অস্তিত্ব সন্ধান ও তারপর

ইথার রৌদ্র জগন্নাথ

ছোটবেলা থেকে আমি বেশ আবেগী ও অভিমানী ধাচের এবং এই ব্যাপারটা বুঝতে আমার যথেষ্ট সময় লেগেছে। এসএসসি পরীক্ষার পর আব্বুর কোনো একটা কথায় অনেক অভিমান হয়েছিলো, আবেগে একটা বাক্য লিখেছিলাম –

“আমি আমার অস্তিত্বের সন্ধানে”

সেদিন যেদিন আমি এই বাক্যটা লিখি অথবা নিজের মনের অজান্তে বাক্যটাকে অনুভব করি, তারপরও অনেক দিন পর্যন্ত ঘুণাক্ষরেও মনে হয়নি খুব দ্রুতই আমি বিরাট “অস্তিত্বের সংকট” এ পড়ে যাবো।

স্কুলে ভালো শিক্ষার্থী, ভালো বন্ধু, ভালো মেয়ে সবটাই ছিলাম। স্কুল জীবনের না পাওয়া হয়তো এতটুকু যে আমার এসএসসি রেজাল্ট আমি অনুযায়ী ভালো হয়নি। আমি এবং আমার চারপাশের সবাই এটা বিশ্বাস করতো যেই রেজাল্ট আমার হয়েছে তার থেকে অনেক বেশি কিছু অর্জনের যোগ্যতা রাখি। অসাধারণ ফলাফল হয়নি তাই অসাধারণ কলেজ পাইনি। ঘড়ির কাঁটা হাতের বাম দিক থেকে ডান দিকে ঘুড়ে। যেদিন আমার কলেজ সিলেকশনের মেসেজ টা আমার মোবাইলে পাই সেদিন থেকে আমার জীবনে ঘড়ির কাঁটার দিক ছিলো প্রচলিত দিকের বিপরীত!

আমি যেদিন শেষবার মন খুলে হাসি, যেদিন শেষবার মন হালকা ছিলো আমার, যেদিন শেষবার যেকোনো চিন্তা থেকে স্বাধীন ছিলাম সেটা ২০১৮ সালের জুলাইয়ের ১ তারিখ!

আমার কলেজ জীবনে আমাকে নিয়ে আমার একটা বিশাল আবিষ্কার উন্মুক্ত করে সেই দ্বার, উন্মোচন করে সেই জগৎ, নিদারুণ নিষ্ঠুরভাবে টানতে থাকে সেই বাস্তবতার দিকে যা মেনে নেওয়া ছিলো আরেকটাবার জন্ম নেবার সমতুল্য। সত্যিই আমি অস্তিত্বের সন্ধান করতে থাকি, এদিক থেকে ওদিক, এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত; কত প্রশ্ন যার উত্তর নেই, কত পরিস্থিতি যার ব্যাখ্যা নেই, কত অনুভূতি যাদের মূল্যায়ন নেই।

চতুরতা, ছলনা, আবেগের খেলা!

না! না! না! ধ্বনি জেগে উঠে প্রতিটা চিৎকারে। অন্যায়! অন্যায়! অন্যায়!

আমি আসামী – ধর্মের কাছে

আমি আসামী – সমাজের কাছে

আমি আসামী – পরিবারের কাছে

আমি আসামী – সেই প্রতিটা বিষমকামী মানুষের আমার প্রতি অসাধারণ ভালোবাসার কাছে যাদের মূল্যায়ন আমি করতে পারিনি

আমি আসামী – আমার প্রেমিকার কাছে যার ভাগ্যে সুখ লিখতে চেয়েও দুখের দূত হয়ে হাজির হয়েছি

আমি আসামী – তোমার চোখে

আমি আসামী – আমার চোখে

পৃথিবীতে আর কী এমন আছে যা মানুষ জাতি-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী-জাত নির্বিশেষে সম্মিলিতভাবে ঘৃণা করে?

প্রায়ই আমার মনে হয়, কোনো এক সাম্প্রদায়িক দাংগার মাঝে ৩-৪ জন গিয়ে যদি বলি “আমরা সমকামী”; সেই মুহূর্তে দাংগা থামিয়ে আগে আমাদের শেষ করতে তারা সব সাম্প্রদায়িকতা ভুলে নতুন একাত্মতা খুঁজে পাবে।

অতঃপর ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে কিছু মানুষ শত প্রতিকূলতার পরও নিজ সাধ্যের মধ্যে আলো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তারা জানে সবাইকে আলোর পথ দেখানো হয়ে উঠবেনা কিন্তু যদি একজনও এই পথে আলোর আশায় আসে সে যেন অন্ধকারে হারিয়ে না যায়।

আমাদের হারিয়ে যাওয়া প্রত্যাশা, আমাদের হারিয়ে যাওয়া প্রাপ্তী, আমাদের লড়তে থাকা সুখ, আমাদের শুকিয়ে যাওয়া চোখের জল; আমাদের এই অভিনয়ের হাসি, আমাদের মৃত আত্মা যার রেজিস্ট্রি হয়নি, আমাদের সচল দেহ নিথর জীবন যার ময়নাতদন্ত সম্ভব না; আমাদের প্রতি এই সমাজের ঘৃণার আঘাত সহ্য করে এই সমাজকেই ভালো রাখতে আমাদের প্রতিটা আত্মত্যাগ – এত খুন, এত লুটপাট, এত ঋণ, এত দেনা আমাদের কাছে তোমাদের!!!

হে সমাজ!

এত খুনের বিচার করবে কিভাবে? এত লুটপাট, ঋণ শোধ করবে কিভাবে? ভেবে দেখেছো? পারবে উত্তর দিতে?

আমি এখন আলো খুঁজতে এসেছি, হয়তো একদিন আলো হাতে দাঁড়িয়ে থাকবো। তারপর এই অস্তিত্ব উপাখ্যান সমাপ্ত করে আলোর মশাল কাউকে দিয়ে যাত্রা শুরু করবো।

সেদিন যাত্রা হবে নশ্বর হয়ে অবিনশ্বরের পথে!

প্রথম প্রকাশিত
আসর
বাংলাদেশের প্রথম ও ভিন্ন ঘরানার বহুমাত্রিক ক্যুইয়ার নারী সংকলন

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.