
নীলা
একটা পোশাকের শো রুম। বেশ পশ বলা যায় দোকানটাকে। হ্যাঙ্গারগুলোয়, তাকে সাজানো হরেক রকম রঙিন পোশাক। চোখ কেড়ে নেবার মতোই। চোখ কেড়ে নেয়ও ওর। ঢুকবে কি ঢুকবে না ভেবে ইতস্তত করেও শেষ পর্যন্ত ঢুকে পড়লো ও। “পছন্দ করেন। এই দিকে আরও আছে। দেখাবো?” আগ্রহী হয়ে প্রশ্ন করে স্মার্ট সেলস গার্লটি। যেকোন কারণেই হোক ক্রেতার ভীড় নেই একেবারেই। এমনিতেই এক সারিতে এত এত দোকান, তাছাড়া বিশেষ কোন উৎসবও নেই সামনে। তাই হয়তো দোকানগুলো এত ফাঁকা। আগ্রহী হওয়াটা স্বাভাবিক মেয়েটির পক্ষে। সে কোনমতে অস্পষ্টভাবে না বলে। “দেখছি আমি। পছন্দ হলে বলবো।” জামাগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে থাকে ও। পেছনদিকের প্রাইস ট্যাগগুলোও দেখে নেয়। পছন্দ হয় কিছু কিছু পোশাক। দাম? তা একটু বেশিই বটে। এই ধরণের উচ্চকোটির সাজানো দোকানগুলোয় পোশাকের দাম নেহাত কম নয়। তবে এটা ঠিক মানের দিক থেকেও খারাপ না পোশাকগুলো। মাপটা ঠিক বোঝে না সে। প্রস্থে তো ঠিকই আছে। তবু কাঁধের দিকে কি একটু আটোসাটো হয়ে যাবে? কিভাবে বুঝবে। চোখ বুঝে আন্দাজ করতে চেষ্টা করে। আটত্রিশ নাকি চল্লিশ নাকি একেবারে বেয়াল্লিশ। আরেকটু বড় মাপের হবে কিনা এই ড্রেসটা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও আটকে যায়। বড় লজ্জা লাগে। কেমন যেন সংকোচ হয়। এই বোধহয় ধরা পড়ে যাবে তার মনের কথাগুলো সেলসগার্লটির কাছে। আবার সে ভাবে হয়তো একটু ভালো করে খুঁজলে পছন্দসই মাপের পছন্দমতো পোশাক পাওয়া যাবে। পেয়েও যায়। লাল রঙের একটা লং সালোয়ার কামিজ। কাপড়টা ভালোই, সুতি। গরম লাগবে না। বুকের দিকের নকশাটা বড় সুন্দর। গোল ছাট জামা ওর খুব প্রিয়, গাউনই তো বলা যায় একে, নাকি? ওড়না জর্জেটের। জর্জেটের ওড়না ভালো লাগে ওর। কখনো পরা হয় নি যদিও। লাল পরী। লাল পরী লাগবে ঠিক। ওর জন্য নির্দিষ্ট পোশাকগুলোয় এমন উজ্জ্বল লাল রঙ থাকে না সাধারণত। তবু লাল ওর ভালো লাগে, ওর জলপাই রঙের চামড়ায় লাল মানাবে না জেনেও। একবার কিশোর বেলায় লাল রঙের একটা ফতুয়া কিনেছিল সে শখ করে। ফতুয়াটা পরে এক বন্ধুর বাসায় গিয়েছে। বন্ধুর মা দুম করে মুখের উপর বলে বসলেন তোমার এই কালো রঙে লাল কিন্তু একেবারেই মানাচ্ছে না। বড্ড মন খারাপ হয়েছিল। মানুষ যে কেন অন্যকে এভাবে আঘাত দিয়ে কথা বলে। স্মৃতি হাতরানো শেষে বর্তমানে ফিরে আসে ও। একটা দীর্ঘশ্বাসও বোধহয় ফেলে। অলৌকিকত্বে ওর বিশ্বাস নেই। তবু পরীরা আছে কোথাও কোন অজানা লোকে ভাবতে ভালো লাগে। ডানা না থাক, পরীদের সাথে যদি কখনো দেখা হতো। ওদের অনুরোধ করতো তাকেও পরী বানিয়ে দিতে ওদের মতো। ওদের সাথে পরী হয়ে মিশে ওদের দেশে যদি চলে যেতে পারতো ও। নিজেই মনে মনে এসব ভেবে হেসে ফেলে ও। আশেপাশে সেলস গার্লটির অস্তিত্ব বুঝে হাসিটা সামলে নেয় কোনমতে। এই জামাটা পরে পাকিস্তানি মেয়েদের ঢং এ ওড়না দিয়ে ঘোমটা দিতে পারলে কেমন লাগবে ভাবতে থাকে ও। ওরকমভাবে ওড়না পরা ওর একটা স্বপ্ন কেন কে জানে। কিনতে পারে সে চাইলে ড্রেসটা। মাপটাও মনে হয় হয়ে যাবে। পকেটে তো নগদ টাকা আছে, টাকা আছে কার্ডেও। তবু কেনা হয় না। এমন একটা ভাব করে যে পছন্দ হয় নি। আস্তে আস্তে হেঁটে দোকান থেকে বের হয়ে যায় ও। যাওয়ার সময় আড়চোখে শেষবারের মতো পোশাকের হ্যাঙ্গারগুলোর দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকায়। লাল ড্রেসটা তাকে যেন ডাকছে, আমাকে নাও নিয়ে যাও। সে ডাকে সাড়া দেয়া হয় না। তারপর আরেকটা দোকানে ঢোকে সে। অবিকল আগের কাহিনী। তারপর আরেকটিতে। কেনা হয় না কিছুই। যদিও চাইলেই কেনা যেত।
সন্ধ্যার শহরটাতে সে এভাবে হেঁটে বেড়ায়। এটা এখন আর তার শহর নয়, ছিল এককালে। তবু এসেছে সে শহরটায় অফিসের দরকারে দিন কয়েকের জন্য। এই শহরে তার তেমন কোন বন্ধু নেই, ছিল যারা কোথায় আছে এখন কে জানে। দু চারজন এর সাথে ফোনে যোগাযোগ থাকলেও এত দূরে দূরে থাকে ওরা যে দেখা করতে যেতে ক্লান্তি লাগে। সন্ধ্যাগুলো তাই একঘেয়ে, কর্মহীন। তবু এই সময়েও একটা শান্তি খুঁজে পায় সে। কিছুটা মুক্তির আনন্দ। শহরটা ভালো লাগে না। তবু কেউ তো তেমন চেনে না ওকে এখানে। এই কোটি দেড় কোটি মানুষের শহরে কয়টা মুখচেনা মানুষই বা তার আছে। ইতস্তত যেকোন দোকানে ঢুকে পছন্দের জিনিসগুলো দেখা যায়, না কিনুক, কাছে থেকে দেখতে পারে যে এটাও কম নয়। নিজের শহরে একই কাজ করতে কেমন যেন সংকোচ লাগে ওর। এই শহরটা রাজধানী। কোন একসময় এই কোটি মানুষের ভীড়ের একজন সেও ছিল, আজও তাই। তবে তখন ছিল এখানকার নাগরিক, আজ অচেনা অতিথি।
আশেপাশেই আরও অসংখ্য দোকান। নামিদামি ব্র্যান্ড শপগুলোর প্রায় সবাই আছে এই রাস্তায়। তাই রাস্তাও পার হতে হয় না, হেঁটে হেঁটেই দেখা যায়। তাই সন্ধ্যার পর সে হাঁটছে গত দুদিন ধরে। কালই বাড়ি ফিরবে। ভাবতে ভালো লাগছে। প্রিয়জনদের জন্য খেলনা, পোশাক কেনা হয়ে গেছে। নিজের জন্য? না কিছুই কেনা হয় নি। কিনতে ইচ্ছা করে না। কী কিনবে? যা কিনতে চায় তা তো কেনা হয় না। কিনতে পারে না। ইচ্ছে হয় ভালো কাপড়ের তৈরি নিঁখুত নকশার একটা পোশাক কেনে। কখনো কেনা হয় নি। অপচয় হবে। টাকাগুলো জলে ফেলতে মন চায় না। আলোঝলমলে শোরুমগুলো ফেলে সে চলে আসে ফু টপাথে। উঠে পড়ে অন্ধকার ওভারব্রিজটাতে। নিচের রেস্টুরেন্ট থেকে সদ্য তৈরি করা মনকাড়া খাবারের গন্ধ আসে। জমে আসা ক্ষুধাকে অনুভব করে সে। সন্ধ্যায় তেমন কিছু খাওয়া হয় নি। তবু খাবার চিন্তা বাদ দেয়। ওভারব্রিজের ভিড়, ওজন মাপার মেশিন নিয়ে বসা লোক, ভিক্ষুক, রেলিং এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করতে থাকা মানুষ আর কিছু ব্যস্ত জনতাকে পেরিয়ে অন্ধকার থেকে আবার আলোয় ফেরে সে। পকেট টা হাত দিয়ে দেখে নেয়, সব ঠিকঠাক আছে কি না। এখানে নাকি অনেক পকেটমার, ছিনতাইকারীর ভিড়। তবু ওর সাথে আজ পর্যন্ত কিছু হয় নি সেটাই বাঁচোয়া। ওর চেহারাটা নাকি তামিল গুন্ডাদের মতো অনেকে বলে, অথচ ও তো জানে ও কতোটা নিরীহ। তবে এই চেহারারও উপকারি দিক কিছু আছে। মাঝেমাঝে চেহারার ক্যামাফ্লোজটাও রক্ষা করে হোক না সে অসুন্দর।
ওভারব্রিজের পাশে ফুটপাথেই কিছু ফেরিওয়ালা বাচ্চাদের আর মেয়েদের কাপড় নিয়ে বসেছে । নিশ্চয়ই অবৈধ। তবু আছে এরা, বহাল তবিয়তেই আছে। বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবস্থাও ওরা করেছে কিভাবে কে জানে। বিক্রি বোধহয় ভালোই, যদিও তেমন বৈচিত্র্য নেই পোশাকে। ক্যাটকেটে উজ্জ্বল রঙ, খসখসে কাপড়, দাম কিন্তু বেশি না। চাইলে ২০০ টাকা কি ৩০০ টাকায়ও একটা জামা হয়ে যাবে। কিনবে? সেই তো ফেলেই দিতে হবে বাসায় ফেরার পথে। তবু আজ রাতে একা হোটেল রুমে একবার হয়তো পরা যেত। পরে থাকা যেত সারা রাত যতই গরম লাগুক না কেন। তবু, নাহ এগুলো মাপে হবে না। দোকানদারকে জিজ্ঞেস করেও লাভ হয় না, এই যা আছে তাই। ইচ্ছে হলে নেন না হলে না। কিনবে কি কিনবে না ধন্ধে পড়ে যায় সে।
মনে পড়ে আলো ঝলমলে দোকানের সেই লাল সালোয়ার কামিজটা। কি মসৃণ পাতলা কাপড়টা। পরলে নিশ্চয়ই অনেক আরাম লাগতো। একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। কেনা হয় না। কখনোই কোন পছন্দের জামা কেনা হয় না ওর, কেনা হয় না কাজল, আইলাইনার, লিপস্টিক। হাতের মাপে চুড়ি কি কানের দুল কেনা হয় না কিছুই। একটা উইগ পর্যন্ত কিনতে পারেনি আজও। কোথায় রাখবে? কখন পরবে? হয়তো আজ রাতেপরা যেত তবুও এতগুলো টাকা এভাবে খরচ করবে ভেবে কখনোই কিছু কেনা হয় না। টাকার মূল্য ও বোঝে। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারেই বড় হয়েছে। এখন নিজে মোটামুটি চাকরি করছে তাই স্বচ্ছলতা না থাকলেও দারিদ্র্যও নেই। তবু মনে সাধ জাগে সেই লাল সালোয়ার কামিজটা যদি কিনতে পারতো! কিন্তু যে জিনিসটা রাখতে পারবে না তার পেছনে খামাখা চার অংকের গুণিতক একটা অর্থ খরচ করতে মন মানে না। টাকাগুলো তো কষ্টের রোজগার করা। এভাবে তো জলে ফেলতে পারে না। এর চেয়ে জরুরি অনেক চাহিদা যে আছে জীবনে। অসীম চাহিদার বিপরীতে অর্থ যে সীমিত। তাই কেনা হয় না কিছুই আর।
উদাস হয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরায় সে। পাশের টং এর দোকানীকে এক কাপ চা দিতে বলে। ফুটপাতের দোকানির রাখা রঙিন পোশাকগুলোর দিকে চোখ চলে যায় বারবার। এমনসময় সামনে ব্যস্ত ভঙ্গীতে হেটে গেল এক নারী। সাজপোশাক একটু বেশি উজ্জ্বল, চোখে, মুখে রঙের একটু যেন তীব্রতা। এমন সাজ সাধারণত বিয়ে বাড়িতে বা কোন উৎসব অনুষ্ঠানে দেখা যায়। মেয়েটি একটি ছেলের হাতে হাত ধরে যাচ্ছে যার পোশাক খুবই সাধারণ, মলিন। এই বৈপরীত্যের জন্যই রাস্তার আশেপাশের ব্যস্ত এবং ব্যস্ততাবিহীন মানুষের চোখ বারবার চলে যাচ্ছে ওদের দিকে। সেও তাকায় ওদিকে কিছুটা কৌতূহল নিয়ে। পাশে দিয়ে যাবার সময় মেয়েটি গলার আওয়াজ একটু উঁচু করে একজন রিকশাওয়ালাকে ডাকলো। রিকশাওয়ালা পিছন ফিরে তাকিয়েও যেন একটা তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে উত্তর না দিয়েই চলে গেল। তখনই প্রথম বুঝতে পারলো সে, মেয়েটি কোন বায়োলজিক্যাল মেয়ে নয়, সমাজের চোখে একজন বৃহন্নলা। পাশে দাঁড়ানো মাঝবয়েসী একজন মহিলা সরু চোখে মেয়েটির দিকে তাকাচ্ছেন আর শক্ত করে ধরে আছেন নিজের কিশোরী কন্যাটিকে, যেন কোন অস্পৃশ্য মানুষ হেঁটে যাচ্ছে সামনে দিয়ে। আশেপাশের অন্য মানুষদের চোখেও কৌতূহলের সাথে যেন একটা তাচ্ছিল্যের ভাষা পড়তে পারলো সে। একটা একাত্মতা বোধ করে সে মেয়েটির সাথে। ওর চেয়ে তো অন্তত অনেকগুণ সাহসী মেয়েটি। নিজেকে যা ভাবে সেভাবে প্রকাশ করার শক্তি আর সাহসটা আছে ওর। আর সে? নিজের কথা ভাবে ও। পরিবারের কথা, সমাজের কথা ভেবে বরাবর নিজের ইচ্ছেকে টুঁটি চেপে রেখেছে। আড়াল করে রেখেছে নিজেকে একটা অদৃশ্য মুখোশ পরে। কখনো নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে এমন কারো সাথে কথা বলা হয় নি ওর। একাত্ববোধ, মমত্ব অনুভব করলেও, প্রকাশ করতে পারে নি। আজও পারলো না। উদাস চোখে ওদের চলে যাওয়া দেখল সে। ইচ্ছা হচ্ছিল তার ওর সাথে ওর মতো করেই সেই লাল সালোয়ার কামিজটা পরে হেঁটে যেতে, তবে সে তো শুধু কল্পনায়। চায়ের বিল মিটিয়ে ক্লান্ত পায়ে ফেরার পথ ধরে সে। ফুটপাথের রঙিন পোশাকগুলো আরেকবার নেড়েচেড়ে দেখে সে, তারপর দরদাম না করেই চলে আসে।
ওভারব্রিজ পেরিয়ে রাস্তার ওপারে আবারও আলোঝলমলে শোরুমগুলোর সামনে দাঁড়ায় সে। একটা কতবেল কেনে। বড় প্রিয় ফল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঠি দিয়ে খায় নুন ঝাল মেশানো ফলটি। কতবেল খেতে খেতেই চাতকের মতো চায় সামনের সেই পোশাকের শোরুমটির দিকে। লাল সালোয়ার কামিজটা দেখা যাচ্ছে এখান থেকেই। চোখ বোজে সে। কল্পনায় সেই লাল জামাটা ওরই গায়ে। নিজেকে মনে হয় লাল পরী। কোন এক পথচারীর ধাক্কায় কল্পনাটা ভেঙে যায়। যেমন ভাঙে স্বপ্নগুলো। বিষণ্ণ সন্ধ্যায় বিষণ্ণ মনে সে পা বাড়ায় তার অস্থায়ী আবাসের দিকে। মনে মনে বলে লাল পরী, মন খারাপ করো না। সব স্বপ্ন পূরণ হয় না, তাই বলে কি স্বপ্ন দেখবে না?
প্রথম প্রকাশিত
আসর
বাংলাদেশের প্রথম ও ভিন্ন ঘরানার বহুমাত্রিক ক্যুইয়ার নারী সংকলন