
মনিকণ্ঠ
তথাকথিত ধর্মীয় অনুভূতি এবং ব্যক্তিগত লিঙ্গ ও যৌন সত্তার মধ্যে দোটানায় পড়েননি এমন লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় ব্যক্তির সন্ধান প্রায় অসম্ভবই ব্যাপার। সাধারণত এই সংকটপূর্ণ অবস্থায় একজন ব্যক্তির তিনদিকে ধাবিত হওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকে, (১) ধর্মকে স্বীকার না করা (২)ধর্ম এবং লিঙ্গ বৈচিত্র্যতাকে একইসাথে ধারণ করা এবং (৩) নিজের লিঙ্গ ও যৌন বৈচিত্র্যময়তাকে অস্বীকার করার কথা বলা। সাধারণত একটি মতাদর্শের বা সত্তার পরিচয়ের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিবর্গের জন্য সাংঘর্ষিক বা ভিন্ন কোন মতাদর্শের বা পরিচয়ের ব্যক্তিবর্গই বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।কিন্তু এক্ষেত্রে আমাদের লিঙ্গ ও যৌনবৈচিত্র্যময় কমিউনিটিতে ঘটে সম্পূর্ণ এর উল্টো ঘটনা। আমাদের কমিউনিটির মানুষ বাইরের মানুষদের থেকে যতটা না অসুরক্ষিত তার থেকে বেশি অসুরক্ষিত কমিউনিটিতে অবস্থানরত অসহনশীল এবং উগ্রবাদী “অর্ধ-ধার্মিক” দের থেকে।
বাংলাদেশের কুইয়ার জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় আইন এবং সামাজিক ট্যাবু থেকে নিজেদের নিরাপদ রাখতে ফেইসবুকে ফেইক আইডির মাধ্যমে পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করে থাকে। সেখানে সকলেই নিজেদের লিঙ্গ ও যৌন বৈচিত্রতা, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয়-ধর্মীয়-সামাজিক বিষয়ে নিজেদের চিন্তা-মনোভাব স্বাধীনভাবেই প্রকাশ করে এসেছে। কিন্তু বর্তমানে নিজেদের এই কমিউনিটি-ভিত্তিক জোনেও এই মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা কমে যাচ্ছে এবং ধর্মান্ধতার উত্থান হচ্ছে। ২০২০ এ ফেইক আইডির সংযোগে সৃষ্ট ভার্চুয়াল এলজিবিটি+ কমিউনিটি একটি পোস্ট নিয়ে বেশ উত্তপ্ত। পোস্টটির বিষয়বস্তু ফ্রান্সের বিরুদ্ধে করা হেফাজতে ইসলামের মানববন্ধনে রেইনবো-ফ্ল্যাগ যুক্ত করে তৈরি করা একটি ব্যঙ্গচিত্র নিয়ে যা পোস্ট-কর্তা মুক্তমনাদের গ্রুপ থেকে সংগ্রহ করেন।তারপরই তার কাছে আসতে থাকে একের পর এক প্রাণ সংশয়পূর্ণ হুমকি বার্তা, অকথ্য ভাষায় গালি, বডি শেমিং এবং রেসিজমযুক্ত বার্তা এবং কমেন্ট। তাদের কেও পোস্ট-কর্তাকে নিজেরাই মারতে চান আবার কেও কমিউনিটির বাইরের মৌলবাদীদের দ্বারা হত্যা করাতে চান।” তোর ছবি আমার কাছে আছে, বেশি পাকলে পুঁতে রাখবো তোরে।” “অফিস থেকে বের হয়ে খানকি মাগিটারে দেখতেছি”, “এদের দুয়েকটার কল্লা কাটলে এদের শিক্ষা হবে।”, “ওর পোস্টটা রিয়েল আইডি দিয়ে বড় বড় গ্রুপগুলোতে পোস্ট করেন ওর কতো হেডাং বোঝা যাবোনে”, “বাংলাদেশে থাইকা এসব নিয়ে কথা বলস, খুন করে রাইখা দিবো” এগুলো কয়েকটি কমেন্টের নমুনা মাত্র। তাকে হুমকি-দাতাদের মধ্যে তথাকথিত উচ্চ ডিগ্রিধারী ব্যক্তিরাও কম ছিলেন না। আধুনিক শিক্ষালাভ করলেও তাদের মধ্যের ধর্মান্ধতা তাদের “মানবাধিকার”, “মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা”, “পরমত সহিষ্ণুতা” এর মতো মানবীয় গুণাবলিকে সমূলে নাশ করেছে। শুধু পোস্ট-কর্তাই নন, তার বন্ধুদেরও পাঠানো হয় হুমকি-পূর্ণ বার্তা, একজনকে বলা হয় তার ছবি তাদের কাছে রয়েছে এবং সে ভবিষ্যতে বিপদে পড়বে। আরেকজন বন্ধুকে ফোন দিয়ে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়। একসময় যিনি বন্ধু ছিলেন এবং যাকে বিশ্বাস করে ফোন নাম্বার দেয়া হয়েছে তিনি রাতারাতি বদলে হয়ে উঠলেন তার শত্রু। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থেকে অসহনশীল সহিংসপূর্ণ সম্পর্কেপরিণত হওয়ার জন্য মূল কারণ ছিল তার বন্ধুর মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা।
এই ধর্মান্ধদের চেনা কিন্তু খুবই মুশকিল,তারা বাইরে সুশীলতার চাদর পড়ে “আমরা উগ্রতা ছড়াই না” ট্যাগ ব্যবহার করে চললেও, সুযোগ পেলেই তারা খোলস ছেড়ে নিজের আসল রূপে আসে। আবার পরবর্তীতে চাদরে ঢেকে নতুন উগ্রতার সন্ধানে থাকে। আর তখন তাদের এই সুপ্তাবস্থায় সহায়তা করে অর্ধ-ধার্মিক ব্যক্তিগণ। যাদের সাথে একসময় আড্ডা না দিলে চলতোই না তাদের থেকেও “এই খানকিটাকে এবার একটা শিক্ষা দেওয়া উচিত” শুনলে আর কাউকে বিশ্বাস করার বিষয়ই থাকে না। যে রক্ষণশীল ধর্মনিয়ন্ত্রিত সমাজ এবং মৌলবাদ থেকে বাঁচতে ফেইক-আইডিভিত্তিক কমিউনিটিতে যোগাযোগ করা, সেখানেই যদি এমন ধর্মীয় মৌলবাদ, অসহিষ্ণুতার জন্ম হয় তাহলে তা সমগ্র কমিউনিটির জন্যই হুমকিস্বরূপ।
এর থেকে রক্ষা পেতে আমাদের মধ্যে মানবাধিকারের চর্চা বাড়াতে হবে এবং সহিষ্ণুতা ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার মতো গুণগুলো আয়ত্ত করতে হবে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রত্যেকের স্ব স্ব অবস্থান থেকে সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই।
মনিকণ্ঠ একজন সমকামী পুরুষ। তিনি মিথোলজিকাল বিষয়ে আগ্রহী এবং পড়াশোনার পাশাপাশি চিত্রশিল্প চর্চা করছেন।
প্রথম প্রকাশ
ঠাহর (দ্বিতীয় সংখ্যা)
মন্দ্র থেকে প্রকাশিত জেন্ডার, সেক্সুয়ালিটি এবং কুইয়্যার বিষয়ক ম্যাগাজিন