রং-তুলির ইতিহাসে রামধনুর অস্তিত্ব

Mondro blog

 কৌস্তভ

সেই গুহামানবদের আদিমযুগ থেকেই চিত্রকলা মানুষের মত কিংবা ভাবপ্রকাশের অনন্য মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। ভাষায় লিখে বা বলে যা প্রকাশ করা যায়না, সেটাই আমরা চেষ্টা করি ছবির মাধ্যমে অন্যের হৃদয়কে স্পর্শ করাতে।

তাই যুগ যুগ ধরে মত প্রকাশের স্বাধীনতাই বলুন, কিংবা নিজের অস্তিত্বকে জানান দেয়ার আন্দোলনই হোক, ছবি এঁকে নিজের কথা তুলে ধরা একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সমকামিতা এই আধুনিক যুগে এসেও বিশ্বের অনেক দেশে নিষিদ্ধ এবং জঘন্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। 

তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কল্যাণে, অনেক দেশই ধীরেধীরে সমকামিতাকে স্বীকৃতি প্রদানসহ শাস্তি লাঘবে উদ্ধুদ্ধ হচ্ছে।

বাংলাদেশ এটিকে পশ্চিমা সংস্কৃতির আগ্রাসনের ফল হিসেবে আখ্যা দিলেও, সমকামিতা যে এই উপমহাদেশ সহ সারাবিশ্বের নানা প্রান্তে প্রাচীনকাল থেকেই বিদ্যমান তা নানা চিত্রকলা,ভাস্কর্য,উপকথা এবং ধর্মীয় গ্রন্থগুলো থেকে সহজেই অনুমেয়। আব্রাহামিক ধর্মসমূহের সংস্কৃতিতে সমকামিতাকে কট্টরভাবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত করা হলেও, প্রাচীন গ্রীক সভ্যতা এবং হিন্দুধর্মের পুরাণ সমূহে সমকামিতার নানা গল্প পাওয়া যায়। 

terracotta of sexuality and sensuality
ভারতের খাজুরাহো মন্দিরে গোপনাঙ্গ স্পর্শরত পুরুষ যুগল

খাজুরাহোর মন্দিরগুলি স্থাপত্যশিল্প এবং কামুক ভাস্কর্যের জন্য পরিচিত। এই মন্দিরগুলিতে পাওয়া অনেক ইরোটিক ভাস্কর্যের মধ্যে এটিই সমকামিতার একমাত্র উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। কান্দারিয়া মহাদেব মন্দিরের বাইরের দিকে এই ভাস্কর্যটির দেখা মেলে।

এই ভাস্কর্যগুলি তখনকার সমসাময়িক গল্পকে ব্যক্ত করার পাশাপাশি জনসাধারণের জীবনযাত্রা এবং তাদের যৌনতার গল্প বলে, যা প্রায়শই সে সময়কার উন্মুক্ত চিন্তাভাবনার অগ্রগতি প্রতিফলিত করে।

Lesbian intercourse using organic tools
মোঘল শাসনামলে অংকিত একটি চিত্রকর্ম। দুজন মহিলা একে অপরকে আলিঙ্গন করছেন এবং গাজরকে ডিলডো হিসাবে ব্যবহার করছেন। (একজন ভারতীয় চিত্রশিল্পীর গাউচে চিত্রকর্ম c.1900)
seducing
মুহাম্মদ কাশিম কর্তৃক অঙ্কিত। ইরান (১৬২৭)

এই ক্ষুদ্র চিত্রকর্মটিতে পারস্যের শাহ আব্বাস প্রথম এবং উনার সেবকের সাথে আলাপচারিতা এবং ওয়াইন ভাগ করে নেওয়া দেখানো হয়েছে। চিত্রটি আবেদনময় এবং অন্তরঙ্গ কেননা ছেলেটি ওয়াইনের পাত্রটি শাহের গোপনাঙ্গে স্পর্শ করে ধরে রেখেছেন।

"উটাগাওয়া হিরোশিগে" কর্তৃক অঙ্কিত মৈথুনরত সমকামী যুগল
“উটাগাওয়া হিরোশিগে” কর্তৃক অঙ্কিত মৈথুনরত সমকামী যুগল

শুঙ্গা, যার আক্ষরিক অর্থ ‘বসন্তের ছবি’, যেটিকে জাপানে ইরোটিক শিল্পকে বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয়। প্রাচীনযুগে জাপানে সমকামিতা যে শুধুমাত্র ব্যাপকভাবে গৃহীত ছিল তাই নয়, উপরন্তু রীতিমতো উদযাপন করা হতো। জাপানে সমকামিতা শুডো, ওয়াকাশুডো এবং নানশোকু নামে পরিচিত, যেগুলো সবই পুরুষ প্রেমকে নির্দেশ করে। ধরা হয়, সমকামিতা হিয়ান যুগ(794-1185) থেকে শুঙ্গায় আবির্ভূত হয়েছিলো। শোনা যায় যে, সমকামিতা চীন থেকে আমদানি করেছিলেন কুকাই(774-835), যিনি জাপানি গুহ্য বৌদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠাতা।

দু'জন রমণী কামরত
শিল্পী: কাতুশিকা হকুসই
দু’জন রমণী কামরত
শিল্পী: কাতুশিকা হকুসই

সামুরাই প্রশিক্ষণে থাকাকালীন, একটি ছেলের অভিজ্ঞ প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের দ্বারা শিক্ষানবিশ হওয়ার প্রথা ছিল। ছেলেটির সম্মতি পাওয়া গেলে, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত বয়স্ক ব্যক্তিটি ছেলেটিকে তার প্রেমিক হিসাবে গ্রহণ করতে পারতেন। এই অনুশীলনটি বয়স-গঠিত সমকামিতার প্রথা হিসেবে বিকশিত হয়েছিল যা শুডো নামে পরিচিত, সংক্ষেপে ওয়াকাশুডো (যার অর্থ তরুণদের পথ)।

সামুরাই এবং তার যুবক পুরুষ প্রেমিক
শিল্পীঃ মিয়াগাওয়া ইশো
সামুরাই এবং তার যুবক পুরুষ প্রেমিক
শিল্পীঃ মিয়াগাওয়া ইশো
একজন তরুণী বিশাল হারিগাটা(জাপানিজ ডিল্ডো) পরে আছেন, অন্য মেয়েটি তা ধরে লুব্রিকেন্ট ব্যবহার করছেন
শিল্পীঃ চকিসই ইরি।
একজন তরুণী বিশাল হারিগাটা(জাপানিজ ডিল্ডো) পরে আছেন, অন্য মেয়েটি তা ধরে লুব্রিকেন্ট ব্যবহার করছেন
শিল্পীঃ চকিসই ইরি।
একজন তরুণী বিশাল হারিগাটা(জাপানিজ ডিল্ডো) পরে আছেন, অন্য মেয়েটি তা ধরে লুব্রিকেন্ট ব্যবহার করছেন
শিল্পীঃ চকিসই ইরি।
পুরুষ প্রণয়ীযুগল ও মহিলা গুপ্তচর (মাঞ্চু রাজবংশ, চীন)

নিয়ানখখনুম (বামে) এবং খনুমহোটেপ (ডানে)
নিয়ানখখনুমের কাঁধে তার ডান হাত (মিশর)
নিয়ানখখনুম (বামে) এবং খনুমহোটেপ (ডানে)
নিয়ানখখনুমের কাঁধে তার ডান হাত (মিশর)

Khnumhotep এবং Niankhkhnum এর সমাধিটি 1964 সালে উন্মোচিত হয়েছিল এবং তখন থেকেই এটি একটি তীব্র সমালোচনার  বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের কেউ যমজ, কেউবা প্রেমিক, ভাই এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলে অ্যাখায়িত করেছেন। এই ছবিতে নাক দিয়ে নাক স্পর্শ করার “চুম্বন” ভঙ্গিটি অন্তরঙ্গ এবং সে সময়ের মিশরীয় শিল্পে শুধুমাত্র নারী-পুরুষ বিবাহিত দম্পতিদের এভাবে আঁকা হতো।

গ্রীক মৃৎপাত্রে সমকামী চিত্রকর্ম
গ্রীক মৃৎপাত্রে সমকামী চিত্রকর্ম

প্রাচীন গ্রীক সমাজে সমকামী শিল্পের প্রাচীনতম সু-বিকশিত উদাহরণগুলির মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো। অন্যান্য প্রাচীন সংস্কৃতির বিপরীতে গ্রীকরা প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষের যৌন আকর্ষণকে স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক মনে করত। এমনকি বয়ঃসন্ধিকালে প্রবেশকারী পুরুষদের জন্য উত্তরণের আচার হিসাবে কিশোর ছেলে এবং বয়স্ক পুরুষদের মধ্যকার সম্পর্ককে অনুমোদন দেয়া হতো। এই হোমোইরোটিক সম্পর্কগুলি ছিল বিস্তৃত গ্রীক কবিতা এবং শিল্পের বিষয়বস্তু।

পরিশেষে বলতে চাই, সমকামিতা প্রাচীনকাল থেকেই মানবসভ্যতায় বিদ্যমান। এটিকে অগ্রাহ্য করার কোনো কারণ নেই। উপরক্ত চিত্রকর্মগুলো এবং ভাস্কর্য ছাড়াও ইতিহাসে সমকামি মানুষদের আরো অনেক নিদর্শন রয়েছে। বর্তমান সময়কালের চেয়ে পূর্বে জনসাধারণের কাছে সমকামিতা অনেকটাই গ্রহণযোগ্য এবং স্বাভাবিক ছিলো। কালের বিবর্তনে নানা কট্টরপন্থী মনোভাবে আজ এই মৌলিক এবং জন্মগত অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে। এসব মৌলবাদী মনোভাব ত্যাগ করে মানবিক হওয়া সময়ের দাবি।

*** ব্লগটিতে ব্যবহৃত প্রতিটি ছবি ইন্টারনেট হতে সংগৃহীত ***

লিংক সমুহ:

জাপান-

https://pen-online.com/culture/rituals-of-ancient-gay-shunga-erotica/?scrolled=0

https://en.thevalue.com/articles/japanese-erotic-art-shunga-homosexuality-bestiality

ভারত-

https://commons.m.wikimedia.org/wiki/File:Homosexuality_in_Khajuraho_sculpture.jpg#mw-jump-to-license

https://commons.m.wikimedia.org/wiki/File:Two_women_embracing_and_using_carrots_as_dildoes._Gouache_Wellcome_L0033073.jpg#mw-jump-to-license

ইরান-

https://commons.m.wikimedia.org/wiki/File:Shah_Abbas_and_Wine_Boy.jpg

গ্রীক-

https://www.etsy.com/nz/listing/867312835/homosexual-love-gay-sex-painting-ancient

https://www.historyextra.com/period/ancient-greece/pederasty-homosexuality-ancient-greece-boys-sparta-girls-plato-sappho-consent/

মিশর-

https://medium.com/lessons-from-history/historys-first-gay-couple-f877be3a5b86

অন্যান্য-

https://www.revelandriot.com/resources/lgbt-art-history/

https://www.wikiwand.com/bn/%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A6%BE

১৮ পার হবার কিছু আগেই কমিউনিটি সমন্ধে অবগত হই। এর আগে নিজের অস্তিত্বকে চেনার যাত্রায় ছিলাম। চেষ্টা করি টুকটাক লেখালেখি করার। বাংলাদেশের কমিউনিটির পাশে কাজ করে যাবার প্রত্যয়ে অঙ্গিকারবদ্ধ।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.