
দিব্বু দত্ত
সন্দেহ নেই মনুষ্য হিসেবে আমরা পরিচয়ের বিভিন্ন মাত্রা ধারণ করি, বিশ্বাস করি, বা তা কখনো কখনো আরোপিত হলেও দিব্যি যেন আত্মজ করে ফেলি। চৈতন্যের বিজ্ঞানে আমরা এখনও ততটুকু অগ্রসর না হতে পারি, অন্তত এতটুকু আমরা সুনিশ্চিত হতে পারি যে পরিপ্রেক্ষিত ভিন্ন প্রাণী নই আমরা। ইতিহাসের যে মুহূর্তে, যে সামাজিক ডিসকোর্সগুলোর মাঝে আমাদের জন্ম তা অনেকাংশেই আমাদের আজীবনের ব্যক্তিক রূপ ঠিক করে দেয়। তবে সে যাই হোক, ‘পরিচয়’ ধারণ করা ও পরিচয় ভিত্তিক যে রাজনীতি তা যেমন প্রান্তিকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি দেখা প্রয়োজন কে এই পরিচয়ের রাজনীতিতেও প্রান্তিক হয়।
পরিচয়ের রাজনীতির সমস্যা যদি বিশ্লেষণ করি তবে বলতে হয় যে এখানে গুরুতর সম্ভাবনা রয়েছে যে যারা কিনা ‘সঠিক’ রূপে পরিচয়ের রাজনীতিবিদদের কাঠামো তে পড়ছেন না, তাদের সংগ্রাম অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। তাদের অনন্য প্রান্তিকতা পরিচয়ের রাজনীতির যে চলমান ডিস্কোর্স গুলো রয়েছে তা দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব না হতে পারে। সমস্যাকে দেখবার ক্ষেত্রে একটা কাঠামোগত ফাঁক থেকে যেতে পারে। এই ব্যাপারটিকে ভালো করে বুঝতে কালো নারীবাদী কিম্বারলি ক্রেনশ এর আফ্রিকান-আমেরিকান কালো নারীর যে যুগপৎ কালো ও সেই সাথে নারী হওয়ার কারণে যে অনন্য প্রান্তিকতার সৃষ্টি হয় সেই আলোচনা প্রাসঙ্গিক হতে পারে। পরবর্তীতে তার এই আলোচনা থেকেই যারা “LGBTQ” -এই পরিচয়ের রাজনীতিতে যুক্ত আছেন তাদের সেই রাজনীতিতে কারা প্রান্তিক হতে পারে তা তুলে ধরাই এই লিখার উদ্দেশ্য।
তত্ত্বের বর্ণনায় বিরক্তির সৃষ্টি করতে চাই না, তবু সংক্ষেপে যদি বলি, ১৯৮৯ সালে কিম্বারলি ক্রেনশ ‘ইন্টারসেকশনালিটি’ ধারণাটির প্রবর্তন করেন পরিচয়ের রাজনীতির সমস্যার প্রেক্ষিতে৷ তাঁর মতে মানুষ কখনোই কোন একক পরিচয়ে নিজেকে ধারণ করে না; পরিচয়ের মাত্রা বহু (১)। সেখানে আছে জেন্ডার, যৌন পরিচয়, শ্রেণী, রেইস, বর্ণ ইত্যাদি। তিনি আমেরিকায় কালো নারীর তার বর্ণ ও জেন্ডার পরিচয়ের হেতু অনন্যভাবে প্রান্তিক হওয়া আর তা কীভাবে নারীবাদী ডিস্কোর্স এবং একইসাথে রেসিজম-বিরোধী ডিস্কোর্সে স্থান পায়না সে সম্পর্কে সমালোচনা ব্যক্ত করেন। তার মতে বাস্তবে যা হয় তা হল, যখন নারীবাদী ডিস্কোর্সে নারীর প্রান্তিক হওয়াকে গুরুত্ব দেওয়া হয় তখন নারীর বর্ণপরিচয়কে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছেনা। এক্ষেত্রে তিনি আমেরিকায় নারীর ধর্ষণ ও নিপীড়নের উদাহরণ টেনে বলেন যে, একজন সাদা নারী অত্যাচারিত হবার পর যতটুকুই বা ফোকাস পান তা কালো নারীর ক্ষেত্রে দেখা যায় না। কেবল সাদা নারীরাই যেন নারী। যেন বা কালো নারী নারীর সংজ্ঞায় পড়ছে না। অর্থাৎ তাদের ডিস্কোর্সে নারীর যে বর্ণপরিচয় তা গুরুত্ব না পাবার কারণে কালো নারী নারীবাদী ডিস্কোর্সে প্রান্তিক হয়। আবার, রেসিজম-বিরোধী ডিস্কোর্সে কালো পুরুষকে রক্ষা করার যতটুকু প্রয়াস দেখা যায় আমেরিকায়, তা কালো নারীর ক্ষেত্রে দেখা যায় না। অর্থাৎ এই ডিস্কোর্সে বর্ণপরিচয় কে গুরুত্ব দিলেও জেন্ডার পরিচয়কে গুরুত্ব না দেবার কারণে কালো নারী আবারও প্রান্তিক হয়। উদাহরণ স্বরূপ তাঁর উল্লেখ্য হচ্ছে যে, কালো পরিচয়ের মানুষকে রক্ষা করতে গিয়ে অনেকসময় কালো পুরুষ দ্বারাও যে কালো নারীরা নির্যাতিত হয়, ধর্ষিত হয় তা ঢেকে ফেলা হয়। কারণ যেহেতু ইতিমধ্যে রেসিজম-বিরোধী ডিস্কোর্স এটা প্রতিষ্ঠা করতে চায় যে বর্ণপরিচয়ের ভিত্তিতে কারও চরিত্রের ক্যাটাগরাইজেশন করা যাবে না। ফলে কালো পরিচয় কে রক্ষা করতে গিয়ে আবারও কালো নারী প্রান্তিক হয়। কিম্বারলি ‘DeGraffenreid v. General Motors’ (১৯৭৬) এর যে কেসটি হাজির করেন, তাতে দেখা যায় Emma DeGraffenreid, General Motors এর বিরুদ্ধে মামলা করে এই মর্মে যে তাকে তার পরিচয়ের কারণে চাকরিতে বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে। কোর্ট এই মামলা খারিজ করে দেয় এই বলে যে General Motors -এ সকলে কাজ করতে পারে। অর্থাৎ বর্ণ পরিচয় বা জেন্ডারের ভিত্তিতে কোন অসমতা নেই। কিন্তু বাস্তবিক কিম্বারলি দেখান, সেখানে যে কালো মানুষরা কাজ করে তারা হলেন পুরুষ আর যে নারীরা কাজ করেন তারা হলেন সাদা। ফলে কিম্বারলির মতে কালো নারীর অসম অবস্থাকে বুঝতে চলমান রাজনৈতিক ডিস্কোর্সগুলো কাঠামোগত ভাবে অন্ধ।
এজন্যই তিনি ইন্টারসেকশনালিটির কথা বলেন। পরিচয়ের অন্তচ্ছেদীতার কথা বলেন। আর এর মধ্য দিয়ে প্রান্তিকতাকে বুঝতে বলেন। এখন আমরা যদি “LGBTQ” এর ডিস্কোর্সে তাকাই তবে আমাদের দেখতে হবে আদৌ এই পরিচয়ের রাজনীতির ডিস্কোর্স সবাইকে রাখতে সমর্থ হচ্ছে কিনা। প্রথমত এই ডিস্কোর্সের উৎপত্তি স্থল যে পশ্চিমে তাতে সন্দেহ নেই। এখন, আমার মতামতের জায়গা হচ্ছে যে, এই পশ্চিমা ডিস্কোর্স দিয়ে আমরা কি পুরো দুনিয়ার সকল পরিচয়ের মানুষের প্রান্তিকতাকে বুঝতে পারব যারা নিজেদের বিষমকামী সিস পুরুষ বা নারী হিসেবে পরিচয় দেন না? ইন্টারসেকশনালিটির তত্ত্বটি আমাকে এই জায়গায় ভাবায়। তবে এই নিয়েও আমি সম্যক অবগত আছি যে অন্তত ঔপনিবেশিক আমলের পর উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোতে পশ্চিমা ডিস্কোর্সের অন্তঃপ্রবিষ্টটার ফলে যেন পশ্চিমের ফ্রেম দিয়ে নিজেকে চিনতে হয়। অবশ্যই পোস্ট কলোনিয়াল তত্ত্বের আলোচনা আরেকদিন করা যাবে, তবে এই মুহূর্তে এটা বুঝাতে চাই যে আমাদের চেতনার জায়গাটুকু, জ্ঞান অর্জনের পথটুকু কিসের মধ্যে দিয়ে হচ্ছে তা দেখা প্রয়োজন (২)। আর এই জায়গায় যে সকলেই স্থান পায় না তা দেখার সূক্ষ্ম দৃষ্টি প্রয়োজন। যেমন: উপমহাদেশের হিজড়া জনগোষ্ঠী পশ্চিমা ””LGBTQ” ডিস্কোর্সের বাইরে। সুতরাং তাদের যে নিত্যদিনের প্রান্তিকতা তা বুঝতে হলে কিন্তু এই ডিস্কোর্স কাজে দেয় না। আমাদের দেখতে হয় এই উপমহাদেশের স্থানিকতা, ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত, শ্রেণী পরিচয়। আরও, যদি বলতে হয়, ধরুন বাংলাদেশেই কোন একজন মানুষ যিনি নিজেকে রূপান্তর-কামী নারী হিসেবে পরিচয় দিতে চান আর একইসাথে তিনি যৌনতার চর্চায় একজন ‘নারী’ দেহী মানুষকেই চান। সমস্যাটা এই জায়গায় যে, এই রূপান্তর-কামী মানুষকে আমরা কেবল তার জেন্ডার পরিচয়ে যেন বেঁধে ফেলতে চাই ”LGBTQ’ ডিস্কোর্সে। যেন বা তিনি শুধু ট্রান্স। তার নিজের যে যৌন পরিচয় তা যেন উধাও হয়ে যায় বা তা কীভাবে তাকে প্রান্তিক করে এই ডিস্কোর্স আমাদের তা দেখাতে পারে না (তিনি নিজেকে লেসবিয়ান বলবেন বা কী বলবেন তা অন্য প্রসঙ্গ)। যেন বা বিষমকামী সিস মানুষ বাদে শুধুই Gay, শুধুই Lesbian, শুধুই Bisexual, শুধুই Trans, আর কিছু নাহলে তাকে অবশ্যই Queer হতে হবে। অবশ্যই, কেউ যদি পরিচয়ের একটি মাত্রাকে ধারণ করতে চায় তাতে কোন সমস্যা নেই, কিন্তু কারা এখানে কোন একটি পরিচয়ের অংশ হবার পরও অন্য কোন পরিচয়ের কারণে প্রান্তিক থেকে যাচ্ছে, অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, কাঠামোগত ভাবে কোন পরিচয়ের কারণে চলমান ডিস্কোর্সে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে, তাতে আলোকপাত প্রয়োজন। একইসাথে, “LGBTQ” ডিস্কোর্সে পশ্চিমের সাদা সমকামী পুরুষ বা নারী পরিচয়ের মানুষ গুলোর বাইরে অন্যান্য মানুষের জায়গা কতটুকু? যারা একইসাথে কালো অথবা বাদামী, রূপান্তরকামী নারী বা পুরুষ, যারা শ্রেণীগত ভাবে সচ্ছল নয়? এই প্রান্তিকতা গুলোর স্থাপন কি আমরা শুধুই জেন্ডার বা শুধুই যৌনতার পরিচয় দিয়ে পারব? বরং বলতে চাই যে, মানুষগুলোর যে পরিচয়ের বিভিন্ন মাত্রা অন্তচ্ছেদীভাবে তাদের প্রান্তিক করে তুলে তা দেখা প্রয়োজন। ডিস্কোর্স এর রাজনীতিতে কে তা নিয়ন্ত্রণ করে তা বুঝবার সজাগ দৃষ্টি প্রয়োজন। বা একটু নাড়া দিয়ে যদি বলি, নতুন কোন ডিস্কোর্স কি তৈরি সম্ভব হবে যা ইতিমধ্যে প্রান্তিকদের যে পরিচয়ের রাজনীতি আছে তাকে আরও ইনক্লুসিভ করবে? সম্ভব কি? নাকি যতদিন পর্যন্ত মানুষের নিজের পরিচয় দেবার বাসনা আছে ততদিন কেউ না কেউ প্রান্তিক হবে? তবে কি আমরা পরিচয়হীন হব? কেমন হবে সে দুনিয়া?
চিন্তার শেষ নেই!
রেফারেন্সঃ
১) On Intersectionality- Kimberlé Crenshaw
২) The Archaeology of Knowledge- Michel Foucault
দিব্বু দত্ত। জীবন, বিশ্ব, চৈতন্য নিয়ে রয়েছে অবিরাম কৌতূহল। এজেন্সির পক্ষে আছি। নিজের, অন্যের। উদ্দেশ্য পানি পানি সময় কাটানো। চাপ হীন। আর বিথহোভেনের “ওডি টু জয়” শুনতে শুনতে পরপার হবার বাসনা আছে।