আর কতো বৈষম্য?

নরএপিনেফ্রিন

জামালপুরে চারজন মেয়েকে সমকামিতার অভিযোগে পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে – বুধবার সকালের এই খবর অনেকের সাথে আমিও জানতে পারি। খবর জানার পরের প্রতিক্রিয়া এরকম ছিলো যেন ঘুম থেকে উঠে কোনো দুর্ঘটনার সংবাদ পেলাম, এবং আমারই অনেক কাছের মানুষ এই দুর্ঘটনার কবলে পরে প্রচন্ড আহত হয়েছেন। একভাবে দেখলে ব্যাপারটা এরকম নয় কি?

জামালপুরে ধনবাড়ি এলাকার কিশোরী অরত্রি (ছদ্মনাম) তার প্রেমিকা অধরার (ছদ্মনাম) সাথে ৩ বছরের প্রেমের সম্পর্কের পর বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন।  বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, তারা একই ইউনিয়নের একই বিদ্যালয়ের যথাক্রমে নবম ও দশম শ্রেনীর ছাত্রী। ফেসবুকে তাদের পরিচয় হয় ও প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। কিছুদিন আগে অধরা জানতে পারে অরত্রিকে তার বাসা থেকে বিয়ে দিতে চায় এবং যার ফলে তারা দুজন একসাথে থাকার জন্য জামালপুর থেকে ঢাকা চলে আসে। ঢাকায় তারা একটা সাদা কাগজে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা নির্ধারণ করে বিয়ের অঙ্গীকারনামা তৈরি করে। এই ব্যাপারে পরিবার জানতে পারলে  বুধবার (২১শে সেপ্টেম্বর) তাদের দুইজনকে ঢাকা থেকে জামালপুর ফেরত নেওয়া হয়। এছাড়াও সম্পূর্না (ছদ্মনাম) ও জয়িতা (ছদ্মনাম) নামে আরও দুজন মেয়ে এসব কাজের প্রলোভন দেখিয়েছেন ও সহযোগিতা করেছেন – এই অভিযোগে তাদের উভয়কে জামালপুর নিয়ে যায় মেয়ের পরিবার। সেখানকার ইউপি চেয়ারম্যানের অধীনে সালিশ বসানো হয়। ইউপি চেয়ারম্যান জানান এটা একটা “ন্যাক্কারজনক ঘটনা” এবং সেই চারজন কে পুলিশে দেওয়া হয়। পুলিশের ওসি জানান, তিনি কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে পরিবারের কাছে মেয়েদের হস্তান্তর করবেন। 

এই ধরণের ঘটনা নতুন কিছু নয়। আমরা বছরের শুরুর দিকে কিশোরগঞ্জে একই রকম ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি। প্রথমত, আমরা দৃঢ় কণ্ঠে কুইয়্যার কমিউনিটির উপর এহেন হেনস্তা, অপমানজনক ও মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ করার মতো কাজের প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমরা দেশের বৈষম্যমূলক আইন, এর পৃষ্ঠপোষক এবং মিডিয়ার অতিরঞ্জিত ও কুইয়্যার কমিউনিটি নিয়ে অপপ্রচার নিয়ে তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। নানান অনলাইন পোর্টাল ও টিভি নিউজে মেয়েদের নাম, বাবার নাম, মেয়েদের চেহারা, পরিচয় এমনকি কিছু ক্ষেত্রে কত নাম্বার রোডে তার পরিবার থাকে তাও প্রকাশ করা হচ্ছে। সালিশে হাজার লোকের সামনে কোনো নিরাপত্তা ছাড়াই এই মেয়েগুলোকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। পরবর্তীতে এলাকাবাসী থেকে তাদের পরিবারের নিরাপত্তার বিষয়ে পুলিশ আশ্বাস দিলেও তা কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য এবং উপযুক্ত সে প্রশ্ন রয়েই যায়। 

অরত্রির পরিবার চেয়ারম্যানের কাছে দাবী করেন তাদের মেয়েকে ফুসলিয়ে ঢাকা নেওয়া হয়েছে ও এসব করানো হয়েছে কিন্তু অরত্রি নিজেই এটা অস্বীকার করেন এবং সালিশেই সবার সামনে অধরা জানান তাদের দুইজনের কারোরই ছেলেদের প্রতি আকর্ষণ নেই ও তারা একে অপরকে ছাড়া থাকতে পারবেন না। অপরদিকে স্থানীয় গণমাধ্যম গুলো যা-তা ভাবে এই সম্পূর্ণ ঘটনা কে প্রচার করছে যেটা ভবিষ্যতে সম্পূর্ণ কুইয়্যার কমিউনিটির জন্যই ঝামেলার কারণ হবে। পুলিশের ওসি বিশেষভাবে “অল্প বয়সে স্মার্টফোন চালানো এবং মা-বাবার অসচেতনতাকে” এই ঘটনার জন্য দায়ী করছেন। চেয়ারম্যান ভাষ্য এই যে এরকম কোনো জিনিস সে আগে কখনো তার জীবনে শুনেননি এবং সে এসব (সমকামিতা) ব্যাপারে কিছুই জানেন না। তবে তিনি এটা বুঝতে পেরেছেন এগুলো সামাজিক কিংবা ধর্মীয় দিক থেকে ঠিক নয়। অপপ্রচারণা ও সমকামিতা নিয়ে বিভ্রান্তিকর খবর ছড়ানোর মাধ্যমে কমিউনিটির মানুষজন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এভাবে যেকোনো সময় পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনা কুইয়্যার গোষ্ঠীর মানবাধিকার বারবার লঙ্ঘন করছে যা নিয়ে রাষ্ট্রের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। এছাড়াও বেশ কিছু ইউটিউব চ্যানেলের ভিডিও পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় তারা “সমকামিতা” শব্দ বিভিন্ন কায়দায় ব্যবহার করে সমাজের মানুষকে “ট্রিগার” করতে চাচ্ছেন যা যেকোনো খারাপ পরিণতির ইঙ্গিত দেয়। 

বর্তমানে কুইয়্যার গোষ্ঠী নিয়ে কাজ করা সংস্থার সংখ্যা নগণ্য নয়, কিংবা তারা যে পরিসরে কাজ করেন তাকেও ক্ষুদ্র বলা চলেনা। কিন্তু হতাশার বিষয় এই যে এরকম ঘটনা বারবার ঘটার পরও ভবিষ্যতে এগুলো সামলানো অথবা ভুক্তভোগীদের সাহায্য করার মতো ফলপ্রসূ পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ চোখে পড়ে না। অর্থাৎ এসকল সংস্থার ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ হওয়া অস্বাভাবিক নয়। যদিও আমরা শুনেছি যে হাতেগোনা কয়েকটি সংস্থা কিছু করবার চেষ্টা করছে তবে সেটাও খানিকটা অনিচ্ছা থেকেই। ঘটনার ভুক্তভোগী চারজন নারী, আমাদের দেশের বিভিন্ন নারীবাদী সংগঠন থেকেও উল্লেখযোগ্য কোন উদ্যোগ দেখতে পাইনি। নিরাপত্তা একটি জরুরি বিষয় বটেই, কিন্তু তাই বলে সবকিছু নিরাপত্তার নাম দিয়ে এড়ানো কতোটুকু যুক্তিযুক্ত? 

দিনশেষে বৈষম্যের পাল্লা ভারী হতে ভারী হয়ে চলছে।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.