জলপরীর জীবন

Green_Bug

ড্যানিশ লেখক ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের ‘জলপরীর গল্প’ ছোটবেলায় আমরা প্রায় সবাই শুনেছি বা পড়ে এসেছি। Disney তো অন্য সব রূপকথার মতো এই জলপরীর গল্প নিয়েও একটা franchise চালাচ্ছে। সমুদ্র-দেশের রাজকন্যা ছোট জলপরী স্থলভাগের এক রাজপুত্রের প্রেমে পড়ে যায়, আর সেই প্রেমকে কাছে পাবার জন্য সে সমুদ্র ছেড়ে স্থলের মানুষ হবার স্বপ্ন দেখা শুরু করে। একদিন যদিও সেই স্বপ্ন সত্যি হয়, কিন্তু এই পৃথিবীতে কোনকিছুই বিনামূল্যে আসে না, কিছু পাওয়ার জন্য কিছু বিসর্জন দিতেই হয়। জলপরীকেও তার মীন-সদৃশ লেজের পরিবর্তে মনুষ্য-চরণ পাওয়ার জন্য মূল্য দিতে হয়েছিল।  

প্রবাসে আমার জীবনটাও অনেকটা সেই জলপরীর মতো। জলপরী তার প্রেমিককে পাওয়ার জন্য নিজেকে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, আমিও বাংলাদেশ ছেড়ে সবসময় প্রবাসে পাড়ি জমাতে চেয়েছি এই আশায়, যে হয়তো কোনদিন তাতে আমিও আমার স্বপ্নের জীবন পাব, যেখানে আমি স্বামী-সন্তানসহ হয়তো একটা সুখের সংসার পেতে বসতে পারব। I know that’s so cliché, but again what’s so wrong with it? এই ২০২২ এর মার্চে তিন বছর হবে যে দেশ ছেড়ে চলে এসেছি। এসেই এখানকার জীবনের সাথে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য সংগ্রামে নেমে পড়তে হয়েছে। এখানকার গ্রোসারি শপে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে ক্যাশিয়ারের কাজ শুরু করলাম, দেশে আমার প্রায় ৫ বছরের আর্কিটেকচার প্র্যাকটিস ছেড়ে দিয়ে প্রবাসে এসে যখন নীল কলারের চাকরি করা শুরু করলাম, শুরুতে মনটা কেমন খারাপ হয়ে যেতো। ৯টা-৫টার চেয়ারে বসা চাকরী ছেড়ে মুদি দোকানের কোন সারিতে corn-bread আর কোন সারিতে sparkling water পাওয়া যায়, এসবের উত্তর দিতে দিতে নিজের প্রতি একটা হীনমন্যতা বোধ কাজ করত। এসবের পাশাপাশি চলছিল গাড়ী চালানো শেখা।

যখন শুরু করেছিলাম এই গাড়ী চালানো শেখাটা, তখন আমার কাছে একদম অত্যাচারের মতো মনে হত এটাকে। কিন্তু আমেরিকার শহরগুলো এমনভাবে প্ল্যান করা আর পাবলিক ট্রান্সপোর্টের মান ভাল হলেও পরিমাণ কম, তাই বাস-ট্রেনের উপর ভরসা করে থাকলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় মূল্যবান সময় নষ্ট করা ছাড়া উপায় নাই। এসব ছাড়াও আরও চলছিল এখানকার ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার জন্য GRE নিয়ে পড়াশোনা। দেশ ছেড়ে চলে আসার সময় আমার ইচ্ছা ছিল ক্রিয়েটিভ আর আনন্দদায়ক কিছু, যেমন animation নিয়ে পড়ার, কিন্তু এখানে আসার পরে যখন জানতে পারলাম এই বিষয়ে গ্রাজুয়েশনের পরে চাকরীর বাজারে খুব ভালো মানের চাকরী নেই, তখন সেই জলপরীর মতো আমিও নিজের আগ্রহ বিসর্জন দিয়ে নিরাপদ পথ Information Technology নিয়ে আগানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। 

গল্পের জলপরী কিন্তু ত্যাগ স্বীকার করেও তার প্রেমকে শেষ পর্যন্ত পায়নি, যখন প্রেমিকের কাছে নিজের প্রেম নিবেদন করতে গিয়েছিল তখন সে আবিষ্কার করল, পদযুগল পাওয়ার বিনিময়ে সে তার বাকশক্তি বিসর্জন দিয়ে এসেছে। শত চেষ্টা করেও তার মুখ থেকে তখন একটা শব্দও বের হয়নি, ভারাক্রান্ত মন নিয়ে জলপরী সাগরের বুকে নিজের জীবন বিসর্জন দেওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। আসলে তথাকথিত প্রেম খুঁজে পাওয়া নয়, আমার দেশ ছাড়ার পিছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশের সামাজিক ব্যবস্থার প্রতি ক্ষোভ, যেখানে আমাকে একটা পর্যায়ে বিপরীত লিঙ্গের একটা মানুষের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতেই হবে। এই ধারণার সাথে আমি কোনভাবেই নিজের জীবনকে মানিয়ে নিতে রাজি ছিলাম না। শুধুমাত্র পরিবার, সমাজকে খুশি রাখার জন্য আমি কেবল নাটক করে যাব এমন একটা মিথ্যা জীবন মেনে নেয়ার থেকে মৃত্যু আমার কাছে অনেক শ্রেয়। আমার মা-বাবা, পরিবারের আরও অনেককে আমি ভালোবাসি, তাদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য আমি ক্ষুদ্র ত্যাগ-তিতিক্ষা মেনে নিতে রাজী, কিন্তু এত বড় ত্যাগ কোনভাবেই সম্ভব না। দেশের এই প্রাচীন সমাজ-ব্যবস্থার হাত থেকে রক্ষা পেতে, কোন একদিন হয়তো একজন ভালোবাসার মানুষ খুঁজে পাব, এই আশায় আমি দেশের ৫ বছরের career, চিরচেনা পরিবেশ, বন্ধুবান্ধবদের ছেড়ে চলে এসেছি। জলপরীর মতোই আমার এখানে আসার মূল উদ্দেশ্য এখনো পূরণ হয় নাই, কিন্তু দেশে ছেড়ে আসা চিরচেনা পরিবেশটার প্রতি মাঝে মধ্যে আমি একটা হাহাকার অনুভব করি।

আমরা অনেকেই জানি যে, জলপরীর আত্মহত্যার মধ্য দিয়েই গল্পের সমাপ্তি, কিন্তু মূল গল্পের শেষে জলপরী যখন সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়েছিল, তখন সে একটা রূপান্তর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়। তার দেহ চলে গেলেও সে আবিষ্কার করল যে সে একজন আলোকিত, এবং এই পৃথিবীর সাথে চিরাচরিত বন্ধনে আবদ্ধ এক সত্ত্বাতে রূপান্তরিত হয়েছে। আমেরিকায় এসে এখানকার সংস্কৃতি-জীবনযাত্রার সাথে মানিয়ে নিতে আমার শুরুতে খুবই কষ্ট হয়েছে, এবং সত্যি কথা বলতে গেলে এখনো আমি সেই struggling phase পুরোপুরি পার করে উঠতে পারি নাই। কিন্তু Walmart এ কাজ করার সময় যখন আমার এক বয়স্ক সহকর্মী মহিলাকে দেখতাম সে কীভাবে হাসিমুখে বছরের পর বছর এই নীল কলারের চাকরী করে আসছে, কিন্তু তাকে তো কখনো এসব নিয়ে আমার মতো বিরক্ত হতে দেখি না, তখন আমিও নিজের চিন্তা-ভাবনাকে আরও positive করার চেষ্টা করা শুরু করলাম। আর সত্যি কথা বলতে গেলে এসব চাকরী আমাকে শিখিয়েছে মানুষের প্রতি কীভাবে আরও সহানুভূতিশীল হতে হয়। বদরাগী-অভদ্র কাস্টমাররা যখন কোন কারণ ছাড়াই খারাপ ব্যবহার করত, তখন সেই অভিজ্ঞতা আমাকে empathetic হতে শিখিয়েছে। প্রায় আড়াই বছরের মতো নীল কলারের চাকরী করার পরে Fall 2021 থেকে আমি এখন একটা multi-national accounting company এর IT section এ paid intern হিসেবে কাজ করছি। বাসাতে বসেই কম্পিউটারে কাজ। আমার ম্যানেজাররা আমার কাজ নিয়ে এতই সন্তুষ্ট যে Spring 2022তেও আমার internship contract renew করা হয়েছে। Information Technology নিয়ে পড়াশোনা করব এই সিদ্ধান্ত যখন নিয়েছিলাম তখন কিছুটা মন খারাপ হয়েছিল, কিন্তু এখন আমার এই trackটার প্রতি বরং বেশ আগ্রহ জন্মে গেছে, প্রায় প্রতিদিনই আমি নতুন কিছু শিখতে পারছি আর এই ব্যাপারটায় আমি বেশ আনন্দ পাচ্ছি। গাড়ী চালানো প্রথম দিকে শিখতে না চাইলেও এখন আমার কাছে গাড়ী চালাতে ভালই লাগে। আমার সময় হলেই মন মতো কোথাও ঘুরতে যেতে পারছি। 

হয়তো দেশ ছেড়ে চলে আসার প্রাথমিক উদ্দেশ্য আমার এখনো সফল হয় নাই, হয়তো এখনো সেইভাবে নিজের আর্থিক স্বাধীনতা এখনো হয়ে উঠে নাই, এখনো এখানে আমার সেই সামাজিক জীবন গড়ে উঠে নাই, কিন্তু আমি ধীরে ধীরে হলেও সেই গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। আমার কেন যেন মনে হয় জলপরীর গল্পের শেষটা অনেক মিডিয়াতেই নেতিবাচক ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। হয়তো পরিবর্তনের দিকে অন্যদেরকে অগ্রসর হওয়ার থেকে নিরুৎসাহিত করার উদ্দেশ্যেই, সমাজের বুর্জোয়াদের এটা একটা বুদ্ধি। কিন্তু আমার মতে গল্পটা আমাদের শেখায় নিজের মনের কথা শুনতে, শত বাধা বিপত্তি থাকলেও তুমি যদি কিছু চাও তো তার দিকে অগ্রসর হতে, হয়তো যাত্রাপথে তুমি তোমার প্রাথমিক উদ্দেশ্যের কাছে নাও পৌঁছাতে পারো, হয়তোবা একটু সময় লাগছে তোমার গন্তব্যে পৌঁছাতে। কিন্তু তাও আমার মতে, জলপরীর মতোই আমাদের মাঝেমধ্যে সাহসী হওয়ার চেষ্টা করা উচিৎ। এভাবেই দিনশেষে হয়তোবা আমাদের স্বপ্ন পূরণ হবে অথবা জীবনের যাত্রাপথে অন্য কোন একটা সুন্দর জায়গায় এসে উপস্থিত হব আমরা। 

My name is Green_Bug, just an adventurer who likes to roam around the earth and take pictures. Writing has never been my thing but I tried to share something with you guys. I hope you will be considerate while reading the piece and forgive any mistakes.

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.