রূপান্তর

নিউট্রন

ধীরে ধীরে আয়নার শরীরটা বদলে যেতে থাকে। কমনীয় নারী শরীরটার জায়গায় একটা মাংসল পুরুষালি দেহ দাঁড়িয়ে থাকে। চওড়া কাঁধ, শক্ত চোয়াল, ওষ্ঠের উপর পাতলা গোঁফের রেখা; ভরাট স্তন যুগল মিলিয়ে যায়, যোনির জায়গা দখল করে পুরুষাঙ্গ।

শান্ত নিজের লোমশ হাত, পা, বুক স্পর্শ করে। লম্বা ভেজা চুলগুলো কায়দা করে পেছনে নিয়ে আটকে দেয়। তারপর মুগ্ধ দৃষ্টিতে আয়নার শরীরটার দিকে তাকিয়ে থাকে।

“কিরে শান্তা! গোসল করতে কয় ঘন্টা লাগে?”

মায়ের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পায়। আয়নায় আবার আগের মেয়েলি শরীরটা ফেরত এসেছে। শরীরটার দিকে দ্বিতীয়বার তাকাতে ইচ্ছা করে না। ঝটপট জামা পরে বেরিয়ে আসে।

মা শোবার ঘরে কাপড় ভাঁজ করে আলমারিতে তুলছেন। চুল মুছতে মুছতে দরজায় গিয়ে দাঁড়ায় শান্তা।

“কিরে হলো?” মাথাটা বারকয়েক উপর নিচ করে সায় দেয়, হয়েছে।

“ভালো জামাকাপড় নাই তোর? এসব কী পরিস? ছোট খালা গত ঈদে যে জামাটা দিয়েছিল ওটা পরগে যা। বাসায় মেহমান আসছে।”

নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। হলুদের উপর সাদা ফুলের কাজ করা জামাটা খুঁজে বের করে। ওটা গায়ে চাপিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে আয়নার মেয়েটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরখ করতে থাকে। মাঝারি গড়ন, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ গায়ের রং, কাঁধ পর্যন্ত ঢেউ খেলানো কালো চুল, গাঢ় বাদামী চোখ আর মিষ্টি

হাসি- যেসব বৈশিষ্ট্য থাকলে বাঙালি মেয়েদের সুন্দরী বলা হয়ে থাকে প্রায় সবগুলোই আছে ওর মধ্যে। “সুন্দরী!” শব্দটা সুঁচালো হয়ে মগজে গিয়ে বিঁধে। প্রাণপণ চেষ্টায়ও সেটাকে মগজ থেকে বের করতে পারা যায় না।

স্কুল ওর খুব অপছন্দের একটা জায়গা। এখানে আসতে একদম ইচ্ছে করে না। স্কুলড্রেসটাও যেন কেমন। সাদা পায়জামার সাথে বেগুনী রঙয়ের ফ্রক। তার উপর সাদা ক্রসবেল্ট। বরং ছেলেদের ইউনিফর্মটা সুন্দর। নেভি ব্লু প্যান্টের সাথে সাদা শার্ট পরে স্কুলে আসতে পারলে স্কুল ব্যাপারটা এতটাও মন্দ লাগত না বোধহয়। এখানে ওর

তেমন বন্ধুও নেই। মেয়েদের সাথে মিশতে বরাবরই একটা সংকোচ বোধ করে। ঠিক খাপ খাওয়াতে পারে না। স্কুলের কোনকিছুই ভালো লাগে না ওর। শুধু মুনা বাদে। মুনা মেয়েটাকে ওর বেশ ভালো লাগে। ছটফটে টাইপের মেয়ে। কোথাও স্থির হয়ে বসতে পারে না। কথা বলার সময় মনে হয় এ- কান ও- কান ভেদ করে একটা মেল ট্রেন

ছুটে গেল। মুনা খুব সুন্দ র করে হাসে। ওর উপরের পাটিতে একটা গজ দাঁত আছে। গজ দাঁতওয়ালা মেয়েদের ওর খুব ভালো লাগে। পুরো স্কুলে মুনাই ওর একমাত্র বন্ধু।

স্কুল ছুটির পর এক ছুটে বাসায় চলে আসে শান্তা। তলপেটে প্রচণ্ড চাপ দিচ্ছে। বাথরুমে যাওয়া দরকার। থার্ড পিরিয়ড থেকেই চেপে বসে ছিল। প্রায়ই এরকম হয় ওর সাথে। স্কুলের বাথরুমে কখনোই যেতে পারে না। ছেলেরা বুঝি মেয়েদের বাথরুমে যায়! মাঝেমধ্যে নিজের উপর প্রচণ্ড রাগ হয়। ভুল শরীরে জন্মানোর দায়টা যেন তারই।

মাঝেমধ্যে রাগটা গিয়ে পড়ে ঈশ্বরের উপর। প্রায়ই মনে হয় ব্যাটা ইচ্ছা করে তাকে এমন বানিয়েছে। যাতে মাঝেমধ্যে ওর দুর্দশা দেখে খুব একচোট হেসে নেওয়া যায়।

শায়লা বেগম গয়নার বাক্সটা বের করে গয়নাগুলো উল্টেপাল্টে দেখতে থাকেন। একমাত্র মেয়ের বিয়ের জন্য এগুলো তুলে রেখেছেন। একদিন খুব ধুম ধাম করে মেয়ের বিয়ে দেবেন। মেয়ে পরের বাড়ি চলে যাবে ভাবতে ভাবতেই চোখের কোনায় জমে উঠা বাষ্পকে শাড়ির আঁচলে আড়াল করে বাক্সটা আবার তুলে রাখেন। একটা মেয়ের খুব শখ ছিল। আল্লাহপাক তার সেই আশা পূর্ণকরেছেন যখন বাকিটাও করবেন। সৃষ্টিকর্তাকে কোনদিন নাখোশ করেছেন বলে মনে পড়ে না তার।

মা প্রতিদিন দুপুরে খাওয়ার পরে ঘন্টাখানেক ঘুমান। আজও ঘুমাচ্ছেন। তবুও অতিরিক্ত সাবধানতাবশত ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দেয় শান্তা। সন্তর্পণে স্কুল ব্যাগ থেকে পলিথিনে মোড়ানো কাগজের প্যাকেটটা বের করে। প্যাকেট খুলে নতুন কেনা শার্টটা বের করে। স্কুল থেকে ফেরার পথে জলপাই সবুজ রঙয়ের শার্টটা দেখে লোভ সংবরণ করতে পারে নি। তাই দুই মাস ধরে জমানো টিফিনের টাকা পুরোটাই খরচ করে কিনে ফেলেছে এটা। ঝটপট শার্টটা গায়ে চাপিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় শান্ত। একটু বড় হয়েছে। কাঁধের কাছটা ঢলঢল করছে। তবুও আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে খুশিতে সবগুলো দাঁত বের হয়ে যায়। বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেকে দেখতে থাকে। তখন বসার ঘরে কারো পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। চমকে উঠে তড়িঘড়ি করে জামাটা বদলে শার্টটা লুকিয়ে ফেলে ভালোমতন। মা দেখলে আস্ত রাখবেন না। বুকের ভেতর কেউ যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে। হঠাৎ খুব কান্না পেতে থাকে ওর।

মুনার হতবিহ্বল চোখের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে শান্ত। সে যে ঠাট্টা করছে না সেটা বোঝাতেই অনেকটা বেগ পেতে হয়েছে তাকে। বুঝে উঠার পরপরই কিভাবে কথা বলতে হয় সেটাই ভুলে গেছে। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে কেবল।

“তুই জানিস কী বলছিস?”

“জানি।”

“জানিস এগুলো পাপ?”

“কোনগুলো?”

“এই যে একটা মেয়ে আরেকটা মেয়েকে—”

“আমি মেয়ে না।”

“তো তুই কী?”

“আমি ছেলে। আমার নাম শান্ত।”

“মাথাটা ঠিক আছে তোর?”

ঝড়ের বেগে ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে যায় মুনা। ফাঁকা ক্লাসরুমের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে আবরারের সাথে হেঁটে যাচ্ছে মেয়েটা। মাঝেমধ্যে খুব আবরার হতে ইচ্ছে করে। আবরার না হতে পারার যন্ত্রণায় দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। ঝাপসা চোখের সামনে ওরা আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায়।

সেলুনের ডজনখানেক চিড়িয়া দেখা চোখকে উপেক্ষা করে একটা ফাঁকা চেয়ারে বসে পড়ে শান্ত। নাপিতকে কিছু নির্দেশনা দিয়ে ঘাড় শক্ত করে বসে থাকে। মনে হচ্ছে এখানকার প্রত্যেকটা লোক ওর হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছে। যতটা সম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যায়।

“এইটা কী?”

“ছেলে না মেয়ে?”

“দেখ দেখ দেখ।” এইরকম অজস্র মন্তব্য এবং কৌতূহলী দৃষ্টির সামনে দ্রুত পায়ে মাথা নিচু করে হেঁটে যেতে থাকে ও। লজ্জায় আর অপমানে মাটির নিচে সেঁধিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। বাসায় ঢোকার সময় মাকে কোথাও দেখতে পায় না। এক দৌড়ে গিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। হাঁটু গেড়ে বিছানায় বসে থাকে। যে কোনো সময় মায়ের মুখোমুখি হতে হবে তাকে। হঠাৎ বিছানার পাশে রাখা আয়নায় চোখ পড়ে। আয়নার প্রতিবিম্বটার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণের জন্য সব ভুলে যায় সে। এইতো শান্তা থেকে ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে উঠছে ও। একদিন ও পুরোপুরি শান্ত হবে। নিজের দিকে তাকিয়ে একবার মুচকি হাসে। আয়নার ছেলেটাকে এবার বেশ সুদর্শন মনে হয় ওর।

প্রথম প্রকাশ: সমারূঢ়
(মন্দ্র প্রকাশিত বাংলাদেশের প্রথম কুইয়ার ছোটগল্প সংকলন)

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.