আমার কুইয়্যার সুখ দুঃখ

আ.আ

‘যে ভালোবাসে, তাহাকে ঘৃণা করার অপবাদ দেওয়ার মত গুরুতর শাস্তি আর নাই, এ কথা ভালোবাসাই বলিয়া দেয়’। শরৎচন্দ্রের কথা দিয়েই শুরু করি। আমার মনে হয় আমার এই ছোট জীবনে সত্যিকার অর্থে শুরু হয়েছে নিজের সত্ত্বা’কে স্বীকার করে। আসলেই কি তাই নাকি সব কিছু ভুল? 

আমার মধ্যে এত হতাশা কেন? ছবি তুলতে গেলেই সবার কষ্ট চোখে পড়ে, বলতে গেলে দীর্ঘশ্বাস পড়ে, লিখতে গেলে কান্না হয়। হালকা ঠাণ্ডার একটা অনুভূতি কিন্তু সারাক্ষণ রয়ে যাচ্ছে। হয়ত আমি একজন লেখক হিসাবে, একজন শ্রোতা হিসাবে, একজন দর্শক হিসাবে ভীষণ রকমের ব্যর্থ। হয়ত আমি কোন কুইয়ার মানুষই না। হয়ত আজ থেকে পৃথিবীর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক আমি ছিন্ন করতে চাই। আজ থেকে একাই আমি দাঁড়িয়ে থাকব সশব্দ সমুদ্র সন্নিহিত একটি নোনা ধরা ভেঙে পড়া বাড়ির দরজায়।

অনেকদিন আগে অনেক দূরের এক শহরে এক বন্ধু বলেছিলো, অপারেশন করলেই কি সব পরিবর্তন হয়ে যায়? তুমি যতই আশা করো না কেন, শরীর থেকে কেটে ফেলার পরেই বুঝবা কি হারাইলা। আসলেই হারানোর আছে কি? চাইলেই কি সব কিছু নিজের হয়ে যায়? নাকি সব উপরে উপরে লোক দেখানো?

‘ছোটবেলা থেকেই আমার তেমন একটা সুখের স্মৃতি নাই’, ফরাসি লেখক এডওয়ার্ড লুইয়ের প্রথম বই ‘দ্য এন্ড অফ এডি’র প্রথম লাইন। দারুণ নামকরা একটা বই। অসাধারণ ভাবে সাম্প্রতিক সময়ে ফ্রান্সে ডান পন্থীদের উত্থানের সাথে সাথে দেশের মধ্যবিত্তদের মাঝে জেনোফবিয়া আর হোমোফোবিয়ার সম্পর্ক ব্যবচ্ছেদ করেছেন। বইয়ের শুরু অনেকটা এমন, পৃথিবীতে কোন সুখ নাই। সুখের কোন অবকাশ নাই। এমন একটা পৃথিবী যেখানে আকর্ষণীয় দারিদ্র আর সংঘাতে পরিপূর্ণ। ঠিক এর মাঝেই কথক নিজের সুপ্ত সত্ত্বার কথা বুঝতে পেরেছেন, এবং সেটার সামাজিক গুরুত্ব। ‘তুই একটা ফ্যাগট, তাই না?’ সাথে সাথে তার সমবয়সী দুজনের থুতু; কথকের জন্য ফ্যাগট আর থুতু একটা চিরস্থায়ী সিলের মতো হয়ে গেলো। লুইয়ের পক্ষে, অন্যের থুতু দিয়ে ব্যাপ্টিজমের মতো গ্রহণ করতে গেলে আরেকবার পুনর্জন্ম নিতে হবে। এই পুনর্জন্ম  তার পূর্বসূরী জিন জেনিটের কল্পনার কলমের মতো নয়।

‘আওয়ার লেডি অফ দ্য ফ্লাওয়ারস’ এ কথকের শরীরে যে থুতু ছড়িয়ে পড়েছিল, তাকে গোপনে লজ্জিত করার জন্য গোলাপের মালায় ফুল দেয়। আবার লুইয়ের এই সুতীব্র কষ্টই তাকে অন্যের বেদনা বোঝার জন্য অক্ষম বানিয়ে দেয়। 

‘আমি জানি না আমি কি ভাবছিলাম যখন আমাকে ওরা থুতু দিলো, ফ্যাগট বলে গালি দিলো’। তার নেশাগ্রস্ত মা পাবলিক টয়লেটে গর্ভপাত করানোর চেষ্টা করেন। বয়সের সাথে সাথে তিনি যে সহিংসতার মুখোমুখি হন তা অন্য মানুষকে ব্যক্তি হিসাবে দেখার ক্ষমতা নষ্ট করে দেয় এবং তবুও ‘দ্য এন্ড অফ এডি’ একটি উপন্যাস, একটি বইয়ের ছদ্মবেশ ধারণ করে এমন একটি উপাদান, যা সামাজিক স্বতন্ত্রতার দাবিতে পরিণত হয় এবং যেটা তাকে ফাগোট এডি বেলগ্যুলে থেকে লেখক এডওয়ার্ড লুই এ পরিণত করে।

তালিকাগুলি প্রমাণ হিসাবে প্রমাণিত হয় না, তালিকা আর্গুমেন্ট নয়, তালিকা মাত্রই চিন্তাভাবনা তৈরি করে। তবে কখনও কখনও তালিকাগুলি আমাদের চিন্তায় বিশ্বাস কি করতে পারে তা দেখতে সহায়তা করতে পারে। লেডি গাগা টাকিলা শটস বাহারি চুল কালারফুল আন্ডারওয়্যার সুন্দর জামা কানে ছোট দুল কব্জিতে কাটা দাগ।  আমি যতদূর মনে পড়ে সমকামী শব্দটির সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগ পর্যন্ত পরিচয় হয়নি আমার। হলেও অপমান ছাড়া অন্য কোথাও কুইয়ার শব্দটি কখনও শুনিনি। আমি জানি যে নামটি দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে আমি সেই জীবনযাপন করি তবে আমি জানি গে/কুইয়ার/লেসবিয়ান/ ট্রান্স নাম ছাড়াও জীবনযাপন করা যায়। আমি পার্টি এবং ক্লাবগুলিতে সেই মুহূর্তগুলির চেয়ে জীবনকে আরও তীব্রভাবে অনুভব করি নি যখন বিভিন্ন বাসনা, আকাঙ্ক্ষাগুলো সহ অন্য লোকেদের পূর্ণতা বর্জন করা প্রয়োজন, তবুও কিছু একটা একত্রিত করার জন্য সবাই একত্রিত হয়।

সংস্কৃতি হিসাবে এটাই তো বিশাল কিছু! একটি প্রজন্ম হিসাবে সময়ের সাথে এতটা আবদ্ধ কিছু, একটি পরিচয় হিসাবে এত স্থির কিছুই। কি জানি!

আমেরিকান পণ্ডিত সাইদিয়া হার্টম্যান, যিনি কালো আমেরিকানদের জীবনে দাসত্বের উত্তরাধিকার নিয়ে গবেষণার জন্য নিজের জীবনের বিশাল একটা সময় পার করেছেন, একবার তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো—‘আপনি কীভাবে আনন্দকে সংজ্ঞায়িত করেন, আপনার কাছে আনন্দের অর্থ কী?’

তিনি উত্তর দিয়েছিলেন এইভাবে, ‘আমি অন্যরকম রূপে ব্যক্তি বা বিষয়বস্তুর সীমাবদ্ধতা বা পোশাক থেকে রূপান্তর বা মুক্তির এই অভিজ্ঞতাকেই আনন্দ হিসাবে চিন্তা করি। ধারণ করি। সুতরাং, আমার জন্য আমি মনে করি এটি একটি ভাসমান অবস্থা, আবার এটি কিছুই নয় এবং একই সাথে সব কিছু হওয়ার বিষয়ে; পৃথিবী, সাগর, আকাশ, ভূমির বিশালতার প্রসঙ্গে অদৃশ্য হওয়ার এই অনুভূতি। এই জাতীয় আনন্দ সর্বদা আত্মকেন্দ্রিক’। তাহলে খুশি হওয়ার অর্থ কি?

আমার তো মনে হয়, সুখ সম্পর্কে মোটেও লেখা সম্ভব নয়। হেনরি ডি মন্টেরল্যান্ড বলেন, ‘সুখ একটি সাদা পাতায় সাদা কালি লিখে দেয়’। বিশাল শূন্য অবস্থায় সুখের কোন চিহ্ন নাই, এবং আবার এটাই সুখের কারণ সুখের কোনও চিহ্ন রাখে না। সুখের মুহূর্তগুলিতে, আমরা রেকর্ড করি না, আমরা লিখে রাখি না, আমরা খালি অনুভব করি। আমরা অতীত এবং ভবিষ্যতের মধ্যে আমাদের আত্মকে বিভক্ত করি নি, কিন্তু এই বিভক্তি যা প্রতিটি লেখার সাথে হয়। তাহলে কি কেউ আর সুখী হবে না?

বা এটা কি কেবল সুখ একটি বিশেষ রঙে আঁকা বলে আমরা সেটা পড়তে জানি না? আগের দিনের প্রেমিক-প্রেমিকারা সাদা রঙে চিঠি লিখত, আবার স্পাই এজেন্ট লেবু রস এবং অদৃশ্য কালি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাঠাতো। এখন অবশ্য মোবাইলেই গোপন এনক্রিপ্টেড মেসেজ পাঠানো যায়।

ফ্রয়েডের কাছে, সুখ সমস্ত মানুষের কাজে নিহিত জীবনের লক্ষ্য হিসাবে মনে হয়েছিল: মানুষ ‘সুখের জন্য চেষ্টা করে, তারা সুখী হতে চায় এবং তাই থাকতে চায়’। তবুও ফ্রয়েডের জন্য ‘আমরা যাকে সুখ বলি, শব্দের কঠোর অর্থে, গোপন প্রয়োজনের হঠাৎ সন্তুষ্টি থেকে উদ্ভূত হয়’, কেবলমাত্র শারীরবৃত্তীয় আনন্দের অবস্থা। তিনি বলেছিলেন, যৌন প্রেমের কাজটি ‘মানুষকে তৃপ্তির সবচেয়ে শক্তিশালী অভিজ্ঞতা দান করেছিল এবং প্রকৃত পক্ষে তাকে সমস্ত সুখের ধারা সরবরাহ করেছিল’ এর পরিণতিতে যে তিনি ‘যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার সুখ অন্বেষণ করতে যাবেন এবং যৌনাঙ্গে যৌন প্রেমকে তার জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে দিন’। তবে ফ্রয়েডের কাছে এটি ছিল একটি ভুল। যৌনতার দ্বারা উৎপাদিত রাষ্ট্র হল বিশ্বাস। একটি মায়া যা আনন্দের নীতিটি আকাঙ্ক্ষার সত্যি কারের অসচ্ছলতার মুখোশ দেওয়ার জন্য স্থির করে। আসলে, আমরা মনে মনে ভাবি যে, যৌনতা আমাদের সুখী করতে পারে তা হ’ল আমাদের দুঃখের উৎস। কেউ বলতে আগ্রহী হয়ে বলতে পারে যে ফ্রয়েডের কাছে যৌনতার পরিকল্পনায় সুখের কোনও অংশ নেই।

মানুষের মনের অবস্থা কেমন হতে পারে, আমরা সেই পাঠটি শিখতে পারি যেটা আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের একটা গল্প দিবে। যদিও যৌন ‘সুখ’ একটি মায়া হতে পারে তবে আপনি এই অবস্থার সাথে কীভাবে লড়াই করেন সেটা কিন্তু আপনাকেই ঠিক করতে হবে। ফ্রয়েড দুর্দশাগ্রস্ত ব্যক্তিকে পৃথক করে তোলে এই বিশ্বাসে খুব একটা বিশ্বাসী ছিলেন না বললেই চলে। তবুও ফ্রয়েডের যৌনতার তত্ত্ব এবং এটি থেকে উৎপন্ন সব কিছুই আমাদের এই বিশ্বাসের সাথে ছেড়ে দিয়েছে যে যৌনতা এমন একটি বিষয় যা কখনই সম্পূর্ণ সত্য বা আমাদের পুরোপুরি সুখী করতে পারে না, আমরা কীভাবে আমাদের অসুখী জীবন যাপন করি তার গল্পটি আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের। আর প্রতিটি গল্প ভীষণ রকমের ব্যক্তিগত।

প্রথম প্রকাশ
ঠাহর (দ্বিতীয় সংখ্যা)
মন্দ্র থেকে প্রকাশিত জেন্ডার, সেক্সুয়ালিটি এবং কুইয়্যার বিষয়ক ম্যাগাজিন

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.