
হৃৎকমল
সরস্বতী পূজোর দিন। কলকাতার কাছাকাছি এক সরকারি হাসপাতালের ইমার্জেন্সি অপারেশন থিয়েটার। একে তো পূজোর দিনে ২৪ ঘণ্টা ডিউটি, তার ওপর পেশেন্টের এত চাপ। সবাই কাজ করে যাচ্ছি বটে, কিন্তু মেজাজ সবারই সপ্তমে। ট্রাফিক অ্যাক্সিডেন্টে লিভারে গুরুতর আঘাত পাওয়া একটা পেশেন্টের অপারেশন থেকে বেরিয়ে প্রমাদ গুনছি, ভোরের আগে অন্তত সব অপারেশন শেষ হবে তো! পরদিন সকাল আটটা থেকেই আবার রাউন্ড শুরু হবে।
ঠিক তখনই এক বয়স্ক মহিলা কাঁদতে কাঁদতে ওটি’র বাইরের পেশেন্ট ওয়েটিং এরিয়াতে উপস্থিত। তার কাছে কী হয়েছে জানতে চাওয়ায় যা বোঝা গেলো তার সারাংশ হল এই, তার ছেলের ছোট একটা রেস্টুরেন্ট আছে কাছেই। দিনের কাজ শেষে সে নাকি সবজি কাটছিল পরের দিনের জন্য। আর তখনই ৫-৬ জন লোক মদ্যপ অবস্থায় এসে দোকান ভাঙচুর করে আর তার ছেলেকে খুব বাজে ভাবে বাঁশ দিয়ে মারে। তারা নাকি বাঁশ দিয়ে পায়ুপথেও আঘাত করেছে, যার জন্যই তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা।
এসব শুনতে শুনতে দেখলাম ৩-৪ জন লোক বছর চল্লিশের ব্যথায় কাতরানো পেশেন্টকে নিয়ে এসেছে। পুরো ঘটনাটাই নাকি রাজনৈতিক দলাদলি প্রসূত। পেশেন্টকে জিজ্ঞেস করে বিশেষ কিছু জানা গেল না, সে ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। অনেক পরীক্ষা করে দেখা গেলো এদের কথা মাফিক যেরকম মারপিট হয়েছে, সেরকম বিশেষ কাটা-ছেঁড়ার কোনো চিহ্ন রোগীর গায়ে নেই। কিন্তু ইমার্জেন্সি ওটি, তাই বেশি সময় ব্যয় না করে এক্স-রে করতে পাঠানো হলো। রিপোর্টে ফরেন বডি (Foreign Body) পাওয়া গেলো, যা কাঠ বা বাঁশের ভাঙ্গা টুকরো বলে ধরে নিয়েই অপারেশন টেবিলে তোলা হলো পেশেন্টকে। ২ ঘণ্টার অস্ত্রোপচারের পর পায়ুপথ থেকে বেরোলো একটা তেল মাখানো প্লাস্টিকে মোড়া গাজর। সার্জনরা প্রথমে বেশ অবাক হয়েছিল, তারপর থেকেই শুরু হলো সারাদিনের ক্লান্তি দূর করতে হাসি-ঠাট্টা। যার খোরাক হলো প্রান্তিক, হয়তো যৌন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মাঝবয়েসী রোগীটি। সরস্বতী পূজোর প্রেমের আবহে সঙ্গী না পাওয়ায় নাকি তার এই পরিণতি, যার জন্যে আমাদের এত সময় ফালতু নষ্ট!
সত্যিই তো! যৌন শিক্ষা সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র ধারণা না থাকা মানুষটা জানবে কী করে যে সেক্স টয় ব্যবহার করা কোনো যৌন বিকৃতি নয়। কিংবা জানা থাকলেও তার হয়তো সামর্থ্য ছিল না তা কেনার। কিন্তু ডাক্তাররা যতই জাজমেন্টাল হোক, ভগবান তো! তাই হাসি-ঠাট্টা-ইয়ার্কির বিনিময়ে ভোর রাতে অস্ত্রোপাচার করে হলো রোগীর রোগমুক্তি, শুধু থেকে গেলো তার লজ্জাটা!
একজন কুইয়্যার জুনিয়র ডাক্তার হিসেবে কাজ করতে গিয়ে প্রত্যক্ষভাবে যে বৈষম্যের শিকার হয়েছি তা হয়তো নয়। কিন্তু প্রতি পদেই বুঝেছি যে মানবদেহ-মনের খুঁটিনাটি ক্রিয়া-প্রক্রিয়া জানলেই একজন সংবেদনশীল মানুষ হয়ে ওঠা যায় না। মানুষের নানা আচরণ-অভিব্যক্তির পেছনে লুকিয়ে থাকা কারণ, বৈজ্ঞানিক যুক্তি মোটা মোটা বই থেকে মুখস্থ করলেই আদর্শ ডাক্তার হওয়া যায় না, যদি তৃতীয় লিঙ্গের কোনো রোগী তার চেম্বারে এলে এত বছরের রিগ্রেসিভ (regressive) চিন্তাধারা তার ডাক্তারি বিদ্যার উদার আকাশে অস্বস্তির কালো মেঘ হয়ে দেখা দেয়।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, আমাদের কিছু পাঠ্যবইতেই, এই গত বছর পর্যন্তও ‘হোমোসেক্সুয়ালিটি’ আর পশ্বাচার (bestiality) একসাথে যৌন বিকৃতির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা ছিল। ক্লাসে রাশভারী প্রফেসররাও এই বিষয়গুলো পড়ানোর সময়, কুরুচিকর মন্তব্য করতেন তাচ্ছিল্যের সুরে, কেউ কেউ আবার পুরোপুরি এড়িয়ে যেতেন, স্কুলে বায়োলজি ক্লাসের জননের চ্যাপ্টারের মতো। কেউবা আবার নিজের রসবোধের পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করতেন কিছু অযৌক্তিক কুরুচিকর জোকস্ এর মাধ্যমে।
২০১৮ এর সেপ্টেম্বরে ৩৭৭ ধারা খারিজের পর সমকামিতার উপর থেকে ‘অ-প্রাকৃতিক যৌনতা’ ট্যাগটি ঘুচলেও, চিকিৎসাশাস্ত্রের পাঠ্যবইগুলো এবং এই সংক্রান্ত বিষয়গুলি পড়ানোর পদ্ধতিতে বিশেষ পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়নি। উল্লেখ্য যে, ২০২১ সালে দু’টি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কেরালা হাইকোর্টে মেডিক্যাল পাঠ্যবইতে কুইয়ারফোবিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা ও ভুল তথ্য পরিবেশন করার অভিযোগ এনে মামলা করে এবং আদালত রায় দেয় যে, সবরকম যৌন বৈষম্য দূর করে, পুনঃমার্জন করে বই প্রকাশ করতে হবে। এরপরেই মাদ্রাজ হাইকোর্ট রূপান্তরকামী চিকিৎসক ড. ত্রিনেত্রা হালদার গুম্মারাজুর করা মামলার রায় দেয় যে, কোনো স্বাস্থ্য কর্মী বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো রোগী তার লিঙ্গ বা সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশনের ভিত্তিতে বৈষম্যের শিকার যেন না হয়। সকল স্বাস্থ্য কর্মীর কর্তব্য প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের চিকিৎসা করাকালীন তাদের লিঙ্গ বা সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশনভিত্তিক বিভেদ না করে, তাদেরকে আর পাঁচটা রোগীর মতোই সুস্থ করে তোলার দিকে মনোযোগী হওয়া।
সমাজে এখনও LGBTQIA+ গোষ্ঠীর মানুষদের প্রতি বিরূপ মনোভাব, পরিবারের সম্মতি না পাওয়া, জীবনে চলার পথে পদে পদে বৈষম্যের শিকার হওয়া – এই সব কারণে প্রান্তিক মানুষদের মাঝে depression, suicide, রূপান্তরকামী মানুষদের body dysmorphia, eating disorders – এই রকম বহু মানসিক সুস্বাস্থ্য বিঘ্নকারী রোগের প্রবণতা উচ্চহারে দেখা যায়। তাদের তাই প্রয়োজন সংবেদনশীল, সচেতন এবং পক্ষপাতশূন্য মনোবিদদের সহায়তা। এতদিন তাদের হয়তো চিকিৎসার নামে antidepressants আর erectile dysfunction এর ওষুধ দিয়ে ‘রোগ’ সারানোর চেষ্টা চলত conversion therapyকে আধুনিক চিকিৎসার মিথ্যে মোড়কে সাজিয়ে।
তবে সত্যিই এই রায়ের ফলে স্বাস্থ্য কর্মীরা খোলা মনে এই বিষয়ে সচেতন হয়ে, আরও উন্নতমানের চিকিৎসা ও সমানাধিকার দিতে সচেষ্ট হবেন কি না তা সময়ই বলে দিবে।
শুধু রোগীরাই নয়, যে সকল ডাক্তার বা অন্যান্য স্বাস্থ্য কর্মীরা LGBTQIA+ গোষ্ঠীর, তাদেরকেও নিজেদের কর্মস্থলে অনেক বৈষম্যের সম্মুখীন হতে হয়। আমাদের এক সিনিয়র ডাক্তারকে জনৈক সমকামী জুনিয়র ডাক্তারের সম্পর্কে বলতে শুনেছিলাম , “Gay হওয়া সত্ত্বেও সে খুব ভালো কাজ করে!” ওই যে সেই দ্বিতীয় বর্ষের Forensic Medicine বইটি, যাতে homosexuality পুরোপুরি রোগ না হলেও প্রতিবন্ধকতা হিসেবে গণ্য হয়েছে, বোধ হয় বেশিই মন দিয়ে পড়েছিলেন তিনি। তাই তো সব নিয়ম পাল্টালেও এখনও অনেকটা পথ বাকি বোধ হয়!
সরকারি হাসপাতালের পরিকাঠামো পরিবর্তন, ডাক্তারি পাঠ্যবই সংশোধন ও পুনঃমার্জন, সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ যেমন চলছে, তেমনি কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আর বেসরকারি হাসপাতালের যৌথ উদ্যোগে শুরু হয়েছে ‘অন্তর’, রাজ্যের প্রথম ট্রান্সজেন্ডার ক্লিনিক। রয়েছে Grindr, বার্তা ট্রাস্ট আর SAATHII স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার যৌথ উদ্যোগে চালু করা online database, যাতে পাওয়া যাবে যৌন স্বাস্থ্য সচেতনতা, চিকিৎসা, মানসিক স্বাস্থ্য এবং আইনি বিষয় সংক্রান্ত পরামর্শ ও সহায়তা।
কয়েকটা আইনের পরিবর্তনের ফলস্বরূপ সাধারণ মানুষের মনোভাব যে রাতারাতি পাল্টে যাবে, সেটা আশা করাও ভুল। কিন্তু পরিবর্তনের চাকা ঘোরা শুরু হয়েছে, আর এটাই বোধ হয় আমাদের এত বছরের লড়াইকে সার্থকতা এনে দেয়।
বাংলাদেশের পাঠকদের সামনে পড়শী রাষ্ট্রের প্রান্তিক মানুষদের চিকিৎসা ব্যবস্থার চিত্র তুলে ধরে, বর্তমান সমাজব্যবস্থার জয়গান করা একেবারেই এই লেখার উদ্দেশ্য না। বর্তমান ভারত সরকারের মহামান্য কাণ্ডারিদের জামানায় ধারা ৩৭৭ খারিজ হলেও, তারা সকলেই LGBTQIA+ এর বিরোধিতায় সরব হয়েছেন বারংবার।
বিশ্বাস করুন, আমরা আপনাদের থেকে অনেক অনেক ভালো আছি এমনটা নয়। অনেক বছরের ঝড়-বাদলের পর, আকাশে রামধনুর ক্ষীণ একটা রেখা মাত্র দেখা গেছে হয়তো। ঢাকার এক ডাক্তার বন্ধুর কাছে বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষদের চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা জানতে চাওয়ায় এই শুনে মন খারাপ হলো যে, যেসব স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন চোখে নতুন স্বপ্ন নিয়ে, উদ্যোগী হয়ে এই সব কাজে এগিয়ে আসত, জুলহাজ-তনয়ের মর্মান্তিক ভাবে চলে যাওয়ার পরে, তারা এখন গোপনেই চেষ্টা করে যাচ্ছে শুভ উদ্যোগগুলোকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার। সমাজ-প্রশাসন-আইনের চোখ রাঙানোকে তুচ্ছ করে যারা নিরন্তর কাজ করে চলেছে একটা নতুন দিনের আশায়, তাদের সাহসকে কুর্নিশ জানাই আমি।
একদিনে সরকার বদলায় না, সমাজ বদলায় না, কয়েকশো বছর ধরে মানুষের মনে গেঁথে দেওয়া অযৌক্তিক চিন্তাধারা বদলায় না। কিন্তু আমরা একেকজন হয়তো পারি ব্যক্তিগত স্তরে আশেপাশের মানুষগুলোকে একটু সংবেদনশীল, সচেতন এবং সহিষ্ণু করে তুলতে। ২০১৬ সালে American International University – Bangladesh এর এক স্টাডিতে দেখা গেছে ৭৮.৯% রূপান্তরকামী মানুষেরা হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে ডাক্তার, নার্স ব্যতীত অন্যান্য কর্মচারী দ্বারা।
নিজে ডাক্তার হয়ে সাফাই গাইছি না। কিন্তু শিক্ষা ও যেকোনো বিষয়ে আপনার সচেতনতাও কিন্তু অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই আমাদেরই কর্তব্য, যে সকল মানুষেরা LGBTQIA+ ব্যক্তিদের চিকিৎসা বা আইনি সহায়তার মতো জরুরী পরিষেবার সাথে যুক্ত, তাদেরকে অবগত করা এই বিষয়ে যে আমরা কতটা এক, আর কতটাই বা ভিন্ন। একজন একজন করে ছড়িয়ে পড়ুক এই সহিষ্ণুতার মন্ত্র। ২০২১ এর Virtual Pride মাথা তুলে ঢাকার আলপনা রাঙানো রাজপথে হাঁটার ভরসা পাক আগামী বছরে। সেদিন কলকাতায় খুব করে বৃষ্টি হোক আর ঢাকার আকাশ জুড়ে থাকুক ইন্দ্রধনু। কারণ কাঁটাতারের প্ররোচনায় সংবিধান আলাদা হলেও, আকাশ যে আমাদের একটাই!
– সরস্বতী পূজো, ১৪২৯
কোনো অর্থেই লেখক নই। এলোমেলো শব্দবন্ধে মুক্তি খুঁজে চলা এক সামান্য মানুষ মাত্র। চারিপাশে যা দেখছি তার প্রতিফলন মনের আয়নায় ধরে রাখার চেষ্টা করি প্রতিনিয়ত, যদি আর কারো মননে আমার শব্দগুলো নতুন কোনো অভিব্যক্তির সঞ্চার করে! পেশায় চিকিৎসক, নেশা দেশ-বিদেশ ঘুরে মানুষ চেনার পাশাপাশি নিজেকে আরো ভালো করে জানাও। সেই সব অভিজ্ঞতা-অনভিজ্ঞতা, স্বপ্ন-বাস্তবতা সব মিলিয়ে এই কথার জাল বোনা, যেন অন্তরের বর্ণময় মানুষটিকে খুঁজে পাওয়া আরও একটু সহজ হয়।