কল্পনায় বাস্তবতা

ইনসেনলি অ্যাভারেজ

দেয়ালে পিঠ আটকে গেলে ঘুরে দাঁড়ানোই নিয়ম। পিঠ দেয়ালে ঠেকেছে সেই কবেই। তাই, ঘুরে দাঁড়ানোর আলাপ দেওয়া এই মুহূর্তে নিতান্তই আবশ্যিক। এহেন ক্রান্তিকালে ইয়েটসের মত মনের কুঠুরির দরজা খুলে কল্পনার দুনিয়ায় ঝাঁপ দিয়ে স্বস্তি খোঁজার চেষ্টা করা আত্মপ্রতারণারই অপর নাম।

পার্থিব জীবনের গৎবাঁধা ব্যস্ততা থেকে ছুটি নিয়ে একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে কবি ইয়েটস চলে যেতে চাইতেন ইনিসফ্রিতে। ইনিসফ্রি; কবির কল্পনার রাজ্য যেখানে মেলে একটু শান্তির খোঁজ। যেখানে শান্তি নেমে আসে ধীরে। যেখানে শান্তির এই নেমে আসা শুরু হয় ভোরের চাদর বেয়ে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের ক্ষণ নামবার আগপর্যন্ত শান্তির এই ধারাপ্রবাহ যেখানে থামে না। বাস্তবতার প্রতি তীব্র অরুচির বিরুদ্ধে নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে কবি রওনা দেন ইনিসফ্রির লেকের ধারে। লেকের পানির কুলকুল শব্দ অনুরণন ঘটায় কবির মস্তিষ্কে। ভাবনাটা বেশ লোভনীয়ই।

ঘাড়ের ওপরের এই ছোট্ট মাথার ভেতরটাকে বিনা পয়সার হলিডে ডেসটিনেশন বানিয়ে ঘুরে বেরিয়ে যদি মানসিক চাপমুক্তি ঘটে তাতে ক্ষতি কী! কিন্তু, বাস্তবতার ডামাডোল যখন প্রতিমুহূর্তে জানিয়ে দেয় এই বাস্তবতায় টিকে থাকা দায় সেখানে মস্তিষ্কের ভেতরটাও দূষিত হয়ে পড়ে। সেই দূষণ সুন্দর কোন বাস্তব না হোক, অন্তত একটা কল্পনার রাজ্য পাবার ইচ্ছাকেও কি ধু ধু মরুর ধূসর মরীচিকায় পরিণত করে দেয় না?

চলমান বাস্তবতায় টিকে থাকা দায় তো বটেই। নিজেকে প্রকাশ করায় দায়।

জীবনকে উপভোগ করায় দায় । চাওয়ায় দায়, পাওয়ায় দায়, ভালবাসায় দায়।

প্রতিটি পদক্ষেপেশিকলের ঝনঝনানি। অস্তিত্বকে বুকের খাঁচায় বন্দি রেখে দেখ দেখনদারিত্বের রঙঢঙয়ের জীবনযাপন। ওতে শান্তি কোথায়? শান্তি আর অস্তিত্বের পারস্পরিক সম্পর্কটা মাখামাখির। অস্তিত্বকে বন্দি রাখলে শান্তিটাও আটকে যায় ইনিসফ্রির ওই লেকের পাড়ে। কিন্তু, ইয়েটসের মত সৌভাগ্য আমাদের হয় না। আমাদের লেকের পানিতে স্রোত নেই, আছে কেবল শোকের মত স্তব্ধতা। আমাদের লেকের পানিতে মরা মাছ ভেসে ওঠে মৃত্যুর ছটফটানি সহ্য করে। মাছের এই ছটফটানিতে যেন অনূদিত হয় আমাদের আত্মার কান্না। স্বাধীনতার তৃষ্ণায় আর্ত আমাদের আত্মা  যখন তখন কেঁদে ওঠে। শ্রাব্যতার মাত্রা পেরিয়ে যায় এই কান্নার রোল। আমরা কাঁদি। কেউ শোনে না। অশ্রুর বদলে গাল বেয়ে নামে রক্ত। হৃদয়ের রক্তক্ষরণ অশ্রু হয়ে ঝরে।

সামাজিকতার মুখরোচক রেসিপিতে আমরা গণ্ডায় গণ্ডায় ঢালতে থাকি আপস, আত্মত্যাগ আর পিপল প্লিজিংয়ের মত নানান উপকরণ। দিনশেষে সে খাদ্য গেলে সমাজ নামের বিশাল ক্ষুধার্ত এক দানব। ধর্মের নাগপাশ আটকে ধরে আমাদের। আমরা নিজেদের ছাড়াতে পারি না। যত চেষ্টা করি চোরাবালির মত আটকে যাই। পরিবারের অদৃশ্য মুখ রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে আমরা জন্মাই। সে দায়িত্ব পালন করতে না পারবার অর্থ তো নির্ঘাত খুন হওয়া। খুন হবার প্রক্রিয়াটাও চমৎকার। ধুপধাপ খুন করে হাত ধুয়ে নিস্তার দেবে সে খেয়াল নেই।  তিলে তিলে, খোঁচাতে খোঁচাতে মৃত্যুর কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া হয় প্রতিটা দিন। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবার ঠিক পর-মুহূর্তেই আমরা আরেকটু শ্বাস নিয়ে বেঁচে উঠি। তৈরি হই আরেকটু মরবার উদ্দেশ্যে। তবু আমরা থামি না। আসলেই কি থামি না?

আমাদের স্বপ্নগুলি থামে। দ্রুতগতির যান হঠাত ব্রেক কষে যেমন। আমাদের স্বপ্নের ব্রেক একবার কষলে হুইল চালিয়ে আর কাজ হয় না। সুস্থ চিন্তাগুলোও হাত পা নাড়িয়ে চলাফেরা বন্ধ করে দেয়। তীব্র অবিশ্বাসে চেয়ে চেয়ে নিজেদের স্বপ্নগুলিকে আমরা লাশ হতে দেখি। স্বপ্নের এ অপমৃত্যুর কোনো প্রতিকার পাই না। বাতাস ভারী হয়ে ওঠে আমাদের দীর্ঘশ্বাসে। 

প্রতিকার পাই না। বাতাস ভারী হয়েয়ে ওঠে আমাদের দীর্ঘশ্বাসে। অতীতের স্বপ্নগুলো আমাদের কাছে বোকা বোকা লাগতে শুরু করে। বাস্তবতার দেওয়া কড়া দাগা পেয়ে শিক্ষা নিই। শিক্ষা নিই নিজেদের ভুলে থাকার। প্রচলিত মত-বিশ্বাসের কাছে মাথা নত করে আজীবনের জন্য সঁপে দিই। আমরা বুঝি না, বুঝতে চাই না যে, আমাদের প্রতিরোধ হয়ত নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উন্মুক্ত করত। হয়ত আমরা লাশ হয়ে যাওয়া স্বপ্নগুলিকে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে জাগরণ ঘটাতে পারতাম কোন এক ফিনিক্সের। আমরা হতে পারতাম সেই ইকারুস যার ডানা গলে যাওয়ার ভয় নেই, যে উড়তে পারে সর্বত্র। আমরা হই না।

ক্লান্তি ছেয়ে যায়, হতাশা গ্রাস করে। জীবন শ্রীহীন হয়ে একাকার। পাওলো কোয়েলহোকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে নিসর্গ আমাদের চাওয়া পূরণে ষড়যন্ত্র করতে নামে না। আমরা যা চাই সব বিপরীত ঘটে। শান্তির খোঁজ করে বিষণ্ণতার ব্যাধি জোটে। শুরু হয় জীবনভর এক যুদ্ধের। শত-বর্ষব্যাপী যুদ্ধেরও আছে ইতি ঘটবার ইতিহাস।

অথচ, বিষন্নতার বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধের কোনো বিরতি নেই, সন্ধি নেই, সমাপ্তি নেই।  আমরা নিরবচ্ছিন্ন ভাবে লড়ি, লড়েই যাই। মাঝেমধ্যে জিতে যায় বিষণ্ণতা। হঠাৎ এক-দুবার আমাদের জয়ও যে হয় না তা নয়। তারপর যেই-কে সেই।

লাগামছাড়া চাপা বেদনার দংশনে বিষাক্রান্ত আমরা নীল হয়ে থাকি। তবু, মানিয়ে নিতে হয়। যেন নদীর মাঝখানে আস্ত এক বাঁধ। পানির প্রবাহ আটকে যাবার মত আমাদেরও আটকে দিতে হয় অনুভূতির ধারালো কামড়। দেয়ালে পিঠ আটকে গেলে ঘুরে দাঁড়ানোই নিয়ম। পিঠ দেয়ালে ঠেকেছে সেই কবেই। তাই, ঘুরে দাঁড়ানোর আলাপ দেওয়া এই মুহূর্তেনিতান্তই আবশ্যিক। এহেন ক্রান্তিকালে ইয়েটসের মত মনের কুঠুরির দরজা খুলে কল্পনার দুনিয়ায় ঝাঁপ দিয়ে স্বস্তি খোঁজার চেষ্টা করা আত্মপ্রতারণারই অপর নাম। সে নাম জপবার চেয়ে বরং নতুনের আবাহনের কোলাহলে বেজে উঠুক আমাদের প্রাণ।

পরিবর্তনই সমাধান এই মর্মে বাজুক আমাদের আত্মার ভায়োলিন। পরিবর্তনের গানটা সুরেলা হোক কিংবা বেসুরো, বেজে চলুক দিনভর অবিরাম। সমস্ত শেকল ছিঁড়ে যেয়ে দিগ্বিদিক আছড়ে পড়ুক। অমূল্য জীবনগুলি নেহাত সস্তায় বিলিয়ে দিয়ে অপচয় করবার কোন মানেই নেই। রাতারাতি না-ই বা হল। একটু একটু করেই হোক? জীবনের জয়গান হোক। অনুভূতির নহর বয়ে যাক নির্বিবাদে। অন্তত কথাটুকুহোক?

জোরালো কণ্ঠে আওয়াজ উঠুক। ভীষণ ভীষণ কলরবে নিস্তব্ধতার জাল কেটে বেরিয়ে স্বপ্নের পাখিরা উড়াল দিক দূর আকাশে।

লেখক গড়পড়তা মানুষ হবার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে নিজের পক্ষ নিয়ে। পক্ষটা কী? আত্মদর্শন ও আত্মবিশ্লেষণ। এই দর্শন ও বিশ্লেষণ শেষে কোথায় যেয়ে উনি দাঁড়ায় তা দেখবার তুমুল আগ্রহে বেঁচে থাকছে প্রতিক্ষণে।

প্রথম প্রকাশ
ঠাহর (দ্বিতীয় সংখ্যা)
মন্দ্র থেকে প্রকাশিত জেন্ডার, সেক্সুয়ালিটি এবং কুইয়্যার বিষয়ক ম্যাগাজিন

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.