের কথা বলবে। যাওয়ার জন্য জোরাজুরি করবে। আমি অনেক দুর্ভাগা কারন বহুবার তিনি আমাকে তার সাথে ট্যুরে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু আমি যাই নাই। এক অজানা অভিমানে আমি দূরে সরে গিয়েছিলাম। গুটিয়ে নিয়েছিলাম আমাকে তার কাছ থেকে। তখনো জুলহাজ ভাই সেলেব্রিটি হন নাই। কিন্তু তাই বলে তিনি পরিচিত ছিলেন না তা নয়। আমার সাথে তার পরিচয় হয়েছিল এক ডিসেম্বরে। মনে আছে একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার প্রোফাইল দেখে আমিই নক করেছিলাম। আমি তখন এই কমিউনিটি তে নতুন। সম্ভবত তার আইডি টি ছিল ব্লপ্রিন্স।কিন্তু অদ্ভুদ ছবি আপলোড করে তিনি চলে গিয়েছিলেন কলকাতা।এই ছবি দেখেই তার দরজায় কড়া নেমেছিলেম আমি।বন্ধুত্বের আহবান জানিয়েছিলাম। তিনি কলকাতা থেকে ফিরে এসে আমার মেসেজের উত্তর দিলেন। ইয়াহু আইডি এক্সচেঞ্জ করলাম। প্রচুর চ্যাট হত। কারন তখন আমি ফ্রি থাকতাম। আর জুলহাজ ভাইয়া তখন ফ্রি ল্যান্সর হিসেবে কাজ করতেন। সাধারণত রাতে চ্যাট হত।শীতের রাতে চাঁদর পেঁচিয়ে ডেস্ক টপে বসে চ্যাট করতাম।ভুলবো না সেই রাত গুলোর কথা।নানা বিষয় নিয়ে চ্যাট হত। ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে ফ্যাশন, প্রকৃতি প্রেম।যতই দিন যেতে লাগলো জুলহাজ ভাইয়া আমার পছন্দের মানুষ হয়ে উঠলেন। জানি না আমি তার কতটুকু পছন্দের মানুষ হয়েছিলেম।তখনো আমার তার সাথে দেখা হয় নাই।এই সময় মজার একটা ঘটনা ঘটেছিল। জুলহাজ ভাইয়া সন্দেহ করছিলেন আমি তার পরিচিত একজন বন্ধু ।তাকে বোকা বানানোর জন্য ফেক আইডি দিয়ে চ্যাট করছি। পরে আমার বেশ কয়েকটা ছবি দেয়ার পর তিনি বিশ্বাস করলেন। একদিন জানলাম জুলহাজ ভাইয়া আমেরিকান দূতাবাসে চাকুরী পেয়েছেন।সেই উপলক্ষে তিনি একটা পার্টি দিলেন সান্টুর রেস্টুরেন্টে। আমাকেও দাওয়াত দিলেন। আমি এর আগে কক্ষনোই কোন পার্টি তে যাই নাই। এতজন নতুন মানুষের সাথে আমার দেখা হবে। সর্বোপরি জুলহাজ ভাইয়ের সাথে দেখা হবে। এতদিনের অপেক্ষা আমার। দুরু দুরু বুকে পার্টি তে উপস্থিত হলাম। যা ভাবতাম জুলহাজ ভাইয়া কে। তিনি সামনাসামনি ঠিক তেমনি। হাসি খুশি, প্রাণ চঞ্চল ।আমার এখনো মনে আছে জুলহাজ ভাই একটি চমৎকার একটি ফুলহাতা সিল্ক এর শার্ট পরেছিলেন।চুল লম্বা। সর্বদা হাসি মুখ। এই তো একজনের সাথে নাচছেন তো। আবার ধরে নিয়ে আসলেন আরেকজন কে ড্যান্স ফ্লোরে নাচার জন্য। আমাকেও দুই একবার চেষ্টা করলেন নাচানোর জন্য। কিন্তু আমি খুবই লাজুক ছিলাম তখন। তার উপর কাউকেই চিনি না। তার এই উৎসাহ পুরাই বিফলে গেলো। আমি নাচলাম না। কিন্তু ভাল লাগার এক অনুভূতি নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। দ্বিতীয় বার দেখা হল পরেরদিনই টি এস সি তে।জুলহাজ ভাই ছিলেন সারকাসম এর রাজা। কেউ তার সারকাসম থেকে রক্ষা পেতো না। আমিও না। ধীরে ধীরে জুলহাজ ভাইয়ের ফ্রেন্ড সার্কেলে পরিচিত হয়ে উঠলাম।জুলহাজ ভাইয়ার সাথে যাই বিভিন্ন আড্ডা , পার্টি তে। জুলহাজ ভাই আমার খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠলেন। একদিন ধানমন্ডি লেকে বসে জুলহাজ ভাই আমাকে বললেন তার স্কুল জীবন , কলেজ জীবন আর ভার্সিটি জীবনের কথা। আমি খুব আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছিলাম সেদিন। আমি নিজেকে খুলে দিয়েছিলাম খোলা বইয়ের মত। বলেছিলাম আমার নিজের জীবনের কথা। জুলহাজ ভাই আসলে এমন মানুষ যাকে ভরসা করে সব কথা বলেছিলাম। জুলহাজ ভাই আমাকে অনেক উপদেশ দিতেন কিভাবে নিজেকে আরও সুন্দর ভাবে প্রেজেন্ট করা যায়।তাকে দেখেই আমি বুঝেছি কিভাবে জীবনটা কে সহজ ভাবে নেয়া যায়। মনে আছে বর্ষার প্রথম দিনে আমরা সবাই বের হয়ে ছিলাম চারুকলায় (জুলহাজ ভাই আর তার বন্ধু সার্কেল)। ইফতার পার্টি , জুলহাজ ভাইয়ার জন্মদিন,ডিজে পার্টি আরও ছোট ছোট আড্ডা তো অনেক রয়েছেই।সবই মনের পর্দায় একে একে আসছে।পরীক্ষার আগের দিনও আমাকে তিনি বাসা থেকে টেনে নামালেন। বললেন ১ ঘণ্টার জন্য কিছু হবে না। বরং মাথা ঠাণ্ডা হবে। এক বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যার কথা মনে পড়ে আমার। বসুন্ধরা সিটি তে আড্ডা দিয়ে বের হলাম জুলহাজ ভাইয়ার সাথে। বাইরে টিপ টিপ বৃষ্টি । রাস্তার উলটা দিকে গ্রিন রোডের মোড় থেকে রিক্সা নিবো। আমাকে নামিয়ে দিয়ে জুলহাজ ভাই শ্যামলি চলে যাবেন। রিক্সা উঠতেই ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টি তো আমার অসম্ভব প্রিয়।কেন জানি লিখতে গিয়ে এই সন্ধ্যার কথা মনে পড়ছে। আমার বাসা পর্যন্ত আসতে আসতে আমরা অনেকখানি ভিজেই গেলাম।পুরো রিক্সা তে গল্প করতে করতে আসলাম।কোন উল্লেখ যোগ্য ঘটনা হয়তো না। কিন্তু কেন জানি তারপরও মনে পড়ছে।তাই লিখলাম। আসলে অনেক সামান্য ঘটনাই কখনো কখনো অসামান্য হয়ে যায়। জুলহাজ ভাইয়ার জীবনে গানের একটা অসামান্য অবদান আছে।জুলহাজ ভাইয়া কে খুব একটা বই পড়ার কথা বলতে শুনতাম না। সিনেমা দেখতে খুব ভালবাসতেন তাও নয়।কিন্তু গান ছিল তার জীবনের প্রাণ। আমি যখন তার সাথে মিশতাম তখন তার প্রিয় সঙ্গীত শিল্পী দের যাদের নাম মনে পড়ছে তারা হলেন সায়ান, কৃষ্ণকলি। জুলহাজ ভাইয়ের আরেকটা খুব বড় পছন্দের ব্যাপার ছিল প্রকৃতি। প্রকৃতি প্রেমিক ছিলেন তিনি। ভ্রমণ করতে অসম্ভব পছন্দ করতেন। তার সাথে আড্ডা দেয়ার একটা কমন প্লেস ছিল ধানমণ্ডি ৩২।এছাড়া বেশ কিছু রেস্টুরেন্ট, বসুন্ধরা সিটি তে বসা হত। আমার সাথে সব সময় ধানমন্ডির আশেপাশেই দেখা হত। একবার পিজ্জা খেতে গেলাম দি পেভমেন্টে। স্বাদ তেহারি ঘর, নানদোস, হটহাট, বুমারসে বসা হত। আসলে তখন ধানমণ্ডি এলাকায় এত রেস্টুরেন্ট ছিল না। ঢাকা ভার্সিটি এলাকা, টি এস সি ভুলে গেলাম কিভাবে। ওখানেও প্রায় যাওয়া হত। এছাড়া রবীন্দ্র সরবোর , আজিজ সুপার মার্কেট ছিল আমাদের রেগুলার হ্যাং আউট প্লেস। জুলহাজ ভাইয়ের সাথে পরিচয় এর পরের আমার প্রথম জন্মদিন তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম আমার জন্মদিনে তাকে ট্রিট দিবো ।কিন্তু ভুলে গেলেন। আমার কিছুটা রাগ হয়েছিল।কিন্তু ভুলে যাওয়া স্বাভাবিক। তখন ফেসবুক ছিল না।আমি তাকে এই কথা বলার পর তিনি খুব কষ্ট পেলেন । কিন্তু নিজের পক্ষে সাফাই গাইলেন না। বরং সরি বললেন।আমিও মেনে নিলাম। মজার ব্যাপার ঘটলো পরের জন্মদিনে। তখন জুলহাজ ভাইয়ার সাথে একটা বিশেষ কারনে আমার দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তারপরও তিনি উইশ করে মেসেজ পাঠালেন ।নিচে লিখেছিলেন যে তিনি এক বছর আগে থেকেই আমার জন্মদিনের জন্য অনেক পরিকল্পনা করেছিলেন আমাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য। কিন্তু এখন হয়তো আমি আর তা পছন্দ করবো না।তাই সেগুলো আর করা হল না।এখনো আমার জানতে ইচ্ছা করে কি ছিল সেই সারপ্রাইজ গুলো ।কিন্তু তা জানা তো আর সম্ভব নয়। জুলহাজ ভাইয়ার সাথে শেষ যে পার্টি তে গিয়েছিলাম তা হল নিউ ইয়ার পার্টি। জুলহাজ ভাইয়া, আমি এবং আরও ২ জন ভাইয়া ছিলেন। আমরা গিয়েছিলাম হোটেল শেরাটনের নিউ ইয়ার পার্টি তে।সবার সাথে আমিও নেচেছিলেম অনেক। অনেক উপভোগ করেছিলাম পার্টি । কিন্তু ঐদিনের পর আর সেভাবে মেশা হয় নাই উনার সাথে। একটা অভিমানের কারনে আমি তার থেকে দূরে সরে গিয়েছিলাম। আর সাল টা ছিল ২০০৯। এর পর অনেক বছর কেটে গিয়েছে। আমি তাঁর সব খবরই রাখতাম। কিন্তু যোগাযোগ করা হয়ে উঠে নাই।মাঝে মাঝে তিনি যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু আমি উপেক্ষা করেছি। স্বভাবতই এক সময় থেমে গিয়েছেন তিনি।এরপর আমার তার সাথে দেখা হয়েছে হাতে গুনে ৫ বার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। তার সাথে শেষ দেখা আমার এক বন্ধুর জন্মদিনে।সেখানে ইফতার পার্টির আয়োজন করা হয়েছিল । কারন তখন রমজান মাস।আমি তার হাত ইফতারের প্লেট ধরিয়ে বলেছিলাম কেমন আছেন। এই আমার শেষ কথা তার সাথে। জীবন খুব অদ্ভুত। যা চলে যায় তার জন্য আফসোসের শেষ থাকে না।জুলহাজ ভাইয়ার মত মানুষের বন্ধু হতে পারাটা অনেক বড় ব্যাপার। এখন মনে হয় কেন সকল অভিমান দূর করে কেন আগের মত তার বন্ধু হই নাই।এখন তো চাইলেও তা পারবো না। জানি না সেই অজানা জগতে তিনি কেমন আছেন। কিন্তু আমার ভালবাসা , দুয়া সবসময় তার জন্য থাকবে।
প্রথম প্রকাশ ধী ব্লগ, একটি বয়েজ অফ বাংলাদেশ-এর উদ্যোগ। কপিরাইটঃ বয়েজ অফ বাংলাদেশ। অনুমতি ছাড়া পুনঃপ্রকাশ করা যাবে না।