
তন্ময় সরকার
প্রিয় রবি,
কেমন আছো তুমি? আজকে তোমার মৃত্যুর আশিটা বছর হতে চলল।অথচ তুমি যে মানুষটি, মৃত্যুকে নিজের প্রেমিক ভেবেছ,বলেছ -“মরণ রে, তুঁ হুঁ মম শ্যামসমান!” সেই মৃত্যুই কতটা নিষ্ঠুর ভাবে তোমাকে আমাদের থেকে কেড়ে নিয়েছে! তুমি তো কখনোই জীবনবিমুখী ছিলে না। তাইতো ‘প্রাণ’ কবিতায় বলেই বসেছ –
“মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।
এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে,
জীবন্ত হৃদয় মাঝে যদি স্থান পাই।”
তবে কেন কবি মৃত্যুকে নিয়ে তুমি এতো সব বন্দনা গীতি গেয়েছ, তোমার গান ও কবিতায়? আসলে তুমি এই মৃত্যুকে ‘ধ্বংস কিংবা বিনাশ’ এসবের কিছুই বোঝাও নি। মৃত্যুকে বুঝিয়েছ কেবল ‘কালের স্থানান্তর’ হিসেবে।
আচ্ছা কবি,তোমার কি প্রভাতের রবির আলো হয়ে এই বাংলায় আবার আছড়ে পড়তে ইচ্ছে করে না? তোমার সেই শান্তিনিকেতনে, জোড়াসাঁকো কিংবা শিলাইদহের বাড়িতে পদ্মার স্রোতের মোহনীয় সুরে বুঁদ হয়ে আবার কবিতা কিংবা গান লিখতে? ইচ্ছে করে না, গ্রামবাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আবার মুগ্ধ-অভিভূত হয়ে; বাংলার আকাশ, মেঘ, বৃষ্টি, নদী, মাটি; ফসলভরা নানা রঙের শস্যক্ষেত কিংবা তোমার প্রিয় বর্ষাকালের কোনো বর্ষণসিক্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আবার বুঁদ হতে?
ইচ্ছে যে তোমার হয় না, এ আমি বিশ্বাসই করি না!
আচ্ছা কবি,তোমার রচিত প্রতিটি ছোটগল্প গুলো রচনার প্রেক্ষাপট কি তোমার আজও পুরোপুরি মনে আছে? এ সত্যটি তো অস্বীকারের কোনো উপায় নেই যে, তোমার অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি ছোটগল্পে রূপ নিয়েছে গভীর ভাবনায় ও সহজ-সরল চরিত্র চিত্রণে। সেখানে প্রকৃতি যেমন মুখ্য বিষয়, তেমনি সত্য জীবনবাস্তবতা, যা প্রায়শ ট্র্যাজেডি, কচিৎ কমেডির বৈশিষ্ট্য নিয়ে পরিস্ফুট। তোমার রচিত পদ্মাপর্বের ছোটগল্পগুলো এই দুই ধারাকে আশ্চর্য এক নান্দনিক চমৎকারিত্ব তুলে ধরেছে। একটি কথা তোমারও অস্বীকারের উপায় নেই যে, এই গ্রাম বাংলাই তোমাকে দিয়েছে, বাংলা সাহিত্যে প্রথম প্রকৃত আধুনিক ছোটগল্পকারের মর্যাদা।
তোমার রবীন্দ্রমানসের শিল্পসাহিত্য প্রকৃতি গঠনে গ্রামবাংলার অবদান, বিশেষ করে শিলাইদহ-শাজাদপুর-পতিসরের জীবন-জনপদ ও প্রকৃতির রূপের প্রভাবে, তা অবশ্যই সাহিত্যশিল্পী ‘রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সৃষ্টিকর্মের’ মূল্যায়নে ও বিশ্লেষণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তোমার জীবনসত্যের দার্শনিকতা অনেকাংশে এই গ্রামীণ রূপকল্পের প্রভাবেই সৃষ্ট। এ ক্ষেত্রে ভাববাদ ও বাস্তবতার এক অবিশ্বাস্য, অদ্ভুত মিশ্রণ ঘটেছে! সরসকৌতুকে, কখনো বা গভীর দার্শনিকতায় তোমার এই গভীর ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে ছিন্নপত্রাবলীতে।
তোমার সাহিত্যের বিশালতা ও গভীরতায় আমরা বাঙালি জাতি ঋদ্ধ হয়েছি। তোমার সাথে আমাদেরও আত্মপরিচয় শাণিত হয়েছে। সে কারণেই আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধেও তুমি যুগিয়েছ প্রেরণা ।
জানো কবি,তোমার রেখে যাওয়া বাংলার সেই গ্রামীণ জীবন-জনপদে এখন শহুরে হাওয়া লেগেছে।সর্বত্রই কেবল ব্যস্ততা আর ব্যস্ততা। এই হাঁপিয়ে ওঠা নাগরিক জীবনের নানান কর্ম ব্যস্ততা, প্রেম-বিরহ, আনন্দ-বেদনা নিয়ে তুমি কি আর গান-কবিতা লিখবে না, কবি?
তুমি একদিকে যেমন ছিলে ধর্মভীরু, একই সাথে অন্যদিকে ছিলে, প্রচন্ডরকম অসাম্প্রদায়িক ও যুক্তিবাদী। তোমার ধর্মীয় সত্ত্বা, কখনোই এদের মাঝে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে নি ; বরঞ্চ ভেবেছো একটি অন্যটির পরিপূরক হিসেবেই।তাইতো স্রষ্টার সাথে প্রেমলীলাই ছিল তোমার সারা জীবনের সাধনা। স্রষ্টার পৃথিবী এ জন্য তোমার কাছে মধুময় বলে মনে হয়েছে। তোমার দেয়া জীবনদেবতা, পরমপুরুষ, বন্ধু,সত্য, আনন্দ, অন্তরতম,ছলনাময়ী ইত্যাদি মূলত স্রষ্টারই বহ-নামের বহিঃপ্রকাশ।
স্রষ্টাকে উদ্দেশ্য করে তুমি তাই তোমার “শেষ কবিতা”য় অকপটেই বলেছ –
“তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি।
বিচিত্র ছলনাজালে,হে ছলনাময়ী।
….
অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে,
সে পায় তোমার হাতে শান্তির অক্ষয় অধিকার।”
কেবল কবি হিসেবে,তোমার শিল্প-সাহিত্য চর্চা নিয়েই যদি তোমাকে বিশ্লেষণ করি,তবে সেটি হবে ভীষণ অন্যায়। কারণ বাস্তবিক জীবনে তুমি ছিলে নানাবিধ কর্মযজ্ঞের কেন্দ্রবিন্দু। ছিলে জমিদার, সমাজসংস্কারক, ছিলে শিক্ষাবিদ, আরও কত কী! তোমার জীবন পাঠে বুঝেছি,প্রথাগত জমিদারদের মতো তুমি একদমই ছিলে না। সমাজসংস্কার ও মানুষের কল্যাণে তুমি নিয়েছিলে নানামুখী পদক্ষেপ। কৃষির আধুনিকায়নের জন্য শুনেছি, তুমি তোমার নিজের পুত্রকে কৃষিশিক্ষায় শিক্ষিত করেছ। কলের লাঙল বা যান্ত্রিক কৃষি ও উন্নত বীজ প্রবর্তনের চেষ্টাও করেছ। দরিদ্র কৃষকদের বিনা সুদে ঋণ জোগাতে গ্রামীণ কৃষি ব্যাংকের প্রবর্তনও করেছিলে তুমি। সংস্কৃতির বিকাশেও নিয়েছ নানামুখী পদক্ষেপ।
কিন্তু কবি, তোমার প্রতি আমার আক্ষেপ এই,আমার মত যারা বৈচিত্র্যময় লিঙ্গ ও যৌন পরিচয় নিয়ে এই সমাজে বেঁচে আছে,তাদের কথা কেন তুমি তোমার সাহিত্যে তুলে ধরলে না? তোমার রেখে যাওয়া এ সমাজ, আজও নারী-পুরুষের বাইরে আর কোনো ভিন্ন লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষকে বিন্দুমাত্র স্থান দিতে রাজি নয়। তবে বল কবি, আমাকে তুমি কি পরিচয়ে চিনবে?কি নাম দেবে আমাদের ; সর্বোজয়া,সংশপ্তক নাকি বিজয়া?
এই সমাজের নানান বাধ্যবাধকতা, ধর্মীয় নানান প্রতিকূলতা, যেগুলো আমাদের পরিচয়কে বার বার প্রত্যাখ্যান করেছে, তুমি কি সেসব দুঃখ-দুর্দশার কথা, হাহাকারের চিত্র তোমার গল্পে আবার তুলে ধরবে না, কবি?
তোমার সারাজীবনের কর্ম-সাধনা, শিল্প-সাহিত্য অনেক বিচিত্র পথে হাঁটলেও, তুমি কখনোই লিঙ্গ ও যৌন বৈচিত্রময় মানুষ গুলোকে তাতে কোনো স্থানই দাও নি! বল কবি, এই কবি ভক্তের তোমার প্রতি অভিমান জন্মানো কি খুব দোষের হবে? যদিও তুমি জীবনের একদম শেষ পর্যায়ে এসে ‘ঐকতান’ কবিতায় নিজেই তোমার সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করেছ এভাবে,
“আমার কবিতা, আমি জানি,
গেলেও বিচিত্র পথে, হয় নাই সে সর্বত্রগামী!”
তাই তোমার উপর অভিমান করে থাকতে পারি নে!
জানো কবি,তোমাকে আমি কখনো দেখিনি বটে।কিন্তু তোমার এক অন্য অবয়ব আমার হৃদয় মন্দিরে তুলে রাখা আছে।সে মন্দিরের দেবতা তুমি! তোমার প্রতি আমার যে নিত্য অর্ঘ্য বিরচন, সেটাকে ব্যর্থ করো না কবি!এই বাংলায় তুমি আবার নেমে এসো। আবার আমাদের কন্ঠে ধ্বনিত কর,
“বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো
সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও।
নয়কো বনে, নয় বিজনে
নয়কো আমার আপন মনে –
সবার যেথায় আপন তুমি, হে প্রিয়,
সেথায় আপন আমারও।”
ইতি
তোমার এক স্নেহঋদ্ধ ভক্ত
আমি তন্ময় সরকার। গ্রাজুয়েশন করছি গণিতের উপর। শখের বসত নিয়মিত লেখালেখি করছি। তবে নিজেকে পাঠক হিসেবে ভাবতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। পছন্দ ও আগ্রহের বিষয় বিজ্ঞান, বিশেষত গণিত। তবে শিল্প-সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন সমান ভাবে আকর্ষণ করে।