
তু
বাংলাদেশের সমকামী সমাজের অভ্যন্তরীন অনেক আলোচনার বিষয়ের মধ্যে অন্যতম “এলিট ক্লাস” | কিন্তু পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ বিষয়ে কেউই সরাসরি বা মুক্ত আলোচনায় আগ্রহী নয় | তবে এ বিষয়ে আলোচনার যে প্রয়োজন হয়েছে তাতে কারোরই কোনো দ্বিমত নেই |
অভিধান অনুসারে, এলিট ক্লাস বলতে সচরাচর একটা ছোট গোষ্ঠীকে বোঝায় যারা কোন সমাজে তুলনামূলকভাবে অন্যদের থেকে অনেক বেশি সম্পদ, সুযোগসুবিধা, রাজনৈতিক ক্ষমতা বা দক্ষতার অধিকারী। কিন্তু আমাদের এই কমিউনিটিতে “এলিট ক্লাস” কি শুধু এই আভিধানিক মানেই নির্দেশ করে নাকি আরো অনেক কিছু?
আমাদের এ পাড়ায়, এলিট প্রজাতি হওয়ার মানদণ্ড কি? টাকা পয়সা থাকলে এলিট? শারীরিক বা মানসিক ভাবে ভালো থাকলে এলিট? লেখা-পড়ায় ভালো হলে এলিট? নাকি অন্যান্য কোনো বিশেষ গুনের অধিকারী হলে এলিট?
কমিউনিটির অনেকের সাথে মেলা-মেশা করার সুবাদে নানান আলোচনার সাথে এই বিষয়ে কথা হয়েছে | অনেকের সাথেই আমার ব্যক্তিগত মতামতের মিল পাওয়া গেলো | অনেকে দ্বিমত পোষণ করেছেন |
সেই আলোচনার ঘটনাপ্রবাহের উপর নির্ভর করেই এই লেখা | একথা-দুকথা আর মিসইন্টারপ্রিটেশন ঘটার আগেভাগেই বলে নেয়া ভালো যে এই লেখার মাধ্যমে কোনো পার্থক্যকরণ বা কোনো উপসংহার খোঁজা নয় বরং আমাদের কমিউনিটিতে এই “এলিট ক্লাস” টার্মিনোলজির আবির্ভাব বা ব্যবহারের কারণ অনুসন্ধান |
কমিউনিটির একজন মানুষ কখন তারই সহযাত্রী আর একজনকে এই “এলিট’ শ্রেণীতে বিন্যাস করে? এটা কি নেহাত ইচ্ছার বসে নাকি বাধ্য হয়ে?
ঘটনা ১: শহর বনাম মফস্বল বনাম গ্রাম | ২০০৫ সালে ইন্টারনেট এর বদৌলতে যখন এই গে কমিউনিটিতে প্রবেশ, তখন আউটপার্সোনালে কিছু মানুষ দেখা যেত | বেশিরভাগ বিদেশী রেসিডেন্ট আর ঢাকার বাসিন্দা | এর পর ইয়াহু মেসেঞ্জার গ্রুপ, হাইফাইভ, মাইস্পেস, ম্যাঞ্জাম, মিগ৩৩, ফেসবুক ঘুরে গ্রাইন্ডার আর ব্লুয়েড | কালের প্রবর্তে দেখা গেলো কিভাবে ইন্টারনেট আর মোবাইল ফোনের সহজলভ্যতা শহর থেকে মফস্বল হয়ে গ্রামের ঐ নিরীহ সমকামী সমাজকে এই সমাজের জন্য কাজ করতে অনুপ্রেরণা দিলো | অনেকেই এই বিষয়টি বুঝতে পারলেও, অনেক শহুরে মানুষ ই এই বিষয়টি বুঝতে চান না বা বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকেন | এই বোঝা না বোঝার ভিতরে যে বিশাল সাইকোলজি তা এখানে এখন লিখে বোঝানো যাবে না | যারা এতদিন ইন্টারনেট আর এই এপপ্স গুলোকে “প্রিভিলেজ” হিসেবে দেখতো সেই “প্রিভিলেজ” এখন “নেসিসিটি” তে রূপান্তর হওয়ায় অনেকেই বলেন “এই সব এপ্স এখন সস্তা হয়ে গেছে” | এখন এই “সস্তা”র সংজ্ঞা কি? যারা “সস্তা” বলছেন তারা কিভাবে নিজেদেরকে আলাদা ভাবছেন? নিজেদের ঐতিহ্যবাহী “প্রিভিলেজ” নষ্ট হলো তার জন্য?
ঘটনা ২: যখন ঘটা করে আমরা ডাইভার্সিটির পতাকা উড়িয়ে, নিজের ব্যক্তিগত মতামত আর স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তার কথার ফুলঝুরি ঘটিয়ে গলাবাজি করে চলছি, ঠিক তখনি “ধর্মানুভূতিতে আঘাত” এর অজুহাতে আমাদের সহযাত্রীদের একবার, দুইবার, তিনবার করে গ্রুপ থেকে বের করে দিচ্ছি | এই “ধর্মানুভূতিতে আঘাত” এর জন্যই ২০১৬ সালের ঘটনা প্রবাহ আমাদের দেখতে হলো | আবার আমরাই সেই “ধর্মানুভূতিতে আঘাত” এর দোহাই দিয়ে আমাদের মধ্যেই বিভেদ সৃষ্টি করলাম | ভালো কথা | তো যারা এই “ধর্মানুভূতিতে আঘাত” এর সংজ্ঞা নির্ধারণ করলো দেখা গেলো তারা বেশির ভাগই বড় বড় শহরের বাসিন্দা | আর যে ভিকটিম সে গ্রাম থেকে উঠে আসা একজন | তো ন্যাচারালি এখানে পাওয়ার প্লের বিষয়টা মনে হওয়াই স্বাভাবিক | আর আমাদের সমাজে পাওয়ার তো “এলিট” শ্রেণীর ই থাকে |
ঘটনা ৩: যারা এই কমিউনিটি নিয়ে কম বেশি কাজ করেন সবারই মুখ্য উদ্দেশ্য এই কমিউনিটির ভালোর জন্য কিছু করা | একজন একটা ভালো কিছু করতে গেলেই তার হাজারটা ভুল-ত্রুটি বের করা যেন আমাদের মজ্জাগত | আর তার উপর আছে বিভিন্ন রকম “এক্সপার্ট এডভাইজ” | সমালোচনা স্বাগতম কিন্তু সেই সমালোচনার মোড়কে যখন কোনো ব্যক্তিকে অপদস্থ করা হয় আর সেখানেও যদি এই শহর-মফস্বল-গ্রাম বিবেচনা করা হয়, দেখা যায় সমালোচক শহুরে আর ভিকটিম তার বিপরীত| স্বভাবতই সামাজিক নিয়মে তখন শহুরে শ্রেণী “এলিট” ই পরিণত |
ঘটনা ৪: কিছুদিন আগে ব্রিটিশ হাই কমিশনার এর বাসায় একটা প্রোগ্রাম এর আয়োজন করি | অনুষ্ঠানের গেস্ট তালিকায় নাম থাকা কয়েকজন খুব উৎসাহ নিয়েই বলে বসলো এখানে “এলিট”দের পাশাপাশি কিছু আন্ডার প্রিভিলেজ সদস্যকেও দাওয়াত দেয়া হোক | শুনে অবাক লাগলো কারণ, আমার জানা মতে সেখানে কোনো “এলিট” শ্রেণীর প্রতিনিধি ছিলেন না | তারপরও তাদের এই ধারণা কেন হলো জিজ্ঞাসা করাতে বুঝলাম ঝামেলা কি | বিস্তারিত আলোচনায় বোঝা গেলো, এখানে যাদের ভিনদেশি দূতাবাসে কারণে-অকারণে যাতায়াত আছে, মার্কিন বা নর্ডিক ক্লাবে উইকেন্ড এ যাওয়ার একসেস আছে, অথবা কিছু “সাদা চামড়া” বন্ধু আছে যাদের সাথে অবাধে রুম-ডেট করা যায়, তারাই “এলিট” আর বছরে ২-৩ বার বিদেশ গেলে তো কথাই নেই | তারা “সুপার এলিট” | তো আমাকে বোঝাতে হলো, এগুলা করা অসাধ্য কিছু না আর ১০ টা মানুষের মতো ওসব জায়গাতে যাওয়া বা বিদেশী মানুষের সাথে মেলা-মেশা একজন মানুষ হিসেবে এগুলো খুব স্বাভাবিক | কিন্তু প্রতি উত্তরে জানা গেলো, যারা এই যাতায়াত, যোগাযোগে অভ্যস্ত তারা বরাবরই শহুরে আর গ্রামগোষ্ঠী এড়িয়ে চলেন | তাদের বলনে-চলনে, গ্রাম বা মফস্বলের মানুষের প্রতি সবসমই একটা তাচ্ছিল্যের প্রকাশ |
ঘটনা ৫: আমাদের মনের দৈনতা | যখন আমরা একে অপরকে সমালোচনা করি, আমরা নিজেদের অবস্থান ভুলে যাই | আমরা ভুলে যাই আমরা আমাদের এই গতানুগতিক সমাজ টা পাল্টাতে চাই আর সেক্ষেত্রে আমাদের গতানুগতিক হলে চলে না | আমরা হয়তো অনেকেই অনেক বিষয়ে জ্ঞান রাখি কিন্তু অন্যদেরকে সহায়তা করার জন্য সেই জ্ঞান এর বস্তুনিষ্ঠ ব্যবহারে কখনোই ভূমিকা রাখি না | শ্রদ্ধা, সাহস আর উৎসাহ দেয়ার বদলে আমাদের আছে ডেকচি ভরা উপহাস, সমালোচনা আর জুজুর ভয় | এই দেয়া-নেয়ার খেলায় আবারো পাওয়ার প্লে, গ্রাম-শহর, অভিজ্ঞতা আর এই কমিউনিটি তে কে কত পুরাতন উপর ভিত্তি করে এক একজনের “ক্লাস” এর বাটখারার মাত্রা নির্ধারণ হয় | আর তার থেকেই আবারো “এলিট” শ্রেণীর অবতারণা |
আমাদের এই ছোট কমিউনিটিতে, আমরা সবাই যখন রাষ্ট্রীয় আর সামাজিক কাঠামোর চাপে, দিনকে দিন কোনঠাসা হচ্ছি, তখন নিত্য নতুন এই শ্রেণী বিন্যাস কি আমাদের কোনো উপকারে আসছে? তথাকথিত “এলিট ক্লাস” হয়েও কি আমরা আমাদের কমিউনিটির জন্য উল্লেখযোগ্য কিছু করতে পেরেছি? অথবা “প্রান্তিক” হয়েও কি আমরা একসাথে আমাদের সামাজিক বৈষম্য তুলে ধরতে পেরেছি? রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা তাদের স্বার্থে একজোট, বাস-ট্রাক ড্রাইভাররা কারণে-অকারণে একসাথে ধর্মঘটে, চাল থেকে হাওয়াই চপ্পল ব্যবসায়ীরা মূল্যবৃদ্ধির জন্য নানান অজুহাতে সবাই একসাথে, ডাক্তাররা একসাথে কর্মবিরতিতে, শিক্ষকরা একসাথে আন্দোলনে আর আমরা কোথায়? আমরা কি একসাথে? কোনোদিনও ছিলাম? ভবিষ্যতেও থাকবো কখনো?
লেখক নিজস্ব মতামত প্রকাশ করেছেন