
অনঙ্গ
ঠাহরের জন্য একটা মুভি রিভিউয়ের প্রয়োজন বলে শুনলাম যখন, তখনই ঠিক করেছিলাম পুরুষ সমকামীদের নিয়ে তৈরি কোনো কাজের রিভিউই আমি আপাতত লিখতে বসছি না। এই ব্যাপারটা মাথাতে আপনাতেই চলে এসেছিলো। এমন নয় যে অনেক যুক্তি-প্রতিযুক্তি আর শলা-পরামর্শের পরে ঠিক করেছিলাম এমন সাহসী কিছু করার। কিন্তু ও মা এতে সাহসের কি রয়েছে? আলবাত আছে।
আমি নিজে আমার সর্বনাম হিসেবে হি/হিজ (he/his) ব্যবহার করছি, দু’পায়ের ফাঁকে সদম্ভে একটি নলাকার অঙ্গ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, যেটি সময়ে সময়ে আমায় স্বর্গসুখ দেয়া ছাড়াও এই সমাজের অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিনা কোনো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিপাতের সম্মুখ ীন হয়ে, যে কোনো প্রকার কাজ করার ছাড়পত্র বিনামূল্যে দিয়ে দেয়! আর তাছাড়া পুরুষ হিসেবে পুরুষের অনুভূতি বুঝতে পারব আমি সেটাই স্বাভাবিক। অন্যান্য লৈঙ্গিক অনুভূতির ব্যবচ্ছেদ করতে গেলে সেটি একটি উপদ্রব বৈকি অন্য কিছু মনে হওয়ার তো কথা ও নয়।
কিন্তু এই উপদ্রবটিই করবার ভীষণ শখ আমার! কারণ বিষমকামীতার ডেরা থেকে বেরিয়ে নিজে যতোই ‘আউট অফ দ্য বক্স’ হতে চাই না কেন, এই কমিউনিটির মানুষ আমায় পলিটিকালি কারেক্ট করবার চেষ্টা করবেই করবে। কারণ হয়তো এটাই আজকালকার ট্রেন্ড বলে!
এমন একখানা ভাব তাদের, যেন পুরুষ লেখকদের দৃষ্টিতে নারীর যে বাস্তবতা বিবর্জিত, কিম্ভূতকিমাকার রূপ বহুকাল ধরে প্রকাশ পেয়ে এসেছে, তার ছিটেফোঁটা ও তৎকালীন নারী লেখকদের লেখায় আসেনি। জেন্ডার আর সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশান ব্যাপার দু’টোকে ফ্লুইড হিসেবে যতোই বড় বড় স্কলাররা দিনরাত কপচিয়ে যাক না কেন, দিন শেষে আমি একজন পুরুষ লেখকই রয়ে যাব যে তার ‘মেইল গেইজ’ (male gaze) দিয়ে আজ একটি লেসবিয়ান মুভির ব্যবচ্ছেদ করতে চলেছে। এবং এসব ভেবে আমি যে মাঝেমাঝে কি ভীষণ রস বোধ করি, তা আপনাদের কল্পনার ও অতীত!
১৯৯৬ সালে ভারতে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ফায়ার’ চলচ্চিত্রটিকে ধরা হয় ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রথম লেসবিয়ান মুভি। দীপা মেহতার পরিচালনায় এতে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন শাবানা আজমি (রাধা), নন্দিতা দাস (সীতা), কুলভূষণ খারবান্দা (অশোক) এবং জাভেদ জাফরী (যতীন)। বিয়ের তিনদিনের মাথায় হানিমুন করতে তাজমহলে ঘুরতে এসে, স্বামীর উদাসীনতায় মুষড়ে পড়া সীতা এক পর্যায়ে তাকে প্রশ্ন করে বসে, “তোমার বুঝি আমাকে ভালো লাগে না?” যতীনের উদাসীন মুখে এই প্রশ্ন অবশ্য কোনো ভাবের সঞ্চার ঘটায় না। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে তার মুখ থেকে যে উত্তর শুনি আমরা, তা থেকে সহজেই অনুমেয় হয়ে যায় বেচারী সীতার সাংসারিক জীবন বড়ো একটা সুখের হতে যাচ্ছে না।
এরপর আমরা একে একে জানতে পারি যতীন ও সীতার ভাবী রাধার কথা। একজন মধ্যবয়স্কা আপাতদৃষ্টিতে গুরুগম্ভীর মহিলা। দীর্ঘ সময়ের দাম্পত্যে যে নাকি তার স্বামীকে সন্তান দিতে ব্যর্থ হয়েছিল। আর এই সন্তান না হওয়াকেই দৈব সংকেত হিসেবে ধরে নিয়ে যতীনের বড় ভাই অশোক গ্রহণ করে ব্রহ্মচর্য। নারীসঙ্গ ত্যাগ করে মোক্ষলাভের জন্য তার মরিয়া হয়ে ওঠার লক্ষণ আমরা দেখতে পাই চলচ্চিত্রের পরতে পরতে। মোটা দাগে এটা বুঝতেও বেশিক্ষণ লাগে না যে রাধার সাংসারিক জীবন ও কণ্টকাকীর্ণ, স্বামীর আদর চাইতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হয়েছে সে।
প্রায় দেড়ঘন্টার এই চলচ্চিত্রের প্রথম আধঘণ্টার মাথাতেই এটা বোঝা খুব একটা কঠিন ছিল না, পরিচালক দীপা মেহতার এই চলচ্চিত্র কোন দিকে মোড় নিতে চলেছে।
দাম্পত্য জীবনে প্রবলভাবে অসুখী দুই নারী একে অপরের মাঝে সুখ খুঁজে নেবে, আদর খুঁজে নেবে, এমন গল্প বলতে যাওয়ায় ঠিক দোষের কিছুই নেই। কিন্তু দেখতে দেখতে বারবার আমার মনে প্রশ্ন জাগছিলো এটা কি আদৌ কোনো লেসবিয়ান মুভি?
উত্তরটা হলো, না। তাই একে সবজায়গায় ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রথম লেসবিয়ান চলচ্চিত্র হিসেবে প্রোমোট করার ব্যাপারটাকে আপনার খাপছাড়া মনে হতেই পারে। কিন্তু আরেকটু গভীরভাবে ভাবলে এই সিদ্ধান্তটিকে আপনিও সমর্থন করবেন বৈকী। অবশ্য চলচ্চিত্র কর্তৃপক্ষ এমন কোনো স্ট্রাটেজি মাথায় রেখে এগিয়েছিলো কি-না সে বিষয়ে আমি ঠিক হলফ করে বলতে পারছি না। আসলে ভারতীয় চলচ্চিত্র ইতিহাসে কুইয়ার মুভির সংখ্যা যেমন কম, তেমনি কম নারীকেন্দ্রিক চলচ্চিত্রের সংখ্যাও!
তাই মূলত বাইসেক্সুয়াল (অমনটা ভাবাই বেশি গ্রহণযোগ্য) দু’টি মানুষের প্রেম দেখানো হলেও, একে লেসবিয়ান স্টোরির তকমা দেয়ার ব্যাপারটা, নারী এবং বিশেষত কুইয়ার নারীদের ক্ষমতায়নে একটা প্রচ্ছন্ন তবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পেরেছে বলে বিশ্বাস করি আমি।
ফায়ার চলচ্চিত্রটিতে কেবলই যে নারীদের সমপ্রেম দেখানো হয়েছে ব্যাপারটা কিন্তু তা-ই নয়। একটা সাধারণ ও ‘স্বাভাবিক’ ভারতীয় পরিবারে (অবশ্য কেবল ভারতীয়ই কেন!) একজন নারীকে যে কীভাবে সিস্টেমেটিক নারী- বিদ্বেষ ও শোষণমূলক সংস্কৃতি র মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হয়, তা ও ফুটে উঠেছিল ছবিটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তাই তো বিযি (শ্বাশুড়ী) রাধার মুখে থুথুছুড়ে মারলে আমরা বুঝতে পারি, পুরুষতন্ত্রের বীজ কীভাবে একজন নারীর মনেও ঘূণ ধরিয়ে দিতে পারে ধীরে ধীরে। যখন তাদের বাড়ির কাজের লোক মুন্ডুর বিকৃত কামবাসনা রাধার চোখে ধরা পড়ে গেলেও অশোক তাকে ক্ষমা করে দেয় নিমিষেই, তখন আমরা বুঝতে পারি পুরুষতন্ত্র কেবল পুরুষদের ক্ষমতার মধ্যমণি করতেই ব্যবহৃত হয় না। এটি একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষকে তিলে তিলে বদলে দিতে পারে একজন হিপোক্রিটে।
চলচ্চিত্রটিতে বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখতে পেয়েছি পৌরাণিক রামায়ণের বেশ কিছু চিত্র, যেগুলো গল্প এবং দৃশ্যের সঙ্গে ছিল ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। তবে চলচ্চিত্রটি শেষ হয়ে গেলে, গল্পে এই হিডেন মিসোজিনি আর পুরুষতন্ত্রকে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ব্যবহারের ব্যাপারটা আপনাদের বিরক্তির উদ্রেক ঘটালে, তাতে দোষের কিছু রইবে না। কারণ রাধা আর সীতা তাদের দাম্পত্য জীবনে এমন নাকাল না হলে, তাদের মাঝে এই রোমান্সের গোড়াপত্তন আদৌ ঘটতো কি না তাতে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। হয়তো সেসময়কার ভারতীয় জনতার মাঝে কুইয়ার মানুষদের ব্যাপারে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে এই টোপটাই পরিচালক মহোদয়ার কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়েছিল! দু’জন নারী স্বেচ্ছায় একে অপরকে ভালোবাসার চাইতে, স্বামী-সোহাগ হতে বঞ্চিত হয়ে একে অপরের প্রেমে পড়লে বরং দ্বিতীয়টিই আমজনতার হৃদয় বেশি আর্দ্র করবে৷ ১৯৯৬ সালের সমাজব্যবস্থার সাপেক্ষে এই ‘সংকীর্ণ’ চিন্তাকে একেবারে বয়কট করে দেয়া যায় না।মারাত্মক হোমোফোবিক একটা জনগোষ্ঠীর কাছে এই গল্প পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে এটিকে আমি মন্দের ভালো বলেই ধরে নিয়েছি। কিন্তু মোটাদাগে এটি যে একটি ভীষণ ভুল বার্তা পৌঁছে দিয়েছে দর্শকদের কাছে, সেটির ব্যাপারেও আমাদের নতুন করে আলোচনা করা উচিত। পরিস্থিতির উপর যে কারো সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশান নির্ভর করে না, এই ব্যাপারটি ‘ফায়ার’ দেখে বুঝতে এই হেটারোনর্মেটিভ সমাজ যে ব্যর্থ হবে, তা আমায় নতুন করে বিচলিত করে তুলেছে। বাচ্চাদের যেন সহজে হজম হয় সেই উদ্দেশ্যে খিচুড়ি খাওয়ানো হয় বটে, কিন্তু কেবলমাত্র সেই খিচুড়ি খেয়ে তারা ডাল আর ভাতের পার্থক্য করতে শিখেযাবে, এই ভাবনা ভাবাটা কিন্তু নিতান্তই বোকামি।
ফায়ারের সবচেয়ে দুর্বল দিকটি ছিল এই যে, এটি এর দুই প্রোটাগোনিস্টের মধ্যকার লাভ এঙ্গেলটি ফুটিয়ে তুলতে রীতিমতো ব্যর্থছিল। শাবানা আর নন্দিতা দু’জনই অভিনেত্রী হিসেবে তাদের সর্বোচ্চটুকু দেয়ার চেষ্টা করেছে এবং দিয়েছে ও, কিন্তু তাদের মধ্যকার রসায়নটা জমে উঠতে গিয়ে ও ঠিক জমেনি। তাই লাভ মেকিং সিনগুলোতে তাদেরকে একে অপরের প্রণয়িনীর চাইতে সমব্যথী সখীই বেশি মনে হচ্ছিলো। আর শাবানা আজমীর চরিত্রটি সময়ের সাথে সাথে যতোখানি পরিণত হয়ে উঠেছে, নন্দিতার চরিত্রটি এর বিপরীতে বারবারই মনে হচ্ছিলো কেমন যেন খাপছাড়া। সে কখনো স্বামীর উদাসীনতায় অভিমানী, কখনো বা প্যান্ট পরে, মুখে সিগারেট গুঁজে চপলা-চঞ্চলমনা, কখনো বা বেহিসাবী প্রেমিকা আর কখনো কখনো তার কণ্ঠে ঝংকার দিয়ে উঠছিলো পুরুষতন্ত্রের অন্তঃসারশূন্যতা নিয়ে টিটকারি!
রাধার গুরুগম্ভীর, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, স্থিতধী চিত্ত, সীতার চপল মনের কাছে বাঁধা পড়বার ব্যাপারটি তাই মনে হচ্ছিলো পুরোপুরি স্ক্রিপ্টেড। ‘স্বাভাবিক’ পরিস্থিতিতে যাদের কাছাকাছি আসার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না, নীতা মেহতা যেন গল্পের ফাঁদে তাদেরকে আটকিয়ে আমাদেরকে বোকা বানিয়েছে! অবশ্য নন্দিতা দাস ও তাদের এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করে নিয়েছিলেন চলচ্চিত্রের এই দুর্বলদিকটির ব্যাপারে।
শুটিং চলাকালীন শাবানা বা নন্দিতা কেউই নাকি ঠিক বুঝতে পারছিলেন না কি করে তাদের মধ্যকার রসায়নটা পর্দায় ফুটিয়ে তুলবেন। তখন নীতা তাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন শাবানাকে পুরুষ হিসেবে কল্পনা করে অভিনয় চালিয়ে যেতে। কিন্তু নন্দিতা মুহূর্তেই ছুঁড়ে দেয় পালটা জিজ্ঞাসা,
“কিন্তু ও তো পুরুষ নয়!”
পাঠক, ফায়ার চলচ্চিত্রটিকে আমার বিশেষ পছন্দ হয়নি ব্যাপারটি তা নয়। কিন্তু এই চলচ্চিত্রটির চাইতে আমায় বেশি আকর্ষণ করেছিল এর পেছনের গল্পটা আর এর মুক্তিলাভের পরে যে রাজনীতি চলেছিল পুরো ভারত জুড়ে। সেসময় শিবসেনার (ভারতীয় রাজনৈতিক দল) আক্রোশে সিনেমা হলগুলো থেকে মালিকেরা ছবিটি তুলে নিতে বাধ্য হয়। পরে আরো তিন বছর বাদে ১৯৯৯ সালে চলচ্চিত্রটির নরায় মুক্তির আয়োজন করা হয়। সেসময়কার জনৈক নেতার মতে লেসবিয়ানিজম ভারতীয় সংস্কৃতি র কাছে এলিয়েন স্বরূপ! তাই অচিরেই এর প্রচার বন্ধ করে দিতে হবে।
তবে শিবসেনার ভাঙচুর আর তাণ্ডবের ভিতরেও আরেকটি শক্তি তৎপর ছিল, যাদের সমর্থনেই ফায়ার শেষমেশ উতরে যেতে পেরেছিল এই হিংস্রতার বৈতরণী। শিবসেনার এভাবে বাক স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করার পাঁয়তারার বিরুদ্ধে সাধারণ নাগরিকেরা আয়োজন করে ক্যান্ডেল মার্চের। সমর্থনের স্লোগান ভেসে আসতে শুরু করে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত হতে। এরপর তো আর পিছে ফিরতে হয়নি কাউকেই। ফায়ার একে একে নাম কামিয়ে নেয় বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ফিল্ম ফেস্টিভালে৷ হয়ে ওঠে ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক নতুন ধারার পথিকৃৎ।
তবে সেসময় সাধারণ দর্শকদের মাঝে চলচ্চিত্রটি তৈরি করে একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কুইয়ার নারীদের কোনো আখ্যান নয়, বরং কেবলমাত্র রগরগে যৌনতা উপভোগ করবার স্বার্থেও যে অসংখ্য পুরুষ সিনেমাহলে ভিড় জমিয়েছিল, তা সহজেই অনুমেয়। তবে যে ব্যাপারটিসবচেয়ে ভীতিজনক ছিল সেটি হল দর্শকদের একটি বড় অংশই গল্পটিকে ভুলভাবে গ্রহণ করে। তাই চলচ্চিত্রের শেষে অশোক, বিযি, যতীনের প্রতি তাদের সহানুভূতির পাল্লা কিছুটা বেশিই ভারী হয়ে উঠেছিল বলে, সেসময়কার সংবাদ মাধ্যম থেকে জানতে পারি। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় ছিল এই যে, তৎকালীন সেন্সরবোর্ডকোনোপ্রকার কাটছাঁট ছাড়াই সেসময় ফায়ারকে ছাড়পত্র প্রদান করে, যা ’৯৬ এর প্রেক্ষাপটে ছিল যথেষ্ট প্রগতিশীল। অবশ্য পরে শিবসেনাসহ আরো অনেক রক্ষণশীল ব্যক্তিবর্গ ও সংগঠনের প্রতিবাদের মুখে তারা ‘সীতা’ নামটি পরিবর্তন করে ‘নীতা’ করার ব্যাপারে নির্দেশ প্রদান করে।
আমি সবসময়ই বিশ্বাস করে এসেছি চলচ্চিত্র হতে পারে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার সর্বোত্তম হাতিয়ার।
একজন দিন-রাত খেটে খাওয়া মানুষ, যে নাকি সামাজিক- রাজনৈতিক কোনো কিছুতেই মাথা ঘামানোর ব্যাপারে আগ্রহী নয়, সে ও তার চিন্তাধারা বদলাতে চাইবে যখন দেখবে তার প্রিয় অভিনেতা বাল্যবিবাহ বন্ধ করে হিরো বনে যাচ্ছে, বা ধর্ষণের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে ওয়ান ম্যান আর্মি রূপে!
তাই ফায়ার চলচ্চিত্রটি আদৌ লেসবিয়ান মুভি নাই বা হল, এর প্লট দেখে সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশানের ব্যাপারে পাবলিক পরিষ্কার ধারণা নাই বা পেলো, কিন্তু ১৯৯৬ এ দাঁড়িয়ে এমন গল্প বলা যে আসলে ভীষণভাবে জরুরী ছিল তা আমি একবাক্যে স্বীকার করে নিবো। এমন আরো গুটিকয়েক কুইয়ার চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে হোমোফোবিক একটি রাষ্ট্রে সমপ্রেমের পক্ষে অধিকার আদায় করার যে বিস্তীর্ণ পথ ভারতীয় কুইয়ার কমিউনিটিকে পাড়ি দিতে হয়েছিল, ফায়ার নিঃসন্দেহে সেই পথের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
ফায়ারের চাইতে আরো বহুগুণে ভালো লেসবিয়ান মুভি ছিল যেগুলোর ব্যাপারে আজ আমি আলোচনা করতে পারতাম। তবে কেন ফায়ার? কারণটা সহজ। আমাদের প্রতিবেশী দেশ হিসেবে, হাজার বছর ধরে ভারতের সাথে আমরা ভাগাভাগি করে নিয়েছি আমাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি আর ইতিহাস। তাই আমাদের কুইয়ার কমিউনিটির এক্টিভিজম নিয়ে ভবিষ্যৎ রোডম্যাপ যদি আমরা তৈরি করার কথা ভাবি, তবে ভারতকে স্টাডি করাই সবচাইতে শ্রেয় বলে মনে হয়েছে আমার কাছে। আর সেই উদ্দেশ্য সাধনে এমন একটি পথিকৃৎ ছাড়া আর ভালো অপশন কি-ই বা হতে পারতো? সম্পূর্ণ চলচ্চিত্র দেখার সময়ে আমি কল্পনা করছিলাম কবে বাংলাদেশেও বাতাস বইবে এমন সাহসিকতার? কবে আমরা একটু হাঁফ ছেড়ে নিজেদের মতো বাঁচার সুযোগটুকু পাবো? আমাদের সামনে যে বিস্তীর্ণ অন্ধকার ছেয়ে রয়েছে, সেটি হটাতে আমাদের ও যে প্রয়োজন ফায়ারের মতন একটি আলোকবর্তিকার!
প্রথম প্রকাশ
ঠাহর (দ্বিতীয় সংখ্যা)
মন্দ্র থেকে প্রকাশিত জেন্ডার, সেক্সুয়ালিটি এবং কুইয়্যার বিষয়ক ম্যাগাজিন