প্রথম মুক্তির স্বাদ

জয়ী

ছোটবেলায় আমার নিজেকে খুব বড় ধরনের একটা হিপোক্রেট মনে হতো। আম্মুর কাছে, নানীর কাছে আল্লাহর মহত্ত্ব আর ধর্মীয় গল্প শুনতে শুনতে বড় হয়েছি আমি। সেই গল্পগুলো ছিল ভয় আর পুরস্কারের মিশ্রণ। ঠিকমতো নামায না পড়লে, আল্লাহ ও নবী রসূলের উপদেশ না মানলে কবরে ঠিক কয়টা সাপ কতভাবে কামড় দিবে সবকিছুই ঐ সময়ে মুখস্থ ছিল আমার। কিন্তু বিষয় হল, আমার এসব গল্পে ভয় লাগতো না, কক্ষনই লাগেনি। উল্টো মাঝে মাঝে হাসি পেতো। কিন্তু ভুলেও আমার এই হাস্যকর লাগার বিষয়টি আম্মু বা নানীকেভবুঝতে দিতাম না। ৬/৭ বছরের ছোট্ট আমি ভয়ংকর ভয়ংকর কবরের আযাবের গল্প শুনে মনে মনে হেসে দিব্যি ভয় পাওয়ার ভান করে আম্মু আর নানীর মন রক্ষা করে যেতাম। এই কারণে হিপোক্রেট শব্দটার মানে বোঝার আগেই নিজেকে হিপোক্রেট লাগা শুরু হয়।

আশেপাশের মানুষের মন রক্ষা করতে করতে আমি বড় হতে লাগলাম। এখন চিন্তা করলেভনিজের জন্য মায়াই লাগে, জীবনের ১৭টা বছর ধরে নিজের চিন্তা ভাবনাগুলো কখনো প্রকাশভকরতে না পারাটা বেশ নির্মম ব্যাপার। মাঝে মাঝেই আমার মধ্যে নানান ধরণের প্রশ্ন আসতো। সেই প্রশ্নগুলি যে একেবারে কখনই কাউকে শেয়ার করিনি ব্যাপারটা অবশ্য এমন ও না। মাঝে মাঝে আম্মুকে করতাম। যেমন একবার আম্মুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “ আচ্ছা আম্মু আমরা যে সবসময় আল্লাহর কাছে পুরস্কার পাওয়ার আশায় ভাল কাজ করি, এটা একটুভকেমন যেন হয়ে গেল না? আমাদের কোনরকম পুরস্কারের আশা ছাড়া নিজস্ব নৈতিকতার থেকে ভাল কাজ করা উচিত না?” তখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি। প্রবল ধমকের বন্যা ছাড়া আর কোন উত্তর পাইনি সেদিন।

সেইদিনই বুঝে গিয়েছিলাম আমার বন্ধুর মতো আম্মু ততক্ষণই আমার বন্ধু আছেন যতক্ষণভআমার ভাবনাগুলো ঠিক তার চিন্তার সাথে মিলে যায়। আমি ভিন্ন কেউ হলে আম্মুর পক্ষেভসেটা মেনে নেয়া সম্ভব না। ঠিক একই ব্যাপার ঘটে আমার স্কুলে র বন্ধুদে র সাথেও। একবারভকি দুইবার আমার প্রশ্নগুলো নিয়ে আলাপ জুড়তে যাওয়ার পর ওদের যেই প্রতিক্রিয়া দেখেছিলাম তাতে পরবর্তীতে আর কখনো সাহস হয়নি এসব নিয়ে কথা বলতে। পরিবার,ভবন্ধু কিংবা আত্মীয় স্বজনন- ত্রিভুবনে একটা মানুষ ও পাইনি মনের ভারটা নির্ভয়ে ভাগাভাগিভকরার মতো। এজন্যই কিনা একটা সময় নিজেকে ভীষণ খারাপ ভাবতে শুরু করেছিলাম। নিজের ভিন্ন চিন্তা ভিন্ন বিশ্বাসগুলো কোনভাবেই মানতে পারতাম না তখন। সেইসময় থেকে অনেকটা জোর করেই ধর্ম কর্ম করতে শুরু করেছিলাম, এই যে শুরু হল আমার হিপোক্রেট জীবনের গল্প।

প্রতিদিন, মাসের পর মাস চেষ্টা করে গিয়েছিলাম সবার মধ্যে ফিট-ইন করার। যেইসব জিনিসের প্রতি ছিল আমার তীব্র ঘৃণা ও অনীহা, সেইসব জিনিস নিয়ে অনায়াসে ঘণ্টা পার করে দিতাম আড্ডা দিতে দিতে। জোর করে প্রতিটা ধর্মীয় রীতিনীতি মানার চেষ্টা করতাম। ৫ ওয়াক্ত নামাজ আর ৩০ রোজা তো করে ফেলতাম কিন্তু ঐ যে, মন থেকে কখনোই আসলে বিশ্বাস আর ভালবাসাটা আনতে পারিনি। তারপরও ভান করে যেতাম। একটা পর্যায়ে যেয়ে মনে হচ্ছিলো, আমার পুরো অস্তিত্বই একটা অভিনয়- নিজের বলে আমার কিছুই নেই, নিজের যাওয়ার কোন জায়গা নেই।

এই জন্মসূত্রে পাওয়া কিংবা আমার উপর চাপিয়ে দেয়া ধর্মীয় বিশ্বাসটাকে আমার মেনে নিতে যে কি ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল সেটা লিখে এখন আসলে আমার পক্ষে বোঝানো সম্ভব না। অনেকটা এমন যে, আমার গলায় একটা কাটা ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে এবং যতই দিন যাচ্ছে, কাটার দৈর্ঘ্য বেড়েই যাচ্ছে। একটা সময়ে এই কাটার জন্য শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিলো। এই দমবন্ধ পরিবেশে মনে হয় মরেই যেতাম যদি না আমার জীবনে ২০২১ সাল এসে আস্তে করে গলা থেকে কাটা তুলে না ফেলে দিতো।

একটু ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে গল্পটা নিয়ে যাই ২০২১ এ। আমার এখন ২২ বছর বয়স। সৌভাগ্যবশত জীবনের ১৭ বছরের পর থেকে এমন কিছু মানুষের সাথে পরিচয় , বন্ধুত্ব হয়েছে এবং হচ্ছে যাদের সাথে প্রাণ খুলে কথা বলতে পারি। শুধু কথাই বলতে পারি এমন না, এই কয়েক বছরে এটাও আবিষ্কার করে ফেললাম যে আমি একা না। আমি অতি নিকৃষ্ট কোন প্রাণীও না। আমার মতো আরো অনেক মানুষ একই ধরণের চিন্তা ভাবনা করেন এবং তারা প্রত্যেকেই চমৎকার একেকজন মানুষ। এত সুন্দর সুন্দর মানুষের সান্নিধ্য পাওয়ার পর ও নিজেকে খুঁজে পেতে আমার কয়েক বছর সময় লেগে গেলো। ধর্মের প্রতি কোন বিশ্বাস নেই এটা অনেক আগেই টের পেলেও নিজেকে নাস্তিক হিসেবে গ্রহণ করতে পারছিলাম না। কোথায় জানি একটা বাধা, একটা ভয় কাজ করতো। হয়তো জীবনের বিশাল বড় একটা অংশ জুড়ে নিজেকে ধার্মিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার এবং সংখ্যাগুরুর দলে ফিট ইন করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা একটা ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু ২০২১ সালের একদম শুরুতে, কোন একদিন হুট করেই কোত্থেকে জানি মনে একটা জোর আসলো। মনে হল, অনেক হয়েছে নিজের সাথে যুদ্ধ, আমি আসলে আমার ধর্মটা বিশ্বাস করিনা। কতদিন আর নিজেকে ভুল বোঝাব? ব্যাস!

এতটুকুই। সেইদিন ২২ বছরের জীবনে আমি প্রথমবারের মতো মুক্তির স্বাদ পেয়েছিলাম। নিজেকে গ্রহণ করার মধ্যে যে অনিন্দ্য মুক্তির স্বাদ আছে তা আমি ২০২১ এর এই দিনটা জীবনে না আসলে কখনো জানতেই পারতাম না। সারাটা জীবন ধরে নিজের ও আশপাশের মানুষদের সাথে অভিনয় করার পর অবশেষে আমার ছুটি মেলে। এই দিনের পর থেকে আর কখনো পিছনে ফিরতে হয়নি আমার। সবার সাথে তাল মিলিয়ে চলা, কে কি বলবে- এসব দ্বিধা দ্বন্দ্বগুলো কিভাবে জানি নিমিষেই অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। এখন আমি প্রতিদিন মুক্তির স্বাদ পাই, প্রতিদিন নিজের সবটুকুকে একটু একটু করে গ্রহণ করতে পারি।

প্রথম প্রকাশ
ঠাহর (দ্বিতীয় সংখ্যা)
মন্দ্র থেকে প্রকাশিত জেন্ডার, সেক্সুয়ালিটি এবং কুইয়্যার বিষয়ক ম্যাগাজিন

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.