
দাঁড়কাক
-তোমার ফেইসবুক আইডি কী?
অপরিচিত ধারালো গলার আবদার শুনে পেছন ফিরলো অহনা।
-হাই। আমার?
-আমি এই সেকশনের ক্লাস ক্যাপ্টেন। তোমাকে সবসময় দেখি আমার ক্লাসে ঢু মারতে। কথা হয়নি কখনো তাই আরকি। আমি রূপসা।
হরবর করে কথাগুলো বলছিলো সে। অহনা তাকে সামনে থেকে একবার আপাদমস্তক দেখার ব্যর্থ চেষ্টা করে গেলো।
-আইডি?
-ওহ হ্যাঁ, নাও।
ফেইসবুকে অ্যাড হতে হতেই বলতে লাগলো অহনা,
-আমার বেশিরভাগ বন্ধুরা এই সেকশনে আর আমি পাশের টায়।
-খুব বেশি ফাঁকিবাঁজি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলে তো? আজ পড়ালেখা করলে হয়তো এই সেকশনেই থাকতে বন্ধুদের সাথে।
আশ্চর্য! কেমন রুড মেয়ে! মুখের উপর এমন কথা বলে কেও? এসব ভাবতে ভাবতে কপাল কুঁচকে নকল হাসি দেবার চেষ্টা করলো সে। কথাটা গায়ে না লাগানোর ভান করে এদিক ওদিক চেয়ে অর্ণিকে খুঁজতে লাগলো। যেন কোনো মতে একে এড়িয়ে যেতে পারলেই বাঁচে।
আচ্ছা আমি অর্ণি কে খুঁজছি। কই ও?
অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। আমি গিয়ে স্যারের পার্মিশান নিয়ে ছুটি নিয়ে দিলাম আর বাসায় এগিয়ে দিয়ে এসেছি।
এবার একটু একটু কম নির্দয় মনে হচ্ছে মেয়েটা কে। অর্ণির ওভারি ক্যানসার। যখন তখন অসুস্থ হয়ে পড়ে। স্কুলে তাই যতক্ষন পারে ওর সঙ্গেই থাকে অহনা। ক্যাপ্টেন মেয়েটার এমন দায়িত্বশীলতা দেখে মনে মনে একটু হাঁফ ছাড়লো।
আচ্ছা আমি যাই তাহলে।
চলে যাচ্ছো? টিফিন টাইমের আরো ৮ মিনিট বাকি আছে।
ঘড়ি দেখে এ বলেই চলে গেলো মেয়েটা। গলায় ছিল কেমন যেন একধরনের কঠোর আবদার। এবার একটু তাকে ভালোভাবে দেখে নিলো অহনা। লম্বা, ছিপছিপে গড়ন। অ্যাপ্রন, হিজাব আর নিকাবে চোখ দুটো ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। গলা যতটা তীক্ষ্ণ চোখ দুটো ঠিক ততটাই নরম, মায়াবী। নিজের অজান্তেই অ্যাপ্রনের ওপর দিয়ে ওর শরীরের আকার গঠন বোঝার চেষ্টা করছে সে। খুব আকর্ষনীয় লম্বা গড়ন। কেমন যেন নেশায় মাথা ঝিমঝিম করে উঠছে অহনার।
বাসায় গিয়ে ফোন টা হাতে নিতেই দেখে রূপসা হক নামের আইডি থেকে টেক্সট।
-এই। বাসায় গেলে?
-হ্যাঁ। তুমি?
-আসলাম। বাসায় আসবে?
বিদ্যুৎ খেলে গেল অহনার পুরো শরীরে। একি সাথে আশ্চর্য হলো সে। আগে এমন তো কখনো কারো সাথে কথা হয়নি। এই মেয়েটি চাইছে কী আর কেনোই বা এত আবদার !
-কোথায় থাকো?
দেখেছি রূপ সাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা. . .
গুনগুন করে গাইছে রূপসা। গানের সাথে অলস বিকেলের ঝিরিঝিরি বাতাস আর ক্লান্ত আকাশ উপভোগ করছে অহনা, রূপসার বাড়ির ছাদে। মনে মনে ভাবছে এসে ভালোই করেছে। হিজাব আর নিকাব ছাড়া দেখার সুযোগ পেলো তাকে। তার চেয়ে ফরসা গায়ের রঙ, কিছুটা হলদে। পাতলা গোলাপী দুটো ঠোট। ঝরঝরে হালকা চুল, ঘাড়ে এসে কেমন অবহেলায় পড়ে আছে। তাতে আকর্ষনীয় লম্বা ঘাড় স্পষ্ট দেখছে সে। এই গলা আর ঘাড়ে এসে চোখ আটকে আছে অহনার। কেমন যেন মোহে আছে। খুব কাছ থেকে গলার সুগন্ধ নিতে মন চাইছে, সেখানে নাক ঘষতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। আবারো কেমন যেন নেশাতে মাথা ঝিমঝিম করছে, চোখ বুজে আসতে চাইছে।
-তোমার প্রিয় রঙ কী?
চমকে উঠলো অহনা। যেন এই মাত্র ঘুম ভাঙলো।
-নীল। তোমার?
-তার মানে তুমি একজন দুঃখ বিলাসী।
-পছন্দের রঙের সাথে সুখ-দুখের কি সম্পর্ক?
-আছে। সাইকোলোজী তো তাই বলে।
-তা তোমার কী রঙ পছন্দ?
একটু খানি চুপ থেকে যেন ভেবে নিলো রূপসা।
-লাল।
-তাতে কি বোঝায় তুমি খুব সুখ বিলাসী?
-না। রক্তবিলাসী।
বিকেলের ডুবন্ত সূর্যের সোনালী আলো পড়ছে রূপসার গালে । সে মুখে সূক্ষ্ম চিন্তার ছাপ অহনার চোখ এড়ালো না।
-এই। বাসায় গেলে?
-হ্যাঁ। আজ খুব ভালো সময় কেটেছে। থ্যাংকস।
-আমারো। আচ্ছা আমাকে একটা কথা বলবে?
-হুম
-কখনো ছেড়ে যাবেনা তো আমায়?
আবারো ধাঁধাঁয় পড়ে গেল অহনা। এমন অদ্ভুৎ সব প্রশ্নের মুখোমুখি সে আগে কখনো হয়নি।
অর্ণির গায়ে হাত দিয়ে জ্বর আছে কি না দেখছে অহনা।
-সেদিন নাকি অসুস্থ হয়ে গেছিলি?
-হ্যাঁ। ব্যাথা উঠছিলো খুব। তোকে কে বললো?
-ঐ মেয়েটা।
রূপসার দিকে ইশারা করলো অহনা।
-কে? ক্যাপ্টেন পাগলটা? ওর সাথে আবার কবে থেকে কথা হয় তোর? -পাগল কেনো?
-পাগল না তো কি? আস্ত একটা বদ্ধ পাগল। দিনে ১০বার করে ১০জনের সাথে লেগে যায়। একদম মারামারি অবস্থাও কত্ত হয়।
-সে তো ক্যাপ্টেন বলে। এমনি ভালোই আছে। বাসায়ও গেছিলাম সেদিন।
অহনার কথা শুনে অর্ণির মুখ থেকে পানি পড়ে যাবার উপক্রম। চোখ বড় বড় করে বললো
-এর বাসায়ও গেছিলি তুই? সব্বনাশ!!
-হ্যাঁ।
-কেনো রে? এত শখ পাগলের সাথে খাতির করার? আমি মোটেও মজা করতেছি না ভাই, এ সত্যিকারের পাগল। একা একা কথা বলে, হাসে।
-তো? তোরা পাগল বলিস দেখেই নিজের সাথে নিজে কথা বলে। কোনোদিন কথা বলে দেখিস। আমাকে অনেক কিছু বলছে নিজের ব্যাপারে। ওর ভালো লাগা-খারাপ লাগা সব শেয়ার করে আমার সাথে। ডেইলি ৬-৭বারের উপর কল দেয় আর টেক্সট তো করতেই থাকে। আমার না এত ভালো লাগে ওর কথা শুনতে। মনে হয় যেন কবিতা আবৃত্তি শুনছি। সারাদিন ওর কথাই ঘুরপাক খায় মাথায়। একটা দিন কল না দিলে খুব অস্থির লাগে।
সেই দূরে রূপসার দিক চেয়ে থেকেই কথাগুলো বললো অহনা। রূপসা একেকজনের হোমওয়ার্ক তুলছে। অর্ণি কিছু না বলে শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকলো অহনার দিক।
-এই।
-হুম।
-প্রেমে টেমে পড়িস নাই তো?
অহনার বুক কেঁপে উঠলো। মনে হচ্ছে তাকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে পৃথিবীর কঠিনতম সত্য স্বীকার করতে। এমন কঠিন প্রশ্নের পানির মতো সহজ উত্তর কিন্তু তবুও যেন অহনার পক্ষে দেয়া সম্ভব না। এও কি সম্ভব?
আজ আর রূপসার সাথে কথা বললো না সে।
-এই শুনো…
অহনা শুনেও না শোনার ভান করে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। রূপসার সারা শরীরে কাটা দিয়ে গেল মনে হচ্ছে। দাঁতে দাঁত লেগে, মাথা গরম হয়ে আসছে। চিলের মতো উড়ে গিয়ে অহনার হাত চেপে ধরলো সে খপ করে। ক্লাসের অনেকেরই চোখে পড়লো তা।
-আমার কথা শুনেও চলে যাচ্ছ যে? আমি ডাক দিলাম শুনতে পাওনি?
অহনার হাত প্রচন্ড ব্যাথা করছে। মনে হচ্ছে এই ব্যাথা আর সহ্য করা সম্ভব না। ব্যাথায় তার চোখে পানি চলে আসলো। সে হাত সরানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে।
-আহ! আমার হাত….
ব্যাথায় কুঁকড়ে কোনোমতে এতটুক বললো সে। হঠাৎ অর্ণি এসে রূপসার হাত হ্যাঁচকা টান দিয়ে সরালো। তারপর অহনার হাত নিয়ে দেখলো তাতে রক্ত জমে কালচে হয়ে গেছে আর ধারালো নখের দাগ।
-তোমার মাথায় তো ভালোই সমস্যা! ডাক্তার দেখাও মেয়ে! আর অহনার আশে পাশেও যেন না দেখি তোমায়।
অহনা কে টেনে নিয়ে গেলো অর্ণি। যাবার সময় তার ছলছলে চোখের দিক তাকিয়ে ছিলো রূপসা। কি সুন্দর লাগছে তাকে। এমন চাপা গায়ের রঙের কাউকে ব্যাথা পেলে এত সুন্দর দেখা যায়, জানা ছিলো না রূপসার। ইচ্ছে করছে মেয়েটা কে আরো ব্যাথা দিতে। এতটাই ব্যাথা যাতে ওর গালের দুপাশ লালচে হয়ে উঠবে আর চোখ ফেটে কান্না ঝরবে। আর তখন সে কাছ থেকে চেয়ে থাকবে অহনার দিক। আহ…ভাবতেই কি ভালো লাগছে তার।
সকালের সূর্যের কাঁচা রোদ এসে অহনা কে আজ জাগিয়ে দিলো ঠিকই কিন্তু সে উঠলো না। স্কুল যাবেনা আজ সে। কদিন পর এমনি এসএসসি। এখন ক্লাস হচ্ছেও শুধু শুধু। এরচে বাসায় থেকে প্রস্তুতি নেওয়া আরো ভালো। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো রূপসার ৫০+ মিসড কলস। কাল ঐ কাহিনীর পর থেকে ওকে ইগনোর করছে অহনা। টেক্সট এসছে আরো কত হাজার টা জানি।
হঠাৎ ম্যাসেজ আসলো ফোনে, “আমি তোমার বাসার নিচে, একটু নামবে প্লিজ?” সাথে একটা ছবি রূপসার রক্তাক্ত হাতের। অহনা তা দেখে দৌড়ে বারান্দায় গেলো। সত্যি সত্যি নিচে পায়চারি করতে দেখলো সে রূপসাকে। তাকে চোখের সামনে দেখে আর থাকতে পারলো না সে। টেক্সটের রিপ্লাই দিলো “লিফটের ৮ এ আসো”।
রূপসা কে রুমে ঢুকিয়েই দরজা লাগিয়ে দিলো অহনা। রূপসার হাতে ব্যান্ডেজ চোখে পড়তেই কাছে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। রূপসাও তার ঘারের কাছে মুখ ঢুকিয়ে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। অহনার পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে। রূপসার গায়ের সুন্দর গন্ধে যেন পাগল হয়ে যাচ্ছে সে। শ্বাস-প্রশ্বাস যেন ভারি হয়ে আসছে তার।
-আমাকে ক্ষমা করে দাও প্লিজ। আমি তোমাকে ব্যাথা দিতে চাই নি। আমার মতো অধম হয়তো ক্ষমার যোগ্য না।
-রূপসা…. আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।
পুরো রুমে অলস ছায়া আর পিনপতন নিরবতা তার মাঝে দুজন মানুষ ওতপ্রোত ভাবে মিশে আছে একে অপরের সাথে।
-রূপসা একজন স্যাডিস্ট! ও সাইকোপ্যাথ। ব্যাপারটা বুঝার চেষ্টা কর অহনা!
অর্ণি দাঁতে দাঁত চেপে বেশ জোড় দিয়ে কথাটা বললো।
-সেদিন তোকে হার্ট করলো, কাল নিজেকে। ও সাইকোপ্যাথ, নিজেকে এবং অন্যদের কষ্ট পেতে দেখে ওর ভালো লাগে। এমন মানুষকে ভালোবেসে তুই ভুল করছিস। এর সাথে কদ্দিন থাকতে পারবি, কী করে থাকবি? আর অন্য কিছুর কথা তো বাদ ই দিলাম।
অহনা বুঝতে পারলো অর্ণি তাদের সমপ্রেমের কথা বলছে।
বাসায় এসেই সে রূপসাকে কল দিয়ে বললো,
-তোমার এসব পাগলামি খুব বেশি বেশি হচ্ছে। সেদিন নিজের হাত কাটলে কেনো?
-কারণ তুমি আমাকে কষ্ট দিয়েছিলে, ইগনোর করছিলে। -তাই বলে তুমি নিজেকে আরো কষ্ট দেবে?
-কষ্ট কোথায়? সেই তো ছিলো আমার কষ্ট থেকে মুক্তি পাবার একমাত্র পথ।
-মানে?
-শরীরের চামড়া চিড়ে যখন টকটকে লাল উষ্ণ রক্ত বের হয় তা দেখতে তখন খুব ভালো লাগে। মনে এক ধরনের প্রশান্তি মেলে। তোমার হয়না?
অহনা কোনো কথা বলতে পারছে না। পূবের জানলা দিয়ে সে তাকিয়ে আছে নারিকেল গাছে যেখানে একটি কাক আরেকটি কাককে ঠোকরাচ্ছে। আর অপর কাকটি গলা ফাটিয়ে কা কা করে যাচ্ছে।
হ্যালো? হ্যালো?
-আমার আর কথা বলা সম্ভব না তোমার সাথে। ব্যপারটা এখানেই শেষ করতে হবে।
-ছেড়ে দিচ্ছো?
-আমাদের দুজনেরই ভালোর জন্য বলছি।
আচমকা ঠা ঠা করে হেসে উঠলো রূপসা। যেন অতি আনন্দে আত্মহারা। যে হাসিতে নেই কোনো প্রাণ। নিস্তেজ ও নির্জীব সে হাসি অহনার কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছে, গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো। টানা মিনিট কয়েক এমন পৈশাচিক হাসির পর্ব শেষ করে চুপ হয়ে গেল রূপসা। ওপাশ হতে গুমোট নিরবতা যেন অহনার কানে এসে বাড়ি খাচ্ছে। সে আর পারলো না। ফোন কেঁটে সঙ্গে সঙ্গে রূপসাকে সবখানে ব্লক করে দিলো। বাসায় আসলেও লাভ নেই, দারোয়ান কে বলে দিবে যেন বলে ওরা আর এখানে থাকে না বলে দেয়। স্কুলে ও যাওয়া বন্ধ। মনে মনে কিভাবে রূপসা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে ফেলা যায় সেসব পরিকল্পনা করতে লাগলো। এসব ভাবতেই নিজের অজান্তে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো দু ফোঁটা পানি।
পরদিন খুব দেরী করে ঘুম ভাঙলো অহনার। ইচ্ছে করেই এপাশ-ওপাশ করছে। যেন ভারি কিছু তাকে আটকে ধরে রেখেছে, উঠতে দিচ্ছে না। ফোনে হঠাৎ অপরিচিত নাম্বার থেকে কল দেখে চমকে উঠলো সে।
-হ্যালো?
-আপনার একটা পার্সেল ছিলো।
পার্সেলটি হাতে নিয়ে সে বুঝতে পারলো এসব রূপসার কাজ। এসব করলে যত কঠোর সিদ্ধান্তই হোক না কেন তা রাখা অসম্ভব। সে আর দেরী না করে খুললো বক্সটি। যা দেখলো তাতে তার শিঁরদাড়া বেয়ে বয়ে গেল বরফ শীতল স্রোত। ধাক্কা মেরে কোল থেকে ফেলে দিলো সব।
সঙ্গে সঙ্গে সাদা মেঝে ভেসে গেল লাল উষ্ণ মনুষ্য রক্তে। রূপসার গায়ের গন্ধ আসছে আর কানে বাজছে গতকালের ঠা ঠা করা পৈশাচিক সে হাসি।
প্রথম প্রকাশিত
আসর
বাংলাদেশের প্রথম ও ভিন্ন ঘরানার বহুমাত্রিক ক্যুইয়ার নারী সংকলন