অদ্ভুত বাস্তবতা

আহ, হাঁপিয়ে গেলাম, আর পারিনা, দাঁড়িয়ে গেলাম রাস্তার মাঝে। পানির বোতলটা খুলে যেই মুখে দিতে যাবো, পেছন থেকে এক ধাক্কা খেয়ে বোতলটা উলটে হাত থেকে পড়ে গেলো। ধুর ছাই, চোখ গরম করে দুটো ধমক দিতে যাবো, সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি সে কখন মানুষের রেললাইন এর মাঝে হারিয়ে গেছে। বিকালবেলা রমনা পার্কে এই বয়সে হাটা টা দিনদিন মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। সব যুবক বয়সের ছেলেরা জগিং করে, দৌড়ায়, এদের সাথে তাল মিলিয়ে পারা যায়না। তার উপর কিছু নির্লজ্জ মেয়েরা তো আছেই, ছোটখাটো টাইট জামাকাপড় পড়ে কিভাবে হাটে, দৌড়িয়ে বেড়ায়, তাকানো ও যায়না ঠিকভাবে কোথাও। উফফ, আবার সেই হাপানির টান টা শুরু হলো, বিরক্তির সাথে বোতলটা তুলে মুখটা লাগিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখলাম অক্সিজেন পয়েন্টটা দেখা যাচ্ছে। এখানকার বড় বড় গাছগুলো আমার খুব ভালো লাগে, কি সুন্দর সবুজ, প্রবীণ বয়সের প্রজ্ঞার এক ছাপ আছে। সামনে এগিয়ে গিয়ে এক বিশাল অর্জুন গাছের গুড়ির উপর হেলান দিয়ে বসে পড়লাম। বুক ভরে শ্বাস নিলাম, ফুসফুসটা একটু শান্ত হলো। প্রশান্তিতে ঢুলুনি চলে এলো, চোখটা বুজে বসে রইলাম। তন্দ্রার ঘোরে চলে গিয়েছিলাম, কিছুক্ষণ পর হঠাৎ মনে হলো কে যেনো আমায় কানে সুড়সুড়ি দিলো। হকচকিয়ে উঠে বসলাম, আশেপাশে চোখ বুলিয়ে কিছুই দেখতে পেলাম না। উলটো জায়গাটা কেমন যেনো নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছে, মানুষজন দেখা যাচ্ছেনা কোনো। বিকালের আলোও পড়ে এসেছে, অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে।

“আহা বয়স হয়েছে তো অনেক, আর নিতে পারিনা তো এত ভার।” চমকে এদিক ওদিক তাকালাম, কে কথা বললো? জায়গাটা জনমানবহীন, কাউকে দেখতে পেলাম না। “এইযে ভাই আমিই বলছি, আমার গুঁড়ির উপর অনেকক্ষণ ধরে তো বসে রইলেন, এবার একটু নিস্তার দিন।” এই হালকা শীতের মাঝেও দরদর করে ঘামতে লাগলাম। এই গাছটা আমার সাথে কথা বলছে, আমি কি পাগল হয়ে গেলাম নাকি। উঠে বসে এদিক ওদিক তাকালাম। এদিকে গাছটা আবার বলে উঠলো,

“বুঝলেন ভাই, বয়স তো কম হলোনা, তবে যতই দিন যায় ততই নতুন জিনিস দেখি, শিখি। প্রতিবছর যেমন শীতকালে পুরোনো পাতা ঝরে যায়, তেমনই আবার বসন্তকালে নতুন পাতার সমাহারে সকল জীর্ণতা পরিত্যাগ করে নতুনত্ব কে আপন করে নেই। এইযে আপনার সাথে আজ কথা বলছি, আর আপনি বুঝতে পারছেন, এই বিষয়টাও নতুন হলো।”

কি সব আবোল তাবোল বকছে গাছটা। একটা বয়সে পৌঁছানোর পর নতুন শেখার কি আছে আর, এ বয়স হলো শেখানোর, সমাজের নিয়ম-কানুন, রীতি-নীতি নতুন প্রজন্মের মাঝে স্থাপন করার। কি শুনছি আমি এসব।

“ভাই ২০০ বছর ধরে এখানেই আছি। কত কিছুই আসলো গেলো, সবই দেখলাম, বুঝলাম, আপন করে নিলাম। বয়সের ভারে আজ পর্যন্ত মনকে বদ্ধ হতে দেইনি, বরং উদার করেছি। শেখানোর তো কত কিছুই আছে, তা বলে জানার যে সীমাবদ্ধতা আছে, তা তো নয়।”

এরকম অযাচিত উপদেশমূলক কথা শুনে রাগ চড়ে গেলো, আর এ গাছটা বুঝছে কিভাবে আমি কি ভাবছি? ভাবলাম, ভালোমতো একটু কথা শুনিয়ে দেই। বললাম, আপনার কথার সাথে আমি একদমই একমত না। এই উচ্ছন্নে যাওয়া প্রজন্ম থেকে কি শিখবো? আমাদের কালের মানুষের যা একটু বোধ-বুদ্ধি ছিলো, এখন তো সামাজিক, ধর্মীয়, কোনো মূল্যবোধেরই কোনো বালাই নেই। সেদিন রাস্তায় দেখলাম, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন নামিয়েছে। সে যাই হোক ভালো কথা, এরপর শুনি স্লোগান দিচ্ছে, “চলো পুরুষতন্ত্র পিষি”। মেজাজটা যে এমন গরম হয়ে গেলো, কি আর বলবো। আপনিই বলেন, পুরুষদের সৃষ্টিই করা হয়েছে নারীদের পরিচালনা করার জন্য, এরা নাহলে নিজে থেকে কিছু করতে পারে? এসব অধিকারের কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলেই তো দুনিয়াটা গোল্লায় যাচ্ছে।

কোনো সাড়া-শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না ওপাশ থেকে। মনে হলো, উপযুক্ত উত্তর দিয়ে দিয়েছি, আর কিছু তার বলার নেই। তখনই গাছটা আবার বলে উঠলো, “এ তো দেখি প্রচুর ভেদাভেদ মানুষের মাঝে। পুরুষরা উত্তম প্রজাতির, আর বাকিরা অধম। আমরা তো সকলের সমান অধিকারেই বিশ্বাসী। হাজার প্রজাতির গাছপালা আমাদের, সকলেরই সমান গুরুত্ব, সমান অধিকার। কেউ কারো উপরে কতৃত্ব খাটানোর চেষ্টায় তো নেই-ই, বরং সবাই মিলে কিভাবে পক্ষপাতশূণ্য, বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি বানাতে পারি সেই উদ্দেশ্যেই কাজ করি। সকলের গঠন, ধরণ, ক্ষমতা ভিন্ন ভিন্ন, তবে কারো ভূমিকাই কারো চাইতে ছোট নয়…”

আর শুনতে পারছিলাম না এসব, তার কথায় বাঁধা দিয়ে বললাম, এসব কথায় কোনো কাজ হবেনা। এত সমতা রক্ষা করে চলতে গেলে সমাজ হয়ে যাবে পঙ্কিলতাপূর্ণ। এখন তো তাই দেখি, আগে মেয়েরা চাকরি করতোনা, ঘরের কাজ সামলাতো, বাচ্চা-কাচ্চা পালন করতো, তাই ভালো ছিলো। এখন পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে চায়। একদিকে যেমন যোগ্য ছেলেপেলেরা এজন্য চাকরি পায়না, অন্যদিকে আছে সংসারে অশান্তি। আমার ছেলের বউ নাকি বলে সে বাচ্চা নিতে চায়না, তার ইচ্ছা নাই। এটা কোনো কথা হইলো বলেন? তারা দুনিয়াতে আসছেই তো এই কাজে, তো সেটা পালন করবে না কেন? পরিবারের প্রতি, সমাজের প্রতি একটা দায়িত্ব আছেনা?

“আসলে বুঝছেন, জোর জবরদস্তির কোনো কিছুই ভালো হয়না। আমাদের মধ্যেও তো দেখেন সব গাছে ফুল, ফল হয়না। এতে একটা সদিচ্ছার ব্যাপার আছে। যাদের জীবনে এর প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করে তারাই এভাবে বংশবিস্তার করে, সকলের প্রতি এই প্রত্যাশা নেই। এদিকে আমরা যেমন বিভিন্ন রকম গঠন, জাত, ধরণের অধিকারী, মানুষের মধ্যেও তো দেখতে পাই চিন্তা-চেতনা, ভাবাদর্শ এবং অভিব্যক্তির এক বিচিত্র সমাহার। তবুও আপনারা দেখি সবাইকে এক বাইনারি কাঠামোতে ফেলার চেষ্টায় ব্যস্ত। কাজ-কর্ম, বাহ্যিক রূপ, সব কিছুই যেন এক শক্ত কাঠামোতে আবদ্ধ।”

মেজাজটা আরো চড়ে যাচ্ছে এর কথায়। উত্তর দিলাম, শক্ত কাঠামো থাকবে না তো কিভাবে সমাজে নিয়ম শৃংখলা বজায় থাকবে? বেশি স্বাধীনতা পেয়েই তো এই নতুন প্রজন্ম উচ্ছৃংখল হয়ে যাচ্ছে। সেদিন দেখি এক ছেলে ইউটিউবে মেক-আপ এর ভিডিও বানাচ্ছে। রাস্তাঘাটে দেখি ছেলেরা শাড়ি পড়ে ঘোরে, মেয়েরা প্যান্ট-শার্ট পড়ে ঘুরছে, কারো কোনো সমাজের নিয়ম-নীতির বালাই নেই। এসব কারণেই তো আজকাল এত অরাজকতা বেড়ে গিয়েছে।

“হুমম, এ তো বড়ই আশ্চর্যের বিষয় দেখি, লিঙ্গ অনুযায়ী আপনাদের পরিধানের বস্ত্র ও অভিব্যক্তির উপায় নির্ধারণ করা হয়! আমরা তো মনে করি প্রকৃতিতে সবাই ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা পালন করতে এসেছে, সবাইকে সাদা-কালো, লাল-নীল, এরকম বাইনারি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ফেলা সম্ভব নয়। তার উপর আমাদের সকলের মাঝে এত বিচিত্র জিন এর সমাহার, আর আপনারা বলছেন সবাইকে একই রকম ভাবে চলা উচিত? আমাদের মাঝেই দেখেন, কারো সাথে কারোর বাহ্যিক রূপে মিল পাবেন না, সকলে নিজেদের সহজাত প্রবৃত্তি অনুযায়ী স্বাত্যন্ত্র নিয়ে সহ-অবস্থান করছি। সকলের স্বাত্যন্ত্রই প্রকৃতিকে এত বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে, আর আমরা এভাবেই সকলকে গ্রহণ করি।”

নাহ, এসব যুক্তি শুনতে আর ভাল্লাগছেনা তোহ। কাজের কথা কিছুই আপনি কানে নিচ্ছেন না। এত বড় বড় কথা যে বলছেন, এসব কত ধরণের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে জানেন? লজ্জার কথা কি বলবো আপনাকে, আজকাল তো দেখি সমলিঙ্গের প্রেম করাও শুরু করেছে। এসব বিকৃত মানসিকতা সমাজে বীজ বুনছে এসব উদারপন্থী চিন্তা চেতনার কারণেই। 

“ঠিকই তো, এটা তো একটা চিন্তার বিষয়। এটা যে কোনো সমস্যা হতে পারে তা তো আগে মনেই হয়নি। আমাদের মাঝে তো বিভিন্ন যৌনতার গাছ আছে, কেউ অযৌন, কেউ কো-সেক্সুয়াল, মোনোয়েশাস, ডাইয়েশাস, পলিগ্যামাস,  ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকারভেদ। আমরা তো কারো অস্তিত্বকে অস্বীকার করিনা। বৃহত্তর প্রকৃতির দিকে তাকালেও দেখতে পাবেন বিবিধ যৌনতার প্রাণের সমাহার। মানুষ তো এই প্রকৃতিরই অংশ, বাইরের কিছু নয়। এমনকি এটা তো বৈজ্ঞানিকভাবেও স্বীকৃত বিষয় যে যৌনতার বৈচিত্র্য কোনো মানসিক ব্যাধি নয়, বরং এক প্রাকৃতিক বিষয়। আর এ বিষয়টা তো নতুন নয়, মানব বিবর্তনের শুরু থেকেই এর অস্তিত্ব রয়েছে।”

এই গাছের কথার আগামাথা কিছুই বুঝছিনা। অসহ্য লাগছে, যুক্তি খুঁজছি। এর মধ্যেই বলে উঠলো আবার, “হুমম, তাহলে তো বলতে হয় মানুষের মাঝে তো সমাজের মনগড়া অসামঞ্জস্যতার ফলে যত সমস্যা। ভিন্নতাকে গ্রহণ না করে সকল বিচিত্রতাকে নিধন করে দেওয়ায় মত্ত। আমরা তো সবাই সবার সত্তাকে শ্রদ্ধার সাথে মেনে নিয়ে একসাথে আছি, যতই ভিন্ন হোক না কেন কেউ।”

এই গাছের যুক্তির সাথে তো পেরে উঠছিনা। ঢাল প্রয়োগ করে বললাম, ভাই আপনি যাই বলেন না কেন, এসব সাম্যবোধ কোনো কাজের নয়। এসব অরাজকতা শক্ত হাতে দমন না করলে সমাজ গোল্লায় যাবে।

“আমরা শান্তিপ্রিয় প্রাণ, সকলের জন্য মুক্ত বাতাস, ছায়া ও অন্নের ব্যবস্থা করেই আমাদের সার্থকতা। সকলের মঙ্গলই আমরা কামনা করি, প্রকৃতিতে এরকম অবিচার দেখলে মেনে নিতে বড় কষ্ট হয়। আপনার সাথে কথা বলে আজ অনেক কিছুই বুঝলাম, জানলাম। এই সমাজের সকল জঞ্জাল, সমস্যা, ভেদাভেদের কারণ নিয়ে অনেকদিন ধরেই চিন্তা করছি, কোনো সদুত্তর পাচ্ছিলাম না। আজ আপনার চিন্তা-ভাবনার উপর প্রতিফলন করে অনেকটাই বুঝতে পারলাম। পৃথিবীর শুরু থেকেই আমরা আছি, আধুনিক মানুষ পৃথিবীতে বিচরণ করছে মাত্র দুই লাখ বছর হলো, এর মধ্যেই পৃথিবীকে নিয়ে এসেছে ধবংসের দ্বারপ্রান্তে। আমাদের কাছ থেকেও হয়তো আপনাদের কিছু শেখার আছে।”

রাগে শরীর জ্বলতে লাগলো। ঢের শুনলাম, একে তো এখন কিছু কঠোর কথা শোনাতেই হবে। হঠাত দেখি কে যেনো ধাক্কা দিচ্ছে আমায়। চোখ মেলে দেখি পার্কের টোকাই এর দল এর এক ছোট্ট ছেলে আমায় ডাকছে। “কাকা, ঘুমায়ে গেসলেন নাকি, ওঠেন, সুরযো ডুইব্যা গেসেগা।” ধরফর করে উঠে চোখ কচলায়ে গাছটার দিকে তাকালাম। বিস্তর ডালপালা ছড়িয়ে শত বছরের পুরানো গাছটি মনে হলো হাস্যরসাত্মক ভঙ্গিতে নিথর দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বাসার পথে হাঁটা শুরু করলাম।

আমি একজন স্নাতক শিক্ষার্থী যে অর্থনীতি এবং অর্থায়নর দিকে আমার ভালোবাসাটা ফলো করছি। আপনি আমাকে খুঁজে পাবেন আমার প্রিয় খেলা খেলতে অথবা মাঠে আমার প্রিয় দলের জন্য উল্লাস করতে;  হোক সেটা ব্যাডমিন্টন, ক্রিকেট বা ফুটবল। অন্য সময়ে আমি বইয়ের পাতায় হারিয়ে যেতে পছন্দ করি যেগুলো এখনও শেষ করতে পারিনি, নিজেকে গানের মধ্যে ডুবিয়ে রাখি যা আমাকে অনুভব করতে সাহায্য করে; বেঁচে থাকার অনুভূতি আর কি। আমি ভ্রমণ করেতে ভালোবাসি। ভালবাসি নতুন মানুষদের সাথে সাক্ষাৎ করতে, চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে। আমি মনে করি লেখা একটা মহান মাধ্যম যার মাধ্যমে আমি আমার ভেতরের চিন্তা ও অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে পারি।  ফাঁকা পৃষ্ঠাগুলো অস্পষ্ট চিন্তা থেকে শুরু করে শব্দ দিয়ে পূর্ণ হয় এবং একটা ভাষা খুঁজে পায়। আমি যে লেখাটা জমা দিয়েছি তা আমাদের সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন লিঙ্গ এবং যৌনতা সম্পর্কিত সমস্যাগুলির প্রতি আমার যে আশঙ্কা রয়েছে সেটা কে ইঙ্গিত করে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা। লেখাটা আমার জন্য অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ একটা যাত্রা হয়েছে, এবং আশা করি এটি পাঠকদের মধ্যেও চিন্তার ট্রেন জাগিয়ে তুলবে।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.