ট্রান্সফোবিয়ার ইতিবৃত্ত

অরণ্যরাত্রি

খুব সংক্ষেপে যদি বলা হয় ট্রান্সজেন্ডার মানুষের প্রতি নেতিবাচক ধারণা, অমূলক ভয় এবং ঘৃণা কে ট্রান্সফোবিয়া বলে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে জীবনের প্রতি ধাপে ধাপে ট্রান্সজেন্ডার মানুষেরা ট্রান্সফোবিয়ার শিকার হয়। আর সমস্ত পৃথিবীর দিকে তাকালে বলা যায় অনেক উন্নত দেশেও এখনো ট্রান্সজেন্ডার মানুষ রা অবহেলিত হচ্ছে এবং সমান অধিকার পাচ্ছে না। আমাদের দেশটা খুব রক্ষণশীল।

অধিকাংশ মানুষই ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের কে ভাল চোখে দেখে না। এবং তাদের বেশির ভাগ মানুষই ট্রান্সজেন্ডার এবং সমকামিতাকে গুলিয়ে ফেলে। ট্রান্সজেন্ডার কারা সেই সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেই। আবার কেউ কেউ ট্রান্সজেন্ডার মানে হিজড়া মনে করে। কিন্তু হিজড়া কোন জেন্ডার আইডেন্টিটি নয়। এটা একটা গোষ্ঠী। আবার ইন্টারসেক্স আর ট্রান্সজেন্ডার এর পার্থক্য অনেকে ধরতে পারে না। 

ট্রান্সফোবিয়ার সূচনা হয় ধাপে ধাপে শৈশব থেকেই।

শৈশব 

একদম জন্মের পর যৌনাঙ্গ দেখে নির্বাচন করা হয় কে ছেলে কে মেয়ে। সেই সময়

কেউ ট্রান্সজেন্ডার কিনা তা বুঝা যায় না। তারপর আস্তে আস্তে শিশুটা বড় হতে থাকে। কিন্তু একটা শিশু তো শিশুই। সে কিন্তু বুঝে না ছেলে বা মেয়ের পার্থক্য। বরং সমাজ এবং অভিভাবকরা তাদের মত করে শিখায় কে ছেলে আর কে মেয়ে। এবং ছেলে হলে কি করতে হয় আর মেয়ে হলে কি করতে হয়। যেমন ৩-৪ থেকে বছর বয়স থেকেই একটা বায়োলজিক্যালি নির্ধারিত ছেলের হাতে তুলে দেয়া হয়-একটা খেলনা গাড়ি বা ট্রাক। আর মেয়েকে দেয়া হয় পুতুল।

কিন্তু সব বায়োলজিক্যালি নির্ধারিত ছেলে বাচ্চাই কি ট্রাক বা গাড়ি পছন্দ করে? অনেকেই পুতুল পছন্দ করে। অনেক বাচ্চাই ছেলে মেয়ে ভেদাভেদ না করে মেলামেশা করে। সে সময় হয়তো অভিভাবকরা তেমন চিন্তা করেন না। কিন্তু আরও কয়েক বছর যেতেই তারা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। ছেলে কেন মেয়েদের সাথে মিশছে, অন্য ছেলে দের সাথে মিশছে না। কিংবা ক্রিকেট ফুটবল বাদ দিয়ে পুতুলের বিয়ে দিচ্ছে কেন? তখন তারা ক্রমাগত সন্তানদের বুঝাতে থাকে যে মেয়েদের সাথে খেলা ভাল নয়। বরং অন্য ছেলেদের সাথে ক্রিকেট ফুটবল খেলা উচিৎ। এমন কি ছেলেটি কথা না শুনলে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করা হয়।  যে পুতুলটি হয়তো বাবাই কিনে দিয়েছিল সে পুতুলটি বাবাই আবার ফেলে দেয়।

স্কুলে যাওয়ার বয়স হলে ধর্মের দোহাই দিয়ে ছেলে মেয়েদের একসাথে মেলামেশা বন্ধ করা হয়। কো এডুকেশন স্কুলগুলোতেও আলাদা বসার ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু তারপরও ছেলে বাবা মার জোরাজুরি তে হয়তো ছেলেদের সাথে খেলতে যায়। কিন্তু মন পড়ে থাকে সেই পুতুলেরবিয়েতে।হয়তো সেই ছেলে গোপনে লুকিয়ে মায়ের শাড়ি পরে, লিপস্টিক লাগায়। এই বাল্যকাল থেকেই টক্সিকম্যাস্কুলিনিটি চর্চা করা হয়। ছেলেদের বলা হয় গোলাপি মেয়েদের রঙ। কক্ষনো এই রঙের জামা পরবে না। বলাহয় ছেলেরা হবে মানসিক ভাবে শক্ত আর মেয়েরা নরম মনের।

এখন প্রশ্ন হল শিশু কালে কি ট্রান্সজেন্ডার কিনা তা বুঝা যায়? এই যে একটা বায়োলজিক্যালি ছেলে মায়ের শাড়ি পরছে কিংবা পুতুল নিয়ে খেলছে তা কক্ষনো নির্ধারণ করে না যে ছেলেটা ট্রান্সজেন্ডার। তবে তাদের অন্যদের তুলনায় ট্রান্সজেন্ডার হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

সমস্যা শুরু হয় স্কুল থেকে। ট্রান্সজেন্ডার নারী কে কিন্তু ছেলেদের আসনেই বসতে হয়। থাকতে হয় ছেলেদের মত। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ , প্রকাশ ভঙ্গি কিন্তু ছেলেদের মত হয় না। তখনই শুরু হয় বুলিং। সে এক ভয়াবহ অবস্থা। তাকে নানা ভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। অবমাননা করা হয়। ডাকা হয় নানা অবমাননাকর নামে। যেমন মাইজ্ঞা, হাফ লেডিস। কেউ তার সাথে মিশতে চায় না। সে প্রতিবাদ করলে সবাই মিলে আরও বেশি লাঞ্ছিত করে। এমন কি শিক্ষকরাও কেউ কেউ তাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে। এই বয়সেই এই ভয়াবহ চাপ তাদের কে নিতে হয়। তাদের অনেকেই আক্রান্ত হয় চরম বিষণ্ণতা আর হতাশায়।

কামআউট করার পরিণতি আমাদের দেশে খুব একটা ভাল হয় না। বেশিরভাগ বাবা মা কোনভাবেই এই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারে না।শুরু হয় মানসিক এবং শারীরিক অত্যাচার, সারাক্ষণ শোনানো হয় ধর্মে কথা। আশে পাশের মানুষ প্রতিবেশী রা তাকে নিয়ে শুরু করে হাসিঠাট্টা। গসিপ করে। সে হয়ে যায় সমাজে কোণঠাসা। আর তার পরিবার হয়ে যায় উদ্বিগ্ন। কারণ তাদের কেও সহ্য করতে হয় নানাঅপমানজনক কথা। আবার যারা একটু শিক্ষিত তারা সন্তান কে নিয়ে যায় ডাক্তারের কাছে। খুব কষ্ট হলেও আমি বলছি বাংলাদেশের বেশির ভাগ ডাক্তার জানেই না বা মানে না যে ট্রান্সজেন্ডার কোন অসুস্থতা নয়। আগের জেন্ডার আইডেন্টিটি ডিসঅর্ডার কে এখন আর মানা হয় না। বরং আই সি ডি -১১ এ খুব স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে ট্রান্সজেন্ডার কোন অসুস্থতা নয়। তারপরও কোন কোন ডাক্তার ট্রান্সজেন্ডার মানুষকে তথাকথিত সুস্থ করার লক্ষ্যে কড়া ডোজের এন্টিসাইকোটিক ড্রাগ দিয়ে রেখে দেয়। কাউকে কাউকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। আর কখনো কখনো সাইকো-থেরাপির মাধ্যমে করা হয়, মানসিক অত্যাচার। অনেক থেরাপিস্ট এর কথায় সে নিজে কে হীন মনে করে। নিজের অবস্থা কেন হল সেই অপরাধ বোধ তাকে গ্রাস করে ফেলে।

কমিউনিটি

এতক্ষণ বললাম হেটারোসেক্সুয়াল মানুষ দের কথা। কিন্তু গে, লেসবিয়ান বা বাইসেক্সুয়াল মানুষ কি ট্রান্সজেন্ডার মানুষকে সহজ ভাবে নিতে পারে? যেখান একটি ছেলে যখন একটু মেয়েলী হয় তখন তাদের নিয়ে চলে অনেক সমালোচনা এবং গসিপ। সেখানে ট্রান্সজেন্ডার মানুষ তো আরও অবহেলিত। অথচ এই গে বা লেসবিয়ানরাও কিন্তু বাইরের মানুষ দ্বারা হোমোফোবিয়ার শিকার হয়। অথচ তারাই আবার ট্রান্সফোবিক হয়। অনেকেই ফেসবুকে ট্রান্সজেন্ডার শুনলেই ব্লক করে দেয়। একটা ট্রান্সজেন্ডার নারী যখন শাড়ি চুরি পরে সেজে আসে তখন তাদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলে। এটাই তাদের ট্রান্সফোবিয়ার বহিঃপ্রকাশ। কতি, পান্থি, টপ বোটম ভেদেও অনেক বৈষম্য করা হয়। অনেকের কাছে কতি একটি ঘৃণ্য শব্দ। টপ যারা তাদের অনেকেই, কতি (বটম) রা তাদের থেকে নিম্ন এই ধারণা পোষণ করে। এখানে কতি শব্দটি কিন্তু শুধু মাত্র সমকামীদের ইংগিত করে না। এক সময় গ্রাইন্ডারে একটি প্রোফাইলে দেখেছিলাম যে লিখা ছিল ডগস এন্ড ফেমিনিন ডোন্ট নক মি। কতখানি অসুস্থ মানসিকতার হলে একটি মানুষ এমন কথা লিখতে পারে। এই ছেলেটা সরাসরি এটা প্রকাশ করেছে। কিন্তু অনেক সমকামী মানুষ কিন্তু ভিতরে ভিতরে এমন ধারণা লালন করছে।

অন্যাযান্য্য ক্ষেত্রে ক্ষেত্রে চাকুরীর ক্ষেত্রে যারা ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে কাম আউট করেছে তারা বৈষম্যের শিকার হয়। বড় বড় প্রতিষ্ঠান গুলোতে সহজে চাকুরী পাওয়ায় যায় না। এমন কি ইন্টার্ভিউ পর্যন্ত ডাকা হয় না। মার্কেটে কেনা কাটা করতে গেলে আশের পাশের মানুষ তির্যক মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়। হাসাহাসি করে। এছাড়া মেডিকেল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের এক্সেস সহজ হয় না।

পরিণতি

ট্রান্সজেন্ডার মানুষ যারা কাম আউট করেছে অথবা করেনি উভয় পক্ষের অনেকেই বিষণ্ণতা, হতাশায় আক্রান্ত হয়। অনেকে ড্রাগ নেয়। আবার কেউ কেউ তাদের কে রিলেশনের স্বপ্ন দেখিয়ে শুধুমাত্র শারীরিক সম্পর্ক করে একসময় সম্পর্কশেষ করে দেয়। যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। তাদের এটিচুড এমন যে ট্রান্স মানুষ দের সাথে শুধুসেক্স করা যায় কিন্তু স্থায়ী রিলেশন নয়। অনেকেই পরিবারের চাপে বিয়ে করে কিন্তু সারা জীবন এই বিয়ে ঘানি টানতে হয়। অনেকের ডিভোর্স হয়ে যায়। আবার কেউ কেউ হতাশা, বিষণ্ণতায় আত্মহত্যা করে। গবেষণার দেখা গিয়েছে এলজিবিটি মানুষের মাঝে যৌবনে আত্মহত্যার হার অন্যদের তুলনায় বেশি। যারা আত্মপ্রকাশ করে তারা কেউ কেউ সহিংসতার শিকার হয়। এমনকি তা হত্যা পর্যন্ত গড়ায়।

পৃথিবী সুন্দর। আমরা সুন্দর পৃথিবী তে সবার সাথে সুন্দর ভাবে বাঁচতে চাই। কিন্তু কিছুকিছু মানুষের জন্য ট্রান্সজেন্ডার মানুষের জীবন হয়ে উঠে নরক। সবার মত সুন্দরভাবে বাঁচার অধিকার তাদের রয়েছে। কিন্তু সেই গুটিকতক মানুষের ট্রান্সফোবিয়া তাদের এই অধিকার ভোগ করতে দেয় না। তারা হয়ে পড়ে সমাজের চোখে পাপী। কিছুকিছু মানুষের মতে তারা পৃথিবীতে যেমন পঙ্কিল তেমনি মৃত্যুর পরও তাদের শান্তি নেই।  আসুন ট্রান্সফোবিয়া দূর করার লক্ষে কাজ করি। নিজের পক্ষে যতটুকু সম্ভব ততটুকুই অন্তত করি। একজন মানুষেরও যদি ট্রান্স মানুষদের প্রতি মনোভাব পরিবর্তন করতে পারি সেটাও একটা বড় অবদান হবে। নিজের ঘর থেকেই আসুন শুরু করি। শিক্ষিত করি নিজের বাবা মা এবং বন্ধুদেরকে।

প্রথম প্রকাশিত
ঠাহর (দ্বিতীয় সংখ্যা)
মন্দ্র থেকে প্রকাশিত জেন্ডার, সেক্সুয়ালিটি এবং কুইয়্যার বিষয়ক ম্যাগাজিন

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.