জেন্ডার ননকনফর্মিং বিষয়টা আসলে কি

চোখের বালি

জেন্ডার নন কনফার্মিং বিষয়টি নিয়ে আমরা খুব কম আলোচনা করি। এমনকি যারা জেন্ডার ননকনফার্মিং তাদের জার্নিটাকেও অনেক সময় ছোট করে দেখি, নিজের মনগড়া বক্তব্য চাপিয়ে দিই। একজন মানুষ যিনি কিনা জীবনের নানান সময়ে নানান ভাবে নিজেকে দেখছেন, রাখছেন সে নিশ্চয় লোক হাসানোর জন্য সেটি করছেন না!

আমার ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে যদি বলি,নিজের জীবনের সমস্ত সিদ্ধান্ত আমিই নিই বহুবছর ধরে, কিন্তু কখনো সখনো নিজের ভেতরে নারীত্ব জেগে উঠলেও শরীরটিকে পরিবর্তন করতে চাইনি। কারণ আমি আমাকে জানতাম, দুদিন পর পর আমার জেন্ডার চেঞ্জ হয়, এটি কারোর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নয়, একেবারে মন থেকে। যদিও আমাদের মন সমাজ দ্বারাই প্রভাবিত। এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে কাছের পাশের অনেকে আমাকে নানাভাবে বিদ্রূপ করেছে। বলেছে তুই আসলে কি চাস! তোরে ঠিক বুঝিনা আমরা, তোর আসলে সমস্যা কি! হেন তেন। বিশেষ করে সিস হেটারো ম্যান বন্ধুদে র সাথে যখন কোন নারীর প্রতি ভাল লাগা কিংবা সম্পৃক্ত তার কথা শেয়ার করতে গেছি, তারা আমাকে বীর পুরুষ খেতাব দিয়ে বলেছে দোস্ত তুই আসলে বীর পুরুষ, তোর মাথাটা কে বা কারা যেন নষ্ট করে দিছে তাই পোলাগোর দিকে তাকাস।

কমিউনিটির মানুষগুলো আমার ম্যাসকুলিন বিহেভিয়ারকে বাহবা দিলেও আমি যখন কোন নারীসুলভ অঙ্গভঙ্গি বা বেশভূষা ধারণ করেছি তখন একেবারে ব্রাত্য করেছে ম্যাসকুলিনিটির চর্চা করা কমিউনিটির একাংশ। কেউ কেউতো বলেছেই সরাসরি, তোর সব ভালো বাট তুই আরেকটু ম্যানলি হ। কথা বলবিনা এতো স্টাইল করে, বেশি স্টাইল করে কথা বললে মেয়ে মেয়ে লাগে কণ্ঠটা। আমি তখনো কারোর কথা শুনিনি, কিন্তু এই স্টেজে এসে আজকাল অনেক ক্লান্ত লাগে। মনে হয় এতো লোকের একরকম চিন্তার ভিড়ে ভিন্ন চিন্তা নিয়ে সত্যিই বাঁচা মুশকিল। যখন ট্রান্স বা হিজড়া কমিউনিটিতে গেছি, তখন তাদের বেশিরভাগই আমাকে বলেছে শাড়িটা পরবি যেহেতু তাহলে দাঁড়িটা কেন! ব্লাউজটা পরবি যেহেতু তাহলে ব্রা টা পরোসনা কেন! আমি তখন তর্ক করে সবার সাথে পেরে উঠতে পারিনি। বোঝাতে পারিনি আমি আসলে কি চাই,কি আমার মনন। আমিতো শারীরিকভাবে কিংবা আর দশটা মেয়ের মানসিকতার মতনও নই, আমি হতেও চাইনি তথাকথিত নারী।

তাহলে আমাকে কেন নকল কিছু লাগিয়ে একটি পোশাক পরতে হবে, কেন আমার লোমকে আমার দাঁড়িকে অস্বীকার করতে হবে? সম্পর্কে জড়াতে গিয়ে কতবারে হোঁচট খেয়েছি। বোকার মত সিস হেটারো মেন যে বা যারা তাদের কখনো সখনো ভালবেসে ফেলেছি, যারা কিনা কেবল বীর্যপাত ঘটানোর জন্যই সমকামিতায় লিপ্ত হয়, তাদের সাথে থেকে মনে হতো আমাকে নারীর মত দেখতে চাইছে তারা, কিন্তু আমিতো সেটি নই, আমিতো আমার লোম সরাতে চাইনা, দাঁড়ি ফেলে তেলতেল মুখ রাখতে চাইনা।

খুব হীনমন্যতায় ভুগতাম তখন। সেখান থেকে বের হয়ে এসে আবার নতুন করে শুরু করি নতুন জার্নি, আবার নিজেকে তথাকথিত পুরুষের ভাবনার মতন গড়তে চেষ্টা করি। কিন্তু আমার ভেতর যে বৈচিত্র্যটা তা আমি অস্বীকার করবোইবা কিভাবে! কমিউনিটির কোন নারীসুলভ পুরুষের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করলে সেটি যদি ভুলেও কারো সাথে শেয়ার করেছি তবেই সেরেছে, সে কি কমেন্ট কত রকম।

একবার যখন দুজনের মানসিকতা মিলে গিয়ে কিছুদিন একটা সম্পর্কেও গেলাম, তখন চেনা জানা কমিউনিটির বন্ধুগুলোতো বলাবলি শুরু করলো দুইটা বটম রিলেশনে গেছে। মানে তাদের আমি না বললেও আমার সেক্সুয়াল পজিশন বিবেচনা করে বসলো আমার দু একটি জেন্ডার নর্মস দেখেই। আহত হলাম, এভাবেই কত শতবার আহত হচ্ছি। কিন্তু কারোর মতন হতে পারিনি। আমি এই জিনিসটি এখনো মানুষকে বোঝাতে পারিনা যে কিছুকিছু মানুষ এরকমই হয়, তারা জানেনা কখন তাদের কি অনুভব হয়। ভাঙা গড়ার মাঝে, কনফিউশন এর মাঝেই তাদের জীবনটা যায়। কারণ জেন্ডারটি কারোর কারোর বেলায় খুবই নন কনফার্মিং। সেক্সুয়ালিটির বেলাতেও তাই হয় কারো কারো। আমর আপনার ভাল লাগা বা ভাবনার বাহিরেও অনেক মানুষের অনেক ব্যতিক্রম ভাবনা থাকতে পারে,চয়েস থাকতে পারে। আমি শাড়ি চুরি পরলেই আমি নারী হয়ে যাবো,কিংবা নারী হয়ে গেলেই আরেকটা নারীকে ভালোবাসতে পারবোনা, শুতে পারবোনা এমনটা নাও হতে পারে। আমি পুরুষালী ভঙ্গিতে চললেই আমার ভেতরের পুরুষ জেগে উঠবে এমনটা নাও হতে পারে। আবার নারীসুলভ পুরুষদের প্রতি আকর্ষিত হয়ে আমি একেবারে মেসকুলিন হয়ে যাবো তাদের জন্য এমনটা নাও হতে পারে। আমি কোন স্টাইলে কথা বলি,আমি কি পোশাক পরি, সেটি আমার জেন্ডার নয়,সেটি আমার সেক্সুয়ালিটিও নয়,এমনকি আমার সেক্সুয়াল পজিশনও সেটি দ্বারা বিবেচনা করা সম্ভব নয়। আমাদের কমিউনিটিতে ম্যানলি বটমরা বাহবা পেলেও গার্লি টপরা চরম ব্রাত্য হয়। হয়তো তাদের টপ সত্ত্বা বাঁচিয়ে রাখতে বাধ্যই হয় ঐ তথাকথিত ম্যাসকুলিনিটির চর্চা করতে।

আমার প্রশ্ন হল আমাদের আকর্ষণগুলো এই মেসকুলিন ফেমিনিন বিষয় দ্বারা কিভাবে প্রভাবিত হল? হল তার কারণ সমাজটা পুরুষতান্ত্রিক। একটি পুরুষালী নারীকে যেমন হেট্রোসেক্সুয়াল রা উহ আহ করে বলে জিনিসটাতো সেই,কিন্তু এই একই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কোন পুরুষ যদি শাড়ি জড়িয়ে হেঁটে যায় তাহলে কোন নারী তার সাথে প্রেম করতে চাইবে দূরে থাক,দশ হাত দূরে যাবে। পয়েন্টটিই এখানে, নারীসুলভ বিষয়টি কিছুই না আসলে,এটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের হর্তা কর্তারা নারীদের জন্যই রেখেছিলো, যেহেতু নারী তাদের নিচে, তাদের জাতের নয় সেহেতু নিচুজাতের সবকিছুই নিচুচোখেই দেখা হবে। এই ভাবনা কেবল পুরুষতান্ত্রিক নারী পুরুষরা রাখেনা, কুইয়ার মানুষেরাও রাখে। কারণ কুইয়ার নন কুইয়ার বলে কথা নয়, সবাই আমরা একই গোয়ালের গরু। আমাদের আকর্ষণগুলাও তাই টক্সিক, ভালোবাসাগুলাও। তাই আমরা আমাদেরই ভালবাসতে শিখিনি, প্রেম সম্পর্ক এসব নানান উল্টা পাল্টা চিন্তার কারণেই টিকে না, কঠিন করে রেখেছি আমরা আমাদের। আর এসব থেকে যারা বের হতে চায়, তাদেরও আমরা ব্রাত্য করি। যেন একটি বক্সে আমাদের ঢুকতেই হবে, না ঢুকলে সব রসাতলে যাবে, গোল্লায় যাবে।

লেখক একজন জেন্ডার ননকনফার্মিং মানুষ, কুইয়্যার রাইটার, এবং জেন্ডার এক্টিভিস্ট 

প্রথম প্রকাশ
ঠাহর (দ্বিতীয় সংখ্যা)
মন্দ্র থেকে প্রকাশিত জেন্ডার, সেক্সুয়ালিটি এবং কুইয়্যার বিষয়ক ম্যাগাজিন

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.