
দ্যা ইনমেট
কপাল থেকে চোখের দিকে গড়িয়ে পড়তে থাকা ঘামের বিন্দুটা আঙুলের ডগায় নিয়ে ছুঁড়ে ফেলতে ফেলতে সূর্যের দিকে তাকালাম। ঘড়ির কাটা বেলা বারোটা পেরিয়ে চব্বিশের পথে। মধ্যগগনের সূর্যটা তেতে আছে যেন অভিমানী প্রেমিকার মেজাজের মত। ডিআইটি রোডের জ্যামে হুড খোলা রিকশায় বসে ঘামতে খারাপ লাগছে না। শরীর দিয়ে নায়াগ্রা ফলস বয়ে যাচ্ছে। বেরিয়েছি সেই সকালে। না খেয়ে কেন বেরোচ্ছি তা নিয়ে মায়ের সঙ্গে এক পশলা ঝগড়া হয়ে গেল। রোজকার মতই। এসব ঝগড়ায় এখন আর রাগ হয় না। বরং, মন খারাপ হয়। দিনকয়েক পর এসব আহ্লাদ আর থাকবে না। জীবনের বাঁক বদলের টানাপোড়েনে শ্বাস নিতে ভুলে যাবার মুহূর্তে নিজেকে বাদে অন্য কাউকে পাশে পাব সে আশা নেই।
আর কিছুদিন। এরপরই তো নতুন যুদ্ধ শুরু!
ক্লাস শেষে তমা, অমিতদের সঙ্গে ছবির হাটে আড্ডায় বসবার কথা ছিল। আড্ডা ফেলে বনশ্রী যেতে হচ্ছে সে নিয়ে মনটা খচখচ করছে বটে, প্রজেক্টের কাজ এক ধাপ এগিয়ে যাচ্ছে সেই খুশিতে গরমে ঘামতেও খারাপ লাগছে না। কমিউনিটির বন্ধুবান্ধবরা একসঙ্গে হলেই যেসব আলাপ হয় তাতে মন খারাপ করা উপাদানই বেশি থাকে। পারিবারিক দ্বন্দ ও রোমান্টিক সম্পর্কের অবনতি তো আছেই, ছোট্ট এই কমিউনিটির অল্প কিছু মানুষজন সম্পর্কে কূটকথা, পরচর্চা; এসব বলে বলে মন খালি হয় হয়ত। এরপর হালকা হওয়া মনটা কি বিতৃষ্ণায় ভরে ওঠে না? সেদিক থেকে তমা, অমিতদের সার্কেলটার সঙ্গে আলাপে বসলে পরিষ্কার বাতাসে এক বুক দম নেওয়ার অনুভূতি হয়। একদল তরুণ ঘুণে ধরা সমাজ নিয়ে কথা না বলে ঘুণপোকা নিধনের পথ বের করার চেষ্টা করছে; তারুণ্যের প্রতীকী চিত্র বুঝি এরকমই হবার কথা। ইফ ইয়্যু আর নট এ পার্ট অফ দ্য সল্যুশন, ইয়্যু আর দ্য প্রবলেম!
জ্যামে বসেই কি একটা বেজে যাবে? দেড়টা থেকে মিটিং। অন্তত সোয়া একটার মধ্যে তো উপস্থিত থাকা উচিত! এই জ্যামটা ছাড়লেও মুক্তি নেই। পূর্ব রামপুরা রোড হা করে বসে আছে গিলে নেবার অপেক্ষায়। আশেপাশে তাকাতেই অনেক কিছু মনে পড়ল। জায়গা, ঘ্রাণ আর গান; এই তিনটা ব্যাপার না চাইতেও অনেক স্মৃতির অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। এই ডিআইটি রোডে কত কত স্মৃতি! জীবনটা ভারি অদ্ভুত, না? বিগত একুশ বছরে কতশত মানুষের জীবন ছুঁয়ে দিয়েছি, কত মানুষ নাড়া দিয়ে গিয়েছে আমার জীবন। কেউ কেউ গাছের পাতা নড়ান হালকা বাতাসের মত। আবার কেউ দমকা বাতাসে খুঁটি উপড়ে দেওয়ার মত। কেউ কেউ হৃদয় খুলে রাখতে চেয়েছে আমার পায়ের কাছে। কারও জন্য আমি হৃদয় দুমড়েমুচড়ে শেষ বিন্দু আবেগটুকু পর্যন্ত বুঝিয়ে দিয়েছি। প্রত্যেকের কাছেই কিছু না কিছু শিখেছি, নয়ত শিখিয়েছি।
কাবেরীর সঙ্গে প্রথম দেখা এই ডিআইটি রোডে। অনলাইনে বহুদিন কথা বলে শেষমেশ দেখা। চিন্তায় অপরিপক্ব, কথাবার্তায় অগোছালো কারও প্রেমে পড়বার কোন পরিকল্পনা কখনও ছিল না। কিন্তু, শুধু কি প্রেমে পড়া? হাজারটা রেড ফ্ল্যাগ অগ্রাহ্য করে একেবারে কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে সমতলে আছড়ে পড়লাম যেন। কিছু সময় বাদে অগ্রাহ্য করবার শাস্তি হিসেবেই রেড ফ্ল্যাগগুলো নিজেদের শেড বাড়াতে লাগল। ফলাফল যা হবার তাই। ছাড়াছাড়ি। কারও হয়ত কোন দোষ ছিল না। প্রত্যেকেই কিছু প্রত্যাশা নিয়ে একটা সম্পর্কে ঢোকে। সেই প্রত্যাশা পূরণ না হলে কচ্ছপের মত আঁকড়ে ধরে বসে না থেকে সম্পর্কটাকে যেতে দেওয়াই ভাল বৈকি। সময় আর আবেগ অপচয়ের কোন অর্থ হয় না।
ভিত্তি নেই, অগ্রপশ্চাৎ নেই এমন সম্পর্কও বছরের পর বছর চালিয়ে নিয়ে যেতে দেখেছি কত! একজনের আগ্রহে অথবা দুজনেরই অনিচ্ছা সত্ত্বেও অমর্যাদার এসব সম্পর্ক দিনের পর দিন ভাঙে না। যখন একবারে ভাঙে, সম্পর্ক তো ভাঙেই; ভাঙে মন, ভাঙে বিশ্বাস আর প্রতিশ্রুতি। মনিকার তের বছরের সম্পর্ক শেষ হয়ে গিয়েছিল তিন বছরের মাথায়ই। পরিবারের চাপে মনিকার প্রেমিকার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল সেবছর। বিচ্ছেদটাকে চুইংগামের মত টেনে ওরা বিলম্বিত করেছে পরবর্তী দশ বছর! পরিস্থিতির শিকার বিবাহিত লেসবিয়ানদের নিত্যদিনকার আর্তনাদের গল্পগুলো তো আরও হৃদয়বিদারক। অসুখী বৈবাহিক জীবনকে খানিকটা ক্রিস্পি করে তুলতে অবিবাহিত মেয়েদের শরণাপন্ন হতে দেখেছি কত লেসবিয়ানকে! সব জেনেবুঝেও আবেগের ডালি নিয়ে আত্মাহুতি দিতে পিছপা হন না অনেকেই। বাস্তবতা যখন কড়া নাড়ে তখন আবেগ সামলান দায় হয়ে পড়ে, সত্যটাও মেনে নেওয়া যায় না।
হর্নের শব্দে সংবিৎ ফিরে পেলাম। পাশের টয়োটা অ্যালিয়নের ড্রাইভিং সিট থেকে মাথা বের করে আছেন এক ভদ্রলোক। জ্যামের উৎসমুখ দেখার চেষ্টা করতে করতে হাতটাকেও ব্যস্ত রাখতে চাইছেন বুঝি। অবিরাম হর্ন বাজিয়েই যাচ্ছেন। হর্নের শব্দ আর্তচিৎকারের মত লাগছে। পরিবারের চাপে পড়ে সেক্সুয়ালিটির বিরুদ্ধে যেয়ে বিয়ে করে ফেলা মেয়েদের অব্যক্ত, অনুচ্চারিত শব্দ আর চিৎকারও কি এই হর্নের মত শোনাবে না? কে জানে সেই চিৎকার না নিতে পেরে হয়ত শুধু ডিআইটি রোড নয়, পুরো ঢাকার সমস্ত রাস্তাই ফাঁকা হয়ে যেত! আচ্ছা, বিবাহিত অবস্থায় আরেকটা মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়াটা কি ঠিক? পরিবারের চাপে পড়ে নিজেকে বিসর্জন দিতে হয়েছে সত্য। তারপরও, পলিঅ্যামারাস না হয়েও কেবল নিজের সাময়িক প্রশান্তির জন্য জীবনসঙ্গীকে না জানিয়ে নতুন একটি সম্পর্কে জড়ালে সেক্ষেত্রে কি দুজন মানুষকে ঠকান হয় না? হয়ত হয়, হয়ত হয় না। ঠিক বেঠিক নির্ধারণ করবার আমি কে? জীবন তো এত ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট না, অধিকাংশটাই গ্রে। অনেক সময় অন্যের জীবনের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েও নিজের জীবনের সেরাটা দেখতে হয়, নিজের মনের শান্তিটা বেছে নিতে হয়। হ্যাঁ, দোষের কাজ এটা নিঃসন্দেহে। কিন্তু, একবাক্যে দোষী সাব্যস্ত করে দেওয়াও কি ঠিক? একটাই তো জীবন। অশান্তি, অপূর্ণতা, অস্থিরতায় কাটিয়ে দিয়ে লাভ কী? মন যা চাইছে তা শুনতে চেয়ে আপাত দোষ করেও যদি নিজের জীবনে শান্তি আসে তো আসুক না। দিনশেষে আমরা সবাই তো শান্তিটাই খুঁজি !
সে যাই হোক। নিজেকে নিয়ে ভাবা যাক বরং। গ্র্যাজুয়েশনের আর খুব বেশি বাকি নেই। দেশ না ছাড়ার গোয়ার্তুমি ধরে রাখতে পারলে আগামী বছর পাঁচ-দশেকের ভেতর দেশের মধ্যেই ক্যারিয়ারটাকে একটা দর্শনীয় চেহারা দিতে হবে। গ্র্যাজুয়েশনের পর প্রথম কাজ পরিবার ছেড়ে নিজের জন্য পৃথক একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই বের করা। এরপর সুযোগ বুঝে কামিং আউটটাও সারতে হবে। বিয়ের চাপ সহ্য করা আমার কর্ম নয়। তারচেয়ে বরং আমার সেক্সুয়ালিটি জেনে আমাকে গ্রহণ বা বর্জনের কোন একটা ব্যবস্থা হোক। সত্যি বলতে, পরিবার বা বন্ধুবান্ধবদের অ্যাকসেপটেনস নিয়ে এখন আর মাথা ঘামাই না। টিনএইজের একটা বড় সময় নষ্ট করেছি এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করে। দুশ্চিন্তা করে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি ছাড়া বিশেষ কোন উপকার হয় না। তাই, কী হবে ভেবে কান্নাকাটি করে লাভ নেই।
অবশ্য, ভাবব না ভাবব না করেও কি না ভেবে থাকা যায়? অতিরিক্ত ভেবে ভেবেই কি জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়ের নিদারুণ এক অপচয় করছি না? সবকিছু যেখানে এত অনিশ্চিত সেখানে এই মুহূর্তে এই জীবনের সঙ্গে অন্য আরেকটা জীবনের সংযোগ ঘটান কতটা যুক্তিযুক্ত তার কূলকিনারা করতে না পেরে নিজেকে কত সম্ভাবনা থেকে গুটিয়ে রাখছি! যদিও চাই না তবু মাঝেমাঝে হেটারোসেক্সুয়াল জীবন নিয়ে খানিক ঈর্ষা হয়। সবার জীবনই অনিশ্চিত। তবু, সকল অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও বিষমকামীদের জীবনের একটা প্যাটার্ন থাকে। কেবল এই প্যাটার্নের অনুপস্থিতিতে সমকামী জীবনটা আরও বেশি অনিশ্চিত হয়ে ওঠে। বছর কয়েক বাদে সেক্সুয়ালিটি অনুযায়ী লাইফস্টাইল বেছে নিতে কোথায় থাকব, কী করব, পরিবার-বন্ধুদের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক থাকবে, মেরে ফেলা হবে নাকি বেঁচেই থাকব ইত্যাদি ইত্যাদি ভেবে মনে হয় জীবনে আরেকটা ভার যুক্ত করার কী দরকার? আগে নিজেকে গুছিয়ে নিই। ভালবাসা তাই অন্য কোথাও চায়ের কাপে নিজের সাম্রাজ্য নিজেই গড়ুক। অর্ণবের সূত্র মেনে আমি বরং ততক্ষণ তারা নিংড়ান আলোয় চাঁদকে পাহারা দিই।
ঘড়িতে বারোটা সাতচল্লিশ বাজতে চলল। এখন মনে হচ্ছে মিটিং বাদ দিয়ে আড্ডায় যোগ দিলেও পারতাম। অন্তত জ্যাম সমস্যা সমাধানের উপায় নিয়ে আলাপ দিয়ে সাময়িক শান্তি পাওয়া যেত। হয়ত পিচগলা গরমের মধ্যে চা খেয়ে ঘেমে একসা হতে হতে আমেরিকান সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া কোন রায় নিয়ে বিশ্লেষণ হত খুব। ছবির হাট কিংবা টিএসসির চায়ের দোকানে বসেই নিজেদের জিতিয়ে দিতাম পেনাল কোডের তিনশ সাতাত্তর ধারার বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে করা কোন এক কাল্পনিক রিট। প্রতিদিন খবরের কাগজ পড়েও আস্তিক থাকছি কী করে তার যুক্তি দর্শাতাম হয়ত। কোন রাজনীতিকের নতুন কোন অরাজনৈতিক বক্তব্যে বিনোদনের খোরাক জোগালেন তা নিয়ে হাস্যরসে মেতে উঠতেও হয়ত ভুলতাম না। এসব বাদ রেখে জ্যামের মধ্যে বসে হিসেব নিকেশের খেরোখাতা খুলে বসতে কার ভাল লাগে?
এরোপ্লেন ছাড়া দেড়টার আগে বনশ্রী পৌঁছাতে পারবার কোন সম্ভাবনা দেখছি না। রোদের মধ্যে ঘামতেই যদি হবে রিকশায় বসে ঘামবার কোন অর্থ হয় না। ভাড়া মিটিয়ে রিকশা থেকে নেমে গিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। দেখি কতদূর যাওয়া যায়। রাস্তার। আর জীবনেরও।
প্রথম প্রকাশিত
আসর
বাংলাদেশের প্রথম ও ভিন্ন ঘরানার বহুমাত্রিক ক্যুইয়ার নারী সংকলন