
নিলয় নীল
বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? এই গল্প তো কমবেশি সবাই পড়েছেন! বেড়ালের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য ইঁদুর নেতারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বেধে দেবে কিন্তু এক বিচক্ষণ ইঁদুরের ছোট্ট একটি প্রশ্নে সমস্ত সভাসদ থামকে গিয়েছিল। হ্যাঁ, সেই প্রশ্নটিই ছিল “বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাধবে কে”?
বর্তমানে LGBTQI অধিকার আন্দোলনের অবস্থাও গল্পের সেই ইঁদুরদের মতোই। সবাই বলছে অবস্থার পরিবর্তন হবে, পরিবর্তন হবে! কিন্তু কবে হবে আর কে পরিবর্তন করবে? এই প্রশ্নে সবাই চুপ!
LGBTQI অধিকার আন্দোলন এর নেতা-কর্মীরা আজ দুই দলে বিভক্ত। একদল বলছে পরিবর্তনের কার্যক্রম এখনি শুরু করতে হবে। আরেকদল বলছে না এখনও সময় আসে নি কোন কিছু করার। আমার অবস্থান প্রথম দলে। কারণ দ্বিতীয় দল আমাদেরকে এখনও উত্তর দেয় নি, কবে আসবে সেই সময় আর কে পরিবর্তন করবে?
এই দুই দলে দুই অবস্থানের মানুষ যোগ দিয়েছে। প্রথম দলে যোগ দিয়েছে প্রান্তিক শ্রেণির মানুষগুলো। যাদেরকে তার যৌন পরিচয়ের কারণে প্রতিদিন নানা অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়। কখনও কখনও এদেরকে হারাতে হয়েছে পরিবার কিংবা কাছের মানুষদের, কখনও সম্পদ থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছে, কখনও বা হজম করতে হয় নানা গালমন্দ। কাউকে আবার সমাজ পরিবারের সাথে আপোষ করার জন্য নিজের সত্ত্বাকেই গলা টিপে হত্যা করতে হয়। এই মানুষগুলো নতুন করে বাঁচার তাগিদেই মনে করে এখনি বৃহত্তর আন্দোলনের প্রস্তুতি নেয়ার সময়। এই দলের সাথে গুটিকতক সেই মানুষগুলোও যুক্ত যারা নিজেরা ভাল থাকার পরও অনুভব করেন কমিউনিটির অন্যদের ভাল রাখার জন্য অধিকারের এই লড়াইয়ে তাদেরও অংশগ্রহণ উচিৎ।
দ্বিতীয় দলে তারাই যোগ দিয়েছে যাদের LGBTQI সম্প্রদায়ের বৈধতা থাকলেও কিছু যায় আসে না আর না থাকলেও কিছু যায় আসে না। বরং এখন যে পরিস্থিতি আছে তা তাদের জন্য বেশ ভালই। সামাজিক অবস্থানের কারণে ব্যক্তি জীবনে নিজেদের ইচ্ছামতো জীবন কাটালেও কারও সাহস নাই তাদের দিকে আঙ্গুল তোলার। হাত বাড়ালেই তাদের মনোরঞ্জনের জন্য আছে পশ্চিমা ঘরানার নানা ব্যবস্থা। কমিউনিটির মানুষরা এদের দর্শন লাভ করুক বা না করুক, বড় সাহেবদের দর্শন দেয়ার জন্য এরা সর্বদা প্রস্তুত। কমিউনিটির মানুষ কেমন আছে? কি চায়? কিভাবে চায়? এটা তারা জানার প্রয়োজন মনে না করলেও নেতা সেজে কিন্তু সবখানে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য তারা প্রস্তুত থাকে । যখন কেউ অধিকার প্রতিষ্ঠায় সামনে আগায় তখনই এরা রৈ রৈ করে তাকে পিছনে টেনে ধরার জন্য দৌড়ায়। কারণ অধিকার চাইলেই, সামাজিক আন্দোলনের পথ রচনা করলেই এদের অবস্থানও নড়ে যাবে আর মোড়লত্বও ঝুঁকির মুখে পড়বে। প্রথম দলের নেতা-কর্মীরা এদেরকে হিংসা করে না বরং এটাই বুঝাতে চায় তোমরা ভাল থাকলেও কমিউনিটির বিশাল একটি অংশ ভালো নাই।
এই দুই দলের বাইরেও আরেকটি দল আছে। এটা হয়ত তৃতীয়পক্ষ। LGBTQI movement থাকল নাকি বন্ধ হল এসব নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নাই। ন্যুড ছবি পোষ্ট করলে এরা ঠিকই হুমড়ি খেয়ে কমেন্ট করে কিন্তু সিরিয়াস কোন পোষ্টে অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও এদের
টিকিটাও খুঁজে পাওয়া যায় না। দিনের বেলা সমকামিতা পাপ পাপ বলে মুখে ফেলা তোলে আর রাতের বেলা তা ভুলে গিয়ে সমকামিতায় জড়িয়ে পড়ে। ঘরে বউ বাচ্চা রেখে সমকামিতা করলে এদের জাত যায় না কিন্তু কেউ বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিলেই এদের আতে ঘা লাগে। সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম সমকামীদের শূলে চড়ালেও এদের সহানুভূতি জাগে না কিন্তু এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে কিছু বললেই এদের ধর্মানুভূতিতে ফোস্কা ওঠে। মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা থাকলে এরা দুই দলের সাথেই থাকে। তবে সাথে থাকলেও এদের উপর কোন ভরসা নাই।
আমি আগেই বলেছি আমার অবস্থান প্রথম দলে। এর কারণ হিসেবে বলব, আমি বিশ্বাস করি, সমাজ এমনি এমনি পরিবর্তন হয় না, স্বাধীনতা কেউ দেয় না, কুসংস্কার হাওয়ায় ভেসে ভেসে বিস্তৃতি লাভ করলেও সংস্কার সহজে প্রচার হয় না, ধর্মান্ধতা এবং উগ্রবাদ বিনা প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠালাভ করলেও মানবতা সংগ্রাম ছাড়া প্রতিষ্ঠিত হয় না, অবিচার গুটিকতক মানুষের হাত ধরে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জেঁকে বসতে পারে কিন্তু ন্যায় ও বৈষম্য মুক্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলতে কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিতেই হয়। LGBTQI সম্প্রদায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য শফি হুজুর কাজ করবে না, এন্টার্কটিক বিজ্ঞানী মুফতি কাজি ইব্রাহিম সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলবে না, আব্দুর রাজ্জাক বই লিখবে না, কোন সেকু-মাকু রাজপথে নামবে না। শফি, ইব্রাহিম, রাজ্জাকরা বরং সমকামীদের গলায় চাপাতি লাগানোর জন্য উৎসাহিত করবে। তাদের সমকামী বিদ্বেষী প্রচারের বিরুদ্ধে আমাদেরকেই লিখতে হবে, প্রতিরোধ করতে হবে। এখন থেকে এই প্রতিরোধ শুরু না করলে সেই দিন খুব বেশি দূরে নয়, যে দিন ব্রুনাই, ইন্দোনেশিয়ার মতো বাংলাদেশেও সমকামীদের পাথর ছুড়ে হত্যা করা / বেত্রাঘাত করার আইন জাড়ি হওয়া দেখতে হবে। সেদিন সেকু-মাকু, এলিট কেউ প্রতিবাদ করবে না। এতে এদের কোন ক্ষতি না হলেও আপনার-আমার, আমাদের পরিবর্তী প্রজন্মের জন্য আরও অন্ধকার ডেকে আনবে। তাই এগিয়ে আসুন, নিজেদের অধিকারের জন্য কাজ করুন। কাজ করলে সমালোচনা হবে, বাধা আসবেই। আর এসব কিছুকে বৃদ্ধা আঙ্গুল দেখিয়ে বলুন, “I don’t care”.