
বিশেষ টীকাঃ ২০১৪ সালে ‘হোমসেক্সুয়ালিটি ইজ নট অ্যান ইলনেস’ নামক ফেসবুক ভিত্তিক কুইয়ার গ্রুপে মাহবুব তনয় এর এই সাক্ষাৎকার ‘সামির থ্রন’ ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়। ২০১৬ সালে তনয়-জুলহাজ হত্যাকাণ্ডের পর গ্রুপের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ‘মন্দ্র’ এর উদ্যোগে নানা ভাবে খোঁজাখুঁজি করার পর সাক্ষাৎকারটি উদ্ধার করা হয়। আজ ছয় বছর পর তনয়-এর জন্মদিনে সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করা হল। প্রশ্নকারী এবং তনয় তাদের ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ করেছে। ‘মন্দ্র’ এর অনুমতি ছাড়া এই সাক্ষাৎকার পুনঃপ্রকাশ করা যাবে না।
শুভ জন্মদিন, তনয়!
২৪শে এপ্রিল, ২০২০
প্রশ্নঃ আপনার সম্পর্কে কিছু বলুন।
আমার পুরো নাম অনেক বড় ছিল। তারপরে এস.এস.সি পরীক্ষা রেজিস্ট্রেশন করার সময় সংক্ষিপ্ত করে “খ. মাহবুব রাব্বী” অফিসিয়াল নাম হিসেবে রাখা হয়। আমার সার্টিফিকেট এবং পাসপোর্ট এই নামেই করা। এখানে “খ.” মানে হচ্ছে খন্দকার। সামীর বা তনয় আমার সম্পূর্ণ নামের ছোট দুটি অংশ। আমার স্কুল ও কলেজের ফ্রেন্ডরা আমাকে সামীর নামে এবং বাসার সবাই তনয় নামে ডাকে।
এরপরে আমার বাবার সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হবার পর থেকে তাঁর নামের অংশ খন্দকার ও রাব্বী বাদ দিয়ে আমি অফিসিয়াল ভাবে আমার নাম “মাহবুব তনয়” ব্যবহার করা শুরু করি।
আমার পড়াশোনার অংশটুকু আরও কমপ্লিকেটেড। আমার একটি সমস্যা আছে, যার নাম ডাইলেক্সিয়া। এটা অনেকটা এক ধরণের অসুখের মতন। যারা “তারে জামিন পার” ছবিটি দেখেছেন তারা কিছুটা বুঝতে পারবেন। ঐ ছবির মূল চরিত্র ঈশান আবাস্তী এর যেই সমস্যাটি ছিল আমারও অনেকটা এক। সেজন্য আমার স্টাডি লাইফে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে। আমার এস.এস.সি পাশ করতে লেগেছে চার বছর এবং এইচ.এস.সি মোট পাঁচ বছর। এরপরে এখন পর্যন্ত আর সম্পূর্ণভাবে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করা হয়নি। সেটা অন-প্রসেসে আছে, জানি না আর কত বছর লেগে যাবে। পারফর্মিং আর্টস এর উপর আমার কিছু ডিপ্লোমা কোর্স করা আছে। সেটার উপর ভিত্তি করেই মোটামুটি ভাবে আপাতত জীবিকা নির্বাহ করছি। আমি বিভিন্ন কালচারাল সেক্টরে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করি। কখনো বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, কখনো পি.টি.এ, কখনো কোন বিদেশী এমব্যাসির কালচারাল ডিপার্টমেন্ট, আবার কখনো টিভি চ্যানেল। তবে বেশিরভাগ সময়ই বেকার। কিন্তু সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে পড়াশোনার এত দুর্বলতা নিয়েও আমি একটি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে এবং দুটি ইউনিভার্সিটিতে টিচার হিসেবে কিছুদিন কাজ করেছি। যদিও সেটা ছিল কালচারাল সেক্টর বা ড্রামা ডিপার্টমেন্টে, তারপরও ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েশন লেভেলের স্টুডেন্টরা আমাকে স্যার বলেই সম্বোধন করতো। ব্যাপারটা আমার জন্য খুব মজার ছিল। সবকিছুই সম্ভব হয়েছে আমার অভিজ্ঞতার জন্য। এসবের বাইরে টুকটাক লেখালিখির সাথে জড়িত আছি। আমার লেখা কয়েকটি নাটক টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে আমার নির্মিত বাংলাদেশের প্রথম শ্যাডো পাপেট শো একটি চ্যানেলে প্রচারিত হচ্ছে। আর ছোটবেলা থেকেই আমি থিয়েটারে সাথে জড়িত।
প্রশ্নঃ আমরা জানি আপনি মিডিয়ার সাথে যুক্ত। অনেকে বলে থাকেন যে মিডিয়ার আশি ভাগ ছেলে সমপ্রেমী। এই বিষয়ে আপনার মতামত কি?
দেখুন কে সমপ্রেমী আর কে বিষমকামী এটা কখনো অন্য কোন ব্যক্তি নির্ধারণ করতে পারে না। এটা প্রকাশ করতে হয় নিজেকেই। পৃথিবীর সকল নীতিমালা এবং আইন অনুযায়ী একজন মানুষ কখনই বলতে পারে না যে “ঐ দেখ একজন গে/লেসবিয়ান হেঁটে যাচ্ছে” যতক্ষণ পর্যন্ত না ঐ ব্যক্তি নিজে সে কথা সকলের সামনে প্রকাশ করছেন। একটা ছেলে মেয়েদের মতো করে কথা বললে বা হাত-পা নাড়ালেই তাকে আমরা গে বা কতি বলতে পারি না। এই বিহেভিয়ার মানুষ সম্পূর্ণ ন্যাচারাল উপায়ে পেয়ে থাকে। এর উপর মানুষের স্বাভাবিক ভাবে কখনো কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এমন কি একজন মানুষের হঠাৎ করে তার সমলিঙ্গের অন্য মানুষের সাথে শারীরিক সম্পর্ক ঘটে যাওয়ার মানে এই না যে মানুষ দু’জন গে। অনেকে হয়তো সাময়িক আগ্রহ থেকে এমন কাজ করে থাকে। গে অথবা লেসবিয়ান শব্দটি একটি মানুষের সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশনই শুধু নয় এটি একটি সম্পূর্ণ লাইফস্টাইলের প্রতিনিধিত্ব করে। ছোটবেলায় প্রায় আমরা সবাই কমবেশি কাজিনদের সাথে কিছু সেক্সুয়াল অ্যাক্টে জড়িয়ে থাকি। কিন্তু তারপরে বড় হয়ে তাদের মধ্যে সবাই কিন্তু সমকামী হয়ে উঠে না। তেমনি হয়তো মিডিয়ায় একসঙ্গে কাজ করতে গেলে অনেকের এই জাতীয় অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে। কিন্তু তা থেকে এই প্রমাণিত হয় না যে তারা সকলেই সমপ্রেমী। একজন বিষমকামী ব্যক্তিও শখের বশত বা হঠাৎ প্রয়োজনে সমলিঙ্গের মানুষের সাথে শারীরিক ভাবে মিলিত হতে পারে। কিন্তু ঐ ঘটনার উপর ভিত্তি করে তাকে কখনোই সমকামী বলা যায় না। আর শুধু মাত্র মিডিয়াতে কেন, কমবেশি সব জায়গাতেই সমপ্রেমী লোকজন বিরাজ করে। হয়তো কোথাও সেটা প্রকাশ পায়, কোথাও পায় না।
প্রশ্নঃ আপনার সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন সম্পর্কে কিছু বলুন। আপনি কি হোমোসেক্সুয়াল না বাইসেক্সুয়াল?
……. সম্ভবত আমি পুরোপুরি ভাবে এর কোনটিই নই। আমি ওমোনিসেক্সুয়াল বা প্যানসেক্সুয়াল। এর মানে হচ্ছে, যেসব মানুষ জেন্ডার ব্লাইন্ড। যারা পৃথিবীর যেকোন জেন্ডার বা সেক্সুয়ালিটির মানুষের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে তাদেরকে প্যানসেক্সুয়াল বলা হয়।
সত্যিকার অর্থে আমি আসলে ভালোবাসায় বিশ্বাস করি। এখন সেই ভালোবাসা একটি ছেলের সাথে হতে পারে, একজন ক্রসড্রেসারের সাথে হতে পারে, ট্রান্সেক্সুয়ালের সাথে হতে পারে, হয়তো একজন নারীর প্রতি হতে পারে আবার হয়তো কোন জড় বস্তু যেমন একটি সিলিকন ডলের সাথেও হতে পারে। যেহেতু জীবনে এখনো পর্যন্ত সঠিক ভালোবাসার মানুষটির সন্ধান পাইনি তাই ইচ্ছে আছে ছয়, সাত হাজার ডলার জমিয়ে একটি মানুষ রূপক সিলিকন ডল বানিয়ে নিয়ে তার সঙ্গেই বাকি জীবন কাটিয়ে দেবো। কিন্তু হ্যাঁ, এখানে আরো একটি কথা থেকে যায়। আমি সাময়িক ভাবে কোন নারীর প্রতি হয়তো আকর্ষণ বোধ করলেও কখনোই কোন মেয়ের সাথে বিয়ে করে সংসার করার কথা ভাবতে পারি না। আমার জীবনে এমন কোন পরিকল্পনাও নেই। হয়তোবা এর প্রধান কারণ হল আমি কখনো কোন বাচ্চা অ্যাডপ্ট করতে চাই না। বিষয়টি আপনার কাছে খুব অবাক লাগতে পারে, কিন্তু হ্যাঁ এটাই সত্যি। বেশির ভাগ মানুষই জীবনে অন্তত একটি সন্তানের স্বপ্ন দেখে থাকেন, কিন্তু আমি এর বিপরীত। আমি যে ছোট বাচ্চা অপছন্দ করি তা কিন্তু নয়। কিন্তু আমি নিজে কখনো কোন বাচ্চা চাই না। জীবনে যা কিছু অর্জন করব, তা ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে শেষ করে তারপর মরবো। আর যদি পুরোপুরি শেষ না করতে পারি তাহলে কোন এতিমখানায় দান করে যাব। সে কারণেই আমি সমপ্রেমী জীবন বা গে লাইফস্টাইল চর্চা করি আর একজন পুরুষের সাথেই ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দেবার স্বপ্ন দেখি। তাই আপনি নিঃসন্দেহে আমাকে একজন সমপ্রেমী বলতে পারেন।
প্রশ্নঃ আপনার সমপ্রেমী জীবন সম্পর্কে আশেপাশের প্রায় সবাই জানে। আপনি প্রথম কিভাবে পরিবারের সদস্যদের কাছে আত্মপ্রকাশ করেছেন?
দেখুন, প্রথম কথা হচ্ছে যে আমি বিশ্বাস করি প্রতিটি মা’ই তার সন্তানদের সম্পর্কে প্রথম থেকে অবহিত থাকেন। কারণ সন্তান এবং তার মায়ের মধ্যেকার সম্পর্ক হচ্ছে নাড়ির সম্পর্ক। একজন মা প্রায় নয় মাস তার সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেন। তাই তার থেকে ভালোভাবে অন্য কারো সেই সন্তানকে বুঝতে পারার কথা না। হয়তো প্রায় সব মা’ই তার সন্তান সম্পর্কে প্রথম থেকেই সব কিছু অনুধাবন করতে পারেন, কেউ তা লুকিয়ে রাখেন আবার কেউ কেউ তা প্রকাশ করেন। আমার ধারণা যে আমার মা, ছোটবেলা থেকেই আমার সম্পর্কে বুঝতে পারতো।
আমি যে অনেক স্বাধীন চিত্ত পরিবারে বড় হয়েছি, তা কিন্তু নয়। আমার বাবা একজন মেরিন অফিসার এবং মা সাইক্রিয়াটিক কনসাল্টেশনের চর্চা ছেড়ে একটি স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল। আমার বাবা প্রায় সবসময়ই চাকুরীর সুবাদে দেশের বাইরে থাকতেন। তাই আমরা থাকতাম নানার কাছে। নানুবাসায় আমাদের যৌথ পরিবার বরাবরই অনেক রক্ষণশীল মনোভাবের ছিল। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে সব কাজিনদের একসঙ্গে পড়তে বসা, সন্ধ্যার আযানের আগে বাড়ি ফেরা, পারিবারিক বন্ধু ছাড়া বাসায় কখনো কোন বন্ধু না আনা, কোন মেয়ে বন্ধুর টেলিফোন অ্যালাউ না করা এসবের মধ্যে দিয়েই আমার ছোটবেলা পার হয়েছে।
তারপরেও আমি সবসময় বিশ্বাস করতাম যে নিজের ইচ্ছা ও সাহসটাই হচ্ছে সবচাইতে বড় সম্পদ। আমি নিজে যখন কোন ব্যাপারকে স্বাভাবিক ভাবে নিজের ভেতরে ধারন করবো তখনই আমি আমার সামনের মানুষটির কাছে সেই বিষয়টিকে স্বাভাবিক ভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হবো। নিজের ভেতর সাহস সঞ্চয় করাটাই সবচাইতে প্রধান বিষয়। যেই বিষয়ে আমি নিজে দ্বিধা বোধ করবো, তা আমি কখনোই অন্য কারো কাছে বিশ্বাস যোগ্য করে তুলে ধরতে সক্ষম হব না।
তাই আমি একদিন হঠাৎ করে অনেকটা নাটকীয় ভাবেই আমার সমপ্রেমী জীবন পরিবারের সদস্যদের সামনে তুলে ধরি। আমার ভাবখানা এমন ছিল যে এটা অতি সাধারণ এবং স্বাভাবিক একটি বিষয়। আমার সেই সাবলীল ভাবে উপস্থাপনের কারণেই পরিবারের লোকজন সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় এবং ঘটনাটিকে তারাও আস্তে আস্তে স্বাভাবিক ভাবেই নেয়া শুরু করে।
আমি তখনো স্কুলে পড়ি। আমার প্রথম বয়ফ্রেন্ড আমার সমবয়সী ছিল। একদিন হঠাৎ তাকে প্রথমবারের মতো আমার বাসায় নিয়ে এসে সবার সামনে ঠাট্টার সুরে বলে বসি যে “আম্মু ও হচ্ছে তোমাদের জামাই, আমার হ্যাসবেন্ড।” আমি এমনটি করবো তা কেউই আগে থেকে জানতো না, এমনকি আমার বন্ধুটিও না। আমার ঐ হাসি হাসি মুখে বলার কারণে কথাগুলোকে সবাই প্রথমে স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছিল। কিন্তু তার পরে আস্তে আস্তে তারা অনুধাবন করতে পারে যে আমার ঐ কথাটি আসলে কোন ঠাট্টা বা মশকরা ছিল না। কিন্তু ততদিনে আমার বন্ধুটি সবার সাথে মিশে পরিবারের একটি অংশ হয়ে গিয়েছিল তাই আর কারোই কিছু বলার অবকাশ ছিল না।
আমার আর ওর সম্পর্কটি অনেক গোছানো এবং সুন্দর ছিল। ও ছিল একজন অতি ভদ্র ছেলে তাই আমার মা’ও তাকে অনেক ভালোবাসতো।
এভাবেই সবার কাছে সব কিছু আমি আস্তে আস্তে অনেক স্বাভাবিক করে তুলি। হ্যাঁ সময় অবশ্যই লেগেছে, কিন্তু আমি আমার ধৈর্য্য কখনো হারাইনি।
প্রশ্নঃ আপনার মা আপনার এই জীবনকে স্বাভাবিক চোখেই দেখেন?
না। এটা অনেক দুঃখের বিষয় যে এখন আর তিনি সব কিছু আগের মতন স্বাভাবিক চোখে দেখেন না। কারণ হচ্ছে যে, আমার প্রথম সম্পর্কের সময় আমি ছিলাম নিতান্তই ছোট। ভালো মন্দ বাছবিচারের জ্ঞান তখনও আমার পুরোপুরি হয়ে ওঠেনি। কলেজে ওঠার পরে আমরা ঐ সম্পর্কের ইতি টানতে বাধ্য হই অত্যন্ত বাজে ভাবে। আমাদের ব্রেক-আপটি ছিল দুই পরিবারের জন্য বড় একটি ডিজাসটার।
এর পর থেকে আমার মা’র মনে দৃঢ় ধারনা হয়েছে যে সমপ্রেমী সম্পর্ক কখনোই টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তাই সে এর উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। তাই তার ধারণা আমি যদি বিষমকামী হয়ে যাই তাহলে জীবনে সুখী হতে পারবো। আর না হয় প্রতিবারই সমস্যায় পড়তে হবে। :v
কিন্তু এটিতো আর সম্ভব নয়। সে আমার সম্পর্কে সবকিছুই জানে কিন্তু আপাতত মানতে চায় না। হয়তোবা জীবনে যদি কারো সাথে সুখী হতে দেখে তাহলে হয়তো আবারো মেনে নেবেন।
প্রশ্নঃ ঐ প্রথম সম্পর্কের পরে কি আপনার জীবনে আর কখনো কোন প্রেম আসেনি ? আর আপনিতো প্রায় ছোটবেলা থেকেই থিয়েটারের সাথে আছেন, সেখানে কাজ করবার সময় কি কখনো কারো সাথে সখ্যতা গড়ে উঠেছে?
জী এসেছে এবং গড়েও উঠেছে। আপনার এই দু’টো প্রশ্নের উত্তর প্রায় একসাথেই দেয়া যায়। আমি প্রথম ব্রেক-আপের পর প্রায় অনেক দিন একাই ছিলাম। বলতে পারেন প্রায় নার্সিসাস হয়ে গিয়েছিলাম। আমার থিয়েটারে একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। ওর সাথে বন্ধুত্বের প্রায় চার-পাঁচ বছর পরে ও হঠাৎ করে আমার সাথে অন্য রকম ভাবে ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করে এবং একদিন হঠাৎ প্রেম নিবেদন করে বসে। তারপর আস্তে আস্তে তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ও ছিল আমার জীবনের পরিনত বয়সের প্রথম ভালোলাগা। প্রথম প্রথম আমি তাকে আমার বন্ধু ছাড়া আর কিছু ভাবতেই পারতাম না। কিন্তু তার পাগলামি আর ভালোবাসায় এক পর্যায়ে আমিও তাকে ভালোবাসতে বাধ্য হই।
কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য বশতঃ একদিন হঠাৎ করে একটি অ্যাকসিডেন্টে সে আমাদের সবাইকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে যায়। যেখান থেকে ফিরে আসা আর কখনোই সম্ভব নয়। চলে যাবার সময় প্রতিটি মুহূর্তই আমি তার পাশে ছিলাম। তার পাশে বসে থাকা, তাকে গোসল করানো, এমনকি কবরে নামা পর্যন্ত। আমার কাছে মনে হচ্ছিল যেন আমি একটি স্বপ্ন দেখছি . . . ভয়ঙ্কর কোন এক দুঃস্বপ্ন। ঘুম ভাঙ্গলেই সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি কিছুই ঠিক হয়নি। সবকিছুই শেষ . . .
এই ঘটনার পরে আমার স্বাভাবিক হতে অনেক সময় লেগেছে। কিন্তু জীবন কখনোই থেমে থাকেনা। আমিও থেমে নেই। এখন বলতে পারেন প্রায় সবকিছুই স্বাভাবিক। সময় সব ক্ষতই পূরণ করতে সক্ষম।
প্রশ্নঃ বর্তমানে আপনি আমাদের কমিউনিটির কি কি কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন ?
আমার এক বন্ধুর সাথে মিলে একটি অনলাইন মুভি লাইব্রেরির দেখাশোনা করছি, যেখানে দেশ-বিদেশের নানান রকম এল.জি.বি.টি কাহিনী নির্ভর চলচ্চিত্র সংরক্ষণ করা হয়। তিনটি ফেসবুক পেজের অ্যাডমিন হিসেবে নিযুক্ত আছি। আনন্দ ধারার গল্প অবলম্বনে নির্মিত একটি সমপ্রেম কাহিনী নির্ভর সংক্ষিপ্ত চলচ্চিত্রে অভিনেতা হিসেবে কাজ করছি। বয়েজ অব বাংলাদেশে ভলান্টিয়ার হিসেবে যুক্ত আছি। রূপবানের বিভিন্ন ইভেন্টে ভলান্টিয়ার হিসেবে টিকে থাকার চেষ্টা করছি।
প্রশ্নঃ আমাদের মধ্যে “কমিউনিটি” শব্দটির ব্যবহার নিয়ে অনেকের মধ্যে আপত্তি আছে। অনেকে বলেন যে স্ট্রেইটদের তো কোন আলাদা কমিউনিটি নেই, তাহলে আমাদের কেন থাকবে ? এই বিষয়ে আপনার কি বলার আছে ?
প্রথম কথা হচ্ছে আমি এই স্ট্রেইট শব্দটি ব্যবহারের বিরুদ্ধে। সেইজন্যই আমি আমার উত্তর গুলোতে বারবার বিষমকামী বা হেটারোসেক্সুয়াল শব্দটি ব্যবহার করেছি। আমরা বাঁকা নই যে অন্য মানুষদেরকে স্ট্রেইট বলতে হবে।
দ্বিতীয় কথা এই যে, আমাদের মধ্যে জ্ঞান চর্চা করার ইচ্ছের বড়ই অভাব। কিছু মানুষ সবসময় নিজের মতামত জাহির করতে আনন্দ বোধ করেন। এটা দোষের কিছু না। কিন্তু কোনো বিষয়ে মতামত প্রকাশ করার আগে সেই বিষয়ে নূন্যতম ভাবে হলেও যে কিছু জেনে নিতে হয়, তা বরাবরই তারা ভুলে যান।
কে বলেছে যে বিষমকামীদের কোন কমিউনিটি নেই ? সেই ব্রিটিশ আমল থেকে ইংরেজ কমিউনিটি, পারসী কমিউনিটি, আর্মি কমিউনিটি, হিন্দু কমিউনিটি, মুসলিম কমিউনিটি এবং ব্যাচেলর কমিউনিটি পর্যন্ত আমাদের সমাজে প্রচলিত। এমনকি বিষমকামীদের যেখানে বিয়ে হয়, সেই জায়গাকে পর্যন্ত কমিউনিটি সেন্টার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কথাটি আমি ফান করে নয়, বরঞ্চ বোঝানোর সুবিধার্থে ব্যবহার করলাম।
আপনাকে বুঝতে হবে যে কমিউনিটি শব্দটি আমাদেরকে দুর্বল বা আলাদা করার জন্য নয় বরঞ্চ আমাদের মানুষজনকে একত্রিত ও শক্তিশালী করার জন্যে ব্যবহার করা হয়। সমাজে যখন আপনি একা সকলের থেকে আলাদা হয়েও নিজের মৌলিক অধিকার নিয়ে বসবাস করতে যাবেন, তখন আপনাকে বারবার ব্যর্থ হতে হবে। কিন্তু একই রকম কিছু মানুষ যখন একসাথে একত্রিত হয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবেন, তখন কেউ যত শক্তিশালীই হোক না কেন, সে আপনার কোন ক্ষতি করবার আগে অন্তত একবার হলেও চিন্তা করতে বাধ্য হবে।
প্রশ্নঃ আপনি কি পলিগ্যামী না মনোগ্যামী ?
আমি রিলেশনশীপে বিশ্বাসী এবং রিলেশনের ক্ষেত্রে অবশ্যই মনোগ্যামী। কিন্তু রিলেশনশীপে না থাকলে কিছুটা পলিওমোরী। মানে যারা একসঙ্গে একাধিক মানুষের প্রতি প্রেম অনুভব করে।
প্রশ্নঃ আপনি সাধারণত কোন ধরণের মানুষদের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন ?
আমি সাধারণত সব বয়সের ক্রিয়েটিভ, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং বুদ্ধিমান মানুষদের প্রতি আকর্ষণ বোধ করি। আমার ভালোলাগার নির্দিষ্ট কোন বয়সসীমা নেই। তারপরেও যেটা অনেকের অপছন্দ, কিছুটা গার্লিশ ও ট্যুইঙ্ক টাইপের ছেলেদের প্রতি আমার বিশেষ অনুভূতি কাজ করে।
প্রশ্নঃ অনেকেই বলে যে আপনি প্রচন্ড রকম অ্যালকোহলিক এবং নিজের বাড়িতে ওয়াইন তৈরি করেন। এই বিষয়ে আপনার কি বলার আছে?
আমার অ্যালকোহলের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা আছে, এই কথা সত্য। আমার সবচাইতে প্রিয় তিনটি জিনিস হচ্ছে অ্যালকোহল, পারফিউম ও চকলেট। যে কেউ আমাকে এই সব জিনিস উপহার হিসেবে দিলে আমি অনেক খুশি হয়ে যাই। কিন্তু আমি সবসময়ই সবকিছুর উপর অনেক কন্ট্রোল রাখতে পারি। সেটা সেক্স লাইফ হোক অথবা অ্যালকোহল। আমি সিজনালি বাসায় ওয়াইন তৈরি এবং তা সংরক্ষণ করি। আমার এক বন্ধুর কানাডায় ওয়াইনের ব্যাবসা আছে, তার কাছ থেকেই আমার এই বিদ্যা অর্জন করা। কিন্তু আমি প্রতিদিন মদ্যপান করি বা মদ খেয়ে নিত্য দিন মাতলামি করি, একথা কখনোই কেউ বলতে পারবে না।
প্রশ্নঃ আমরা শুনেছি যে আপনার সাইকোলজিক্যাল কনসাল্টেশনের উপর কিছু অভিজ্ঞতা আছে সেটা কিরকম?
আমম . . . এটা আমার জীবনের আরো একটি মজার অধ্যায়। আপনাকে পূর্বেই বলেছি যে আমার মা একসময় সাইকোলজিক্যাল কনসাল্টেশনের চর্চা করতেন। তার কাছ থেকে আমার, মানুষের মনস্তত্ত্বের অনেক মজার মজার বিষয় শেখা হয়েছে। এর বাইরে পরিবারে আমার অনেক ঘনিষ্ঠ এক খালা এবং কাজিন হচ্ছেন সাইক্রিয়াটিক। আমরা একই বাসায় বহুদিন থেকেছি। আমার খালার বয়স অনেক বেশি হলেও আমরা একে অপরের অনেক ভালো বন্ধু। তার কাছে প্রায় সময়ই বিভিন্ন রকম সুইসাইডাল কেস আসতো যার বেশির ভাগ ভিক্টিম থাকতো প্রায় আমার বয়সী। আমাদের দেশের টিনেজাররা খুব সহজে বা কম সময়ের মধ্যে বয়স্ক কারো সাথে ক্লোজ হতে পারে না। তাই আমার সেই খালা আমাকে মিডিয়াম বানিয়ে মাঝে মাঝে ভলান্টিয়ারি কাজ করাতেন। সমবয়সী হবার কারণে ভিক্টিমরা আমার সাথে অল্পতেই ক্লোজ হয়ে যেত এবং অনেক কথা শেয়ার করতো যা কিনা আমার খালার কাছে বলতে সঙ্কোচ বোধ করতো। এভাবে প্রায় কয়েক বছর আমি আমার সাইক্রিয়াটিক খালার সহকারী হিসেবে কাজ করেছি। এসব কারণে আমার মনোবিজ্ঞানের উপর আগ্রহ অনেক বেশি। আমি একটি উপন্যাসের চাইতেও একজন মানুষের মনের বিভিন্ন দিক জানতে বেশি আগ্রহ বোধ করি।
প্রশ্নঃ আমাদের কমিউনিটির মানুষদের কোন ব্যাপার আপনার সবচেয়ে অপছন্দ ?
বেয়াদবি এবং শিষ্টাচারের অভাব। অনেকের মধ্যে একটি কমন প্রবনতা কাজ করে যে ছোট বড় সবাইকে তার পারমিশন ছাড়াই তুমি করে ডাকার। আমি নির্দিষ্ট ভাবে কাউক ইঙ্গিত করে বলছি না কিন্তু অনেকে আবার বলে যে “আমি কাউকে আপনি করে ডাকতে পারিনা”। আমি জানিনা যে তাদের বাসায় তাদেরকে ছোটবেলায় কি শিষ্টাচারের পাঠ শেখানো হয়েছে। এর একটি সাইকোলজিক্যাল ব্যাখ্যা হচ্ছে যে একজন মানুষকে “তুমি” করে ডাকলে অনেক দ্রুত তার গায়ে হাত দেয়া সহজ হয়ে যায়। কিন্তু আমাদেরতো আসলে সব সিনিয়রদের বেডরুম পর্যন্ত যাবার কোন দরকার নেই।
আমাদের কমিউনিটির বড়দের সবচাইতে ভালো দিক হচ্ছে যে তারা অনেক বেশি বন্ধুসূলভ। কেউ তাদের সাথে বন্ধুর মতন করে কথা বললে তারা কখনোই কিছু মনে করেন না। কিন্তু সকলের মনে রাখা উচিত যে বন্ধু আর ক্লাসমেট কখনো এক জিনিস নয়। যেকোনো বয়সের মানুষই আমার বন্ধু হতে পারে, কিন্তু তাই বলে যে সে আমার আর তার বয়সের ব্যবধানটি ভুলে যাবে তা কিন্তু কিছুতেই কাম্য নয়।
প্রশ্নঃ আমাদের দেশের অনেক সমপ্রেমী মানুষ অধিকারের পক্ষে, আবার অনেকে এই অধিকারের বিপক্ষে। আপনি কোনটা সমর্থন করেন এবং কেন?
স্বাভাবিক ভাবেই একজন সমপ্রেমী মানুষের মাথায় কাজ করে যে, কি দরকার এত আদিখ্যেতার ? আমরা যেমন আছি তাতে খারাপটা কি ? এখনও তো চলতে পারছি, ফিরতে পারছি, গোপনে গোপনে বাসায় পার্টনারকে এনে যা ইচ্ছা হয় তাই করতে পারছি। কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে তাহলে বন্ধু বলে কথা পাশ কাটিয়ে দিতে পারছি। যখন সমাজের সবাই জানতে পারবে তখন তো এসব বন্ধ হয়ে যাবে। ফ্যামিলি মেম্বারদের সামনে মুখ দেখাবো কি উপায়ে ?
প্রতিটি মানুষই জীবনে মাথা উঁচু করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। একজন মানুষ জন্মের পর থেকে স্বাভাবিক ভাবেই তার ফান্ডামেন্টাল রাইটস বা মৌলিক অধিকার গুলো পেয়ে থাকে। মানুষ তার জীবনের সবচাইতে কাছের লোকটির হাতে হাত রেখে সবার সামনে সন্মানের সাথে দাঁড়াতে চায়।
গোপনে গোপনে চোরের মতোন সবকিছু করে যাওয়াও জীবন, আবার নিজের বেঁচে থাকার অধিকার নিয়ে আর দশটা মানুষের মতন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকার নামও জীবন। এখন আপনি সিদ্ধান্ত নিন যে কোনটা সঠিক ? চোর হয়ে বেঁচে থাকা, নাকি স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে থাকা। যতক্ষণ পর্যন্ত সমাজে সমপ্রেমীদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত আপনি একজন অপরাধী। আপনার অপরাধ, কেন আপনি এভাবে জন্মালেন। যেকোনো সময় রাষ্ট্র বা আপনার আশেপাশের লোকজন আপনাকে অপরাধী প্রমাণ করে সারাজীবনের জন্যে জেলে ঢুকিয়ে রাখতে পারে। আপনি কি তা মেনে নেবেন ? আমরা তো কোন অপরাধ করি নি। আমরা শুধু আমাদের মতন করে বাঁচতে চেয়েছি, তাহলে কেন আর দশটা মানুষ আমাদের দিকে আঙুল তুলে বলার সুযোগ পাবে যে “ঐ দেখ পশুর চাইতেও নিকৃষ্টতম প্রানী যায়। ওদের হত্যা করলে সোওয়াব হবে। ওদের কে পুড়িয়ে মারো। কুত্তা দিয়ে চো* খাওয়ানো হোক।” এই কি আপনার মনুষ্য জীবনের প্রাপ্তি ? এটাই আপনার সমাজের কাছ থেকে চাওয়া পাওয়া ? আপনার নিজস্ব জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আপনি কেন অন্যকে দেবেন ? মানুষ হয়ে যেহেতু জন্মেছি, তাই আর সব মানুষের মতন করে বাঁচতে চাওয়ার অধিকারও আমার আছে। এবং সেই অধিকার আমি চাই।
প্রশ্নঃ সমপ্রেমী জীবন ব্যবস্থা নিয়ে আপনার মন্তব্য কি? আপনার কি এই জীবন নিয়ে কোন ক্ষোভ বা আক্ষেপ রয়েছে ?
আমি আমার জীবনে যেমন আছি, মোটামুটি ভাবে ভালো আছি। যাতে আরও ভালো থাকতে পারি তাই নিজের অধিকার গুলো নিশ্চিত করতে চাই। আর নিজের জীবন ব্যবস্থাকে নিজেদেরই নির্ধারণ করতে হয়। একই রকম চিন্তার মানুষ হলেই যে সবার জীবনের গতি এক হবে, তা কিন্তু নয়। তাই সকলেরই উচিৎ যার যার নিজস্ব পছন্দ, অপছন্দ বিচার করে জীবনটাকে সাজানো। আমি কখনো অন্য কারো দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে নিজের মতন করেই চলতে পছন্দ করি। আমার যা ইচ্ছে হয়, অন্যের কোন ক্ষতি না করে আমি ঠিক সেভাবেই চলবো। এতে সমাজের মানুষজন কি চিন্তা করছে, তা আমার দেখবার বিষয় নয়। আমি বিশ্বাস করি যে মানুষের সুবিধা বা উপকারের জন্যই সমাজ, কিন্তু সমাজের উপকারের জন্য মানুষ নয়। যেই সমাজ আমার কোন উপকারে না এসে বরঞ্চ অপকার করতে চায়, তাকে আমার তোয়াক্কা করার কোন কারণ দেখি না। এবং আমি সমপ্রেমী এটা নিয়ে আমার মধ্যে কোন প্রকার ক্ষোভ বা হতাশা নেই। আমাকে এমনটি স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই তৈরি করে পাঠিয়েছেন। তাই আমি আমার নিজের জীবন নিয়ে সবসময় গর্ব বোধ করি।
প্রশ্নঃ আপনি আপনার জীবনে কি কি ভালো কাজ করেছেন বলে মনে করেন?
এই কথা তো আমার চাইতে বেশি জনগন বলতে পারবেন। নিজের গুনের গল্প নিজে কি করে বলি, যাহ !!! লজ্জা লাগে।আমি কখনোই কারো উপর কোন চাপ প্রয়োগ করিনি। যখন আমি কোন কাজ করি বা সহকারীদের দ্বারা কাজটি করাই তখন সম্পূর্ণ ভাবে সবাইকে স্বাধীনতা দান করার চেষ্টা করি।আমাদের নিজেদের কেউ কোন বিষয়ে সহযোগিতা চাইলে, প্রফেশনাল চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে সেই কাজের একটি অংশ হবার সর্বাত্মক চেষ্টা করি।
কেউ আমাকে কষ্ট দিলে বা ক্ষতি করলে তার উপর কখনো সচরাচর পাল্টা প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করি না।একজন মানুষ আমার নামে মিথ্যা কথা অনবরত বলেই যাচ্ছে, বা কারো কোন ভুল সিদ্ধান্তে আমি কষ্ট পেলেও তাকে সেটা না বুঝতে দিয়ে আমি আমার মতন কাজ করে যাই। আমার একটি ভালো দিক হচ্ছে আমি সহজে কাউকে বদনাম করতে চাই না। আমি চাইলে এই ইন্টারভিউয়ে অনেকের কনট্রোভার্সিয়াল কাজ কর্মের কথা ফাঁস করে তাসলিমা নাসরিন বা সিল্ক হয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু সমাজ পরিবর্তনের দায় আমি নিয়ে বসিনি। আপনি যতই চেষ্টা করুন না কেন প্রত্যেক যুগেই সমাজে নতুন নতুন অসঙ্গতি ছিল এবং তা থাকবেই। এর পরিবর্তন কখনোই সম্ভব নয়।
আমি মনে করি যে পৃথিবীর কেউই সবার কাছে ভালো হতে পারে না। আমি একজনের কাছে খারাপ বলেই আরেক জনের কাছে ভালো। তাই কেউ আমার নামে আরেক জনের কাছে খারাপ কথা বললেও আমি কখনোই সেটার তোয়াক্কা না করে বরং বিষয়টা উপভোগ করি এবং নিজেকে খুব প্রিভিলেইজড মনে করি।
আমি নিজেকে বাংলাদেশের সমপ্রেমীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের একটি সক্রিয় অংশ হিসেবে চিন্তা করতে পছন্দ করি। এই আন্দোলন করার জন্য কাউকে আপাতত রাস্তায় নামার কোন দরকার নেই কিন্তু ভেতরে বিশ্বাস স্থাপন করাই যথেষ্ট। অন্তত নিজেকেই একবার বলুন যে আমি আমার অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে।
প্রশ্নঃ কিভাবে সমপ্রেমী জীবনে পজিটিভ থাকা যায় ?
জীবনে আপনি যেই পর্যায়েই থাকুন না কেন, খুশি থাকার চেষ্টা করুন। লোকলজ্জার কথা একেবারেই ভুলে যান, নিজের জন্যে সমস্যা ডেকে এনে আরেক জনের চিন্তা করে লাভ নেই। কখনো সৃষ্টিকর্তাকে দোষারোপ করবেন না, কারণ তিনি আপনাকে সুন্দর করে আপনার মতনই তৈরি করেছেন। দোষ তার নয়, দোষ হচ্ছে মানুষের, যারা আপনাকে আপনার নিজের সৃষ্ট দুর্বলতার কারণে বৈষম্যের কাতারে ফেলে দেয়। মনে রাখবেন আপনার সবচাইতে বড় শত্রু স্বয়ং আপনি নিজেই। মানুষ নিজেই নিজেকে হতাশ করে দেয়। তাই আপনার ভেতরকার দুর্বলতাকে চিহ্নিত করে তার মুকাবিলা করুন। আর সবচাইতে বড় বিষয় হচ্ছে . . . সবার প্রথমে নিজেকে ভালোবাসুন।
আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ এমন সঠিক আর সত্য উত্তর দেওয়ার জন্য।
জী, আপনাকে এবং সেই সঙ্গে আমাদের পাঠকবৃন্দকে জানাচ্ছি অনেক অনেক ধন্যবাদ, এতো সময় ধৈর্য্য ধরে এবং কষ্ট করে এই লেখাটা পড়বার জন্যে। হয়তো আরো অনেক কিছুই বলা বাকি রয়ে গেল, কারণ ইন্টারভিউটি এর থেকেও বেশি লম্বা করতে গেলে পাবলিকের মার খাওয়া ছাড়া আর কোন গতি থাকত না।
যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি আমার কোন ভুল উত্তরের কারণে অন্যের ব্যক্তিগত বিষয় না জড়িয়ে আবার নতুন কোন সমালোচনার ঝড় না ওঠাবার। জানিনা যে কতটুকু সফল হতে পেরেছি। যদি এর পরেও আমার কোন উত্তরে কেউ মানসিক ভাবে আঘাত পেয়ে থাকেন, তাহলে কিছুটা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। সবাই ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন . . . বিদায়!
(সাক্ষাৎকার শেষ)
যেখানেই আছো তনয়, ভালো থেকো।