পীড়া

চৈত্রদাহে ঘুম ভাঙেনি, উপরি ভোর রাত থেকেই প্রকৃতি বেশ ঠান্ডা মেজাজে আছেন আজ। বৃষ্টি ঝরছিলো কখন থেকে টেরও পাইনি। সকালে উঠি উঠি করেও উঠতে ইচ্ছে করছিলোনা, শরীরে ডালপালা মেলেছে রাজ্যের আলস্য। ঠিক করলাম, ‘আজ আমি কোথাও যাবোনা’।

আহারে বৃষ্টি, কত শত স্মৃতি এই বৃষ্টি নিয়ে! এরকমই কোন একটা বৃষ্টিস্নাত ছুটির দিনে জুলহাজ ভাইয়ার ঘরে বসে কথা হচ্ছিলো তাঁর সাথে, কথায় কথায় উনি শুনতে চাইলেন আমার ছেলেবেলার বাদলা দিনের মজার কোন স্মৃতি। আমি শুরু করলাম।

‘আমার একটা বন্ধু ছিলো স্কুলে, হৃদয় নামের। মধ্যাহ্ন বিরতির পর, বর্ষাকালে প্রায় প্রতিদিনই তার দেরি হতো ক্লাসে আসতে। তাই ওর জন্য রীতিমতো বাঁধাধরা ছিলো কেমিস্ট্রির মুস্তাফা স্যারের বকুনি।

-‘হৃদয়, আজও দেরি! কেন এমনটা হলো তোর?’

ওর রোজ একই কথা

– ‘সরি স্যার, বৃষ্টির জন্য দেরি হয়ে গেলো’।

স্যার ভেবে কুল পেতেন না, ছেলেটার ছাতা নেই নাকি!’

-‘আসল ঘটনা ছিলো কি?’-আমি বললাম। 

ঈষৎ হেসে জুলহাজ ভাইয়া বললেন,

-‘কি?’

-‘ব্যাপারটা হলো ওর একটা বান্ধবীর নাম ছিলো বৃষ্টি। প্রতিদিন টিফিন ব্রেকে হৃদয় গার্লস স্কুলের সামনে গিয়ে ওকে একবার করে দেখে আসতো। কিশোর বয়সের আবেগী প্রেম বটে, কিন্তু সে মিথ্যে বলার মতো ছেলে ছিলো না মোটেও’। ‘স্যার জিজ্ঞেস করতেন, তোর দেরি হলো কেন রে? হৃদয় নিরীহ ভাবেই জবাব দিতো, স্যার বৃষ্টির জন্য। ও সত্যি কথাই বলতো, কিন্তু মুস্তাফা স্যারের কোনদিনও জানা হলোনা কোন বৃষ্টি ওকে দেরি করিয়ে দিতো’।

জুলহাজ ভাইয়া হা হা করে হেসে উঠলেন। ততক্ষণে আমি কিছুটা চমকিত! আমি উনাকে বেশিরভাগই দেখেছি চুপচাপ শান্ত একজন মানুষ হিসেবে। উনি যে এভাবে প্রাণ খুলে হাসতে পারতেন ততদিনেও আমি সত্যি জানতাম না! উনি ছিলেন প্রায় আমার মায়ের কাছাকাছি বয়সী একজন মানুষ, কিন্তু তাঁর বয়স আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে প্রভাব ফেলেনি কখনো।

তাঁকে আমি বছর কয়েক ধরে জানতাম। আমার কাছে তিনি ছিলেন পরম আস্থার, শ্রদ্ধাভাজন একজন মানুষ। সময়ের সাথে তৈরি হওয়া আস্থায় আমি নিজের অনেক ব্যক্তিগত সমস্যায় তাঁর পরামর্শ চেয়েছি, উনি আমাকে বুঝতে শিখিয়েছিলেন আমরা চেষ্টা করলেই সুখী হতে, সুখে থাকতে এবং প্রিয় মানুষগুলোকে সুখে রাখতে পারি।

আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিলো কর্মসূত্রে, আমার ও বাবুর একটা ইভেন্টের ভ্যেনুর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন উনি- নিজেই উপযাজক হয়ে। এরপর আমরা ‘সখিনার ঘর’ ও জুলহাজ ভাইয়ার সমর্থন পেয়েছি বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন কাজে, বহুবার। একসাথে কাজও করেছি বিভিন্ন সময়। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠক, তাঁর আচরণ কখনোই কতৃত্বপূর্ণ ছিলোনা। কিন্তু তাঁর নেতৃত্বগুণ ছিলো অসামান্য। তিনি ছিলেন সদালাপী একজন মানুষ, তাঁকে কখনো খুব বেশি রাগতে বা কটূ ভাষা ব্যবহার করতে দেখিনি আমি। অনিয়মের মধ্যেও মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ চালিয়ে যাওয়ার যে অদ্ভুত গুণ তাঁর ছিলো, আমি তা নিজের মধ্যে ধারণ করেছি, তিনি আমার কাছে একজন অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে থাকবেন সবসময়।

যা আমাকে আজও পীড়া দেয় তা হলো তাঁর শেষের দিনগুলোতে তাঁকে খুব বেশি সময় দিতে পারিনি আমি। তিনি খুব করে চাইতেন আমি তাঁর ‘ইয়ুথ লিডারশিপ প্রোগ্রামে’, আর ‘রূপবানে’ একটু বেশি সময় নিয়ে, সামনের দিকে থেকে কাজ করি। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের মাঝামাঝি সময়ে। ক্লাস, পরীক্ষা, গবেষণা সহযোগীর কাজ, নিজেদের সংগঠনে সময় দেয়াসহ নানা কারণে তাঁকে যতটা সময় দেয়া উচিত ছিলো ততটুকু দিতে পারিনি। 

তিনি চেয়েছিলেন রূপবানে আমার লেখা ধারাবাহিক ‘গ্রীক মিথলজি’ নিয়ে একটা সিরিজ করতে। তাঁর সাথে অনেক ভালো কাজের সুযোগ আমি হারিয়েছি। তিনি কি আমার উপর কিছুটা অভিমান, কিছুটা কষ্ট নিয়ে পৃথিবী ছেড়ে গেলেন? আমি দুঃখিত জুলহাজ ভাইয়া, রুপংক্তিতে লেখা না দেয়ার জন্য, আমি দুঃখিত ইয়ুথ লিডারশিপে সময় দিতে না পারার জন্য, আমি দুঃখিত- রূপবানের সাথে কাজ করতে না পারার জন্য। আমি আসলে ভাবতেও পারিনি আপনি এত তাড়াতাড়ি চলে যাবেন। যাওয়ার সময়ও আপনি আমাকে শিখিয়ে গেলেন, ‘যখনই কোন ভালো কাজের সুযোগ পাই তখনই তা কাজে লাগানো উচিত আমাদের, পরে একই সুযোগ আমরা নাও পেতে পারি’। জীবন কি নির্মম!

ভেবেছিলাম ভবিষ্যতে নিশ্চয় আমরা একসাথে আরও অনেক কাজ করবো। করতামই তো! যদিনা সেই নরকের কীটগুলো তাঁকে আমাদের থেকে ছিনিয়ে নিতো! তিনি তাঁর-আমার মতো মানুষদের অধিকার নিয়ে, সর্বোপরি মানবাধিকার নিয়ে আজীবন কাজ করে গেলেন, সেই মানুষটাকে ‘মানুষরূপী’ কিছু জানোয়ার কি নির্মম ভাবে হত্যা করলো! 

সেইসাথে তনয় ভাইয়া! আমার আরও কাছের একজন মানুষ! কি প্রাণবন্ত একটা মানুষই না ছিলো সে! ছোট্ট ভাইটার মতো আদর করতো আমায়। কোন কস্টিউম বা উইগের দরকার হলে, কিংবা কিভাবে নিবো হ্যালোউইনে ভ্যাম্পায়ারের সাজ- নাট্যকর্মী তনয় ভাইয়ার পরামর্শ ছিলো আমার কাছে অত্যাবশ্যকীয়। এই সৃষ্টিশীল মানুষটা সবার খুব দেখাশোনা করতো। আর কি চমৎকার ছিলো তাঁর সাবলীল অভিনয় আর স্পষ্ট উচ্চারণ! এখনও যেন গমগম করে কানে বাজে। আমাকে সে রেগে গেলে আপনি করে বলতো, অন্য সময় কখনো তুই, কখনো তুমি। আড্ডা’য় কাজ করার কথা ছিলো তাঁর, হয়ে উঠেনি। তাঁর অভাব পূরণ হওয়ার নয়।

জুলহাজ-তনয়, বড্ড অকালে চলে গেলেন তাঁরা, এভাবে তো যাওয়ার কথা ছিলোনা! কি আশ্চর্য দেশে বাস করছি আমরা! এখনও পর্যন্ত কোন বিচার হলোনা, কেউ গ্রেপ্তার হলোনা! রাষ্ট্র না দিলে এদেশে মাথা উঁচু করে বাঁচার নিরাপত্তা কে দেবে আমাকে? তাঁরা গেলেন। এরপর কে? আমি? নাকি আমার অন্য কোন সহকর্মী? কে দেবে জবাব?

তাঁদের অকাল প্রয়াণে আমি হারিয়েছি ভাই, বন্ধু, ও সহকর্মীকে, আর হতভাগ্য এ দেশমাতা হারিয়েছে তাঁর আরও দু’জন সূর্যসন্তানকে। আমাদের অস্তিত্বের জানান দিয়ে, নিজেদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে আমরা যতটুকু এগিয়েছিলাম, সেই অভিশপ্ত কালো দিনটার পর আমরা আবার ঠিক ততটুকুই পিছিয়ে গেছি। অভিজিৎ রায়, জুলহাজ-তনয় সহ সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া সকল মুক্তমনা ব্লগার-এক্টিভিস্ট হত্যাকান্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি আমি, সেইসাথে আমাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ ও এই ব্যাপারে রাষ্ট্রের একটি সুদৃঢ় অবস্থান পরিষ্কার করার জন্য দেশের সকল মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সম্মিলিত আওয়াজ দাবী করছি। 

জুলহাজ মান্নান কিংবা মাহবুব তনয়ের মতো অকুতোভয় মানুষেরা কখনো মরেননা, তাঁদের আদর্শ আর চেতনার বহ্নিশিখা কখনোই কোন উগ্রবাদী সন্ত্রাসীদের থাবায় নিভে যাওয়ার নয়। আমরা, তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম- তাঁরা যে অধ্যায় শুরু করেছিলেন তা সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবো, তাঁদের স্মরণে এই হোক আমাদের প্রত্যয়।

প্রথম প্রকাশ ধী ব্লগ, একটি বয়েজ অফ বাংলাদেশ-এর উদ্যোগ। কপিরাইটঃ বয়েজ অফ বাংলাদেশ। অনুমতি ছাড়া পুনঃপ্রকাশ করা যাবে না।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.