দ্য ইমিটেশন গেম

তন্ময় সরকার

“The Imitation Game” এই চলচ্চিত্রটি আধুনিক কম্পিউটার বিজ্ঞানের জনক অ্যালান টুরিং এর জীবনী থেকে অনুপ্রাণিত।চলচ্চিত্রটিতে দেখানো হয়েছে,কিভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে অ্যালান টুরিং গাণিতিক এলগরিদম, ইঞ্জিনিয়ারিং ও তখনো আবিষ্কার না হওয়া কম্পিউটার বিজ্ঞানের ধারণাকে ব্যবহার করে, বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের তথ্য আদান-প্রদানে ব্যবহার করা এনিগমা মেশিনের কোড ভেঙে সেসব তথ্য উদ্ধার করেন। তবে চলচ্চিত্রটিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে কিংবা ভয়াল কোনো দৃশ্য দেখানো না হলেও, সেই ভয়াবহ পরিস্থিতির একটি আন্দাজ পাওয়া যায়। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, টুরিং এর এই তথ্য উদ্ধারের মাধ্যমেই কেবল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তার সম্ভাব্য সময়ের দু’বছর আগেই শেষ হয়েছিল। যার ফল হিসেবে প্রায় ১৪ মিলিয়ন বা এক কোটি চল্লিশ লাখ মানুষের প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হয়। যদিও এই মহান বিজ্ঞানীর ব্যক্তিগত জীবন ও কর্মক্ষেত্র ছিল রহস্যে ভরা। কিন্তু পরবর্তীতে তাঁর লেখা ও গবেষণার উপর ভিত্তি করেই কম্পিউটার বিজ্ঞানের বর্তমান রূপ রেখা অঙ্কিত হয়। আর তাঁর আবিষ্কৃত “টুরিং মেশিন” থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই তৈরি হয় আজকের “আধুনিক কম্পিউটার”। ২০১৪ সালে মুক্তি পাওয়া “The Imitation Game” সিনেমাটি সে বছর সব থেকে ব্যবসা সফল চলচ্চিত্রের শিরোপা অর্জনের পাশাপাশি, “Best Adapted Screenplay” বিভাগে একটি অস্কারও জিতে নেয়। চলচ্চিত্রটিতে টুরিং চরিত্রে অভিনয় করেন শার্লক হোমস খ্যাত অভিনেতা বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচ (Benedick Cumberbatch) এবং তার টিম মেট ক্লার্কহিসেবে অভিনয় করেন, কিয়েরা নাইটলি (Keira Knightley)।

এবার সিনেমাটির মূল কাহিনীতে আসা যাক- The Imitation Game সিনেমাটিতে অ্যালান ট্যুরিং এর জীবনের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সময়কে আবৃত্তে উপস্থাপন করা হয়েছে। যেখানে টুরিং এর ছেলে বেলা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তাঁর অবদান এবং যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তাঁর সমকামী সত্তার জন্য তাঁর সাথে ঘটে চলা নানান বিড়ম্বনার ঘটনা উপস্থাপন করা হয়েছে। সিনেমাটি শুরুই হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলের একটি দৃশ্য দেখানোর মধ্যমে। ব্রিটিশরা তখন জার্মানের ধারাবাহিক আক্রমণে এক রকম কোণঠাসা। তাই নাৎসি কোড ভাঙাটা খুবই জরুরি। কিন্তু পারা যাচ্ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন ধ্বংসাত্মক রূপ নিয়েছে। আক্রান্ত পোল্যান্ড তখন বাধ্য হয়েই সাহায্যের আশায় উদ্ধার করা জার্মান এনিগমার তথ্যাবলি ব্রিটিশদের সরবরাহ করে। এনিগমা হলো একটি গোপন বার্তা প্রেরণকারী যন্ত্র, যার মাধ্যমে জার্মানরা রেডিও সংকেত দিয়ে দুর্বোধ্য কোডে সৈন্যদের কাছে আক্রমণের দিক নির্দেশনা পাঠাত। কোডগুলো মিত্রবাহিনী পেলেও তা ভাঙতে পারছিল না ব্রিটিশরা।

এরই মধ্যে ক্রিপ্টোবিশেষজ্ঞ টুরিংকে “Bletchley Radio Manufacturing Company” থেকে এনিগমার গোপন বার্তা উদ্ধার কাজে ডাকা হল। এই কোম্পানিটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একটি অতি গোপনীয় সংস্থা হিসেবে পরিচালিত হয়েছিল।সেখানে ট্যুরিং এর কাজ ছিল জার্মানিদের আদান-প্রদান করা বিভিন্ন এনিগমা কোড ডিকোডিং করা। কিন্তু টুরিং এতে মজা পাচ্ছিলেন না। তিনি চাইলেন একটি মেশিন তৈরি করতে। কারণ তাঁর মতে, ‘মানুষের দ্বারা এনিগমাকে হারিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। বরং একটি যন্ত্রের পক্ষেই সেটি সম্ভব।” যার কাজ হবে একবারে সকল তথ্য তুলে নিয়ে আসা। এজন্য তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের কাছে অর্থ অনুদান চেয়ে একটি চিঠিও লেখেন। আশ্চর্যজনক ভাবে সেটি গৃহীত হয় এবং তিনি এক সময় সেই এনিগমা ডিকোডিং মেশিনটি আবিষ্কারও করে ফেলেন। পরবর্তীতে তিনি মেশিনটির নাম দেন “ক্রিস্টোফার”।

এই ক্রিস্টোফার মরকম ছিল টুরিং এর শৈশব কালের একমাত্র বন্ধু। নিঃসঙ্গ, অপমানিত, অবহেলিত টুরিং ক্রিস্টোফারের একান্ত বন্ধু হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। কারণ অঙ্কে চৌকস হয়েও টুরিং স্কুলের ছাত্র-শিক্ষক কারওকাছেই জনপ্রিয় হতে পারেননি। তাছাড়া তখন গ্রিক, রোমান ভাষা, ইতিহাস ও সাহিত্য পড়াকেই আসল ‘শিক্ষা’মনে করা হতো। চুপচাপ স্বভাব, ভাবুক, নিজের কাজে মগ্ন ছেলেটি উচ্চতর ক্যালকুলাস সমাধানেই সব সময় ব্যস্ত থাকত। গণিত আর বিজ্ঞানই ছিল তাঁর উপাস্য। স্কুলের পাঠ্য-পুস্তকের চেয়ে স্বাধীন পড়াশোনায় সময় দিতেন বেশি। তাই সবার কাছেই  দুর্বোধ্য, খাপছাড়া একজন মানুষ হিসেবে হাসির পাত্র হয়ে উঠেছিলেন টুরিং। তাই ক্রিস্টোফারই ছিল টুরিংয়ের পরম ভালোলাগা ও ভালোবাসার একমাত্র স্থান। ‘ক্রিস্টোফার টুরিংকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল সংখ্যাতত্ত্ব, ক্রিপ্টোগ্রাফি, অ্যাস্ট্রোনমির মতো বিষয়ের সঙ্গে। টুরিং বুঝতে পেরেছিলেন একমাত্র ক্রিস্টোফারই তাঁকে বুঝতে পারেন, আর তিনিও ক্রিস্টোফারের সঙ্গে সমান তালে রেজোনেট করতে পারেন। দু’জনই দু’জনার কাছে হয়ে উঠেছিলেন পরম নির্ভরতার জায়গা।’ কিন্তু যক্ষ্মায় ক্রিস্টোফারের অকাল মৃত্যুতে টুরিংয়ের জগত এলোমেলো হয়ে যায়। ভেঙে পড়া টুরিং শোক ভুলতে ডুবে যান পড়াশোনা আর তাঁদের পড়ে থাকা অসমাপ্ত কাজের মধ্যে। ক্রিস্টোফারের মাকে এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘বেঁচে থাকলে ক্রিস্টোফার আমাকে এসব কাজের মাঝেই দেখতে চাইতো।’

ক্রিস্টোফার তৈরির সময় হাট-৮-এর একমাত্র নারী সহকর্মী জোয়ান ক্লার্কের সঙ্গে সমকামী টুরিংয়ের বন্ধুত্ব হয়। ধীরে ধীরে মেয়েটির সঙ্গে এক অভিনব সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন টুরিং। টুরিং ও জোয়ান দু’জনেই বুঝতে পারলেন, এই একত্রে কাজ করার মধ্যে তাঁরা এক ধরনের আনন্দ পান। জোয়ানের মেধা টুরিংয়ের মেধার সঙ্গে সমান গতিতে কাজ করে। জোয়ান টুরিংকে ভালোবেসে ফেলেন। টুরিংয়ের সমকামিতার কথা জেনেও চেয়েছিলেন তাঁর সঙ্গী হয়ে, একই ছাদের নিচে পাশাপাশি থাকবেন। জুটি বেঁধে একসঙ্গে কাজ করবেন। কারণ তত দিনে দু’জনেই বুঝতে পেরেছিলেন পারস্পারিক ভাব আদান-প্রদানের মাধ্যমে তাঁদের কাজের দক্ষতা শতগুণ বেড়ে যায়। তাঁদের এই ভালোবাসা বাগদান পর্যন্ত গড়িয়েছিল। কিন্তু পরে টুরিং নিজেই সরে যান এবং ক্লার্ক এর কারণ জানতে চাইলে টুরিং বলেন, একমাত্র কাজের স্বার্থেই তিনি ক্লার্কের সাথে ভালোবাসার অভিনয় করেছিলেন!

তবে যুদ্ধ পরবর্তী সময়টা ছিল টুরিং এর জন্য সব থেকে দুঃখজনক একটি অধ্যায়। কারণ তাঁর সমকামী পরিচয় ততদিনে লোকচক্ষুর সামনে চলে এসেছে। ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকনিশিয়ান বন্ধু, আর্নল্ড ম্যুরের সঙ্গে টুরিংয়ের সমকামিতার সম্পর্কছিল। এই তথ্যটি প্রকাশিত হলে টুরিংকে আইনের আওতায় এনে সমকামিতার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। বিচারে শাস্তি হিসেবে জেল; নয় তো সমকামিতার চিকিৎসার জন্য অ্যাস্ট্রোজেন ইনজেকশন নিতে বলা হয়। তিনি শাস্তি হিসেবে অ্যাস্ট্রোজেন গ্রহণ মেনে নিলেন। কারণ তিনি জেলের বাইরে থেকে তাঁর কোয়ান্টাম ফিজিক্সের গবেষণার কাজগুলো শেষ করতে চেয়েছিলেন। সে সময় যুক্তরাজ্যে সমকামিতাকে রোগ মনে করা হতো। এর চিকিৎসা ছিল হরমোনাল থেরাপি। থেরাপিটি ‘রোগীর’ যৌন ক্ষমতাকে কমিয়ে দিত, যাতে সে অন্য পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট না হতে পারে। থেরাপিটি একসময় টুরিংকে ‘নপুংসক’ করে দেয়! 

সমকামিতার দরুন তাঁকে সরকারি গোপনীয় কাজ থেকেও বাদ দেওয়া হয়। গোপন করে ফেলা হয় তাঁর সমস্ত অবদান ও গবেষণা পত্রগুলো। সে সময় তাঁকে অবিশ্বাস করা হচ্ছে জেনে টুরিং খুব কষ্ট পান। ধীরে ধীরে তাঁর মানসিক সমস্যাসহ বিভিন্ন শারীরিক উপসর্গদেখা দেয়। খবর পেয়ে জোয়ান ক্লার্ক তাঁকে দেখতে এসেছিল। এটাই ছিল তাঁদের মধ্যে শেষ দেখা। অ্যালান টুরিংকে ১৯৫৪ সালের ৮ জুন, তাঁর ৪২তম জন্মদিনের ১৬ দিন আগে, নিজ বাসায় মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। ময়নাতদন্তে সায়ানাইড পয়জনিংয়ের চিহ্ন পাওয়া যায়। টুরিংয়ের মাথার কাছে ছিল একটি আধ-খাওয়া আপেল। সব শেষে ‘The Imitation Game’ চলচ্চিত্রটির পরিচালক মরটেন টেইল্ডাস তার প্রথম ছবিতেই গল্পের চরিত্র গুলোর জীবন, কাজ, আনন্দ ও হতাশাকে যে দুর্দান্ত ভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন, সেটিকে বাহবা জানাতেই হবে। আর অভিনেতা বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচ টুরিংকে তার অভিনয় গুণে সিনেমার পর্দায় একেবারে জীবন্ত করে তুলেছেন।

তাই ‘The Imitation Game’ চলচ্চিত্রটি নিশ্চিত ভাবেই হারিয়ে যাওয়া টুরিংকে যেন আবার মানুষের সামনে ফিরিয়ে এনেছে। সমাপ্তির আগে ছোট্ট একটু কথা বলেই আমি সিনেমাটির রিভিউ শেষ করব। টুরিংয়ের মতো এমন হাজারো মানুষ আমাদের এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছে, করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। সবাই হয়তো টুরিংয়ের মতো জিনিয়াস হয়ে জন্মায় না। কিছু মানুষ জন্ম নেয় প্রকৃতি প্রদত্ত কিছু অসামঞ্জস্যতা নিয়ে। হয়তো হরমোনের গরমিল, এক্স- ওয়াই ক্রোমোজোমের রহস্যময় আচরণ, অথবা প্রকৃতিরগূঢ় কোন ইচ্ছা পূরণের শিকার এরা। এটা এদের নিজস্ব কোন অভিলাষ নয়। এই কথাগুলো আমরা যত দ্রুত বুঝতে ও বিশ্বাস করতে পারব, ততই মঙ্গল।

প্রথম প্রকাশ
ঠাহর (দ্বিতীয় সংখ্যা)
মন্দ্র থেকে প্রকাশিত জেন্ডার সেক্সুয়ালিটি এবং কুইয়্যার বিষয়ক ম্যাগাজিন

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.