
অরণ্য রাত্রি
এক
গ্রামের নাম পদ্মবাহার। নামের মতই সুন্দর আমাদের এই গ্রামটি। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ক্ষেত। গ্রামের মাঝখান দিয়ে চলে গিয়েছে রেললাইন। গ্রামের শেষ সীমানায় রয়েছে একটা ছোট রেলস্টেশন। প্রতিদিন ভোরে একটা ট্রেন আসে। থামে পাঁচ মিনিটের জন্য। আর বাকি সময়টা নির্জন নিস্তব্ধ থাকে পুরো স্টেশন।
গ্রামের মাঝখানে রয়েছে বিশাল একটি দীঘি। লাল নীল দীঘি। এই দীঘির নামকরণে একটা অদ্ভুত ইতিহাস রয়েছে। কথিত আছে, এই দীঘির পুরো এলাকা জুড়ে বিশাল এক জঙ্গল ছিল। সে জঙ্গলে কিনা ছিল বাঘ, হরিণ, অজগর সাপ। এই অঞ্চলের রাজার ছেলে লালকুমার শিকার করতে খুব ভালবাসতেন। তার সেরা বন্ধু ছিল সেনাপতির ছেলে নীলকুমার। নীলকুমার ছিলেন শিকারে সিদ্ধহস্ত। লালকুমার আর নীলকুমার প্রায়ই শিকারে যেতেন। কিন্তু একবার শিকার করতে গিয়ে তারা আর ফিরলেন না। সবাই বলে লালকুমার এক বাঘের খপ্পরে পরেন। তাকে বাঁচাতে গিয়ে নীলকুমার নিহত হন। লালকুমার বন্ধু হারানোর শোকে ধুতুরা খেয়ে সেখানেই আত্মহত্যা করেন। বন্ধুতের এই ইতিহাস বিরল। আর এই ইতিহাস যেন মানুষের মুখে মুখে ফেরে তাই রাজা জঙ্গল কেটে এই দীঘি খনন করেন। আর দীঘির নামকরণ করেন লাল নীল দিঘী।
দীঘির ঘাটে পা ডুবিয়ে বসে আছি আমি। আমি অমি। এইবার এইচএসসি দিলাম। এখনো রেজাল্ট প্রকাশিত হয় নি। যাই হোক, দীঘির নামকরণের ইতিহাস আমার খুব অদ্ভুত লাগে। একটা বন্ধু কি আসলেই আরেকটি বন্ধুর জন্য এইভাবে জীবন দিতে পারে? আমি একবার লাইব্রেরীতে একটা বই পড়েছিলাম। সেখানে দুইজন পুরুষের মাঝে ভালোবাসার কথা উল্লেখ আছে। যেই ভালোবাসা আমাদের সমাজে নিষিদ্ধ। তাদের মধ্যেও কি এই ভালোবাসা ছিল? মাঝে মাঝে আমার মনে হয় আমি যদি একজন পুরুষ মানুষকে ভালোবাসতে পারতাম! আবার পর মুহূর্তে মনে হয় এই সব কি অদ্ভুত ভাবনা আসছে মনে। এই দেশে এ কি সম্ভব?
মধ্য দুপুরে দীঘির ঘাট শুনশান নীরব থাকে। এই সময়টায় দীঘিটা যেন শুধু আমার। আমি দীঘির ঘাঁটে পা ডুবিয়ে কত কিছু ভাবি। এই ধর্ম, রাজনীতি, বিজ্ঞান…সব কিছু। আমার ভাবতে খুব ভালো লাগে। আজকে দীঘিটা নীরব নয়। গাফ্ফার ভাই দীঘিতে পাথর ছুঁড়ে মারছে। আর মনের অজান্তেই হেসে উঠছে। গাফ্ফার ভাইকে সবাই পাগল মনে করে। কিন্ত গাফ্ফার ভাই এমন ছিল না। গাফফার্ ভাই আমার থেকে তিন বছরের বড়। যখন ছোট ছিলাম তখন আমি আর গাফ্ফার ভাই একসাথে স্কুলে যেতাম। কিন্তু যখন গাফ্ফার ভাই ক্লাস সেভেনে উঠে তখন থেকে তার মধ্যে কিছু মেয়েলি ব্যাপার প্রকট হয়ে উঠে। যেমন হাঁটা চলা, কথা বার্তা। স্কুলের সহপাঠীরা তাকে মানসিক নির্যাতন শুরু করে। প্রতিদিন তাকে নানা অপমান আর কটু কথা সহ্য করতে হয়। আমিও তার সাথে একসাথে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেই। কারণ তার সাথে স্কুলে গেলে অনেক কথা আমাকেও শুনতে হতো। আস্তে আস্তে গাফ্ফার ভাই নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করলো। অন্যদের সাথে আর কথা বলতো না, মিশতো না। ক্লাস এইটে উঠার পরীক্ষায় সে ফেইল করলো। এরপর স্কুলে যাওয়াই বন্ধ করে দিল। বেশির ভাগ সময় একা বাসায় কাটাতে শুরু করলো। আর বাসা থেকে বের হলেও অন্যদের সাথে কথা বলে না। নিজের মনেই বিড়বিড় করে কি বলে বোঝা যায় না।
দুই
আমি দীঘির ঘাট থেকে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। আজকে বিকেলে মেলায় যাবো শুভ্রাকে নিয়ে। শুভ্রা আমার বান্ধবী। আমার হবু বউ। আমাদের বিয়ে অনেক আগেই স্থির করা আছে। তাই ওর সাথে বের হলে গ্রামের মুরুব্বীরা কেউ কিছু মনে করেন না। শুভ্রাকে আমার ভালো লাগে। আমার জীবনের বিশাল অংশ জুড়ে শুভ্রা রয়েছে। কিন্তু আমার মনের দ্বিধা এক জায়গাতেই। আমি কি শুভ্রাকে আসলেই ভালোবাসি নাকি তা শুধু বন্ধুত্ব আর ভালো লাগা? কারণ আমি নিজেকে উভকামী মনে করি। যখন আমার সহপাঠীরা মেয়েদের নিয়ে কথা বলতো তখন আমি নিজে অবাক হয়ে ভাবতাম শুধু মেয়ে কেন আমার তো ছেলেদেরকেও ভালো লাগে। কখনো কখনো মনে হয় আমার ভালো লাগাটা বোধ হয় ছেলেদের প্রতি অনেক বেশি। কিন্তু এই কথা আমি কখনো কারো সাথে শেয়ার করিনি। কেউ জানলে গাফ্ফার ভাই এর মত যদি আমাকেও এক ঘরে করে দেয়? কিন্তু সব ভালো লাগার শেষে একটা চিন্তা এসেই মাথায় আঘাত করে তা হল বিয়ে। সমাজের এই অনুশাসনকে আমার মানতেই হবে। তাই রূপকথার কোন এক রাজপুত্রের কথা না ভেবে বরং শুভ্রাকে নিয়ে ভাবাটাই বেশি যুক্তিযুক্ত। কিন্তু আমি কি শুভ্রাকে ঠকাচ্ছি?
গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে হাঁটছি আর ভাবছি। কখন যে শুভ্রার বাসায় এসে পৌঁছে গেলাম তা খেয়ালই নেই যেন। শুভ্রা উঠানে বসে ছিল। আমাকে দেখে কেমন জানি লজ্জা পেল। উঠে নিজের ঘরে চলে গেল। আজকাল শুভ্রার আচরণ খুব অদ্ভুত লাগে। আগে আমাকে দেখলেই শুভ্রা এসে কত কথা বলতো আর এখন দেখলেই লজ্জা পায়। কাকিমা এসে আমাকে একটা পিঁড়ি নিয়ে বসতে বললেন। আর বললেন,
- কতদিন পর এলে বাবা? আজকে কিন্তু খেয়ে যাবা।
- কাকিমা আজকে তো আমার আর শুভ্রার মেলা দেখতে যাবার কথা।
- বাবা বস। আমি শুভ্রাকে ডাকছি।
শুভ্রা নত মুখে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। কেমন জানি লজ্জা পাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
- কিরে যাবি না মেলায়?
- না রে, তুই একা যা। আমার শরীর ভালো না।
আমার মনটা কেমন জানি দমে গেল। একা একা মেলা দেখতে ভালো লাগে না। আর মেলা দেখতে যাওয়ায় শুভ্রার আগ্রহই বেশি থাকে। আমি শুভ্রাকে জিজ্ঞেস করলাম,
- তোর জন্য কিছু আনবো?
শুভ্রা বললো,
- কদমা, বাতাসা আর এক গোছা রেশমি চুড়ি।
আমি শুভ্রাদের বাসা থেকে বেরিয়ে মেলার উদ্দেশ্যে হাঁটা দিলাম। মেলায় গিয়ে শুনলাম আগামীকাল আমাদের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হবে। মেলা থেকে বের হতে হতে রাত হয়ে গেল। মাঘ মাস, কনকনে শীত। গায়ে চাঁদর জড়িয়ে হাঁটছি রেল লাইন বরাবর। যাওয়ার পথে শুভ্রার বাড়ি হয়ে যেতে হবে। শুভ্রার জন্য রেশমি চুড়ি কিনেছি। রাস্তায় দেখা হয়ে গেল মানিকের সাথে। মানিক আমার ভালো বন্ধু। একসাথে স্কুল আর কলেজে পড়েছি। মানিক আমাকে দেখে বললো,
- যাক তোর সাথে দেখা হয়ে ভালো হলো। একটা খবর দেয়ার ছিল। বড় বাড়িতে দেখলাম সাজ সাজ রব।
বড় বাড়ি আমাদের গ্রামের সবচেয়ে মান্যগণ্য ধনাঢ্য পরিবার। আগে তারা এই অঞ্চলের জমিদার ছিলেন। সারা বছর তাদের নিয়ে গ্রামে চলে আলোচনা সমালোচনা। গ্রামের সাধারণ মানুষের এই বাড়িতে প্রবেশের খুব একটা সুযোগ নেই। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে মানিককে জিজ্ঞেস করলাম,
- কি হয়েছে রে বড় বাড়িতে?
- শুনেছি অমিত এসেছে।
অমিত বড় বাড়ির কর্তা কৃষ্ণ মোদকের নাতি। ক্লাস টু পর্যন্ত অমিত আমাদের স্কুলে পড়েছে। এরপর তাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। অমিতের বাবা মা ও ঢাকায় স্থায়ী হয়। মাঝে মাঝে অমিতের বাবা মা গ্রামে আসতেন শুনতাম। কিন্তু অমিত আর কখনো আসেনি। মানিক অমিতের খুব ভালো বন্ধু ছিল। আমি মানিক কে জিজ্ঞেস করলাম,
- অমিত এর সাথে দেখা হয়েছে?
মানিক বললো,
- আমি বড় বাড়িতে ঢুকতে পারি নাই। তাই অমিত এর সাথে দেখা হয়নি। দেখা হলেও ও আমাকে চিনতে পারবে না।
আমি ভাবলাম আমাকে তো আরও চিনতে পারবে না। কারন আমার সাথে অমিতের কোন বন্ধুত্ব ছিল না। আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম,
- বড়লোকদের কাজ কারবারই আলাদা।
আমি আর মানিকের সাথে বকবক না করে দ্রুত পা চালালাম।
তিন
আমার রেজাল্ট দিয়েছে। আমি গোল্ডেন ফাইভ পেয়েছি। আমাদের এই অঞ্চলে বহুদিন এমন রেজাল্ট কেউ করেনি। বাড়ির সবাই খুব খুশি। বাইরে থেকে অনেক মানুষ আমাকে অভিনন্দন জানাতে এসেছে। কিন্তু আমি খুব একটা খুশি নই। কারণ আমার পরিবার শিক্ষার মর্ম বুঝে না। তারা আমাকে আর পড়তে দিবে না। বাবার ব্যবসার হাল ধরতে বলবে। এত ভালো রেজাল্ট দিয়ে কি হবে, যদি গ্রাজুয়েশনই না করি! মা এসে আমাকে খেতে ডাকলেন। খেতে বসে বাবা পরিবারের নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেন। আজকে দেখলাম স্পেশাল খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বুঝেছি আমার ফলাফলের জন্য। কিন্তু আমার মন খাবারের দিকে নেই। ভাবছি বাবার কাছে ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার কথা তুলতে হবে। কিন্তু কিছু বলার আগে বাবা বললেন,
- এখন কি করবা ঠিক করেছো?
- বাবা আমি ভার্সিটিতে ভর্তি হতে চাই।
- আর পড়াশোনার কোন দরকার নাই। এত পড়ে কি হবে! আমার কি টাকার অভাব? ভগবান আমাকে অনেক দিয়েছেন। এখন তুমি আমার ব্যবসার হাল ধর। আমি তো বুড়া হয়েছি।
আমার খুব কষ্ট লাগছে। আমি বুঝতে পারছি আমার স্বপ্ন কোন দিন পূরণ হবে না। এদিকে মা তুললেন আরেকটা প্রসঙ্গ।
- বাবা তোর তো এখন বিয়ে থা করে সংসার করতে হবে। তুই তো জানিস শুভ্রার সাথে তোর বিয়ে আগে থেকে ঠিক করা। আগামী রবিবার একটা ভালো সময় আছে। পুরুত মশাই বললেন। আমি ভাবছি এইদিন তোদের বিয়ে দিব।
আমি এখন বুঝলাম শুভ্রা কেন লজ্জা পাচ্ছিল। আসলে বিয়ে সামনে। তাই আমাকে দেখে লজ্জা পায়। তার হবু স্বামী বলে কথা। কিন্তু আমি কি আসলেই এই জীবন চেয়েছি? আমার মতামতের কোন দাম নেই। আমি জানি আমাকে শেষ পর্যন্ত শুভ্রাকে বিয়ে করে ব্যবসার হাল ধরতে হবে। তারপর সংসার করা, বাচ্চা পয়দা করা। আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। আমার যে অনেক স্বপ্ন। উচ্চশিক্ষা নেওয়া, বিভিন্ন দেশ বিদেশে ঘুরে বেরানো। কিছু আর হবে না। সবচেয়ে বড় কথা আমি নিশ্চিতই না যে আমি শুভ্রাকে মন থেকে ভালোবাসতে পারবো কিনা।
চার
বড় বাড়ি থেকে দাওয়াত পেয়েছি। আমার ভালো রেজাল্ট এর জন্য এই দাওয়াত। আমি আগে কক্ষনো বড় বাড়িতে যাইনি। আমি খুব উত্তেজিত। আমার সবচেয়ে ভালো যে পোশাক রয়েছে সেটা পরে রওনা দিলাম বড় বাড়ির উদ্দেশ্য। আমাকে অনেক আদর যত্ন করে বসানো হলো। অমিতকে দেখলাম। দেখে চিনতে পেরেছি। কিন্তু আমার মনে হল অমিত আমাকে চিনতে পারেনি। সেটা হতেই পারে। কত বছর আগের কথা। বাড়ির কর্তা কৃষ্ণ মোদকের সাথে বসে খেলাম। খাবার শেষে তিনি আমাকে বই উপহার দিলেন। আমি খুব খুশি। কারণ বই আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় উপহার। আর তা পেলাম বড় বাড়ির কর্তার কাছ থেকে। আমার কাছে মনে হলো এর থেকে বড় সম্মান আমি কখনো পাইনি।
খাওয়ার পর অমিত আমার সাথে বসলো গল্প করার জন্য। অমিত এত ধনী তবুও তার মাঝে এতটুকু অহংকার নেই। সে আমাকে পুরো বড় বাড়ি ঘুরিয়ে দেখালো। কত কি আছে! আলমারি ভর্তি নানা বিষয়ের বই, পুকুরের ঘাট শ্বেত পাথরে বাঁধানো, বাড়ির সাথেই একটা ফুলের বাগান। তাতে একটি পরীর ভাস্কর্য। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আমাকে বাড়ি যেতে হবে। যাওয়ার আগে অমিত আমাকে হাগ করলো আর বললো,
- আজ তো তোমাকে আমাদের বাড়ি ঘুরিয়ে দেখালাম। এর পর তোমার পালা। আমাকে তোমাদের গ্রাম কবে ঘুরিয়ে দেখাবে?
অমিত এর মত এত সুন্দর, স্মার্ট আর হ্যান্ডসাম ছেলে আমি আগে কখনো দেখিনি। আর সে কিনা আমার মত গ্রাম্য একটা ছেলের সাথে ঘুরতে চাচ্ছে। এই অনুরোধ ফেলে দেয়ার কোন প্রশ্নই আসে না। আমি বললাম,
- কালকেই। এখন তো আমি একদম ফ্রি। কোন কাজ নেই।
- ওকে ডান। কাল তুমি আমাদের বাড়িতে এসে আমাকে নিয়ে যাবে। তোমার সাথে সারা দিন ঘুরবো।
সারা রাত ঘুম হলো না। শুধু অমিত এর কথা ভাবছি। যদি অমিত এর সাথে সারা জীবন থাকার সুযোগ থাকতো। আবার পর মুহূর্তে মনে হচ্ছে এ কি ভাবছি আমি। আমার বিয়ে কয়েকদিন পর। আমার বরং শুভ্রার কথা ভাবা উচিৎ। কিন্তু বুঝতে পারছি শুভ্রাকে নিয়ে আমি সেইভাবে ভাবতে পারছি না। আমার খুব পাপ বোধ হতে লাগলো। আমি বুঝলাম অমিতের সাথে কোন রকম যোগাযোগ রাখা উচিৎ না। ভাবলাম সকালে বড় বাড়িতে গিয়ে অমিতকে না করে দিয়ে আসবো ।
কোন রকম রাতটা পার হলো। ভোরেই কনকনে শীতের মধ্যে চাদর গায়ে জড়িয়ে বড় বাড়িতে আসলাম। ভেবেছিলাম অমিত ঘুমিয়ে আছে কিনা কে জানে। কিন্তু গিয়ে দেখলাম অমিত খেজুরের রস খাচ্ছে। আমাকে দেখে হেসে বললো,
- গুড বয়। এত সকাল সকাল?
অমিত আমাকে গুড বয় বলে ডাকে। অমিত কে দেখে মনে হচ্ছে স্রষ্টা কি নিপুণ হাতে অমিতকে বানিয়েছে! এতটা সুদর্শন পুরুষ আমি আগে কখনো দেখিনি। এই ছেলেকে আমি কোন ভাবেই না করতে পারবো না। আমি অমিতের সাথে বসে সকালের নাস্তা করলাম। তারপর অমিতকে নিয়ে বের হলাম গ্রাম ঘুরতে।
গ্রামে ঘোরার মত তেমন জায়গা নেই। একমাত্র লাল নীল দীঘি ছাড়া। অবশ্য অমিত যা দেখছে তাতেই মুগ্ধ হচ্ছে আর ছবি তুলছে। শতবর্ষী বট গাছ, পুরনো ভাঙ্গা মন্দির, পদ্ম পুকুর, সরিষা ক্ষেত, সব কিছুই তাকে মুগ্ধ করছে। আমাদের কাছে এগুলো খুবই সাধারণ কিন্তু অমিতের কাছে সব কিছুই অসাধারণ। সব শেষে লাল নীল দীঘির ঘাটে এসে বসলাম। বিকেল হয়ে গিয়েছে। মিষ্টি এক টুকরো রোদ। আমি অমিতকে দীঘির নামকরণের গল্পটা শুনালাম। গল্প শুনে অমিত বললো,
- রাজপুত্র আর সেনাপতি পুত্র দুইজনই হয় গে বা বাইসেক্সুয়াল ছিল।
আমি এই দুইটা শব্দের মানে জানি। আর আমারও এরকম মনে হয়েছে। আমার সাথে অমিতের ভাবনা একেবারে মিলে গিয়েছে। এ কোন সাধারণ বন্ধুত্ব নয়। আচমকা অমিত এমন একটা কথা বললো তাতে আমি থতমত হয়ে গেলাম। অমিত জিজ্ঞেস করেছে আমি কখনো গে পর্ণ দেখেছি কিনা। আমি হালকা পাতলা ছেলে মেয়ে পর্ণ দেখেছি বটে। কিন্তু গে পর্ণ কখনো দেখিনি। অমিত বললো,
- দাঁড়াও তোমাকে একটা ভিডিও দেখাচ্ছি।
অমিত তার মোবাইলে একটা ভিডিও প্লে করলো। দুইটা ছেলে বেড এ একজন আরেকজন কে জড়িয়ে ধরে আদর করছে। আমি বিস্ফোরিত চোখে দেখছি। আমি বুঝতে পারছি আমার যৌনাঙ্গ উত্থিত হচ্ছে। হঠাৎ অমিত আমার যৌনাঙ্গে হাত দিল। এরপর বললো,
- আমি জানতাম তুমি আমার মতই গে অথবা বাই।
অন্য কেউ হাত দিলে আমি খুব রেগে যেতাম। কিন্তু অমিতের জন্য সব দোষ মাফ। আমার কেন জানি খুব লজ্জা লাগছে। এরপর সন্ধ্যা পর্যন্ত অমিতের সাথে অনেক কথা হলো। আমার জীবনের দুঃখ কষ্ট সব শেয়ার করলাম। অমিত আমার ঘাড়ে হাত দিয়ে বললো,
- আমি আছি। আমি তোমার জীবনের সব সমস্যা দূর করে দিব।
- কিছুই ঠিক করতে পারবে না।
- দেখো পারি কিনা! আগে আমার সাথে তুমি ঢাকা চলো। আমি আমার ফ্ল্যাটে একা থাকি। সেখানেই থাকবে আর কোচিং করবে ভার্সিটির এডমিশন পরীক্ষায় টেকার জন্য।
- কিন্তু আমার বাবা মা তো কখনো রাজি হবে না।
- না বলে আসবে। সব কিছুতে বাবা মা এর আদেশ নির্দেশ মানতে হবে তা না। এখন তোমার সিদ্ধান্ত নিতে হবে তুমি কি করবে।
এর পর আর তেমন কথা হলো না। কেমন জানি সুর কেটে গিয়েছে। আমি অমিতকে বড় বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরে আসলাম।
বাড়ি ফিরে এসে অনেক ভাবলাম। কিন্তু ভেবে দেখলাম কোন উপায় নেই। আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। শুভ্রাকে বিয়ে করতেই হবে। বাবা ও বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছে। এত কাজ একা করতে পারেন না। আমাকে ব্যবসার হাল ধরতেই হবে। অমিত এর প্রস্তাব আসলে মানা সম্ভব না। যদিও আমার খুব ইচ্ছা করছে। কিন্তু একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছুই করতে পারবো না আমি।
পাঁচ
আজ আমার বিয়ে। সকালে গায়ে হলুদ হয়েছে। সন্ধ্যায় বিয়ে। আমি উঠানে বসে রোদ পোহাচ্ছি। সেদিনের পর আর অমিত এর সাথে দেখা হয় নি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি যে অমিত এর সাথে আর দেখা করবো না। শুভ্রাকে বিয়ে করে সংসার ধর্ম করবো। কিন্তু যা ঘটলো তা আচমকা ঘটলো। অমিত আমার বাড়িতে এসে ঢুকলো। আমি কখনো ভাবিনি যে অমিত আমার বাসা পর্যন্ত চলে আসবে। আর কেনই বা আসবে? আমি খুব সাধারণ একটা ছেলে। আমাকে পছন্দ করার কিছুই নেই। আমি অমিত কে দেখে উঠে দাঁড়ালাম। বললাম,
- অমিত তুমি?
- হ্যাঁ আসলাম। বিয়েতে তো দাওয়াত দিলে না। তাই নিজেই এসেছি।
আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। অমিত বললো,
- তোমার সাথে কিছু কথা ছিল। বাইরে আসবে?
আমি গায়ে একটা শার্ট পরে বের হয়ে আসলাম। আমি আর অমিত রেল লাইনের পাশ বরাবর হাঁটছি । দুই পাশে গহীন জঙ্গল। অমিতের সাথে অনেক কথা হলো। সে বলল যে সে নাকি আমাকে পছন্দ করে। আর ভোরের ট্রেনে সে ঢাকা ফিরে যাচ্ছে। তার সাথে যেতে চাইলে রাতের মাঝেই যেন আমি স্টেশনের পাশে যে গুদাম ঘরটা আছে সেখানে চলে আসি।
আমি সারাদিন অনেক ভাবলাম। আমি জানি অমিতের সাথে গেলে আমি জীবনে যা করতে চেয়েছি তা হয়তো পূরণ করতে পারব। কিন্তু কিছুতেই যেন মন থেকে সায় পাচ্ছিলাম না। আর সাহস ও হচ্ছিল না। সন্ধ্যায় বিয়ে। বর যাত্রী যাবে। আমার ধূতি, পাঞ্জাবি আর টোপর সুন্দর করে বিছানার উপর ভাঁজ করে রাখলো মা। সবার মুখে হাসি। আমি খাটের উপর ধূতি, পাঞ্জাবি নিয়ে বসে আছি। এই শেষ সুযোগ। এরপর বিয়ের মন্ডপে বসে যেতে হবে। আমি কি আমার জীবনের সব কিছু বিসর্জন দিয়ে পরিবারের সুখের জন্য বিয়েতে বসবো নাকি নতুন জীবনের জন্য অমিতের সাথে যাবো? সারা দিন নিজেকে অনেক বুঝিয়েছি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে আর পারলাম না। পিছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে আসলাম। সূর্য ডুবে গিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। চাঁদের আলোয় ঝিকমিক করছে চারিদিক। আমি রেল লাইনের রাস্তা ধরে দ্রুত হেঁটে যাচ্ছি। ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ আর মাঝে মাঝে জোনাকি পোকা আলো ছড়িয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আধা ঘন্টার মাঝেই পৌঁছে গেলাম গুদাম ঘরে। দরজা বন্ধ। আমি দরজায় ধাক্কা দিলাম। এক অচেনা মানুষ দরজা খুললো। আমি খুব অবাক হয়ে তাকালাম তার দিকে। অমিত কোথায়! আমাকে দেখে লোকটা কেমন বিচ্ছিরি ভাবে হাসছে। আমি কেমন ভয় পেয়ে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম,
- অমিত কোথায়?
লোকটা চিৎকার করে অমিতকে ডাক দিল। অমিতের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। অমিত এসে আমাকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। আমি একটু চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম। অমিত আর দুইটা ছেলে রয়েছে। তিনজনই নগ্ন। আমার খুব ভয় লাগছে। আগে তো অমিত বলেনি আরও কেউ থাকবে। আমি অমিত কে জিজ্ঞেস করলাম,
- এরা কারা?
- আমরা তিনজন এক সাথে থাকি। আর এখন তো তুমিও আমার সাথে থাকবে। আর আমি তোমাকে এত সাহায্য কেন এমনি এমনি করবো? মাঝে মাঝে আমাদের না হয় একটু আনন্দ দিলে।
আমি ভয় পেয়ে গেলাম। এ ধরণের তো কোন কথা ছিল না অমিতের সাথে। আমি বললাম,
- আমি যাবো না ঢাকায়। আমি বাড়ি যাবো। আমার বিয়ে আজকে। সবাই অপেক্ষা করছে।
- কিন্তু তা তো হবে না। নতুন মাল এসেছে এই কথা বলে বন্ধুদের ডেকে এনেছি।
তিনজনই কেমন কুৎসিত ভাবে হাসতে লাগলো। অমিত এর সুন্দর চেহারাকে মনে হচ্ছিল যেন শয়তানের প্রতিচ্ছবি। এরপর জোর করে তিনজন মিলে আমাকে রেপ করল। আমি চিৎকার করেছি। ছুটে যেতে চেয়েছি। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। আমি এক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে যাই। আমি মরে গিয়েছি এটা ভেবে তারা আমাকে রেখে পালিয়ে যায়।
যখন জ্ঞান ফিরল তখন কোন মতে হেঁটে হেঁটে স্টেশন পর্যন্ত গেলাম। কিভাবে বাড়ি যাবো? বাড়ি গিয়ে কি বলবো? শুভ্রার অবস্থা কি? বাসায় ই বা কি অবস্থা! আমার খুব অবাক লাগছে। নিজের ভালোর জন্য আমি আমার সেরা বন্ধু শুভ্রার কথা একবার ভাবলাম না। বাবা মার সম্মানের কথা একবার ভাবলাম না। বাড়ি যেতে হবে। সবার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। স্টেশন বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছি। হঠাৎ অনেক মানুষের হট্টগোল শুনলাম। একটু আড়ালে গিয়ে দেখলাম কারা হট্টগোল করছে। দেখি শুভ্রা কনে সেজে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে পাঞ্জবি পরা আরেকটি ছেলে। শুভ্রার দূর সম্পর্কের আত্মীয়। ঢাকায় বড় চাকরী করে। শুভ্রা আর ছেলেটাকে বিবাহিত দম্পতি মনে হচ্ছে। ভোরের ট্রেনে তারা ঢাকা যাবে।
পরিশিষ্ট
সেইদিন রাতে আমি পালিয়ে যাওয়ার পর শুভ্রা লগ্নভ্রষ্টা হতে যাচ্ছিল। তখন শুভ্রার এক আত্মীয় শুভ্রাকে বিয়ে করে শুভ্রার মান রক্ষা করে। বাড়ি ফেরার পর আমার পরিবারকে সমাজের চোখে ছোট হতে দেখি তাই পরিবারের মান রক্ষায় আমি বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছি বকুল নামের একটি মেয়েকে। আমার আর ঢাকায় যাওয়া হয়নি। আমার জীবন বহু বছরের যাঁতা কলে পিষ্ট হতে থাকে। বকুলকে আমি ভালবাসিনা। কিন্তু তার কামনা পূরণ করার জন্য তার সাথে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হই। আর দশটা সাধারণ গ্রামের মেয়ের মত সে এতেই সন্তুষ্ট।
সমাজের অনুশাসন গুলো আমি ভাঙতে পারলাম না। শহরে যারা বড় হচ্ছে তাদের অনেকেই সমাজের এই অনুশাসন গুলো ভেঙ্গে বেরিয়ে আসছে। তাদের সহযোগিতা করার জন্য আছে অনেক সংস্থা। কিন্তু আমার মত এই সাধারণ গ্রামের ছেলেদের কি হবে? আমাদের এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কে সাহায্য করবে? নাকি অমিতের মত ছেলেরা বার বার প্রলোভন দেখিয়ে আমাদের ভোগ করে ছুঁড়ে ফেলে দিবে আস্তাকুঁড়ে? নাকি গাফ্ফার ভাইয়ের মত পরিণতি হবে? আমাদের মুক্তি কোথায়?