উদ্ধার

আমরা জীবনের কোন না কোন সময় ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিস’ বা পরিচয়-হীনতায় ভুগি। আমিও এর ব্যতিক্রম ছিলাম না। এক সময় ক্রাইসিসটা খুব ভুগাচ্ছিল আমায়। সেই সময়ে আমার পরিচয় হয় তনয়ের সঙ্গে। 

২০১২ সালের দিকের কথা। তখন আমি প্রথম ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পারি আমার মতো অনেক সমকামী আছে ঢাকা শহরে। তারা একটি ভিন্ন নাম ব্যবহার করে ফেসবুক আইডি চালায়। আমিও সেরকম একটা ফেইক নাম দিয়ে আইডি খুলে বসি। আর সেটা দিয়ে সমমনা মানুষদের খুঁজতে থাকি। সেখানে তনয়ের সঙ্গে পরিচয়। তার আইডি নাম ছিল সামির থ্রণ। আমি ওকে জিগ্যেস করেছিলাম, এটা কি তোমার রিয়েল আইডি? সে বলেছ, হ্যাঁ! কেন নয়? 

তখন নতুন আইডি খুলে চালানোর মজাই আলাদা ছিল। নতুন এক পরিচয় তৈরি করে জগতের মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতা করার মধ্যে এক চাপা উত্তেজনা কাজ করতো। যখন নতুন এলাম তখন বেশ নিরাপত্তা-হীনতায় ভুগতাম। সব কিছুই নতুন। ফেসবুকে দীর্ঘদিন যাবত যাদের সঙ্গে কথা হতো তাদের সঙ্গে মূলত দেখা করতাম। তাও বহুদিন সময় নিয়ে। যেহেতু তনয় আমার সিনিয়র ছিল সেহেতু তনয়ের সঙে এ নিয়ে আলাপ করতাম। ও আমাকে সবসময় সাপোর্ট দিতো।

আমি ওকে জিগ্যেস করেছিলাম, তোমার কি একটাই আইডি? সে উত্তরে বলল, হ্যাঁ। একটাই। এখানে আমার সব পরিচিত মানুষদের অ্যাড করা আছে। আমি তারপর খুব কৌতূহলী হয়ে জিগ্যেস করলাম, তোমার ভয় লাগে না? ও উত্তরে বলল, ভয়? ভয় লাগার কি আছে? 

চ্যাটে অনেক কথা হতো। কিন্তু দেখা হতো না। আমার আবার নতুন কারোর সঙ্গে দেখা হলে বা কথা বললে ভালো লাগার মতো এক অনুভূতি তৈরি হয়। যখন এই ভালো লাগা আরও গভীর হতে লাগে তখন তা গাঢ় ও শক্ত বন্ধুত্বে পরিণত হয়।  খুবই সুন্দর এক অনুভূতি! 

আমি আমার মতো থাকতে খুব পছন্দ করি। ভণিতা করতে আমি পারি না। তাই একটা পর্যায়ে আমার ভার্সিটি ফ্রেন্ডদের সাথে ঘুরাফেরা বন্ধ করে দেই। অভিনয় করে চলাটা আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। আমি তনয়কে মাঝেমধ্যে এ নিয়ে কথা বলতাম। সে বলত, তুমি যেরকম সেরকম থাকো। কোন অভিনয় করার প্রয়োজন নেই। আমাদের কমবেশির সবারই বাহ্যিক আচরণে একটু মেয়েলী ভাব আছে। আমি একবার বললাম, জানো আমার হাঁটা নিয়ে সবাই হাসাহাসি করে ছোটবেলা থেকেই। আমাদের চলাফেরায় সমস্যা, আমরা ম্যানলিভাবে হাঁটতে পারি না। কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে হাঁটি। তোমার আগের ছবিও দেখেছি। ফেসবুকে অনেক ধরণের ছবি ছিল। ক্রস-ড্রেসিং এর। কিভাবে তুমি এরকম মাল্টিপল পারসোনালিটি ধারণ করো? ও উত্তরে বলল, অভিনয়। আমাদের জীবনের সবকিছুই অভিনয়। আমরা নিজেরা নিজেদের সাথে অভিনয় করি। সমাজের সাথে অভিনয় করি। এবং আমার ব্যাপারটা হল আমি অনেক ভালো অভিনয় করি বলে এখন সব ঠিকঠাক। আমি অনেক বছরের পর বছরের অনুশীলনের মাধ্যমে নিজেকে ঠিক করতে পেরেছি। 

তনয়ের সে কথা আমার জন্য অনেক বড় মোটিভেশন ছিল। 

আমার মধ্যে মজার এক উপলব্ধি আছে। যারা খুব বেশি কমিনিউটিতে যাতায়াত করে না, যারা নতুন আসে বা যারা আশপাশ চিনে না, তখন তারা হঠাৎ করে কাউকে ক্রস-ড্রেসিং করতে দেখলে একটা নেতিবাচক অনুভূতি সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয়। আমার মধ্যেও কাজ করতো। তনয়সহ আরও বন্ধুদের ক্রস-ড্রেসিং করতে দেখলাম। বিভিন্ন প্রোগ্রামে তাদেরকে বিভিন্ন অবতারে দেখলাম। তারা পারফর্ম করছে, ছবি তুলছে, নাচছে। বিনা কোন সংকোচে! আমার এক পর্যায়ে ব্যাপারটা গ্রহণ করতে শুরু করি। তারপর আমি নিজে পরবর্তীতে দুইবার ক্রস-ড্রেসিং করি। পারফর্ম পর্যন্ত করেছি। শুরু শুরুতে প্রচণ্ড অদ্ভুত লাগতো তবে ধীরে ধীরে একটা ভালো লাগা বলবো না তবে ঠিকঠাক ছিলাম। শুধু এক বহির আবরণ। এই নিয়ে এতো বাড়াবাড়ি করার কিছুই দেখি না! 

তনয়ের সৌন্দর্য তারিফের যোগ্য। এই জাঁদরেল গোঁফ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আবার এই বড় এক লাল টিপ কপালে লাগিয়ে, গলায় মুক্তার মালা পরে, টকটকে রক্ত লাল শাড়ি গায়ে নিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ যেন নাটকীয় পরিবর্তন। যেন এক দেহ কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়। 

তনয়ের সবকিছুতেই নাটকীয় সৌন্দর্য ছিল – তা আমরা কেউ অস্বীকার করতে পারবো না। ওর কথা বলা, ওরা চলাফেরা সবকিছুর মধ্যে সৌন্দর্য। থিয়েটার ওর জীবনে অনেক বড় প্রভাব রেখেছিল। গোঁফ রেখেও শাড়ি পরত! কি সৌন্দর্য! 

আমি অবাক হতাম। খুব অবাক হতাম।

আজ সে নেই। ভাবতে কষ্ট চেয়েও বেশি কিছু মনে হয়। হয়তো মাসের পর মাস যোগাযোগ থাকতো না তবে আমি জানতাম তনয় যেখানে আছে সেখানে ভালো আছে। চট করেই দেখে আসা যায়, কথা বলা যায়। আর এখন? জলজ্যান্ত মানুষটা মুহূর্তেই গত।

এখনকার আমি অনেক আত্মবিশ্বাসী। নিজেকে নিয়ে গর্বিত। এর পিছনে, শুরুর দিকে যে উন্নতি হচ্ছিল তখন তনয় বেশ বড় উদ্দীপনা যুগিয়েছিল আমার মধ্যে। 

আমরা আপনাআপনি কোন এক নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে নানাভাবে অনুপ্রেরণা পাই। তারা কিন্তু ধরে ধরে আমাদের অনুপ্রাণিত করে না। বলে না যে নাও এ দ্বারা অনুপ্রাণিত হও! তনয়ের অনেক আচরণ আমাকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। সেটা মুখে কখনও বলে না বেড়ালেও, আমার নিজের জীবনের কিছু দিক দেখলেই বুঝতে পারি। আগেকার আমি আর এখনকার আমির মধ্যে বিশাল পার্থক্য আঙ্গুল দিয়ে আলাদা না করলেও আমি বুঝতে পারি। এ ক্ষেত্রে তনয়ের অনেক বড় লুকানো অবদান আছে। তার সাহস, তার আচরণ, তার চালচলন ও তার দর্শন আমাকে সবসময় মোহিত করতো এবং করবে।

আমার ‘পরিচয়-হীনতা’ সিনড্রোম থেকে উদ্ধার করেছে, তনয়। 

প্রথম প্রকাশ ধী ব্লগ, একটি বয়েজ অফ বাংলাদেশ-এর উদ্যোগ। কপিরাইটঃ বয়েজ অফ বাংলাদেশ। অনুমতি ছাড়া পুনঃপ্রকাশ করা যাবে না।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.