সেনোরিটা

নীলা

রিকশায় করে বউকে নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছিল সবুজ। উল্টোদিক থেকে আসা একটা রিকশায় একটা মেয়ে, গায়ে ফিরোজা রংয়ের সালোয়ার কামিজ, কপালে টিপ, অর্নামেন্টসগুলোও ম্যাচিং করা। সব মিলিয়ে সাজ ও পোশাক খুব রুচিশীল। সবুজ মেয়েটির দিকে তাকাচ্ছে দেখে তার বউ টিয়া রেগে গিয়ে বললো ব্যাপার কি বলোতো? আমি পাশে বসে আছি আর তুমি আরেকটা মেয়ের দিকে হা করে তাকিয়ে আছো, আমাকে আর ভালো লাগে না, না? হবেই তো আমার তো গুরুত্ব শেষ এখন…..প্রায় মিনিট তিনেক ধরে অভিযোগের সিরিজ হামলা চললো সবুজ এর উপর। কে না জানে বোবার কোন শত্রু নেই। তাছাড়া অস্বীকার করবে কি করে সবুজ, ঘটনাটা সত্যি, সত্যিই সে মেয়েটির দিকে তাকিয়েছিল, এমন প্রায়ই তাকায়। মুখ ভার করা টিয়াকে তবু কোনমতে শান্ত করে সবুজ।

এমন ঘটনা হঠাৎ হঠাৎ ঘটে যায় সবুজ আর টিয়ার জীবনে।

ভালোবেসেই বিয়ে করেছিল ওরা, সেই ভালোবাসা বিয়ের এই বছর চারেক পরেও শুকিয়ে যায় নি। তবু প্রশ্ন উঠতেই পারে সবুজ কেন অন্য মেয়েদের দিকে তাকাল? আসলে এমন স্বামী বিরল যে স্ত্রী ছাড়া অন্য কোন সুন্দরী মেয়ে দেখলে আড়চোখে তাকায় না, সেই দৃষ্টিতে কি থাকে সেটা আমরা জানি না, তবে খুব কম সংখ্যক স্বামীই বোধহয় এই অভিযোগের আওতায় পড়েন না। স্ত্রীদের মধ্যে এই ব্যাপারটা বোধহয় অনেকটাই কম, সেটা সামাজিক না অন্য কোন কারণ কিনা কে জানে? তবুও সবুজের ঘটনাটা আর আট দশটা এমন ঘটনার মতো ছিলো না, হ্যাঁ সবুজের মেয়েদেরই ভালো লাগে, সিনেমার সুন্দরী নায়িকা বা রাস্তার সুন্দরী মেয়ে দেখলে সে একবার হলেও হয়তো তাকিয়ে দেখে, কিন্তু এ পর্যন্তই। টিয়ার সাথে ভালোবাসা হবার পর সে দ্বিতীয় কারোর প্রতি দূর্বল হয় নি, কখনো হবে বলেও মনে হয় না। সবুজ মেয়েটিকে দেখেও আসলে ঠিক মেয়েটিকে দেখছিলো না, সে যাচাই করছিলো মেয়েটির ড্রেস সেন্স, সাজ এইসব কিছুই।

সাধারাণত একটা মেয়ে কী রঙ এর জামা পরলো বা কিভাবে সাজলো ছেলেরা তা আলাদা করে খেয়ালই করে না। একজন প্রেমিকা প্রতিদিন যদি একই জামা পরেও আসে খুব কম প্রেমিকই মনে হয় তা ধরতে পারবে। না, এটা বোধহয় বাড়াবাড়ি বলা হয়ে গেল। তবে প্রতিদিন যাদের সাথে দেখা হয় এমন নারী সহপাঠী বা সহকর্মীর পোশাক খুব আলাদা করে খেয়াল করে না সাধারণত ছেলেরা। মেয়েরা কিন্তু পুরো উল্টো। পাশের বাসার ভাবী গত সপ্তাহে কোন শাড়িটা পরেছিলেন, অথবা গত  বছরের বিবাহ বার্ষিকীতে প্রিয় বান্ধবী কোন জামাটা পরে এসেছিল এসব তাদের মনে থাকে। মেয়েদের পোশাক, সাজগোজের সবচাইতে বড় জাজ মেয়েরা নিজেরাই। এজন্যই নিত্য নতুন পোশাক তাদের কিনতে হয় যাতে অন্যদের কাছে হেরে যেতে না হয়। অদ্ভুত হলেও সত্যি একটি মেয়েকে একজন ছেলে যতোটা খুটিয়ে দেখে, মেয়েরা দেখে তার চাইতে অনেক বেশি। তারা হয়তো মনে মনে মেয়েটির পোশাকের প্রশংসা বা সমালোচনা করে, সাজগোজ দেখে মনে মনে জাজমেন্ট করে, চুলের কাটিং কিংবা জুতার হিল দেখে মনে মনে মার্কিং করে কি না কে জানে, ভাবে হয়তো অমন একটা জামা যদি আমার থাকতো, ওমন ফর্সা রং, কিংবা সিল্কি চুল অথবা খাঁড়া নাক হতো যদি আমার, বা আমাকে ঐ ভাবে সাজলে কেমন লাগতো, ব্লা ব্লা ব্লা। শুরু করেছিলাম সবুজ দিয়ে কিন্তু ভাবছেন কি সব উল্টো পাল্টা বলে যাচ্ছি, আসলে সবুজ এর ব্যাপারটাও তাই ই।

সেও মেয়েটিকে আরও দশটা মেয়ের মতোই দেখছিল। সে ঐ মেয়েটিকে দেখেও ঐ মেয়েটিকে দেখছিল না, বরং ঐ মেয়ের জায়গায় কল্পনা করছিল নিজেকে। অবাক হলেও সত্যি শপিং মলে সাজানো মেয়েদের হাল ফ্যাশানের পোশাকগুলো সবুজকে যেভাবে আকৃষ্ট করে, ছেলেদের পোশাকের দিকে সে ফিরেও তাকায় না। দৈনিক পত্রিকার ফ্যাশান পাতার আজগুবী ফ্যাশান ফিচারগুলো সে বেশ মন দিয়েই পড়ে। এমনকি টিয়ার জামা বা শাড়ি কেনার ক্ষেত্রে টিয়া কখনো সবুজের পছন্দ ছাড়া কেনে না, তার কারণ এমন না যে সবুজ টিয়ার ওপর তার পছন্দ চাপিয়ে দেয়, বরং টিয়া নিজেও স্বীকার করে তার নিজের চেয়ে সবুজের পছন্দ ঢের ঢের ভালো। না সবুজ কোন ফ্যাশন ডিজাইনার না, বা এ বিষয়ে তার কোন কালে কোন বিশেষ প্রতিভার কথাও প্রকাশ পায় নি। তবু কিছু একটা কারণ তো আছেই। কিশোর বয়েস থেকেই সবুজ টের পেতো সে একটু আলাদা, আর পাঁচটা ছেলের মতো সে না। কথা বা চলার ভঙ্গীতে কখনো প্রকাশ পায় নি, এমনকি সমবয়েসী ছেলেদের সাথে ক্রিকেট বা ফু টবল খেলাতেও তার উৎসাহের ঘাটতি দেখা যায় নি‌। তবু একইরকম আগ্রহ তার ছিল মেয়েদের রঙিন পোশাক, অলংকার আর ফ্যাশন নিয়ে। মনের গভীরে সে বরাবর লুকিয়ে রেখেছিলো যে সে আসলে মেয়ে হতে চায়, নিজেকে মেয়ে হিসেবে কল্পনা করতে ভালোবাসে। কিন্তু এতোটা বোকা সে ছিলো না যে, এই কথাটা কাউকে বলবে, আর কাকেই বা বলবে তেমন নির্ভরযোগ্য ছিল না তো কেউ, আর বললে নিশ্চয়ই প্রতিক্রিয়াটাও সুখকর হতো না।

মনের মধ্যে এই সব কথা চেপে রাখতে রাখতে বিষণ্ণতায় ভুগতে শুরু করলো সে কিশোর বয়েস থেকেই। বাসায় কেউ না থাকলে সবুজ মাঝে মাঝে বোনের ফ্রক বা স্কার্ট পরতো, লিপস্টিক আর টিপ পরে আনাড়ি হাতে সাজতো। আয়নার সামনে ঘুরে ঘুরে নেচে নেচে নিজেকে দেখতো। টিভি চালিয়ে বিজ্ঞাপনের নারী কণ্ঠের সাথে লিপসিং করে কণ্ঠের দূর্বলতা ঢাকতে চাইতো। কখনো বা নিখুঁত ভঙ্গীতে করতো ক্যাটওয়াক। মানাতো কি ওকে এসব আনাড়ি সাজ পোশাকে? হয়তো কিশোর বয়েস বলেই বেশ মানিয়ে যেত। সবুজ নিজেকে দেখে নিজেই মুগ্ধ, এই তো আসল আমি।কিন্তু পোশাক বদলের পরপর তীব্র অপরাধবোধ কুড়ে কুড়ে খেত তাকে।আমি এমন কেন এই ভাবনাটা আসতো কেবল। এমন কি শুধু একাই আমি? নাকি আর কেউও এমন আছে? নিজেকে ভীষণ তুচ্ছ, ঘৃণ্য, অপরাধী মনে হতো ওর। এমনিতেই বেশ সংবেদনশীল আর নরম মনের ছিল বলেই বিষণ্ণতা গ্রাস করা শুরু করলো ওকে, রাতের পর রাত ঘুমহীন কাটিয়েছে সে সেই কিশোর বয়সের দিনগুলোতেই। কেউ টের পেতো না, সেটাই বরং ভালো ছিল, টের পেলে কী হতো কে জানে? মধ্যবিত্ত পরিবারে বাসায় রুম ছিলো কম, মানুষ ছিলো বেশি। তাই লুকিয়ে সাজগোজের বিলাসিতা সবুজ বেশি করতে পারে নি। তার উপর একবার সাজতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েছিলো বড় বোনের কাছে। যে বোন তাকে ভীষণ আদর করতো, শত আবদার, অত্যাচারেও ছোট ভাইটির উপর কখনো রাগ করতো না, সে সেদিন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো ঘৃণায়, অবিশ্বাসে। কাউকে সে হয়তো কিছু বলে নি, কিন্তু সেদিনের পর থেকে বহুদিন আর বোনের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারে নি সবুজ। বোন কোনদিন এই বিষয় নিয়ে আর একটা কথাও বলে নি, তবে সেদিনের সৃষ্টি হওয়া সেই দূরত্ব চিরকালই রয়ে গেছে। তারপর অনেকদিন কেটে গেছে। সবুজ বড় হয়েছে। ছোট বেলার সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা তাকে পরবর্তীতে করেছে আরও সংকুচিত, আরও একা।

মেয়েদের সাথে সহজভাবে সে কখনো মিশতে পারে নি তার স্বভাবসুলভ লাজুকতার জন্যই, তবু কেমন করে জানি কোন যোগসূত্রে টিয়ার সাথে তার ভালোবাসা হয়ে যায়। টিয়া এগিয়ে না আসলে সবুজের মতো ভীরু প্রেমিকের পক্ষে অবশ্য কখনো এই প্রেম সফল হতো না। তারপরও একটু দ্বিধা ছিলো সবুজের ভেতর। একথা সত্যি টিয়াকে সে ভালোবাসতো, সে যে টিয়াকে পছন্দ করে তা সরাসরি না বললেও সেটা না বোঝার কোন কারণ ছিলো না টিয়ার। তবু তার মনে হয়েছিল নিজের ভেতরের অন্য সত্ত্বাটার কথা না জানালে সেটা অন্যায় হবে। তাই সে দুম করে নিজের গোপন সব কথা টিয়া কে বলেছিলো, এরপরও কি মেনে নেবে আমায়? ফোনের ওপারে টিয়া তখন কথাগুলো শুনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো, কী বলবে খুঁজে পাচ্ছিল না। তারপর অনেক পরে খুব মৃদু স্বরে বলেছিলো আচ্ছা আমরা কাল কথা বলি বরং। সবুজ আশা ছেড়ে দিয়েছিল, কিন্তু পরদিন টিয়া যখন হ্যাঁ বললো খুশীর সাথে সাথে অবাকও হয়েছিলো অনেক। যাক এতোদিনে একজন নিজের মানুষ পাওয়া গেল যার কাছে কিছু লুকোনোর দায় থাকবে না।

তারপর বছর দুয়েক প্রেম করলো তারা। বিভিন্ন সময় সবুজ মনে করে দিতো টিয়াকে, ঐ কথাটা মনে আছে তো? বিয়ের পর কিন্তু আমিও মাঝে মাঝে জামা পরবো, আমাকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিবে তো? আচ্ছা বাবা দেব, টিয়া সহজভাবেই উত্তর দিত। আচ্ছা আমার একটা নাম দাও না? সবুজ মাঝে মাঝে আবদার করত। তোমার নাম…তোমার নাম…তোমার নাম রাখলাম সেনোরিটা। সেনোরিটা? কোন ভাষার নাম? কী অর্থ? সেনোরিটা মানে হচ্ছে মিস, স্প্যানীশ ভাষার শব্দ। তুমি তো তাই ই না? ভীষণ খুশি হয় সবুজ। সেনোরিটা…সেনোরিটা। তারপর টিয়া মাঝে মাঝেই সবুজকে সেনোরিটা বলে ডাকত, আশেপাশে কেউ না থাকলে। রেস্টুরেন্টে মুখোমুখি বসে যখন ওরা গল্প করতো তখন দু টেবিলের ওধারে বসা কেউ হয়তো কল্পনাও করে নি, ফিসফিস করে টিয়া ওকে সেনোরিটা বলে ডাকছে কিংবা ওরা আলাপ করছে বিয়ের পর সবুজ কী কী ড্রেস কিনবে? কী করে সাজবে ও। ওদের প্রেম পর্বশেষ হয়, বিয়েতে দুই পরিবারের সম্মতির অভাব হলো না, কেননা দুজনেই প্রতিষ্ঠিত, অপছন্দ করার মতো কেউ নয়।বিয়ের পর পর সবুজ যখন টিয়াকে মনে করিয়ে দিত কী হলো, তুমি বলেছিলে সাজিয়ে দিবে? সবুজ তুমি কি সত্যি সত্যি ওসব বলতে? আমি ভাবতাম ঠাট্টা। বিষ্ময়ের সাথে বলে টিয়া। সবুজ খুব হতাশ হয়? কিছু বলতে পারে না, অভিযোগ করতে শেখে নি সে কখনো। টিয়ারও দোষ নেই, সে ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নেয়নি কখনো। তবু সবুজের মুখ ভার দেখে একটা জামা সে একবার কিনে দেয় সবুজকে। কিন্তু তাই বলে সাজিয়ে দেয়া, টিয়া রাজী হয় না কখনো, তুমি বরং নিজে নিজে সাজো, ঐখানে আমার সব জিনিসপত্র রাখা, আমি ঘুমাই বলে পাশ ফিরে ঘুমায় টিয়া। সবুজ মন ভার করে তবু সাজে তবে তার মন খারাপ হয়ে যায়। মাস চারেক পরেও যখন ওদের কোন সন্তান হচ্ছিলো না, টিয়া অভিযোগ করে বসে নিশ্চয়ই তুমি অমন করো বলে আমাদের কিছু হচ্ছে না।

দাম্পত্যে একটা কালো ছায়া দেখা দিয়ে দিচ্ছিল প্রায়, তবে কিছুদিনের মধ্যে টিয়ার গর্ভে সন্তান আসে, সেই ছায়া সরে যায়। সবুজও ধীরে ধীরে গুটিয়ে নেয় নিজেকে। টিয়ার সাথে এসব নিয়ে আর কথা বলে না, টিয়াও খুশী সবুজ ভালো হয়ে গেছে। সবুজকে কিনে দেয়া সস্তার জামাটাও দান করে বসে এক দুঃখী ভিখারিণীকে। সবুজ চেয়ে চেয়ে দেখে কেবল, বলে না কিছুই। তারপর আরও বছর তিনেক কেটে গেছে। টিয়া সবুজের মেয়ের বয়েস এখন বছর দুয়েক। তিনজনে মিলে সুখেই আছে তারা। সবুজ তবু মনে মনে একটা কিছুচেপে রাখে, টিয়া ঠিক বুঝতে পারে না, আগের সেই ঘটনা সে ভুলেই গেছে। সে জানে সবুজ একদম ঠিক হয়ে গেছে, একদম পুরোপুরি পুরুষ হয়ে উঠেছে। কথাটা যে কতো ভুল! টিয়া জানে না, সবুজের একট ফেসবুক আইডি আছে, সেনোরিটা নামে। লুকিয়ে সে সেই আইডি প্রায়ই ব্যবহার করে। মাঝেমাঝে সবুজকে মোবাইলের স্ক্রীনে তাকিয়ে থাকতে দেখলে টিয়া কিছুটা সন্দেহের চোখে বলে কী ব্যাপার কোন মেয়ের সাথে প্রেম করছো? কিংবা রাস্তার সেই ঘটনার মতো ঘটনায় এমন করে প্রশ্ন করে ঐ মেয়েকে দেখছো কেন? তবু টিয়ার এসব অভিযোগ সাময়িক, সে নিজেও বোঝে এমন সন্দেহ আসলে অমূলক। ঐ আড়ালটুকু ছাড়া সবুজেরও লুকোবার কিছু নেই। টিয়ার কাছ থেকে সেনোরিটা হয়তো হারিয়ে গেছে কিন্তু সবুজের কাছ থেকে হারায় নি। সবুজ অথবা সেনোরিটা এভাবেই হয়তো বাকী জীবনটা কাটিয়ে দেবে….এভাবেই।

প্রথম প্রকাশিত
আসর
বাংলাদেশের প্রথম ও ভিন্ন ঘরানার বহুমাত্রিক ক্যুইয়ার নারী সংকলন

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.