‘সমাজের মাঙ্কিপক্স’ বনাম ‘মাঙ্কিপক্স’

তন্ময় সরকার

বর্তমান বিশ্বে আমাদের সমাজের সকল স্তরে ‘অন্ধত্ব’ মহামারী আকারে রূপ নিয়েছে। চারিদিকে জেঁকে বসেছে এই অন্ধত্ব! যেদিকে তাকানো যায়, সেদিকেই নেতৃত্বে অন্ধত্ব, দলে অন্ধত্ব; অন্ধত্ব আছে ব্যক্তিতে, কর্মস্থলে; পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে। মানুষের কথায় অন্ধত্ব, তাদের বন্ধুতে অন্ধত্ব। অন্ধত্ব সম্পর্কে, অন্ধত্ব বিচারে। বলা যায়, অন্ধত্বের দাপটে পুরো বিশ্বই যেনো আজ অসহায়। অন্ধত্বের কালো থাবাক্রমণে আক্রান্ত হয়ে ব্যক্তি বিবেক আজ যেমন ধূলিস্যাৎ হচ্ছে প্রতিনিয়ত, তেমনই অন্ধত্বের মাঙ্কিপক্সে আজ জর্জরিত বিশ্ব বিবেক-ও। এসব কিছুর মূলে রয়েছে ‘স্বার্থান্ধতা’ আর ‘অজ্ঞতা’ নামক ‘ভাইরাস’। স্বার্থান্ধতা ভাইরাসটির প্রবল ক্ষতিকর। স্বার্থের নিকট যারা পরাজয় বরণ করেন, তারা স্বভাবতই ব্যক্তি বিবেক বিসর্জন দেন। অজ্ঞতা ভাইরাসটি জ্ঞানসীমা রেখায় বিরাজ করে। ফলে অজ্ঞতা জ্ঞানের ওপর নির্ভর করায় বিবিধ ক্ষতির সম্মুখীন হতে না হলেও, সঠিক পথে চলার অন্তরায়। আজকের নিবন্ধে উল্লিখিত যুক্তি হয়তো এক চেটিয়া সর্বমহলে সমর্থন পাবে, এমনটি আশা করা বড়ই দুরূহ। কারণ ‘অন্ধত্ব’ যখন সমাজের রন্ধে রন্ধে ঢুকে মিলেমিশে একাকার। তখন অন্ধত্বকেই দৃষ্টি ভাবা ছাড়া বৈ কী আর আছে? মোদ্দা কথা, অন্ধ সমাজে অন্ধত্বের বিপরীত কিছু কামনা করা বেকার খাটুনি খাটারই নামান্তর।

আমরা যদি বিশ্ব ইতিহাসের দিকে  তাকাই তবে দেখা যাবে, বিভিন্ন সময় কেবল এক বিশেষ শ্রেণির সম্প্রদায় যারা যেকোনো রাষ্ট্রে কিংবা সমাজে সংখ্যালঘু; তারাই  সমস্ত অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ-উৎপীড়নের শিকার হয়েছে বারংবার। আবার তাদের প্রতি বিচারহীনতা ও পক্ষপাত তুষ্ট দৃষ্টি ভঙ্গীর জন্য এসবের সঠিক প্রতিবেদনটিও হয়ত কখনো কখনো গ্রন্থগত হয় নি। কিংবা দেখা গেছে সমাজের  হর্তাকর্তারা নিজেদের কৃতকর্মকে ইতিহাসে হালাল প্রমাণ করার জন্য এইসব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনগণদের নানান  ঘৃণা ও বিদ্বেষ মূলক চরিত্রে, কর্মে ইনিয়েবিনিয়ে তুলে ধরেছেন। যেমন HIV ভাইরাস সংক্রমণের একদম শুরুর দিকে, এটিকে “Gay Disease” বলে বিশ্বে প্রচার করা হয়েছিল। সময়টা এমন যখন পুরো বিশ্বে সমকামীদের ন্যূনতম মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন একদম সাফল্যের দোরগোড়ায়। সুতরাং তৎকালীন এমন নেতিবাচক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন দেশে এই আন্দোলন একপ্রকার হোঁচট খেয়ে বসে।  সমাজের রক্ষণশীলরা HIV ভাইরাস কে পুঁজি করে নানান ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক অপপ্রচার চালাতে থাকে। যার রেশ কিন্তু এখনো কাটে নি। সুতরাং অন্ধত্বে উন্মাদনা চলছেই।

আমরা যদি বর্তমান সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে একটু তাকাই, সেক্ষেত্রেও অবাক না হয়ে পারা যায় না। যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সারা পৃথিবীতে সমকামীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় খুব তৎপর, স্বয়ং তাদের নিজ সমাজ কিংবা মার্কিন লোকজন কী সেই মানসিকতা সমান ভাবে সমুন্নত রাখছেন? খুব রূঢ় শোনালেও, উত্তর হচ্ছে না! কারণ এখনো মার্কিন বিভিন্ন সমাজে সমকামীতা কিংবা সমকামীদের কুরুচিপূর্ণ বলেই ভাবা হয়। কেবল সমকামী পরিচয়ের জন্য তাদের কাছে অনেকে বাড়িভাড়া দিতে ইচ্ছুক না। পাশাপাশি চিকিৎসা ক্ষেত্রে কিংবা কর্ম ক্ষেত্রেও নানান বৈষম্যের শিকার হতে হয় সমকামীদের। তাই অর্থ উপার্জনের জন্য অনেকেই বাধ্য হয়ে যৌন কাজ করছেন নতুবা ‘Porn Industry’ তে নিজের নাম লেখাচ্ছেন। এই হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের মানসিকতা, যারা পুরো বিশ্বকে আলোর দিশা দেখাচ্ছেন বলে প্রচার করেন। অথচ সেখানেও বিভিন্ন স্থানে কিংবা মানুষের মানসিকতায় অন্ধত্বের চর্চা নিত্যই হচ্ছে!

করোনা অতিমারির তাণ্ডবে পুরো বিশ্ব একপ্রকার নাস্তানাবুদ। এই অতিমারির রেশ কাটতে না কাটতেই, মাঙ্কিপক্স চোখ রাঙাচ্ছে পুরো বিশ্বের দিকে চেয়ে। কিন্তু দুঃখজনক ভাবে পুরো বিশ্বে একশ্রেণির গোষ্ঠী যারা রক্ষণশীলতা, অন্ধত্বকে লালন করে যাচ্ছে যুগের পর যুগ; তারা আবারও সমকামী সম্প্রদায়ের উপর ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর নতুন হাতিয়ার হিসেবে এই ‘মাঙ্কিপক্স’ ভাইরাসকে বেছে নিয়েছেন। অথচ এই ভাইরাসটি দ্বারা সৃষ্ট মাঙ্কিপক্স রোগটি নতুন কোনো রোগই নয়। ১৯৫৮ সালে এই ভাইরাসটি প্রথম শনাক্ত করা হয় বানরের দেহে। যেখান থেকে ভাইরাসটির নামকরণ হয় ‘মাঙ্কিপক্স’। অথচ নাম হওয়া উচিত ছিলো ‘র‍্যাটপক্স’! কারন এটির বাহক ইদুর! এখন আবার অনেকেই এই পক্সের নাম ‘Gay Pox’, ‘Homosexual Pox’ বলে নানান মিডিয়া ও পত্র-পত্রিকায় অপ্রচার চালাচ্ছেন। বিষয়টা একই সাথে হতাশাজনক ও হাস্যকর!

এই মাঙ্কিপক্স  ভাইরাসটি ১৯৭০ সালে ‘ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অফ কংগো’ তে প্রথম মানুষের শরীরে শনাক্ত হয়। ১৯৭০ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত গুটিবসন্ত (Small Pox) কে পৃথিবী থেকে নির্মূল করার জন্য ব্যপক হারে টিকাদান কর্মসুচি পুরো বিশ্বেই একযোগে পরিচালনা করা হয়। তখন বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছিল যে, এই টিকা দেয়ার ফলে মাঙ্কিপক্সের বিরুদ্ধেও কিছুটা প্রটেকশেন পাওয়া যাচ্ছে। গুটিবসন্ত বিলুপ্ত হওয়ার পর থেকে আবার কিছু কিছু জায়গায় মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ হচ্ছিল। যেমন পরবর্তীতে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এটি স্থানীয় পর্যায়ে ব্যপক সংক্রমণ ঘটনার নজির আছে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে যেমন ঢাকায় প্রতি বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে ‘ডেঙ্গী’ ভাইরাসের প্রকোপ দেখা যায়, অথচ সেটি নিয়ে পুরো বিশ্ব মিডিয়া কিংবা পত্র-পত্রিকার তেমন কোনো মাথাব্যথা লক্ষ্যই করা যায় না।

আবার অতীতে অফ্রিকার দেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় এই মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত বিভিন্ন রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। এইতো কিছুদিন আগে, ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মাঙ্কিপক্সে সংক্রমণের একটি ঘটনা ঘটেছিল। যেটি সংক্রমিত হয়েছিল কুকুরের মাধ্যমে। সেই কুকুর কে রাখা আবার রাখা হয়েছিল ইদুরের সাথে। যেখান থেকে কুকুরটি সংক্রমিত হয়।  আবার কুকুরটি থেকে তার প্রতিপালক ব্যক্তিটি মাঙ্কিপক্সে সংক্রমিত হন। প্রশ্নজাগে, সেই ব্যক্তিটি কি সমকামী ছিলেন কি না? কিংবা তিনি তার কুকুরটির সাথে যৌনতায় লিপ্ত হয়েছিলেন কি না? বাস্তব সত্য হল, এর একটিও নয়। তবে এখন মনে এই  প্রশ্নটি জাগে, কেন তখন মাঙ্কিপক্সকে  ‘Heterosexual Disease ‘ বলে প্রচার করা হয় নি?।তবে আজকে যখন পুরো বিশ্বে এখন পর্যন্ত কেবল একশত (১০০) জন মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়েছে; যেখানে আবার সবাই সমকামী নয়! তবে সেক্ষেত্রে এটিকে Homosexual Disease, Gay Disease/Pox বলে অপ্রচার চালানোর উদ্দেশ্য কী হতে পারে? সমাজের ও ধর্মের  রক্ষণশীলতা, অজ্ঞতা আর অন্ধত্বে আমাদের আর কত দিন পিষ্ট হতে হবে? আর কত দিন সমাজের সকল স্তরের মানুষের ভীড়ে একদম পিছনের কাতারে দাঁড়িয়ে, আমরা আমাদের অধিকার, প্রবঞ্চনা, নানান ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক অপপ্রচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবো?

বলতে পারবে কি কেউ, সেই সুদিন আসবে কবে?

তথ্যসূত্রঃ

১.https://www.google.com/amp/s/www.aljazeera.com/amp/news/2022/5/23/racist-and-homophobic-coverage-of-monkeypox-un-denounces

২.https://www.thebritishacademy.ac.uk/blog/aids-epidemic-lasting-impact-gay-men/

৩.https://www.hrc.org/resources/hrc-issue-brief-hiv-aids-and-the-lgbt-community

৪.https://www.google.com/amp/s/amp.theguardian.com/world/2022/may/23/un-denounces-homophobic-andue-brief-hiv-aids-and-the-lgbt-community

৫.https://www.cdc.gov/poxvirus/monkeypox/index.html#:~:text=Monkeypox%20was%20first%20discovered%20in,intensified%20effort%20to%20eliminate%20smallpox.

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.