প্রাণের মানুষ

প্রথম পরিচয় সেই ২০১২ সালে। এরপর থেকে জুলহাজ ভাইকে আমি পেয়েছি আমার জীবনের প্রায় সব প্রয়োজনে। ব্যক্তিগত থেকে শুরু করে এলজিবিটি কাজ – প্রায় সব ব্যপারেই আমি তার সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতাম। একজন এলজিবিটি ব্যক্তি হিসেবে আমাদের অধিকার নিয়ে কাজ করার অনুপ্রেরণা, উৎসাহ আর সুযোগ আমি তার কাছ থেকেই পেয়েছিলাম। জুলহাজ ভাইকে দেখেই আমি সাহস পেয়েছি আমার নিজের পরিবার-বন্ধুদের কাছে নিজেকে একজন গে হিসেবে প্রকাশ করার । তার কাছ থেকেই আমি জেনেছিলাম রূপবান এবং বব-এর কথা। আমি মনে করি রূপবান এবং বব আমারই একটা অংশ আর আমি তাদের একটা অংশ।

২০১৬ সালে রূপবানের ইউথ লিডারশীপ প্রোগ্রামে গিয়ে পরিচয় হয় মাহবুব রাব্বি তনয় ভাইয়ার সাথে। অন্য সবার থেকে তনয় ভাইয়ার সাথে আমার একটু বেশিই আন্তরিকতা তৈরি হয়। আমি তনয় ভাইয়াকে বলি যে ওনার অভিনীত “আত্মত্যাগ” শর্ট ফিল্মটি আমি আমার এলজিবিটি ইউটিউব চ্যানেল “ভ্যালেন্টাইন” এ আপলোড করবো। তনয় ভাই একটা মিস্টি হাসি দিয়ে বলেছিলেন অবশ্যই দিয়ো এতে আরো বেশি মানুষ ফিল্মটা দেখার সুযোগ পাবে। পরে যখন লিডারশীপ ট্রেনিং-এর সার্টিফিকেট বিতরণ করা হচ্ছিলো তখন আমরা দু’জন ম্যাচ করে হলুদ রঙের পোশাক পরেছিলাম। আমি পরেছিলাম হলুদ পাঞ্জাবী আর তনয় ভাই হলুদ টিশার্ট। খুব অল্প সময়ে আমরা খুব আপন হয়ে গিয়েছিলাম।

এ কথাগুলো লিখতে লিখতে এখন আমার চোখে পানি চলে এসেছে।  আমার চোখের সামনে দৃশ্যমান সেই দিনের ঘটনাগুলো। যেদিন আমি ইউথ লিডারশীপ ওয়ার্কশপ শেষ করে চলে আসবো সেদিন আমার কাছে আমার ডেবিট কার্ড ছিল কিন্তু ক্যাশ টাকা ছিলো না। আর কুমিল্লার আলেখারচর-এর আশেপাশে টাকা তোলার কোন এটিএম বুথও ছিলো কি না আমি জানতাম না। আমি জুলহাজ ভাইকে ফোন করে বলি আমার প্রবলেমের কথা। তিনি বলেছিলেন তুমি রেডি হয়ে বাসস্টপে যাও আমি সবাইকে নিয়ে ওখানে আসবো আর তোমার বাড়ি যেতে যা টাকা লাগবে তুমি আমার কাছ থেকে নিও। কিন্তু আমি বাসস্টপে গিয়ে দেখলাম সেখানে একটা এটিএম বুথ আছে। বাস যখন ছেড়ে দিবে তখন হঠাৎ দেখি জুলহাজ ভাই তনয় ভাই সহ আরও সবাই বাসস্টপে আসছে। জুলহাজ ভাই আমাকে দেখে ইশারা করলো আর আমিও ইশারায় দেখিয়ে দিলাম যে টাকার ঝামেলা মিটে গেছে। জুলহাজ ভাইসহ সবাই আমাকে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানালো ! সেই দেখাই যে জুলহাজ ভাই আর তনয় ভাইয়ের সাথে আমার শেষ দেখা হবে তা কি আমরা কেউ ভেবেছিলাম?

জুলহাজ ভাইয়ের সেই হাসিমাখা মুখটা এখনো আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে। বৈশাখের রংধনু র‍্যালীতে যাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু পারিবারিক সমস্যার কারণে যেতে পারিনি। এরমধ্যে আমি আমার কিছু এলজিবিটি সম্পর্কিত শৈল্পিক কাজ নিয়ে জুলহাজ ভাইয়ের কাছে যাবো বলেছিলাম। সেটাও আর হোলনা !


২৫শে এপ্রিল সন্ধ্যায় এক বড় ভাইয়ের ফোনে শুনলাম যে আমাদের সবার প্রাণের মানুষ, আমার পথপ্রদর্শক, আমার আদর্শ,  আমার ভাই জুলহাজ মান্নান আর তনয় ভাই আর নেই। আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সাথে সাথে টেলিভিশন অন করি আর খবর দেখে নিশ্চিত হই ।


কি যে এক অস্থির বিভীষিকাময় সময় ছিল সেটা! কি করব কি বলব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কান্না আসছিলো কিন্তু কাঁদতেও পারছিলাম না। এর মধ্যে কম্যুনিটির অনেক এলজিবিটি লেখকরা, যাদের লেখা আমার অনলাইন ভিত্তিক এলজিবিটি ম্যাগাজিন “ভ্যালেন্টাইন” এ প্রকাশিত হয়েছিলো, তারা সেখান থেকে তাদের লেখা মুছে ফেলতে আমাকে অনুরোধ জানায়। খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল তারা। সাথে সাথে আমিও খুব ভয় পেয়ে গেলাম কারণ বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় এলজিবিটি গল্পের পেইজটা আমার। তাই আমিও নিজেকে নিরাপদ মনে করতে পারিনি। সব সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিয়ে নিজেকে লুকিয়ে ফেলি !

কিন্তু আমার মাঝে যে আছে জুলহাজ ভাই আর তনয় ভাই-এর আদর্শ!  তাদের এই আত্মত্যাগকে আমি কিভাবে ভুলে যাবো? আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর কবিতার ৪টা লাইন বার বার মনে পড়তে লাগলোঃ


“অসত্যের কাছে কভু
নত নাহি হবে শির
ভয়ে কাপে কাপুরুষ
লড়ে যায় বীর”


কিছু দিন পর মনে মনে ভাবলাম, না এভাবে থেমে গেলে চলবে না।  আমরা থেমে যাবো না। এই শোককে আমাদের শক্তিতে পরিণত করতে হবে। সাবধানে আমাদের আবার সামনে এগিয়ে যেতে হবে। তাদের মৃত্যু আমাদের চলার পথের গতি ধীর করে দিয়েছে বটে কিন্তু তারাই আমাদের অনুপ্রেরণা, সামনে চলার সাহস, আদর্শ। আমি আবার আমার এলজিবিটি অনলাইন ম্যাগাজিন পাবলিশ করলাম, গ্রুপ ওপেন করলাম, এলাকার এলজিবিটি ব্যক্তি যারা আছে তাদের সাথে ছোট ছোট মিটিং-এর ব্যবস্থা করলাম ।


যেকোন এলজিবিটি আলোচনা শুরু করার আগে আমি জুলহাজ ভাই তনয় ভাইয়ের কথা সবাইকে বলি, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি।
আমি মনে করি আমার ভাইয়েরা আমাদের জন্য জীবন দিয়ে গেছে।  এখন আমাদের দায়িত্ব তাদের অসম্পুর্ন কাজগুলোকে পরিপুর্নতা দেওয়া। আমরা থেমে গেলে তাদের এই আত্মত্যাগ বৃথা যাবে।
কিছু অসৎ মানুষ হয়তো কিছু সময়ের জন্য থামিয়ে দিতে চেষ্টা করবে কিন্তু আমাদের পথচলা থেমে যাবে না। তাদের এই আত্মত্যাগ আমাদেরকে শিখিয়ে দিয়ে গেছে আরো বেশি সাবধানতার সাথে, আরো বেশি দূরদর্শিতার সাথে আমাদের কাজকে, আমাদের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। দ্রুত হোক আর ধীরে আসল কথা যেভাবেই হোক আমরা এগিয়ে যাবো থেমে থাকবো না। আমরা যে যেখানেই থাকিনা কেন আমাদের সবার যার যার অবস্থান থেকে কাজ করে যাবো। আমি গে এটা আমার সেক্সুয়াল পরিচয় আর আমি মানুষ এটাই আমার আসল পরিচয়।

প্রথম প্রকাশ ধী ব্লগ, একটি বয়েজ অফ বাংলাদেশ-এর উদ্যোগ। কপিরাইটঃ বয়েজ অফ বাংলাদেশ। অনুমতি ছাড়া পুনঃপ্রকাশ করা যাবে না।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.