সমকালীন সামাজিক দর্পণে হোমোফোবিয়ার ব্যবচ্ছেদ

নরএপিনেফ্রিন

অনলাইনে হাতেগোনা যে কয়টা জায়গা আছে যেখানে আপনি একজন এলজিবিটি+ (LGBTQIA+) এর সদস্য হিসেবে নিজের কথা অন্য অনেককে জানাতে পারবেন, এমন পেইজে/স্পেসে প্রতিনিয়তই কতিপয় বিশুদ্ধ হোমোফোবিক মানুষজনের দেখা পাওয়া যায়। তন্মধ্যে কয়েকজনের প্রোফাইল ঘুরলে মনে হবে হোমোফোবিয়াটা যেন তাদের নিজ পরিচয়েরই অংশ। তাদের বায়োতে “হোমোফোবিক/ট্রান্সফোবিক” লেখা, প্রোফাইলে কুখ্যাত ধর্ম-ব্যবসায়ীদের কথা-বার্তা, এন্টি-এলজিবিটি সম্পর্কিত পোস্ট/মিমস এবং আরো এরকম অসংখ্য বিদ্বেষমূলক কার্যক্রম চোখে পড়ে। এই বিশুদ্ধ হোমোফোবিকদের এহেন কার্যকলাপে আমার মনে প্রায়শই প্রশ্ন জাগে যে, আমি না হয় সমকামী তাই আমার এসব নিয়ে এত চিন্তা। আমার জীবনে সমকামিতা/সমকামীদের আনাগোনা আছে। আমি এসব পেইজ ফলো করে বেড়াই, কারণ আমি আমার সমমনা মানুষদের সঙ্গে কিছুটা হলেও সংস্পর্শে থাকতে চাই। কিন্তু তারা কেন?

মনে করা যাক, আপনার চোখে আপনি একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম এবং এই সমাজকে কলুষতা থেকে মুক্ত রাখতে আমাদের মতো সমকামীদের পিছনে উঠে পড়ে লেগেছেন। পারলে এই এখনি আমাদের শরীর থেকে মস্তকটা আলাদা করে দিবেন। তবে আমার শরীর থেকে আমার মাথা আলাদা করার আগে আমার একটি প্রশ্ন রয়েছে।

আপনি নিশ্চিত তো, আপনি আমাদেরকে এই যে ঘৃণা করছেন সেটা  কেবল আপনার ধর্মের কাছে আপনার দায়বদ্ধতা থেকেই করছেন?

নাকি নিজের মধ্যকার অপ্রাসঙ্গিক এই ঘৃণাকে ধর্মের বর্মে লুকাতে চাচ্ছেন, যাতে যুক্তির বাণে আপনি বিদ্ধ না হয়ে যান?

আজকে যখন কেউ কাউকে ঘুষ দিচ্ছে বা কারও কাছ থেকে ঘুষ দাবি করছে, আজকে যখন একজন এতিম তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, আজকে যখন কোনো অশীতিপর বৃদ্ধ/বৃদ্ধা তারই গর্ভজাত সন্তানের কাছে লাঞ্ছিত হচ্ছে, আজকে এই মূহুর্তে যখন চড়া সুদে ঋণী হয়ে অনেকে সহায় সম্বল হারাচ্ছে, কিংবা কেউ যখন ক্ষুধার যন্ত্রণা নিয়েই ঘুমিয়ে যাচ্ছে — আমাকে উত্তর দিয়ে যান আপনাদের মুসলিম আবেগ তখন কোথায় থাকে? আপনাদের এই তথাকথিত সমাজকে কলুষতা মুক্ত করার অন্তস্থ আলোড়ন এতই নির্লজ্জতায় মোড়া যে, যাদেরকে থামানোর কথা তাদের না থামিয়ে, একটা গোষ্ঠীর উপর ভর দিয়ে নিজেদের বিশ্বাসী হওয়াটা জাহির করছেন।

সমাজে চলমান অরাজকতা বা দুর্নীতি অথবা দুর্নীতিবাজদের নিয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ কারও নেই। খোঁজ নিলে দেখা যাবে তাদের মধ্যে অনেকে নিজেরাই ঘুষখোর এবং অন্যের অধিকার হরণ করছে। অধিকার হরণ করার শাস্তি ইসলামে কেমন প্রখর তা আশা করি আপনারা জানেন। আবার নাও জানতে পারেন, কেননা আপনাদের ভূষণ নির্লজ্জতা। তাই না জানলে অবাক হব না।

এই যে হোমোফোবিয়াকে নিজেদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে ধরে নেওয়া মানুষজনকে কিন্তু একজন ক্ষমতাশীল অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে কখনো দাঁড়াতে দেখা যাবে না, তাদের নিয়ে মিমস/পোস্ট শেয়ার করতে দেখা যাবে না, এমনকি অন্যায় প্রতিরোধে একজন ব্যক্তির কর্তব্য বিষয়ে ধর্মে যে সকল আলোচনা আছে এসব নিয়েও কথা বলতে দেখা যাবে না তাদের। তবে হ্যাঁ, আরো একটা কাজ তারা ভালো পারেন, নারীদের বন্দী করতে। 

বিশুদ্ধ হোমোফবিকদের বিশাল অংশের আরো একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো উনারা তুখোড় নারী-বিদ্বেষী। এই সমাজে যত সমস্যা তার সৃষ্টি আমাদের নারীদের পড়াশোনা, চাকরি, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার কারণেই এবং তাই তাদের মতে, আমাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আবারও ঘরে বন্দী করতে হবে। আমাদেরকে সারাজীবন রাঁধুনি ও যৌন দাসী হিসেবে রাখতে পারলেই সব সমস্যা যেন উড়াল দিবে।

এই যুক্তি মোতাবেক বর্তমানে আফগানিস্তানের স্বর্গ হওয়ার কথা ছিল বৈকি! কিন্তু কি পরিমাণ অবক্ষয় আফগান সমাজের হয়েছে তা কল্পনার অতীত! নিজের ক্ষুধা মেটাতে সন্তানকে বিক্রি করতে হচ্ছে, ভাবা যায়?! 

কিন্তু কোথায়? এখনো কোনো তেলের খনির অধিপতি আরব রাজপুত্রকে সাহায্যের হাত বাড়াতে তো দেখা গেলো না। হাত বাড়াবেও না। কেননা, তারা যে এখন সপ্তম বিবাহ সম্পাদন করতে এবং নিজ গৃহকর্মীর মাধ্যমে যৌন লালসা মেটাতে ব্যস্ত। 

আমি যখন প্রথম বুঝতে পারি বাংলাদেশে এত এত পুরুষ আজকের দিনেও নারীর স্বাধীনতার বিপক্ষে দুর্দান্ত ভাবে ভূমিকা রাখছেন এবং তারা এতে গর্ব বোধ করেন — আমি ভিতর থেকে খুব অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। অনেকদিন আমার মনে হয়েছিলো আমি শত্রু শিবিরে আছি, এখানে কেউ আমার আপন নয়। আজ সেই অস্থিরতা যখন শক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে, আমি আশা রাখি এসবের জবাব একদিন দৃঢ় কণ্ঠে দিতে পারবো। 

আমি সমকামী ও আমি নারী। আমার পথ শুধু কঠিন নয়, এ যেন জ্বলন্ত কয়লার উপর দিয়ে পুনঃপুনঃ হেঁটে চলা। এই পথ দীর্ঘ এবং এর উপর দিয়ে নিরন্তর ছুটে চলাই বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়। মাইনরিটির উপর নিজ আধিপত্য বজায় রাখতে ধর্মের আশ্রয় নেওয়া পুরানো বিজনেস এবং পলিটিকাল পলিসি। এই পলিসিতে কম ইনভেস্টমেন্টে যেরকম বিশাল প্রফিটের মুখ দেখা যায়, তা লোভনীয় এবং তথাকথিত ধর্মের সৈনিকরা এই লোভ থেকে মুক্ত হতে পারেননি কখনোই।

আমি একজন সমকামী হয়েও এলজিবিটি রিলেটেড পেইজের এত খবর রাখি না, যত খবর বিশুদ্ধ হোমোফবিকরা রাখেন। তাদের চোখে হাদিস তখনই ধরা পড়ে যখন কোনো সমকামীকে দেখেন। এছাড়া বাদবাকি সময়ে তাদের চেতনা থাকে সুপ্ত অবস্থায়। 

হোমোসেক্সুয়াল মানুষজনকে যিনি সৃষ্টি করেছেন এবং হেটেরোসেক্সুয়াল হোমোফবিকদের যিনি সৃষ্টি করেছেন, উনি একজনই, একটাই সত্ত্বা। হোমোসেক্সুয়ালিটি এখন আর বিদেশী কোনো তত্ত্ব নয়। আগে না হয় তথ্যের অভাব ছিল। কিন্তু বর্তমানে চাইলেই যেকোনো বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা যায়। সময় বদলাচ্ছে তবে স্বভাব বদলাচ্ছে না। নিজ সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির উপর বেশিরভাগ হেটেরোসেক্সুয়াল হোমোফবিক মানুষের ভরসা নেই। ভরসা থাকলে সমাজ সহনশীল হতো। আমরা কোন জেন্ডারের প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করি সেটা তখন আর সৎ, সুশীল, সুশিক্ষিত মানুষ হবার একমাত্র মানদণ্ড হয়ে উঠতো না।

সমকামিতা যদি সমাজ ধ্বংসের কারণ হতো, তাহলে পৃথিবী এতদূর মনে হয় না আসতো। কারণ, সমকামী মানুষ সব সভ্যতায়, সব সমাজেই, সব শ্রেণিতেই, সব সময়ই ছিল।

সত্যি বলতে মিলেমিশে থাকার কথা ভাববো এরকম পরিস্থিতি ক্রমেই চলে যাচ্ছে। সম্প্রীতির এই শেষ যাত্রায় সম্প্রীতিকেই আজ নিজ এপিটাফ লেখার প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে!

(বিঃদ্রঃ “বিশুদ্ধ হোমোফবিক” কথাটি ব্যঙ্গাত্বক ভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। ইহা দ্বারা কোনো শ্রেণিবিভাগ করা হয়নি।)

আমি নরএপিনেফ্রিন। এ বছর সাহসী হওয়ার পথে কয়েক ধাপ আগাতে চাই।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.