
সূর্য
অনেক দিন থেকেই কাছের খুবই কাছের বন্ধুটি বলছিল লেখা দাও একটা, কিছু একটা লিখ। সময়ই করে উঠতে পারছিলাম না। অবশেষে শেষ সময়ে এসে সময় বের করলাম। আমি এমনই করি। জীবনের সব কিছুতেই এসে শেষ মুহূর্তে আমি তাড়াহুড়ো করে কাজ শেষ করি। আগে থেকে কিছুই ভাবি না। আর এই কারণেই জীবনে আজ অনেক কিছুর সামনাসামনি হচ্ছি।
আমার নিজেকে নিয়ে বিশেষ কিছুনেই বলার। খুবই সামান্য একজন মানুষ আমি।
১০ বছরের সম্পর্কে “তুমি তোমার মত কাউকে খুঁজে নাও” বলে চলে গেল প্রিয়জন। খুবই ভেঙে পড়েছিলাম। কারণ সে ছাড়া আপন কেউ আমার ছিল না, এমনকি কোন বন্ধুও না। কখনো নিজেকে নিয়ে ভাবিনি, বোকার মতো ওর দিকে তাকিয়ে থেকেছি। পড়ালেখা কিচ্ছুতে মন দিইনি। বাস্তবতার দিকে তাকাই নি। একটা মেয়ে হয়ে আর একটা মেয়েকে ভালবাসা, আর তাদের ভবিষ্যৎ যে কেমন হতে পারে তা কখনো ভাবিনি। ভীষণ রকম কল্পনা প্রবণ নাজুক একটা মন ছিল আমার। কোন কঠিন বাস্তবতা মাথায় ঢুকতো না। ভেবেছিলাম ওকে ভালবাসলেই জীবন পার হয়ে যাবে। কী করে যে অনার্স, মাস্টার্স শেষ করলাম নিজেই জানি না। আমার চিন্তা ভাবনা আর মন একদম এইচএসসি পড়া ছেলেমেয়েদের মত ছিল। আমি কখনোই কঠিন হতে পারতাম না নিজের কাজে এবং সিদ্ধান্তে। সে চলে যাওয়াতে দিশেহারা হয়ে পড়ি চরমভাবে। কোন কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না।বন্ধু বলতে কেউ পাশে ছিল না। পুরোপুরি একা।
নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে একটা সময় একটু শান্ত হতে থাকলাম।তবু রাস্তায় বের হতে ভয় পেতাম, ঢাকা যাওয়ার পথে তার এলাকা ক্রস করে যাওয়ার সময় হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করতাম, হাত পা কাঁপতো, কথা জড়িয়ে আসতো। এমন সময় গুলো পার করেছি। তবে সৃষ্টিকর্তার কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা যে আমি ঐ সময়ে কোন খারাপ নেশায় জড়িয়ে পড়িনি, নিজের ক্ষতি করিনি, সুইসাইড করার কথাও চিন্তা করিনি।
সব রকম যোগাযোগ বন্ধ করেছি, সব ছবি ডিলিট করেছি, নম্বর মুছে দিয়েছি। হয়তো অনেকেই বলতে পারেন মন থেকে কি মোছা যায়? আসলে হয়তো যায় না, কিন্তু চেষ্টা তো করতে হবে নিজেকে ঐ জায়গা থেকে সরিয়ে আনতে। অনেকেই বলে পারি না। তবে পারা যায়। নিজের ওপর বিশ্বাস থাকলে। আর নিজে চাইলে। আর নিজেকে ভালবাসলে।
আর একটা জিনিস উপলব্ধি করেছি তা হলো আমরা যারা সমলিঙ্গের প্রতি ভালোবাসা অনুভব করি তাদের জীবন আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে খুবই কঠিন। তাই সব থেকে বড় ব্যাপার হলো নিজের জন্য ভাল একটা অবস্থান তৈরি করা, পায়ের নিচের মাটি শক্ত করা। তারপর পরিবারের কাছে নিজেকে প্রকাশ করা। অনেকেই নিজেকে প্রকাশ করেন।অনেক পরিবার মেনে নেন তবে অধিকাংশই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। যা খুবই কষ্টকর। আর আমাদের অনেকেরই অন্য আর দশটা মানুষের মত ভাল্লাগে, ভালবাসতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমাদের তো এমন হলে চলবে না, এমনিতেই আমাদের এত বাধা বিপত্তি।
অনেকেই হুট করে সম্পর্কের মাথায় এসে পরিবার ছাড়ার কথা চিন্তা করেন। বা কোন একটি চাকরি না থাকায় নিরবে নিজের ভালবাসার মানুষটিকে নিজের চোখের সামনেই বিয়ে হয়ে যেতে দেখেন। অপর দিকের মানুষটার ক্ষমতাও থাকে না ভালবাসার মানুষটিকে নিজের কাছে নিয়ে আসার। তাই সব থেকে বড় কথা সব সময় আর দশটা মানুষের থেকে আমাদেরকে আরো বেশি এক্টিভ হতে হবে সব দিক দিয়েই। আমি আমাকে দিয়ে বুঝি এটা। পড়ালেখা না করে অনেক ভেসেছি কল্পনায়। এখন মরেকুটে লেগেছি একটা কর্মসংস্থানের জন্য। আমার জীবনে এখন একটা মানুষ আছে।একটা জব হলে ও আমার কাছে আসতে পারবে। কারণ আমার পরিবারে সবাই না হলেও আমার মা, বোন অনেক ফ্লেক্সিবল। সবটা মানিয়ে নিতে পারবো। তবে ঐ যে মূল্যবান সময়টাই নষ্ট করে ফেলেছি ক্যারিয়ারের কথা না ভেবে।
এক একটা পরীক্ষায় যখন ডিসকুয়ালিফাইড হই তখন তীব্র কষ্টে ক্ষোভে বুক ফেটে কান্না আসে। অনেক চেষ্টা করেছি। তাই সবার কাছে একটাই অনুরোধ থাকবে আগে নিজের জীবনটা গড়ে নিন ঠিক ভাবে। না হলে কোন দিকই রক্ষা পাবে না।
আর জীবনে একটা সঠিক মানুষ পাওয়া সেটা ঈশ্বরের আশীর্বাদ।জীবনে জীবনসাথী নিয়ে তাড়াহুড়ার কোন দরকার নেই। সঠিক মানুষটার জন্য অপেক্ষা করা ভাল। কারণ খারাপ মানুষ থাকার থেকে না থাকাও ভাল। নিজের জীবনে আবেগের অনেক মূল্য দিয়েছি। দেয়া ভাল তবে এতটাও নয়। নিজের জীবনের দিকে আর নিজের দিকে বেশি ফোকাস দেয়া উচিত। আর ভাল বন্ধু নির্বাচন করা উচিত।আমি করেছি। এখন আমার জীবনে অসম্ভব ভাল একটা বন্ধু আছে। আর ওর কথাতেই লেখাটা লেখা। এই মানুষটার কথা, পাশে থাকা, তার অনুপ্রেরণা আমার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
আর এখন যে মানুষটা আমার সাথে আছে (জীবনসাথী) সে আমার জীবনে আলো হয়ে এসেছে। আমি আমার আমিকে ফিরে পেয়েছি। নিজেকে ফিরে পেয়েছি। তবে পুরোপুরি গোছানো এক মানুষ আমি। নিজেকে ভালবাসি এখন। আর কোন অবহেলা করি না নিজের কোন কিছুকে। ভাল থাকতে চাই আর সবাইকে ভাল রাখতে চাই।
প্রথম প্রকাশিত
আসর
বাংলাদেশের প্রথম ও ভিন্ন ঘরানার বহুমাত্রিক ক্যুইয়ার নারী সংকলন