কৈশোর এবং বুলিং

লেখকঃ অরণ্য রাত্রি

বেশিরভাগ মানুষ কে যখন প্রশ্ন করা হয় আপনার জীবনের গোল্ডেন পিরিয়ড অথবা শ্রেষ্ঠ সময় কোনটি? তারা বলে, স্কুল জীবনের কথা। কিন্তু কিছু হতভাগ্য মানুষ আছে যাদের কাছে স্কুল জীবন এক নারকীয় জীবন ছিল। কিন্তু কেন? বুলিং এর অভিশপ্ত ছোঁয়ায় সেই সময়টুকু একটি কালো অধ্যায় হয়ে থাকে তাদের জীবনে। যার কথা তারা মনে করতেও চায় না। 

এক পানাপুকুরে কয়েকটি ব্যাঙ বসবাস করত। কতিপয় দুষ্টু বালক ঢিল ছুঁড়ে ব্যাঙগুলোকে আঘাত করত প্রতিনিয়ত। এটি ছিল তাদের কাছে এক মজার খেলা। একদিন এক ব্যাঙ খেলার মুহূর্তে সাহসভরে পানাপুকুর থেকে উঠে এসে বালকদের বলল, তোমরা এটা করছ কেন? জনৈক বালক বলল, আমাদের কাছে এ এক মজার খেলা। ব্যাঙ বলল, ‘তোমাদের কাছে যা খেলা, আমাদের কাছে তা-ই মরণ।

উপরের শেষ লাইনটা বুলিং এর ক্ষেত্রে খুবই প্রযোজ্য। নব্বই দশকের একজন কিশোরের কথা শুনি। ছেলেটি খুব চুপচাপ এবং অন্তর্মুখী ছিল। তেমন কোন বন্ধু বান্ধব তার ছিল না। হঠাৎ করে ক্লাস সেভেনে উঠার পর সেই ছেলেটিকে নিয়ে ক্লাসে অন্যান্য সহপাঠীরা হাসি ঠাট্টা, এক কথায় বুলিং শুরু করলো। প্রথমে সে বুঝতো না সমস্যা টা কোথায়। তার মাঝে নাকি মেয়েলী ভাব রয়েছে। কিন্তু সে নিজের মাঝে তা খুঁজে পায় না। সবাই মেয়েদের দেহ  সৌন্দর্য নিয়ে আলোচনা করে। কিন্তু তার তো ভাল লাগে পুরুষ দেহ। কেন সে এমন! তার উত্তর সে খুঁজে পায় না। তার উপর চলতে থাকে বুলিং এর স্টিম রোলার। জীবনটা থমকে যায় তার কাছে। পড়াশোনা, টিভি কিছুই তার ভালো লাগে না। স্কুল হয়ে যায় দোজখের মত একটি আতঙ্কের জায়গা।তখন ইন্টারনেট কিন্তু সহজলভ্য ছিল না। ছেলেটি মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পরে। কিন্তু বাসার কেউ তা বুঝতে চায় না বা বুঝতে পারে না। তারপরও ছেলেটি আত্মহত্যা করে নাই। 

নব্বই দশকের অসংখ্য ছেলের স্কুলজীবন এরকম বিভীষিকাময় ছিল। আসুন চলে আসি বর্তমানে।

কিশোররা মনে হয় একটু বেশি নিষ্ঠুর হয়। তাই কৈশোরে বুলিং সবচেয়ে বেশি হয়। যখন একজন সমকামী ব্যক্তি কৈশোরে পদার্পণ করে তখন অনেকের মাঝেই  অন্যদের চেয়ে কিছু ভিন্নতা দেখা যায়। যেমন কিছুটা মেয়েলিপনা দেখা যায়। কিন্তু প্রথমে সে নিজে বুঝে না তার এই ভিন্নতার ব্যপারটা। কিন্তু যখন যৌনতার কথা আসে তখন সে অবাক হয়ে ভাবে সে কেন পুরুষ হয়েও পুরুষে আসক্ত? নারী তে নয়। কিন্তু এখন স্মার্ট ফোনের কারণে ইন্টারনেট এখন সবার হাতে হাতে। তাই তার সেই আইডেন্টিটি ক্রাইসিস কেন তা খুঁজে পেতে সময় লাগে না। কিন্তু সে ভীত হয়ে পড়ে, সে কেন অন্যদের চেয়ে আলাদা। সে আরও বেশি বেশি নিজেকে স্কুলে, প্রতিবেশীদের মাঝে এবং বাসায়  খাপ খাইয়ে নিতে চায়। কিন্তু প্রকৃতি মানুষ কে যা দিয়েছে তা তো থাকবেই। এইভাবে পরিবর্তিত হওয়া কি আসলেই সম্ভব? সমাজবিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীর ১০ ভাগ মানুষ সমকামী। আর তারা প্রাকৃতিক ভাবেই সমকামী। তারা চেষ্টা করেও পরিবর্তিত হতে পারে না। 

এখন আসি বুলিং এর ব্যাপারে। এই কিশোরের হাঁটা চলা ফেরা , কথা বলার ভঙ্গি অন্য সহপাঠীদের মাঝে হাসির খোরাক হয়ে উঠে। শুধু তা হলেও না হয় বুঝতাম। কিন্তু তারা দিনের পর দিন তাকে অপদস্থ , হয়রানি  করা শুরু করে। তারা নানা ভাবে তাকে বুলিং করে। এই বুলিং  কিন্তু অনেক প্রকার হয়। যেমন মৌখিক, শারীরিক , সামাজিক এবং সাইবার বুলিং।

মৌখিক বুলিং যেমন তাকে নেতিবাচক, সম্মান হানিকর কোন নামে ডাকা, যেমন হাফ লেডিস। তারপর জুনিয়র ছেলেদের সামনেও নানারকম সম্মানহানিকর কথা বলা। দেখা যায় যে সেই কারণে ছেলেটা টিফিন টাইমে লজ্জায় ক্লাস থেকে বের হয় না।ক্যাফেটেরিয়া তে যায় না। মাঠে খেলতে যায় না। কিংবা ছুটির সময় দৌঁড়ে স্কুল থেকে বের হয়ে যায়,য়যাতে জুনিয়রদের সামনে অপদস্থ না হতে হয়।

শারীরিক ভাবেও নানা ভাবে তাকে অপদস্থ করা হয়। প্রতিবাদ করলে তারা গায়ে হাত তুলে জোটবদ্ধ ভাবে। এতগুলো ছেলের সাথে একজন পেরে উঠা সম্ভব না। কেউ কেউ হয়তো শার্ট এর পিছনে চুইংগাম লাগিয়ে দেয় অথবা লিখে রাখে হাফ লেডিজ।

ক্লাসে সে সম্পূর্ণ একলা হয়ে যায়। যারা তার সাথে মিশতে চায় তারাও মনে মনে ভাবে তারা ওর সাথে মিশলে তারাও হয়তো বুলিং এর শিকার হবে। কোন আড্ডা খেলাধুলায় কেউ তাকে ডাকে না সচারচর।

প্রতিবেশীদের সাথেও একই অবস্থা। মাঠে খেলতে যায় না। চুপচাপ বাসাতেই বিকেল বেলাটা কাটিয়ে দেয়। 

এরপরও শান্তি নেই। নতুন যুক্ত হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। সাইবার বুলিং। মেসেজ , ইমেইল তো রয়েছেই। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর হল সোশ্যাল মিডিয়া তে মর্যাদাহানিকর পোস্ট ।

বাবা মায়ের সাহায্য বা শিক্ষকের সাহায্য সব সময় সম্ভব হয় না। বাবা মা কে বলতে অনেকেই ভয় পায় যদি বাবা মা কোন ভাবে জেনে যায় সে সমকামী। আর আমাদের দেশের মানুষ এখনো অনেক রক্ষণশীল । তারা এখনো সমকামিতা মেনে নেয়াতে অভ্যস্ত হয় নি। আবার কেউ যদি নিজে থেকে বাবা মা কে বলে তাহলেও তারা ভাবে তাদের সন্তান অসুস্থ এবং ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু আমেরিকান সাইক্রিয়াটিক এসোসিয়েশন ১৯৭৩ সালে ঘোষণা করেছে যে সমকামিতা কোন রোগ নয়। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৯০ সালে সমকামিতা কে রোগের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছে। 

আর অনেক বাবা মা এসব বুলিং কে হাল্কা ভাবে নেয়। মনে করে বাচ্চা ছেলেদের মজা রসিকতা, এগুলো তার সন্তানের উপর আর কি এমন প্রভাব ফেলবে? আর এই ধরণের বুলিং তো তারাও ছোট বেলায় দেখে এসেছে কিংবা তারাও হয়তো অংশ নিয়েছে। শত হোক বুলিং এখন একরকম ঐতিহ্য হয়ে পড়েছে। 

কৈশোরে যারা বুলিং এর শিকার হয় তাদের মানসিক অনেক ধরণের সমস্যা দেখা দেয়,যেমন বিষণ্ণতা , দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়া , হীনমন্যতায় ভোগা , হতাশ হয়ে যাওয়া। এই সকল সমস্যা গুলো পরবর্তী জীবনেও প্রভাব ফেলে। 

কৈশোরে শারীরিক ক্ষত যত দ্রুত সেরে যায় কিন্তু মানসিক ভাবে আঘাত পেলে তা সারতে সময় লাগে। বুলিং এর শিকার হয়ে অনেকের সেলফ ইমেজ  পুরোপুরি পঙ্গু হয়ে যায়। অনেকের ভিতর ধীরে ধীরে এমন ভয় ঢুকিয়ে দেয়া হয় যে সে নিজেকে আর সক্রিয় , আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে মনে করে না। বরং এক সময় নিজে কে  ঘৃণা করা শুরু করে। আর এটাই বুলিং এর সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক।

 কারো কারো মাঝে মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হয়। কেউ কেউ আত্মহত্যার প্রচেষ্টা করে। আবার কেউ কেউ সফল হয় যা খুবই দুঃখজনক। কিশোরদের মৃত্যুর সর্বাধিক কারণের মাঝে তৃতীয় হল আত্মহত্যা। আর সমকামীদের মাঝে তা আরও বেশি । প্রায় ২গুন বেশি। 

এই সকল কারণে কারো পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কেউ স্কুল যাওয়া ছেড়ে দেয়। ধূমপান, মাদক নেয়া শুরু করে। একটা কথা ভেবে কষ্ট লাগে বিষমকামীদের থেকে সমকামীরা অনেক গুন বেশি বুলিং এর শিকার হয়।

কিন্তু আশার কথা হল এখন ইন্টারনেটের কারণে পুরো দুনিয়াটা হাতের মুঠোয়। এখন স্কুলে পড়া ছেলেরাও জানে সমকামিতা কি। সোশ্যাল মিডিয়া এবং বিভিন্ন প্লাটফর্মের মাধ্যমে তারাও খুঁজে নিচ্ছে তাদের পছন্দের মানসিকতার বন্ধু। যার কাছে তারা কথা গুলো শেয়ার করতে পারবে। একটু খানি স্পেস পাবে। একটু  নিঃশ্বাস নিতে পারবে। আর যারা নতুন করে এইসব প্লাটফর্মে আসবে তাদের কে সাহায্য করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।যতখানি পারা যায় কাউন্সেলিং করতে হবে। কিভাবে এই বুলিং কে প্রতিরোধ করা যায় সেই ব্যাপারে সাহায্য করা। আত্মহত্যা প্রবণ যারা তাদের কে একটু খেয়াল রাখা , একটু বেশি কেয়ার করা কিন্তু সবার দায়িত্ব। 

বুলি করা প্রতিরোধ করার জন্য কি কি করা যায়?

• যে বুলিং করছে তাকে উপেক্ষা করা

• বডি ল্যাংগুয়েজ এমন হবে যেন অন্যরা তাকে কনফিডেন্ট মনে করে

• কখনো হাতাহাতি বা রেগে গিয়ে শারীরিক কোন ঝগড়ায় লিপ্ত না হওয়া 

• সত্যিকারের বন্ধু যাকে বিশ্বাস করা যায় তার কাছে সব কিছু শেয়ার করা

• এমন কারো সাথে এই ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করা যে  সাপোর্ট , পরামর্শ দিতে পারবে এবং কাউন্সেলিং করতে পারবে। 

• ক্লাসে আর কেউ বুলিং এর শিকার হলে তার পাশে দাঁড়ানো 

• সাইবার বুলিং এর ক্ষেত্রে স্ক্রিনশট রেখে দেয়া যেতে পারে 

পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের মন মানসিকতার তেমন উৎকর্ষতা ঘটে নাই। তাই নব্বই এর দশকে যে ধরনের সমকামী কিশোরদের বুলিং এর শিকার হতে হতো, এখনো তাদের মত কিশোরদের বুলিং এর শিকার হতে হচ্ছে। আমরা মেনে নিতে পারছি না নিজের আইডেন্টিটি বেছে নেয়ার স্বাধীনতা। শুধু স্কুলের ছাত্রদের কথাই কেন বলবো। পূর্ণবয়স্ক মানুষরাই  কি পারছে মেনে নিতে? পদে পদে সমকামী দের হতে হচ্ছে বিড়াম্বনার শিকার। আর এই দেশে তো নিজেদের প্রকাশ করাই মহাপাপ। তাহলে কেনইবা আমরা শুধুমাত্র স্কুলের ছাত্রদের বুলিংকেই দোষারোপ করবো ? সমস্যা তো আগাতেই রয়ে গিয়েছে। আগে তো সেটা সামলাই!

লেখক তার নিজস্ব মতামত প্রকাশ করেছেন

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.