
ডেভিড রোজ
Queer Visibility বা কুইয়্যার দৃশ্যতা নিয়ে কথা বলতে হলে আমাদের প্রথমেই জানতে হবে “What is visibility?”। দেখি আমাদের গুগল কি বলে। গুগল বলে, “The state of being able to see or be seen”৷ অর্থাৎ, কোনোকিছু দেখার বা দেখতে পাওয়ার যে অবস্থা সেটাই Visibility বা দৃশ্যতা।
সুতরাং, একজন কুইয়্যার মানুষ তার নিজস্ব আত্মপরিচয় পাবলিকের প্রতি জানান দেওয়ার যে প্রচেষ্টা এবং সেটা দেখার যে অবস্থা সেটাই কুইয়্যার ভিজিবিলিটি বা কুইয়্যার দৃশ্যতা।
আমরা সবাই জানি যে, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান সরকারের ১৮৬০ সালের সেকশন ৩৭৭ অনুসরণ করে বাংলাদেশে সমকামিতা অবৈধ। সমকামী কার্যক্রমের জন্য একজনের ১০ বছর থেকে যাবজ্জীবন পর্যন্ত শাস্তি হতে পারে।
বাংলাদেশের কুইয়্যার ইতিহাসে প্রকাশ্যে নিজের পরিচয় নিয়ে আসার কথা বলতে গেলে ২০১০ সালের আগে তেমন কেউ ছিলোনা। ১৯৮০ সালের দিকে বাংলাদেশের বিভিন্ন পতিতালয়ে কিছু সমকামী যৌনকর্মী ছিলো। যদিও সে সময় সমকামের বদলে মানুষ Sodomy (বাংলায় পায়ুকাম) শব্দটা বেশি ব্যবহার করতো। ১৯৯৯ সালে রেঙ্গু নামে একজন আদিবাসী মধ্যবয়সী বিদেশী লোক বাংলাদেশের সমকামী মানুষদের জন্য একটা অনলাইন গ্রুপ খোলেন। ওই গ্রুপটার ১০০০ এর মতো মেম্বার ছিলো। যদিও রেঙ্গুর মৃত্যুর পর গ্রুপের কার্যক্রম আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায়। ২০০২ সালে Yahoo! পোর্টালে দুইটা সমকামী গ্রুপ দেখা যায়, Teen Gay Bangladesh (TGB) এবং Boys Only Bangladesh নামে। যদিও দুটি গ্রুপই Yahoo! পোর্টাল ডিলিট করে দেয়।
TGB পরে Bangladesh Gay Boys নামে আত্মপ্রকাশ করে, যেটা এখন Boys of Bangladesh নামে আছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশের প্রথম প্রকাশ্য সমকামী সাময়িকী প্রকাশ হয়। “রূপবান” নামের এ সাময়িকীর প্রকাশক ছিলেন জুলহাজ মান্নান। রূপবানের পক্ষ থেকে ২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৬ সালের পহেলা বৈশাখে প্রকাশ্যে “Rainbow Rally” নামের প্রাইড ইভেন্ট আয়োজন করা হয়। যদিও ২০১৬ সালের র্যালি পুলিশের বাধাতে বাদ দিতে হয়। তার কিছুদিন পর ২৫শে এপ্রিল জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব রাব্বি তনয় তাদের এপার্টমেন্টে আনসার-ঊল-ইসলাম এর চরমপন্থি সদস্যদের হাতে খুন হন।
এতক্ষণ আমরা বলছিলাম বাংলাদেশে কুইয়্যার ভিজিবিলিটির কথা। এখন বলবো বাংলাদেশের মতো চরমপন্থি একটা দেশে কুইয়্যার ভিজিবিলিটি কেন কুইয়্যার মুভমেন্টের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে বেশিরভাগ মানুষই মনে করে সমকামিতা একটা বিকৃত মানসিকতা এবং একটা বড় অংশ মনে করে সমকামীদের হত্যা করা জায়েজ। এজন্য বর্তমানে একজন অ্যাক্টিভিস্টকে অনেক গোপনীয়তা বজায় রেখে কাজ করতে হয়।
২০১৬ সালে জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব রাব্বি তনয়ের খুন হওয়ার পর কিছু অ্যাক্টিভিস্ট প্রাণের ভয়ে বিদেশ চলে যেতে বাধ্য হন এবং কিছু গা ঢাকা দিতে বাধ্য হন। এগুলো তখন সবচেয়ে ভালো পন্থা ছিলো যেহেতু সরকারের পক্ষ থেকে অ্যাক্টিভিস্টদের জন্য কোনো সুরক্ষা ছিলোনা। সেইসময় কুইয়্যার মুভমেন্টের কাজকর্ম অনেক স্তিমিত হয়ে যায়। তবে আস্তে আস্তে গোপন ভাবে অনেকে কাজ করতে শুরু করেন তার ১-২ বছর পর। তো, কুইয়্যার ভিজিবিলিটি কেনো একটা চরমপন্থি দেশে কুইয়্যার মুভমেন্টের জন্য খারাপ সেটার দুইটা উদাহরণ দেই।
বেশিদিন হবেনা, ২০২১ সালে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা অনলাইন লার্নিং স্কুল “10 Minute School” এর কনসালট্যান্ট সাকিব বিন রশিদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে LGBTQIA+ সমর্থন করে একটা পোস্ট শেয়ার করেন। কিন্তু, জনগণের তোপের মুখে পড়ে তিনি পোস্টটি ডিলিট করতে বাধ্য হন এবং ক্ষমা চান। তিনি যে সমকামিতা সমর্থন করে পোস্ট শেয়ার করেছেন সেটা কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা হলো, তিনি যখন একজন পাবলিক ফিগার হিসেবে প্রকাশ্যে সমকামিতা সাপোর্ট করার জন্য জনগণের কাছে ক্ষমা চান, তখন আমাদের কুইয়্যার মুভমেন্ট কিছুটা হলেও বহত হয়। এটা দ্বারা মানুষের কাছে মেসেজ যায় যে আমরা খারাপ।
আরেকটা উদাহরণ দিতে গেলে, The Daily Star এর একটা রিপোর্ট থেকেই বলি। ১৩ জুন ২০১৯, ডেইলি স্টারের অফিসে একটা মেসেজ আসে। শাম্মি হক নামের একজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত জার্মান প্রবাসী নারী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটা পাবলিক ইভেন্ট খোলেন প্রাইড মার্চের জন্য। সেখানে পাবলিক গেস্ট আর ইভেন্ট লোকেশন উল্লেখ ছিল। সেই ইভেন্টের স্ক্রিনশট চরমপন্থিদের মধ্যে ছড়িতে পড়েছিলো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে তাদের পক্ষ হতে নানাভাবে হুমকি আসছিলো। তখনও অ্যাক্টিভিস্টরা ২০১৬ সালের জুলহাজ ও তনয়ের খুনের ধাক্কা সামলিয়ে উঠতে পারেনি। তারা খুব আতংকিত হয়ে পড়েছিলো। শেষপর্যন্ত, শাম্মি হক ইভেন্টটা ক্যান্সেল করতে বাধ্য হন। দেখেন, এখানে শাম্মি হক হয়তো ভালো উদ্দেশ্য নিয়েই ইভেন্ট খুলেছিলো। কিন্তু সেটা কারো কারো জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতো। কেউ কেউ হয়তো সৎ উদ্দেশ্যে নিয়ে সেই ইভেন্ট লোকেশনে যেতো। সেক্ষেত্রে হয়তো আমাদের আরেকটা ২৫ এপ্রিলের সাক্ষী হতে হতো।
এছাড়া, বিভিন্ন জায়গায় মানুষের পুলিশিংতো হরহামেশাই দেখা যায়। এগুলো নিয়ে আমাদের সচেতন থাকা জরুরী।
Related Posts: